পোস্টস

চিন্তা

ইসরাফ ও রিয়া: বাঙ্গালি মুসলিম সমাজের দুটি ব্যাধি।

১৯ জুন ২০২৪

মোহাম্মদ বাহা উদ্দিন

পনের লক্ষ টাকায় একটি খাসি কিনেছেন এক কিশোর। বিক্রেতার ভাষ্যমতে, এর বাহিরেও তিনি ৩৮, লক্ষ টাকার গরু কিনেছেন এ বছর কোরবানি উপলক্ষে। অসমর্থিত সুত্র বলছে, গতো বছরও তিনি প্রায় ৬০, লক্ষ টাকা খরচ করেছেন কুরবানিতে। ক্রেতার পারিবারিক পরিচয় সম্পর্কে সত্য তথ্য পাওয়া যায় নি, ফলে পরিবারের আয়ে উৎস কি বা উপার্জন রাষ্ট্রীয় মানদন্ডে বৈধ কিংবা ধর্মীয় মানদন্ডে হালাল কিনা তাও যাচাই করা যায় নি (সুত্র: বিবিসি বাংলা)। তবে যেখানে মাত্র ১৫-৩০ হাজার টাকায় একটি ভালো মানের খাসি পাওয়া সম্ভব, সেখানে ১৫ লক্ষ টাকায় খাসি কেনাটা সবারই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। 


ধর্মে দুটি বিশেষ পরিভাষা রয়েছে। ১. ইসরাফ ২. রিয়া।
ইসরাফ হলো "যতটুকু প্রয়োজন ঠিক তার বাহিরে গিয়ে অপ্রয়োজনে ব্যাপক অর্থ ব্যায় তথা অপচয় করা।" কুরআনে সুরা আরাফের ৩১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'তোমরা আহার করো ও পান করো; কিন্তু অপচ্যয় করবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ অপচয়কারীকে পছন্দ করেন না। ' ইসলাম মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থামকে বিবেচনায় নেয়। ফলে, যে ব্যাক্তি বা পরিবারের আয় সীমা নিন্ম, তাঁদেরকে মানদন্ড ধরে যার আয়ের পরিধি বেশি তার ক্রয়সীমাকে ইসরাফ বলে না, তথা একজন নিন্মবিত্তের ৫০-৬০ টাকা কেজি চালে দিন চলে, তাই যে উচ্চবিত্ত তার ৯০-১০০ টাকা কেজি চাল খেলেই তা ইসরাফ হবে না। কেননা তার আর্থ-সামাজিক অবস্থান ভিন্ন। কিন্তু, যে ব্যায় সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় এবং লোক দেখাতে বা বেহুদা ঠাট-বাট বজায় রাখতে ব্যায় করা হয়, তা- ইসরাফ (অপব্যায়)

দৈনিক প্রথম আলোর তথ্য মতে, বাংলাদেশে সুপেয় পানি সহজলভ্য হলেও, এক শ্রেণির উচ্চবিত্ত উচ্চমূল্যে আমদানী করা পানি পান করেন। ২২ এপ্রিল, ২০২৪, তারিখে প্রকাশিত এই প্রতিবেদন মতে, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি আমদানি হয় ফ্রান্সের এভিয়ান ব্র্যান্ডের বোতলজাত পানি। ফ্রান্সের আল্পস পর্বতের ঝরনার পানি প্রাকৃতিকভাবে পরিশোধন করে বোতলজাত করে এভিয়ান কোম্পানি। বিশ্বখ্যাত এই ব্র্যান্ডের প্রাকৃতিক পানির কদর সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া ফিজি, একুয়া পান্নাসহ নানা ব্র্যান্ডের বোতলজাত পানিও আমদানি হচ্ছে। মূলত ৩৩০ মিলিলিটার, ৫০০ মিলিলিটার ও দেড় হাজার মিলি.লিটারের বোতলে পানি আমদানি হয়। এসকল পানির ৫০০ মিলিলিটার বিক্রি হচ্ছে ২১৫ টাকায় এবং দেড় লিটার বিক্রি হচ্ছে ৪৫০ টাকায়। রাজস্ব বোর্ডের তথ্যে দেখা যায়, ২০২৩ সালে পানি আমদানিতে ১ লাখ ১৫ হাজার ডলার ব্যয় হয়। শুল্কায়ন মূল্য ছিল ২ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। (সুত্র: প্রাগুক্ত)। যেখানে, ৩০, টাকা লিটারেই ভালো মানের সুপেয় পানি পাওয়া যাচ্ছে, সেখানে ৪৫০-৫০০ টাকা লিটারে পানি পান পুরোটাই ইসরাফ।

 

ধর্মে ঘৃণ্য ভিন্ন একটি  পরিভাষা হলো "রিয়া" তথা ''লৌকিকতাপূর্ণ ইবাদত"। সমাজে আজকাল কিছু লোক দান-সদাকা প্রদান করে তার প্রচারণা এবং খ্যাতি অর্জনে উদ্দেশ্য। ভোট এলে আবার কিছু নেতা দেখা যায়, মদের বারে এবং পতিতালয়ের এরা নিয়মিত খদ্দের হলেও ভোটকে সামনে রেখে এদের মাথায় টুপি, এক ওয়াক্তের নামায লোক দেখাতে ৩/৪ বার করে পড়া, মসজিদে-মাযারে ধর্ণা দেয়। এসবে পূণ্য অর্জন কখনো মুখ্য উদ্দেশ্য থাকে না, বরং ভোট কাটা এবং জনসমক্ষে সম্মান অর্জনই মূখ্য হয়। এসব হলো রিয়া, ধর্মে যার পরিনতি অতন্ত্য ভয়াবহ। একটি হাদিসে হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, আমি আমার উম্মতের জন্য ছোট শিরকের ভয় যত করছি, এত ভয় অন্য কোনো বিষয়ে করি না। উপস্থিত সাহাবারা জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! ছোট শিরক কি? হুজুর (সা.) উত্তর দিলেন, তা হচ্ছে- রিয়া।  অপর একটি হাদিসে আরও বলা হয়েছে, ইবাদতের মধ্যে একটি ধূলিকণা পরিমাণ লোক দেখানো মনোভাব থাকলে আল্লাহতায়ালা ওই ইবাদত কবুল করেন না।

 

আলোচ্য প্রেক্ষাপটে বোধগম্য হয়, যেখানে ১৫-৩০ হাজারে ভালো মানের খাসি এবং অনধিক ২ লক্ষ টাকায় ভালোমানের গরু পাওয়া যাচ্ছে, সেখানে ১৫ লাখে খাসি আর কোটি টাকায় গরু কোরবানি একইসাথে ইসরাফ ও রিয়া উভয়টিই হচ্ছে। আজকাল সমাজে আর্থিক নৈতিকতা কমে গিয়েছে, ফলে কে কোন উপায়ে অর্থ উপার্জন করছে, তার কোন ইয়াত্তা নেই। সমাজে যখনো হাজার লোক অনাহারে অর্ধ-হারে দিনপাত করছে এবং বণ্যায় সিলেটসহ নান উপদ্রুত অঞল ডুবছে, তখনো আমরা দেখি কোটি টাকায় গরু আর পনের লাখে খাসি কেনার প্রতিযোগিতা। আরো দেখি বেনজির এর হাতে আলাদিনের চেরাগ এবং সংশ্লিষ্ট নানা বাস্তবতা। যারা এসবে প্রশ্রয় দিচ্ছে, এমন মহান কুরবানির মুল মর্মকে কলুষিত করছে তাদের প্রতি শত ধিক!!