পোস্টস

বিশ্ব সাহিত্য

Kafka's letter to Milena

২২ জুন ২০২৪

ওয়ালিদ প্রত্যয়

মূল লেখক ফ্রানস্‌ কাফকা

অনুবাদক ওয়ালিদ প্রত্যয়

[মেরান, এপ্রিল-মে ১৯২০] প্রিয় মিলেনা, আগেই বলে নিচ্ছি, কেননা আমি চাইনা বলার আগেই তুমি চিঠি পড়ে বুঝে ফেলোঃ ১৪ দিনের মতো হবে আমার ইনসোমনিয়া বেড়েছে, ঘাবড়াইনি, এমনটা প্রায়শই হয়। আবার এই নির্ঘুমতার কয়েকটা অপ্রয়োজনীয় ব্যাখ্যাও আছে (হাস্যকর ব্যাপার হলো, বায়দেকার* মনে করতেছেন এইটা মেরানের বাতাসের দোষ)। এমনকি ব্যাখ্যাগুলো সচরাচর চোখে না পড়লেও, সেসব মানুষকে কাঠের মতো নিথর আবার জঙ্গলের জানোয়ারের মতো চঞ্চল করে তুলতে পারে। অবশ্য আমার একটা সান্ত্বনা আছে। তুমি শান্তিতে ঘুমিয়েছো, যদিও কিছুটা “এলোমেলোভাবে,” যদিও গতকালও তুমি “বিমারগ্রস্থ”— তবুও তোমার ঘুম ছিলো শান্তির। তাই, যখন ঘুম আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিলো, আমি জানি কোথায় যাচ্ছে আর সান্ত্বনা পেয়েছি। দ্বিমত পোষণ করা বোকামি হবে যে, ঘুমই স্রষ্ঠার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি এবং নির্ঘুম মানুষ সবচেয়ে হতভাগা। অথচ এই বিনিদ্র মানুষটাকেই তুমি গত চিঠিতে ধন্যবাদ জানালে। যদি কোনো অর্ধশিক্ষিত আগন্তুক চিঠিটা পড়তো, সে ভাবতো, ‘কী শক্তসামর্থ্য মানুষ! সে নিশ্চয়ই পাহাড় ডিঙায়।’ অথচ, মানুষটা জীবনে কিছুই করেনি, আঙুল তোলেনি কখনোই (একমাত্র লেখা ছাড়া), দুধ খেয়ে বেঁচে আছে এবং আর কিছু খাবার— সবসময় (প্রায়) “চা ও আপেল” চোখেই দেখে না— এবং সাধারণত যে যেমন তাকে তেমনই থাকতে দেয় ও পাহাড় নিয়ে তার কোনো চিন্তাই নাই। তুমি কি দস্তয়েইভস্কির ফার্স্ট সাকসেসের কাহিনীটা জানো? এর ভেতর বিরাট কিছু ব্যাপার আছে; দস্তয়েইভস্কির মতো একটা মহৎ নাম জড়িত আছে বলেই গল্পটা আমার জন্য বলা সহজ, ঠিক পাশের বাড়ির কিংবা তারচেয়েও কাছের কোনো গল্পের মতো সিগনিফিক্যান্ট। হয়তো গল্পটা আর নামগুলো আমার ঠিকঠাক স্মরণে নাই। দস্তয়েইভস্কি যখন তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘পোর ফোক’ লেখেন, তখন তিনি বন্ধু গ্রিগরিয়েভের সাথে থাকতেন, গ্রিগরি সাহিত্যের মানুষ। মাসকে মাস লেখাভর্তি কাগজ তিনি টেবিলের উপর পড়ে থাকতে দেখেছেন, লেখা শেষ না হওয়া পর্যন্ত মূল পাণ্ডুলিপি হাতে পান নাই। গ্রিগরি উপন্যাসটা পড়লেন, উচ্ছ্বসিত হয়ে দস্তয়েইভস্কিকে না বলেই স্ক্রিপ্ট নিয়ে গেলেন নেকরাসভের কাছে, তখনকার বিখ্যাত ক্রিটিক। সেদিন রাতের তিনটায় লেখকের ডোরবেল বেজে উঠলো। গ্রিগরি আর নেকরাসভ, ঘরে ঢুকে দস্তয়েইভস্কিকে জড়িয়ে ধরলেন, চুমু খেলেন। লেখকের সাথে নেকরাসভের পূর্ব-পরিচিতি ছিলো না, তিনি দস্তয়েইভস্কিকে আখ্যা দিলেন ‘রাশিয়ান সাহিত্যের আশা’ বলে। ভোর পর্যন্ত তাদের আলাপ চলল, সব কথাতেই ঘুরে ফিরে উপন্যাসটার প্রসঙ্গ। সারাজীবন দস্তয়েইভস্কি এই রাতটাকে সবচেয়ে মধুর বলে এসেছেন, জানালার শার্সিতে হেলান দিয়ে ওদের চলে যাওয়া দেখার পর, আর নিজেকে আটকাতে পারলেন না, কেঁদে ফেললেন। তাঁর প্রাথমিক অনুভূতি সম্পর্কে তিনি বলেছেন, কোথায় বলেছেন এই মূহুর্তে আমার মনে নাই, তিনি বলেছেন, “কী অমায়িক লোক দুইজন! ভদ্র এবং সভ্য। অথচ আমি ক্যানো এরমকম নিচ? তারা যদি আমার ভেতরটা দেখতে পেতো! যদি বলতামও আমার ভেতরে কী চলছে, বিশ্বাস করতো?” আসলে ওদের মতো হতে চাওয়াটা দস্তয়েইভস্কির জন্য একটা মুখোশ মাত্র, যুবকের শেষ শব্দগুলো মধ্যে শুধুই অমর হতে চাওয়া, আর যেহেতু এসব আমার গল্পে মুখ্য নয়, সুতরাং আমার গল্পটি এখানেই ফুরালো। তুমি কি, প্রিয় মিলেনা, এই গল্পের রহস্যময় দিকটা বুঝতে পারতেছো, তুমি কি দেখতে পাচ্ছো যা খালি চোখে এই গল্পে দেখা যাচ্ছে না? আমার মনে হয় এমন যে, সহজভাবে দেখলে, গ্রিগরি এবং নেকরাসভ কেউই দস্তয়েইভস্কির চেয়ে মহৎ ছিলেন না, কিন্তু এখন যদি সহজভাবে দেখাটাকে পাশে সরিয়ে রাখি, শুধু দস্তয়েইভস্কির উপর পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে তাকাও, তাহলে তোমাকে এটা বুঝানো সম্ভব যে গ্রিগরি আর নেকরাসভ সত্যিই দূদার্ন্ত আর দস্তয়েইভস্কি মানুষের মতো অপবিত্র, এতো অসম্ভব নিচ যে, তার উপর এমন দানবীয় দয়া দেখানোর জন্য তিনি আর কখনোই গ্রিগরি আর নেকরাসভের কাছাকাছি আসতে পারবেন না। জানালার ধারে দাঁড়ালেই তুমি ওদের সেই চলে যাওয়াটা দেখতে পাবে, বুঝতে পারবে— তাদের পাওয়া যায় না, তারা অপ্রাপ্য।–দুঃখের ব্যাপার, গল্পের আসল অর্থটা মহান দস্তয়েইভস্কির নামের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে। আমার ইনসোমনিয়া আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? আমি নিশ্চিত, এমন দিকে নিয়ে যাচ্ছে যা সুখকর নয়। কাফকা।