পোস্টস

গল্প

ছোট গল্প - 'চমক'

৭ মে ২০২৪

নোমান প্রধান

মূল লেখক নোমান প্রধান

বুকের ব্যাথাটা নতুন না। বুকের বাম পাশে ব্যাথা নেই, এমন পুরুষ আছে নাকি বাঙলায়? স্কুল জীবন থেকে শুরু করে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় আঙিনা। তারপরে বিয়েবাড়ি, পার্ক কিংবা ট্রেনের বগিতেও কতবার বুকের বামপাশটা মোচড়ে গেছে! কে গুনে রাখে সেই হিসাব? তবুও এই ছাপান্ন বছরে ছেচল্লিশ ইঞ্চি ছাতিটা বোধহয় আর চাপ নিতে চাইছিলো না। দুই দিন অফিস কামাই করে শয্যাশায়ী হতেই ঘরের চিরশত্রুর আর সহ্য হলো না। এক উদাস বিকালে, আমায় বগলদাবা করে নিয়ে ছুটে গেলো ডাক্তারের কাছে। সরকারি হাসপাতাল হলেও মানা যেতো! একদম সেন্ট্রাল এসি করা এক প্রাইভেট ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। চকচকে ভবনের ঠান্ডা হাওয়া শরীর স্পর্শ করতেই বুঝলাম, এবার খতি ফক্কা! খতি শব্দটা আব্বার কাছে শেখা। পয়সার ব্যাক্তিগত ভান্ডকে আব্বা খতি বলতেন। সেই শব্দ তিনি তার বাজানের কাছে শিখেছিলেন। তার বাজান শিখেছিলো তারও বাপজানের কাছে। সিলসিলা। তো খতির ইজ্জত বাঁচাতে জানপ্রিয় দুশমনকে বললাম, বুকের ব্যাথাটা এখন একটু কম। সন্ধ্যায় নাহয় মহল্লার মোড়ে হারাধন হোমিও হলে একবার ঢু মেরে আসবো! বউ এই কথা শুনে চোখজোড়া বড় করে চোখের মণি ঠিক মাঝ অবস্থানে এনে যেই চাউনি দিলো এর পরে কোন সুস্থ মস্তিষ্কের পুরুষ তৎক্ষনাৎ ভেজা ইয়ে না হয়ে আর পারবে না। ইয়ে শব্দটা ব্যবহার না করে পারলাম না। পুরুষ তো! সত্য হোক, মিথ্যা হোক- নিজেকে পুষ্যি ভাবা সম্ভব না। 
পকেট কাটার আগে, পা দুটো যেন ক্লান্ত না হয় সেই জন্য লিফটের ব্যবস্থা তারা স্থায়ী ভাবেই করে রেখেছে। টু শব্দ না করে বেগমকে অনুসরণ করে চলে গেলাম শীতল ভবনের চার তলায়। এখানেই বসেন দেশ সেরা সরকারি মেডিক্যাল কলেজের সেরা বক্ষ বিশারদ৷ বক্ষের যে কোন রোগ ধরতে তিনি পারদর্শী। তবে ভদ্রলোকের মাথায় বোধহয় গোলমাল আছে নয়তো সরকারি মেডিক্যালের ডাক্তার হয়ে প্রাইভেট ডায়াগনস্টিক অলংকৃত করছেন কোন আক্কেলে? সে যাই হোক, বউ চোখ টাটিয়েছে সুতরাং গোলমেলে বক্ষরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতেই হবে। আমরা এগিয়ে গেলাম ৪০৩ লেখা এক দরজার সামনে। সেখানে খাতায় রোগীর সিরিয়াল লেখছে এক অপরূপা! শুধু অপরূপা নয়, উর্বর্শী। তাকে এক পলক দেখে মন ভরবে না জোয়ানের। ছাপান্নতে কোন পুরুষ নিশ্চয় জোয়ানই। পরতি হলেও বৃদ্ধ তো আর নয়! আর জোয়ানির নিয়ম রক্ষা করতে চাইলাম অবশ্যই গিন্নীর পিছনে দাঁড়িয়ে। গিন্নী আমার দিকে না তাকিয়েই বললো, ভিসিটের এক হাজার দাও। এমন সুকন্ঠী, গোলাপী রূপসীর হাত পর্যন্ত যদি যায় তবে এক হাজার কেনো? সমস্ত ধনসম্পদও নিশ্চয় ঢেলে দেয়া যায়। যায় না? অবশ্যই যায়। মনে মনে ভাবলাম, সিরিয়ালে ডাক আসার আগ পর্যন্ত বসে আপরূপ রূপ নিহারিবো। অবশ্যই মুটিয়ে যাওয়া ঘরের শত্রুর চোখ ফাঁকি দেয়ার ফন্দি বের করে ফেলতে হবে এর মধ্যেই। আমি ভাবতে লাগলাম কি বলে বউওকে একটু অন্যদিকে পাঠানো যায়! পানি খাবো বলে নিচে পাঠানো যায়। কিংবা তার ফুল বডি চেকাপের জন্য পাঠিয়ে দেয়া যায়। সেক্ষেত্রে বেশ কিছুক্ষণ ফাঁকা পাওয়া যাবে৷ ফুল বডি চেকআপ এখানে আর কত হবে? সাত-আট হাজার? বড়জোর দশ! হলোই বা। সাতাশ বছরের সংসার জীবনে একবারও তো তার ফুলবডি চেকআপ করানো হয় নাই। নাহ, এ বড় অন্যায়। যা হয় নাই তা আজই হোক, এখনই হোক। কথাটা বউয়ের সামনে পাড়তে যাবো এমন সময় স্বর্গ থেকে নেমে আসা অপরূপা বললো, আপনারা ভিতরে যান। আমি আকাশ থেকে পড়লাম! হায়! হায়! যাকে দুচোখ ভরে দেখবো বলে দশ হাজার টাকা গচ্ছা দিতেও আপত্তি ছিলো না সেই কি না... বেশী ভাবার সুযোগ পেলাম না। হটগট (উত্তাপ ছড়িয়ে গটগট করে হেঁটে যাওয়া অর্থে) করে হেঁটে যাওয়া তারে অনুসরণ করে চলে গেলাম ডাক্তারের চেম্বারে।
সেখানে দুইজন পুরুষ সহকারী নিয়ে বেরসিক বুড়ো ডাক্তার বসে আসেন। আমাদের বসতে বললো। এক চ্যালা জিজ্ঞেস করলো, রুগী কে? আমি একটু কুঁজো হতেই অন্য চ্যালাটা এগিয়ে এসে আমার বুকে টেথোস্কোপ লাগিয়ে বললো শ্বাস টানুন। শ্বাস ছাড়ুন। একটু উপর নিচ করলো টেথোস্কোপ আর বললো শ্বাস টানুন। শ্বাস ছাড়ুন। আরে উল্লুক! তুই না বললে কি লোকে শ্বাস না টানবে আর শ্বাস টানলে কি তা না ছাড়ার উপায় আছে? মেশিনটা শুধু জায়গামত ধরে রাখ না চুপচাপ। মুখে কিছু বললাম না। চ্যালাটা গিয়ে বুড়োর কানে কানে কি যেনো বললো। বুড়ো মাথা ঝাঁকিতে কাগজে কলম চালানো সাঁই সাঁই। বুড়োর লেখার গতি দেখলে তাজ্জব বনতে হয়। একটানে প্যাড থেকে কাগজটা ছিড়ে আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, হার্টের এই টেস্ট গুলো করে আনুন! আমি চমকে উঠলাম! খেয়াল করলাম আমার বেগমও চমকে উঠেছে।
আমি ঠিক শুনেছি কিনা তা নিশ্চিত হতে হাতের কাগজটার দিকে তাকালাম। হ্যাঁ! হৃদযন্ত্রের টেস্টই দিয়েছে।  কি আশ্চর্য। কি কেনো? কিভাবে? আমার বউয়ের দিকে তাকালাম। সে বিষ্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে বুড়োর দিকে। বুড়ো মিটিমিটি হাসছে। আমার বউ শেষে মৃদু স্বরে জানতে চাইলো, আপনি নিশ্চিত? বুড়ো মিটিমিটি হাসি বজায় রেখে মাথা নাড়ালো। তিনি নিশ্চিত। আমি কিছু না বলে উঠে দাড়ালাম। খেয়াল করলাম আমার পা কাঁপছে। আমার বেগমও উঠে দাড়ালো। আমাদের মুখে রা জুটছিলো না। আমরা দরজার দিকে পা বাড়ালাম। খুব ধীরে। আমাদের অবস্থা খেয়াল করেছে ডাক্তারের চ্যালাও। একজন পিছু ডেকে বললো- বিশ্বাস না হয় টেস্ট করিয়ে দেখুন। 

আমরা বেড়িয়ে আসলাম। আমার গিন্নী পরম মমতায় আমার হাতের আস্তিন ধরে রেখেছে। না তাকিয়েও বেশ বুঝতে পারছি তার দুই চোখ বেয়ে নামছে নুনের ধারা। সত্যি বলতে, আমার চোখও ভরে উঠেছে তখন জলে। এ যে অবিশ্বাস্য! এ কি শুনলাম আমি। এত গুলো দিন জানতেও পারি নাই। ভাগ্যিস বুকের বাম পাশে ব্যাথাটা এসেছিলো। লিফটের সামনে এসে দাড়ালাম আমরা। বউ তখনো আমার আস্তিন ধরে রেখেছে। মুঠোর জোর বাড়ছে পলে পলে। লিফটে নামার সময় আর কেউ নাই, আমরা দুজন। আমার ঘরের শত্রু আনন্দের অতিশয্যে আমার বুকে মাথা রেখে বিড়বিড় করে বলেই ফেললো, তোমার হৃদয় আছে! শুনেছো? তোমারো হৃদয় আছে। আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। আমার গাল ভিজিয়ে দিয়েও নামল নুনের ধারা। সত্যিই তো! এত গুলো বছর এই পৃথিবীতে! এর আগে কেউ কোন দিন বলে নাই যে- আমারো হৃদয় আছে!