ব্রয়লারের দোকানে সদ্য জবাই দিয়ে ড্রামে ফেলে দেয়া মুরগির মতো মৃত্যু যন্ত্রণায় তড়পাতে তড়পাতে রক্তাত্ত ফুরকান আলীর পুরো জীবন যখন তারই চোখে ভাসতে থাকে তখন প্রায় সুবহে সাদিক। প্রকট মৃত্যু যন্ত্রণা ভাগাড়ের বোটকা আঁশটে গন্ধটাকে প্রছন্ন করে তুলেছিলো ঘাড়ে মরণ কোপটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই। সেখানে হাত দিয়ে রক্তের স্রোত থামানোর বৃথা চেষ্টা থামিয়ে নিথর হয়ে শুয়ে থাকে সে। চিত হয়ে শুয়ে সোজা আকাশের দিকে তাকালে যেমন দিকের হিসেব মেলানো মুশকিল হয় তেমনি মাত্র এক মিনিট আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটার হিসেব মেলাতে কষ্ট হয় তার। ঘাড় বেয়ে গলগলিয়ে রক্ত চুয়ে মাটিতে পড়লে সেটার হালকা গরম ওম তার কাছে তার মৃত স্ত্রী জয়নবের মুখ থেকে আসা নিঃশ্বাসের মতো মনে হয়। আট বছর আগের আষাঢ় মাসের ঝুম বৃষ্টির রাতে যখন জয়নব আকস্মিক মারা যায় তখন ফুরকান আলী তার মাংসের দোকানের চাল চুয়ে অঝোরে পড়তে থাকা পানি আটকানোর চেষ্টায় মগ্ন। রোগা পটকা আজিজ কাক ভেজা অবস্থায় যখন হাঁপাতে হাঁপাতে তার দোকানের সামনে এসে এক নাগাড়ে ঘটনা বলতে থাকে তখন চালে পড়তে থাকা বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটার শব্দের মাঝে কান পেতে ফুরকান যা শোনে তা হলো; ঝুম বৃষ্টির সময় একমাত্র ছেলে জমিরকে খুঁজতে গলির মোড়ে ভিজতে ভিজতে হেঁটে যাবার সময় রাস্তায় পড়ে থাকা বিদ্যুতের তারে পা বেঁধে যায় জয়নবের। বিদ্যুতের তার পা থেকে সরানোর আগেই পুরো শরীর জুড়ে বিদ্যুৎ বয়ে যায় জয়নবের। মুহুর্তেই জমদূত আগে পয়গাম না এনে সরাসরি জান কবজ করে। ঠিক কতক্ষণ লাশটা সেখানে পড়ে ছিলো তা নিয়ে মতভেদ থাকলেও সেটাকে ছুঁতে যে বেশ দেরী করে ফেলেছিলো আশপাশের লোকজন তা স্পষ্ট হয় সালেহার মায়ের কথায়। সে আর রোগা আজিজ যখন লাশটা করলবাগ বস্তির পশ্চিম দিকে ফুরকানের তিন রুমের ঘরটার ভেতরে নিয়ে আসে তখনো আঝোরে বৃষ্টি পড়ছিলো। সে বৃষ্টি উপেক্ষা করেই আশেপাশের ঘরগুলো থেকে লাশ দেখতে মানুষ জড় হয় ঠিক সদ্য হাট থেকে কিনে আনা কুরবানীর গরু দেখতে আসা ভিড়ের মতো। বস্তির চিপা গলি দিয়ে কাকভেজা হয়ে দৌড়ে আসতে আসতে ফুরকান কেঁদেছিল কিনা তা কেউ বলতে পারেনা। মাথা বেয়ে বৃষ্টির পানি আর চোখ বেয়ে পড়া কান্নার লোনা পানির স্বাদের পার্থক্য একমাত্র যে কেঁদেছে সেই ঠাওর করতে পারে। মেঝেতে রাখা জয়নবের ভেজা নিথর দেহটা দেখেছিলো ফুরকান স্তব্ধ হয়ে। তখনো জমিরের খোঁজ কেউ জানেনা। প্রায় চৌদ্দ বছর আগে বিয়ে করে জয়নবকে এই একচালা ঘরেই এনেছিলো সে। সেদিনও এমন বৃষ্টি ছিলো। করলবাগের বিখ্যাত কসাই আশেক মোল্লা যখন সেই বৃষ্টিমাখা সন্ধ্যায় তার একমাত্র মেয়ে জয়নব খাতুনকে শিষ্য ফুরকান আলীর হাতে তুলে দিয়েছিলো তখন জং ধরা চালে বৃষ্টির ঝমঝমানি তার কান্নার শব্দকে মুছে দিয়েছিলো একেবারেই। মাত্র ছয় বছর আগে বরগুনার এক অজপাড়া গাঁ থেকে ঢাকায় আসা এতীম ও বাস্তুহীন ফুরকারনের হাতে নিজের আদরের একমাত্র মেয়েকে তুলে দেবার জন্য আশেক মোল্লাকে অনেক কথা শুনতে হয়েছিলো। অনেকে বলাবলি করেছিলো যে ফুরকান পলাতক আসামী। সে সব কথায় পাত্তা তিনি একেবারেই দেননি। নিজের শেষ সময় আন্দাজ করে ফেলেছিলেন তিনি বেশ আগেই। শরীরে বাসা বেঁধেছিলো এক জটিল রোগ।
বাসর রাতে জয়নবের চাঁদমুখখানা দেখতে ঠিক ঝুম বৃষ্টির পর হাল্কা মেঘে ঢাকা চাঁদের মতো আবছা কিন্তু মায়াবী লাগছিলো। মৃত জয়নবের মুখটা কি আজও ঠিক তেমনই দেখাচ্ছে? সালেহার মায়ের বিলাপে সেই ভ্রম ভাঙ্গে ফুরকানের। ঠিক কখন যে জমির এসে তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে তা বুঝতেই পারেনি সে। বাবা ছেলে দুজনই কাঁকভেজা হয়ে লাশটা দেখতে থাকে। মায়ের মৃত্যুতে জমিরের আচরণে কোনো পরিবর্তন দেখতে পায়না ফুরকান। সে যেন এখনো বৃষ্টিতে খেলার আনন্দের রেশ কাটিয়ে উঠতে পারেনি। অবশ্য মাত্র বারো বছর বয়সে তার থেকে এরচেয়ে বেশি কিছু আশাও করেনা ফুরকান। সে রাতেই জয়নবের লাশ দাফন করে যখন বাবা ছেলে বাসায় ফেরে তখন প্রায় সকাল। ততক্ষণে আগের রাতে ভিজে চুপচুপে হবার দরুন জমিরের জ্বর এসেছে। জ্বরের ঘোরে নিয়মিত বিরতিতে মা মা ডাকের ক্ষীণ আওয়াজ ফুরকানের কানে একরকম জপের মতো শোনায় যেন সেটা জ্বর তাড়ানোর কোনো মহাঔষধ । আধঘন্টা মাথায় জলপট্টি দিয়ে শুইয়ে রাখলে জমির ঘুমিয়ে পড়ে। সদ্যভুমিষ্ঠ শিশুর মতো জিব বের করে রাখা তার চেহারা দেখে ফুরকানের মনে পড়ে সেই দিনের কথা যেদিন সে কোলে করে নিয়ে এসেছিলো জমিরকে। সেদিন ওর গায়ের রঙ কালো হওয়ায় সালেহার মায়ের ভ্রকুটি জয়নবের মনে বেশ দাগ কেটেছিলো। "পালক যখন আনবু তখন কালা আনিচ্ছো ক্যান"—কথাটা জয়নবের মস্তিকে গেঁথে ছিলো বহুদিন। নিঃসন্তান মায়ের আবার বাচ্চার চামড়ার রঙের কষ্ট সমূহক কথাগুলো চার সন্তানের জননী সালেহার মাকে বলেছিলো সে বেশ অকথ্য ভাষায়। তার মুখের ওপর দরজাটা ঠাস করে লাগিয়ে দিলে দুই মাস বয়সী জমিরের ঘুম ভেঙ্গে যায়। সে কান্না থামাতে জয়নবের গেলেছিলো মাত্র দুই মিনিট। স্ত্রীর পর মা হিসেবেও জয়নবের অন্তর্নিবিষ্টতার ব্যাপারে আশ্বস্ত হয়ে ফুরকান এবার মৃত শ্বশুরের মাংসের দোকানে মনোযোগ দিতে পারবে বলে হাফ ছেড়ে বাঁচলো।
প্রায় তিনবছরের চেষ্টাতেও যখন জয়নব-ফুরাকান কোনো সন্তানের দেখা পেলোনা তখন বাটুক কবিরাজ থেকে প্রসূতিরোগের ডাক্তার এবং কামাখ্যা থেকে তন্ত্র চিকিৎসায় দিক্ষিত দাবী করা বাবা থেকে ঢাকার এরোপ্লেন মসজিদের হুজুর কোন কিছুই বাদ রাখেনি তারা। সিলেটে হযরত শাহজালাল (রহঃ) এর মাজারে মানত করে ঢাকার ফেরার পথে উপবন এক্সপ্রেস ট্রেনটা যখন শ্রীমঙ্গল পার করে তখন জানালার পাশের বসা জয়নব গোমড়া মুখ করেই ফুরকানকে পালক সন্তান নেবার কথাটা জানায়। ঠিক কি কারণে জয়নব ওইসময় এ কথা বলেছিলো তা আজও জানে না। হয়ত চা বাগানের ভ্যাপসা বাতাসে মতিভ্রমে অথবা এক রাতের ঝটিকা সফরের ক্লান্তিতে জয়নবের মা হবার আশাটা মলিন হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু মানতে কাজ হবে ভেবে ফুরকান সে কথায় পাত্তা দেয়নি। কিন্তু চারমাস পর যখন তার কানে এক বাচ্চা বিক্রির খবর আসে তখন সেটাকে একরকম নিয়তিই ভেবে নেয় সে। জুয়ায় আসক্ত রিকশাওয়ালা কালুর ঘরের চতুর্থ সন্তান অনাগত থাকায় সেটা বিক্রির ইচ্ছায় আশপাশ খবর লাগায়। কিন্তু কালুর বউ সন্তান বিক্রি করে দিতে না চাইলে রাগে ঘটনার আকস্মিকতায় আট মাসের অন্তস্বত্তা বউয়ের মাথা ফাটায় কালু। রক্তাত্ত বউ মরে গেছে ভেবে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আর ফিরে আসেনা সে । কালুর এমন অন্তর্ধানে বিপাকে পড়ে যে সন্তানকে বিক্রি করতে চায়নি তাকেই ফুরকানকে মাত্র বিশ হাজার টাকায় বিক্রি করে তল্পিতল্পা গুছিয়ে শহর ছাড়ে কালুর বউ। লোকমুখে সে শুনেছে তার স্বামী এখন এক পতীতার সঙ্গে ঘর করছে। জয়নবকে ফুরকান কোনোদিনই জানায়নি টাকা দিয়ে সন্তান কেনার কথাটা এবং তার প্রয়োজনও পড়েনি। একবার সন্তান ঘরে এনে আর পেছনে ফিরে তাকানোর ফুরসত পায়নি ফুরকান। ফুরকান যখন তার শ্বশুরের মতো পাকা কসাই হতে বোন ম্যারো অক্ষুণ্ণ রেখে গরু আর খাসির চারপায়া সঠিক অনুপাতে কাটা রপ্ত করতে ব্যস্ত তখন জমির ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে জয়নবের সাবধানী চোখে। ফুরকানের গোস্তের দোকানটাও বড় হয় তর তর করে। তার মনে হতে থাকে বিশ হাজার টাকা সন্তানের পেছনে লগ্নী করেই সে স্বছলতার মুখ দেখেছে। এসব কথা চিন্তা করতে করতেই সে রাতে বিশ হাজার টাকার ঘুমন্ত ছেলের পাশেই বসে থাকে ক্লান্ত ফুরকান। ইশ! যদি একঘুমেই চার পাঁচ বছর পার করে দেয়া যেতো? তাহলে পল্টুকে বড় করার দায়িত্ব থেকে মুক্তি পাওয়া যেত। ঘুমে ঢলে পড়ে ফুরকান আর সেই সাথে যেন স্বপ্নের মতো এক ঘটনা থেকে আরেক ঘটনায় লাফ দিয়ে বদলে যায় তার জীবনের প্রেক্ষাপট।
ভাদ্র মাসের বিকালের বিশ মিনিটের আচমকা ঝড়ের পর যেমন প্রকৃতি অদ্ভুতভাবে স্বাভাবিক হয়ে যায় তেমনি জয়নবকে দাফন দিয়ে আসার তিনদিন পর সবকিছু আবার স্বাভাবিক হয় ফুরকানের জীবনে। মস্তিক প্রলম্বিত শোক পছন্দ করেনা। সেই মস্তিকের জোরাজুরিতে কিংবা স্বেচ্ছায় ফুরকান সালেহার মায়ের হাতে ছেলের দেখভালের দায়িত্ব দিয়ে তার মাংসের দোকানে ব্যস্ত হয়ে পড়ে । নামী মানুষ হতে হলে ভালো হোক কিংবা খারাপ সবসময় কাজের মধ্যে থাকতে হয়; শ্বশুরের এই কথাটা আত্তস্থ করে নিয়েছিলো সে অনেক আগেই। পরের চার বছরে ফুরকান দক্ষতায় তার শ্বশুরকেও ছাড়িয়ে গেল। নাম ডাক ছড়িয়ে পড়লো আশেপাশের এলাকাতেও। দোকানের কর্মচারী সংখ্যা গিয়ে ঠেকলো ছয় জনে। ফুরকান কসাইয়ের হাতে বকরি কিংবা গরুর জান কবজ করানোর আগ্রহ তখন এলাকা জুড়ে। তার কোপে মাংসের এক একটা পিস যেন নিখুঁত কোনো ভাস্করের কাজ। এক কোপে হাড়গুলোকে বিচ্ছিন্ন করে সে তার পেশী আর ধারালো মনঃসংযোগ দিয়ে। তার পাইটুরা এর রহস্য জিজ্ঞেস করলে সে বলেঃ "হাড্ডি ভাঙ্গে মনোবলে; রামদার ধারে না। যেই জায়গাত কোপ দিবি সেইটা থিকা মনোযোগ সরাইলেই মিসটেক হইবো, হাড্ডি গুড়াগুড়া কইরা ফালাবি।" সন্ধ্যায় দোকানের ছাপি নামিয়ে সিগারেটের আড্ডায় এসব কথা গলা উঁচিয়েই বলে ফুরকান। আটটার দিকে সে বাড়ি গেলে রোগা পটকা আজিজের নেতৃত্বে যে গাঁজার আসর বসে সেখানেও তার কসাইগুণের কীর্তি বাড়িয়ে চাড়িয়ে বলে সবাই। সেই সাথে উঠে আসে ফুরকানের পালক ছেলে জমিরের কসাই হবার অনাগ্রহের কথা। ষোলো বছর বয়স হয়ে গেলে তাও বাপের দোকানে পাও মাড়ায় না সে। সালেহার ছোটছেলের সাথে ঘুরে ফিরে যেন একদম ভদ্দরনোক বনে গেছে সে। ওর ছোকড়াদের গ্রুপের সবাই স্টাইলিশ চুলের কাটিং দিয়ে মোটরসাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়ায় এলাকায়। কোথায় ফুরকান আলী আর কোথায় তার ছেলে জমির। আজিজ অবশ্য বার বার সবাইকে মনে করিয়ে দেয় যে জমির জুয়াড়ি কালুর ছেলে। "রক্তের খাইসলত হইলো আসল খাইসলত; জমিরেক ফেলাট বাড়িতে রাখলেও ওর শইল্লে কালুর রক্ত। জয়নব বিবির পেটে আবার পল্টুকে হান্দাইলেও সে কালুর পোলাই থাকবো,ফুরকান ওস্তাদের পোলা হইবো না"- কষে গাঁজার শেষ টানটা দিতে দিতে মুখ খিঁচিয়ে আজিজ কথাগুলো বললে কেউ কোনো উত্তর দেয় না। সামনের কুরবানির ঈদে খান সাহেবের বাড়ি তিন লাখ টাকার গরু কাটার খ্যাপের উত্তেজনায় বিভোর সবাই বকশিসের বাড়তি টাকা দিয়ে কি কি করবে তার চিন্তায় মগ্ন থাকে। নেশা কেটে গেলে আজিজ ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা দুটো কড়া গন্ধের আগরবাতি জ্বালিয়ে দোকানে তাদের এই আসরের আলামত নষ্ট করে বাড়ির দিকে আগায়।
এদিকে বাড়ি ফিরে ফুরকান তার তিনরুমের কোণার ঘরটায় উচ্চশব্দে গান বাজতে শুনলে সেদিকে এগিয়ে যায়। কাঠের দরজায় কড়া নাড়লে বাংলা ইংলিশের মিশেলে র্যাপ গানটা বন্ধ না করেই জমির এসে দরজা খুলে আর সাথে সাথে আগরবাতির বোটকা গন্ধটা নাকে এসে লাগে তার। প্রতিদিন সকালে দোকানেও এই গন্ধটা পায় সে। বিরক্তি মাখা চেহারাটা বানিয়ে জমির তাকালে ফুরকান ছেলেকে জিজ্ঞেস করে রাতে খাবার কথা। খিদা নাই- বলে জমির দরজাটা লাগিয়ে দিতে থাকলে এক পলক তার ছেলের রুমটা দেখে ফুরকান। ঘুনে ধরা টেবিলে একটা ফোন আর তার পাশে একটা রিং লাইট সেটাপ। পাশে একটা ফুটপাত থেকে কেনা কমদামী সাউন্ডবক্স। ছেলে কি করে এসব দিয়ে সে সেটা না বুঝলেও জানে ঠিকই। একা ভাত খেয়ে ফুরকান যখন বিছানায় শুয়ে জয়নবের চেহারাটা মনে করতে থাকে তখন প্রায় রাত বারোটা। ঠিকঠাক চেহারাটা মনে করতে পারলে তার মুখের কোণে একটা হাসি ফোটে। ঘুম আসবে আসবে ভাব অবস্থায় পাশের রুম থেকে একটা আওয়াজ পেলে উঠে বসে ফুরকান। চাপা গলায় কেউ একজন প্রিস প্রিন্স বলে ডাকছে। দরজার ফাঁক দিয়ে তাকালে সে দেখতে পায় সালেহার ছোট ছেলে মুবিনকে। আরেকবার প্রিন্স বলে ডাকতেই দরজা খোলে জমির। ভ্যাপসা গরমে একটা কালো জ্যাকেট গায়ে দিয়ে মুবিনের সাথে বস্তির গলির অন্ধকারে মিলিয়ে গেলে ফুরকানের মাথায় ঘুরতে থাকে একটাই প্রশ্ন-জমিরের নাম কবে থেকে প্রিন্স হলো? নামটা জমির নিজেই রেখেছে। জয়নবের দেয়া এ নাম নিয়ে মানুষের হাসিতামাশা শুনে কাহিল হয়েই এটা রাখে সে। অলনাইলনে তার নাম কিলার প্রিন্স। বেশ ভালো ফলোয়ারও আছে। সে রাতে ঘুম আসেনা ফুরকানের। ছেলেকে সে পথ থেকে ফেরানোর উপায় ভাবতে থাকে সে। পরদিন সকালে গত রাতের কম ঘুমের প্রভাবে কিংবা ছেলের গতিবিধিতে ভয় পেয়ে সে আজিজকে দিয়ে আগরবাতির গন্ধভর্তি দোকানে জমির ওরফে প্রিন্সকে ডেকে আনায়। জমিরের পড়নে চাপা টিশার্ট, ছেড়া স্টাইলিশ প্যান্ট ও হাতে একটা চেইন। খাঁ সাহেবের বিশালদেহী গরু কুরবানীর কাজে পল্টুকেও সাথে থাকতে হবে এমন আদেশে জমির যতটা না অবাক হয়ে তার চেয়ে বেশি অবাক হয় আজিজ। "ছোকড়া মানুষ, মুরগি তো দূরের কথা মাছিও মারে নাই,হাতির লাগান ফ্রিজিয়ান গরু কাটবে ক্যামনে" – আজিজের এই এমন প্রশ্নে ফুরকান বলে- "আশেক মোল্লার নাতি আর ফুরকান আলীর ছেলে ওয়; উট আনলেও কাটতে পারবো।" আগের রাতে জমিরকে কালুর ছেলে বলে সম্মোধন করা আজিজ কিছু বলতে পারেনা। পরের চারটা দিন আর কুরবানীর আগ রাত পর্যন্ত ছেলেকে মাংস কাটার নানা কৌশল শেখায় ফুরকান। কোথায় কোন কোপ আর রামদা ধরার টেকনিক শেখায় তাকে। গরু বকরির চার পা যে এই জীবিকার মূল অংশ তা জানায় বেশ আগ্রহের সাথেই। ঘাড়ের মাংস আলাদা করার কৌশলটা একটু ভিন্ন। বড় বিদেশী ব্রিডের গরুর ধড়ও হয় বিদেশী গো মতো ত্যাড়া। ভারী রামদা দিয়া ভালো মতো কোপ না দিলে মাংস উইড়া উইড়া ছ্যাড়াব্যাড়া হইবো। নেহারীর জন্য পায়া গুলান হইতে হইবো পিওর মাখন কাট। হাত এমন পাঁকা হইতে হইবো ঠিক মাখনে গরম চাকু রাখলে যেমনে আলতো কইরা ভাগ হয়া যায় ওমন। ছেলেকে ফুরকান এমনভাবে কথাগুলো বলে যেন কোনো তপস্যাগুরু তার শিষ্যদের যোগক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তৃত জ্ঞান দিচ্ছে। এতে কাজও হয়, জমির বেশ পাঁকা হয়ে যায় এই কয়দিনেই। তবে তার চোখে মুখে তীব্র অনিচ্ছা সবারই চোখে পড়ে। কিন্তু প্রতিটি কোপে জমির যেন আরো পক্ক হয়ে উঠছে সেটা সবাই খেয়াল করে। শুধু ছেলের অনিচ্ছার ব্যাপারটা আমলে নেয় না ফুরকান। একটা কাজ ভালোবাসতে অনেক সময় লাগে; সেটা এসে গেলেই আর চিন্তা নেই; এই নীতিতে বিশ্বাসী সে। ঈদের আগের রাতে দোকানে আজিজের গাঁজার আসরে জমির যখন একের পর এক সিদ্ধি টেনে যাচ্ছে তখনো সবাই তার চেহারায় কালুর ছাপ দেখেছে। সবাই এতে ভয়ের চেয়ে বেশি আনন্দ পেলেও সেটা মাটি হতে সবার অপেক্ষা করতে হয়নি। পরদিন ঈদের সকালে যা হলো তাতে বদলে যায় সবকিছু। হাতির মতো ফ্রিজিয়ান গরুটা মাটিতে ফেলতে মোটেই বেগ পায়না তারা। হুজুর এসে জবাই দেবার পর গরুটার গলা দিয়ে রক্তের স্রোত বয়ে যেতে থাকে প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে। হাতির মতো গরু মরলোও হাতির মতো ধীরে ধীরে। ততক্ষণে খাঁ সাহেবের বাড়ির আশেপাশে উৎসাহী মানুষ আর মাংসপ্রার্থীদের ভিড় জমেছে। পক্ক হাতে ফুরকান চামড়া ছিললো খুব দ্রুত আর খাঁ সাহেব ও তার পরিবার চেয়ার নিয়ে বসে ফুরকান আলীর কসাইযজ্ঞ দেখতে লাগলো। একে একে ফুরকান ও তার দল সিনা, বুক, ধড় আর চার পা আলাদা করলো। চাটাইয়ের ওপর সেগুলো জমতে শুরু করলে খাঁ সাহেব বেশ জোর গলায় বললো- গতবারের চেয়ে বেশি মাংস হইবো। ইস, কি সুন্দর মাংস। জ্বি খাঁ সাব, আপনার বাড়ির গরু কোনদিন খারাপ পড়ছে? সাদা টুপি আর পাঞ্জাবি পরা ফুরকান বললো হাসিমুখে। তোমার হাতে কাটা পায়ার নেহারী খাওয়ামু মেয়ের জামাইরে। জলদি ওইটায় আগে হাত দাও। এ কথা শুনে আজিজ নিজের ওস্তাদকে খুশি করতে আর খাঁ সাহেবের বকসিসের লোভে পা গুলোকে আলাদা এক চাটাইয়ে নিতে শুরু করলো। জমির তখন সিনার মাংস থেকে চর্বি ছাড়াচ্ছিলো ছোট ধাঁরালো ছুড়ি দিয়ে। আজ ঈদের দিন, কোথায় সে একটু মজ মাস্তি করবে তা না ,বাপ তার কসাই সাথে তাকেও এই বাড়িতে কামলা খাটাতে নিয়ে এসেছে। এদিকে মুবিন আর গ্যাং গেছে স্থানীয় যুব নেতার বাসায় । নেতা ভাই এমপি প্রার্থী; জয় প্রায় নিশ্চিত। জিতে গেলে এলাকায় বিশাল ক্ষমতার অধিকারী হবে। তার সাথে থাকলে সে ক্ষমতার ছিটে ফোটাও যদি জমিরের আয়ত্ত্বে আসে তাহলে ওর জীবনে আর কিছু লাগে? মানুষের কামলা খেটে সম্মান পাওয়া যায়না। সম্মান পেতে ক্ষমতা লাগে। ফুরকানের ডাকে ভ্রম ভাঙ্গে জমিরের। ফুরকান হাত উঁচিয়ে তাকে ডাকলে সে উঠে তার পাশে যায়। পায়া গুলি সাইজ কর, একদম যেমনে শিখাইসি ওমনি করবি। এক ফোঁটাও পায়ার রস যেন বাইর না হয় । জমির পাশে দাঁড়ানো আজিজের বিস্ফোরিত চেহারা দেখলো। আজিজ আমতা আমতা করে বলেঃ "ওস্তাদ, ওয় তো পারবো না। পরথম বার করতাসে। আমারে দেন, আমিই সাইজ কইরা ফালাই।" তার দিকে না তাকিয়ে ফুরকান বলেঃ "তুই সিনার টা সাইজ কর। পরথম বারেই তোর চেয়ে ভালা পারবো। " ওস্তাদের পালক ছেলের কাছে খাঁ বাড়ির পায়া কাটার এমন সুযোগ হারিয়ে আজিজ যেন শোকে পাথর হয়ে গেল। পায়াগুলোর পাশে বসে পড়লো জমির । পাশে রাখা রামদাটা তুলে নিলো রাগে। আজিজ তখনো তার পাশে দাঁড়ানো। ফুরকানের এক ধমকে ভয়ে এবং রাগে সে চলে গেল সিনার মাংসের চাটাইয়ের কাছে। রামদাটা হাতে নিয়ে দেখলো জমির। পাশ থেকে ফুরকান ধীর গলায় বললো- "বাপজান, দুনিয়াডা এমনই, সুযোগ এমনি এমনি আসেনা, নিয়া নিতে হয়। আমার ক্ষ্যামতা আছে তাই তোরে পরথমবার সুযোগ দিতে পারলাম। সবসময় এমন পাবিনা। বিসমিল্লা বইলা শুরু কর।" সেদিন জমির বিসমিল্লা বলে শুরু করেছিলো কিনা সেটা পাশে বসা ফুরকান আলীও জানেনা। তবে রামদাটা উঁচু করে প্রথম কোপ দিতেই তার চোখে পড়ে ভটভটি নিয়ে দাঁড়ানো মুবিন আর তার তিন বন্ধুকে। তাদের মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি দেখে জমিরের কোপ দেয়া হাড্ডিটা ভাগ হয়ে ছুটে যায় দুই দিকে। হাড়ের গুড়া ছড়িয়ে পড়ে জমির ও ফুরকান আলীসহ আশেপাশের সবার গায়ে। খাঁ সাহেব ও তার মেয়ের জামাইয়ের সাদা পাঞ্জাবিতে ছিটে আসে হাড়ের কাঁচা রস। আর সে হাড়ের বোন ম্যারোর দেখা কেউই পায়নি। সেটা আদৌ এই ধরণিতে আছে নাকি মহাশূণ্যে পাড়ি জমিয়েছে তাও কেউ জানে না। ছেলের আকস্মিক অগ্নিদ্গিরণের কারণ ফুরকানের কাছে বিস্ময়কর ঠেকে। ফুরকান থামানো আগেই দ্বিতীয়বার কোপ বসায় পল্টু। হাড্ডিটা এবার অনেকগুলো টুকরোয় ভাগ হয়ে যায় এবার। পরের দুই মিনিটে জমির যা ঘটায় তাতে খাঁ সাহেবের মেয়ের জামাইয়ের নেহারি খাবার আশা একেবারে শেষই হয়ে যায়। ফুরকান যখন তার ছেলের কলার ধরে তাকে চড় বসায় ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। ফুরকানকে একটা ধাক্কা দিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে যায় জমির। সেদিন খাঁ সাহেবের বকশিস লাভের আশায় আজিজ অনেকক্ষণ ধরে বোন ম্যারো খোঁজে। অনেকক্ষণের চেষ্টায় দুইটা আধাগলা বোনম্যারো খুজে পেয়ে খাঁ সাহেবকে দিলে বকশিসের বদলে উলটো চড় খায় সে। সেরাতে বাড়িও ফেরেনা জমির। তিনদিন পর যখন বাসায় ফেরে ততদিনে এলাকায় তার নামে নানা গুজব রটতে থাকে। করলাবাগ বাজারেই চাঁদাবাজির অভিযোগ আসে তার নামে। এলাকার নানা কুকর্মে জমিরের নাম জড়িত সে কথাটা চলতে থাকে এ বাড়ি থেকে বাড়ি।
এই তিনদিন জমির কোথায় ছিলো তা না জানলেও আজিজ বুঝতে পারে এ কয়দিনের পুরোটা সময় নেশায় বুদ ছিলো সে। "হাজার হোক কালুর ছাওয়াল, ওর রক্তে জুয়া আর নেশার জীবাণু কিলবিল করে; ফুরকানের রক্ত এমন হইবার পারেনা"-এসব কথা গাঁজার নেশায় বুদ হয়ে সবাইকে বলে আজিজ। বাড়ি ফিরে জমির ফুরকানের সাথে কোনো কথাই বলেনা। দরজাটা আটকে ঘরে শুয়ে থাকে সে। ফুরকানও শুয়ে থাকে। দুই ঘরে দুই ধরণের নীরবতা। জয়নবের মৃত্যুর পর এক ঘুমে চার পাঁচ বছর আসলেই কেটেছে কিনা সেটা নিয়ে মন খুঁতখুঁত করতে থাকে তার। এর পরের দুই বছর আসলেই ঘুমের ঘোরে কাটে ফুরকানের। ছেলের সাথে ফুরকানের দূরত্ব বাড়ে আলোকবর্ষের হিসাবে। সেই কুরাবনীর ঘটনার পর জমির আর কোনোদিন তার বাবার সাথে কথাও বলেনি ঠিকমতো। ছেলের চিন্তায় কাজের আয় উন্নতি কমতে থাকে তার। যাকে কিনে লগ্নী হিসেবে মেনে ব্যবসাটা তর তর করে বেড়েছিলো একই গতিতে যেন সেটা নামতে থাকে। এর মধ্যে শরীয়তপুর থেকে আসা এক নতুন কসাই ইলিয়াস এলাকায় প্রভাব জমায়। কমতির দিকে থাকা ব্যবসার কারণে দুইজনকে ছাটাই করতে হয় ফুরকানকে। সবকিছু আয়ত্ত্বের বাইরে যেতে থাকলে ফুরকানের একবার মনে হয় দোকানটা বিক্রি করে বরগুনায় চলে যায়। চাচাতো ভাইয়ের কাছ থেকে বাপের ভিটিটা উদ্ধার করে একটা ঘর তুলে আরামে থাকা যাবে। ছেলেটাও হাতছাড়া হবে না। সেটা করতে পারলে বেশ ভালো হতো। ভাগাড়ের ময়লার ঢিবির পাশে রক্তের স্রোতের ওপর শুয়েও আজ একই কথা মাথায় আসছে তার। পাঁচদিন ধরে জমির নিখোজ থাকাকালীন পুলিশ থেকে খাঁ সাহেব কারো কাছেই ধরনা দিতে বাদ রাখেনি সে। আজ সন্ধ্যায় যখন অজ্ঞাত একটা নাম্বার থেকে যখন ফোন আসে তখন সে জানতে পারে জমির কিডন্যাপ হয়েছে। সিন্দুকে জমানো টাকা আর খাঁ সাহেবের কাছে ধার এনে দুই লাখ কোনোমতে জোগাড় করে সে। কিডন্যাপারদের কথামতো ভোরের আগে উত্তর করলবাগের ময়লার ভাগাড়ে আসে সে একা। আজিজ আসতে চেয়েছিলো; কিন্তু তাকে বাড়িতে রেখে এখানে এসে পড়ে সে। যাবার আগে আজিজ বলেছিলো-"উরা ভালো মানুষ না ওস্তাদ। ট্যাকা নিয়াও পোলা ফেরত নাও দিবার পারে। পালক পুলার জইন্নো এতে ট্যাকা দিবেন ক্যান। কয়দিন পর এমনেই ফেরত দিবো।" ফুরকান আলী গম্ভীর কন্ঠে বলেছিলো- "বিশ হাজার দিয়া এই পুলা খরিদ করছিলাম; ওর দাম এখন দুই লাখ উঠছে। এই পোলা আমার ভবিষ্যতের ইনভেস্টমেন্ট। না দিয়া যাইবো কই।" টাকার পুটলিটা শক্ত করে ধরে রাতের রাস্তা দিয়ে হেটে চলে যায় ফুরকান আলী। আজিজ বুঝতে পারে রক্তের না হলেও টাকা দিয়ে সন্তানের ওপর অধিকার রাখতে শেষ চেষ্টা ফুরকান করবেই।
ভাগাড়ের একমাত্র ল্যাম্পপোস্টের নিচে টাকার পুটলিটা রেখে দেয় ফুরকান। এখন অপেক্ষার পালা। প্রায় বিশ মিনিট পায়চারি করতে করতে তার মাথায় জগতের অনেক কথাই আকুপাকু করতে থাকে। সেটায় ক্ষান্ত দেয় সে ফোনের শব্দে। পরিচিত একটা কন্ঠ তাকে পুটুলি থেকে সামনের ঢিবির সামনে আসতে বলে। সেখানেই জমিরকে পাওয়া যাবে এটুকু বলেই ফোনটা কেটে দেয় সে। ফুরকান কন্ঠটা বোঝার আগেই কেটে গেল। মাথায় কন্ঠটা গেঁথে নিতে নিতে হাটতে থাকে সে। ওইতো ঢিবিটা! বেশ অন্ধকার। ছেলেটাকে কি ওখানে ফেলে রেখেছে ওরা? একটু দ্রুত পা চালায় সে। ঢিবিটার সামনে আসতেই ঘাড়ে আচমকা একটা কোপ পড়ে তার। চিনচিনে ব্যথা সারা শরীরের স্নায়ুগুলোতে তৎপরতা চালায় খুব দ্রুত। ঘাড়ের ক্ষতে হাত চলে যায় সাথে সাথেই। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ফুরকান। কলের পানির মতো বেগে রক্ত বের হতে থাকে। গোটা বিশেক সেকেন্ড ব্রয়লার মুরগির মতো তড়পিয়ে ফুরকান যখন ভাগ্য মেনে নিয়ে স্থির হয়ে আকাশের দিকে তাকায় তখন কোপটার কথা মাথায় খেলে যায় তার। খুব মনযোগী এবং ঠান্ডা মাথার কোপ । একদম পাঁকা হাতের কোপ। মনে হয় যেন বছরের পর বছর কোপ মারার অভ্যাসের হাত। এই মানুষটা হয় একজন জাত খুনি না হয় জাত কসাই। কসাই ফুরকানের মৃত্যু যন্ত্রণা ছাপিয়ে সেই কোপের প্রশংসা মস্তিস্কে ঘুরতে থাকে। গরম রক্তের ওম শরীরকে প্রায় অবশ করে ফেললে ফুরকানের চোখ প্রায় বন্ধ হয়ে আসে। ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে আসে তার পৃথিবী। সুবহে সাদিকের হালকা আলোয় তার চিত হয়ে শুয়ে থাকা ফুরকানের শরীরের সামনে এসে দাঁড়ায় জমির। মলীন হাসি ফুটে ওঠে তার মুখে। ফুরকান ছেলেকে দেখে প্রশান্তির এক নিঃশ্বাস নেয়। খোঁচা খোঁচা দাড়িতে পল্টুকে প্রায় চেনাই যাচ্ছেনা। চোখ খোলা রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে সে। ছেলেটাকে ভালো করে দেখে নিতে ইচ্ছা করছে। একটা হ্যাংলা ছেলে এসে জমিরের হাতে টাকার পুটুলিটা দেয়। জমিরের হাতে থাকা রামদাটা এই প্রথম চোখে পড়ে ফুরকানের। সেখান থেকে চুয়ে চুয়ে রক্ত পড়ছে। হ্যাংলা ছেলেটা ভয়ার্ত কন্ঠে প্রিন্স বলে ডাক দিলেও জমির অপলক তাকিয়ে থাকে তার পালক বাবার দিকে। টাকার পুটলিটা ছেলেটার হাতে দেয় সে। বিমূর্ত এই দুনিয়া ছেড়ে যাবার আনন্দে অথবা ছেলের ঠান্ডা মাথায় মারা অব্যর্থ কোপের খুশিতে ফুরকানের ডান চোখ বেয়ে একফোটা পানি পড়ে। চোখ বন্ধ হবার আগে ফুরকান ছেলেকে দ্বিতীয় কোপ নেবার প্রস্তুতি নিতে দেখে। এই কোপটা তার মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য না; ঘৃণার।