Posts

গল্প

অপরুপ দুঃস্বপ্ন

June 11, 2024

Aqibur Rahman

Original Author আকিবুর রহমান


অপরূপ দুঃস্বপ্ন
আকিবুর রহমান

১.
“আস্ সলাতু খইরুম মিনান নাওম”!
নামাজের আহŸানে বিছানার ওপর লাফিয়ে ওঠে লাবিব। তখনও চারিদিকে স্পষ্ট অন্ধকার। কিন্তু তবুও লাবিবকে বেশ উদ্বীগ্ন মনে হচ্ছে। আজ রাতে তার পড়তে বসার রুাটিন ছিল। গভীর ঘুমে সেটা আর হলো না। আজ তার শেষ পরীক্ষা। 
পড়তে না পারার অনুশোচনা নিয়ে বিছানা ছাড়ে লাবিব। নামাজের প্রস্তুতি নেয়। অজু সেড়ে নিয়ে বাবার সাথে নামাজে যায়। পাখিদের সকাল বেলার গান তার মুখস্থ। ভোরের বিভায় আলিঙ্গন তার স্বভাবসুলব ব্যাপার।
ফজরের নামাজ শেষ। আলোর প্রথম রঙ তখন আক্কার মিনার ছুয়েছে। লাবিবের পরীক্ষার কথা তার বাবা জানে। তাই অন্যান্য দিনের মতো মসজিদে আর বিলম্ব করা হয়না তাদের। দুজনেই মসজিদ থেকে বেড়িয়ে আসে। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য দেখা যাচ্ছে তখন—বাবা ছেলে একসাথে হাত ধরে মসজিদ থেকে ফিরছে। নীরবতা ভাঙে লাবিবের বাবা...
‘লাবিব, আজ তো তোমার পরীক্ষা শেষ’ (?)
‘নিশ্চয়ই’
‘কেমন লাগছে?’
‘বাবা আমার জীবনটা যেন এই পরীক্ষা কারণে থমকে ছিল। মাঝে মাঝে দমবন্ধ লাগত। আজ অবশেষে সমাপ্তি, মুক্তি।’ লাবিবের উত্তরে তার বাবা মুচকি হাসে। ভাবনাচ্ছন্ন হাসি।
‘শোনো লাবিব, আমাদের জীবনটা এই সকাল আর সন্ধ্যার মতোই সংকীর্ণ। আর তুমি তোমার জীবনের যে সময়টা পার করছ তা এই সকালের মতোই অপরূপ, প্রাণবন্ত। তবে একটা কথা মনে রাখবে লাবিব, আমরা কেবল আমাদের জীবনের সকালবেলাটাকেই নির্ণয় করতে পারি; বাকি দুপুর, বিকেল, রাত সবই অনির্ণেয়। যেকোনো সময় বেলা ফুরিয়ে যাবে।’
কথাগুলো খুব ভারি। আর বাবার কাছ থেকে এ কথাগুলো লাবিবের অপরিচিত। সব সময় তার বাবা তার কাছ থেকে তার বন্ধু-বান্ধব, ফুটবল ম্যাচ, স্কুলের সারাদিন আর নানান রকম গল্প নিয়ে আলাপ করে। কিন্তু আজকের কথাগুলো লাবিব তার হৃদয়ের চোখ দিয়ে অনুধাবন করছে। সে খেয়াল করল; জীবনের একটা পর্ব সে অতিক্রম করে ফেলেছে। সামনে তার নতুন জীবন। বাবার কথাগুলো আয়নার কাজ করছে। সে নিজেকে দেখতে পাচ্ছে যেন।
মানুষ কখনোই তার নিজেকে অনুভব করার জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। সে একা একা নিজেকে অনুভব কিংবা নির্ণয় করতে পারে না। মানুষ সবসময়ই অন্যের ওপর নির্ভরশীল। নিজেকে চেনার ক্ষেত্রেও। মানুষ জীবনে প্রথমবার নিজেকে চেনে তার বাবা-মা অথবা অভিভাবকের চোখে। আজ লাবিবও নিজেকে চিনতে শুরু করল।বাসার কাছাকাছি চলে এসেছে তারা। এতক্ষন লাবিব ভাবনায় মগ্ন ছিল। মোড়ের নীল বিল্ডিংটা পার হতেই এতক্ষণের জীবনবোধকে উপেক্ষা করে দোতলার জানালায় তাকায়। দুইটা চোখ তাকিয়ে আছে। সকালের সমস্ত ¯িœগ্ধতা যেন লিপ্টে আছে সেই চেহারায়। মলিন ঠোঁটে খুব সামান্য সময়ের দৃশ্যালাপ হয় তাদের।
ইস্পা। লাবিবের হৃদয়ে এই মেয়েটার জন্য আলাদা একটা জায়গা তোলা আছে। খুব সাধারণ মেয়ে ইস্পা। গোল-গাল ভরাট চেহারা। চোখ দুটো তুলনামূলক বড় বড়। তবে তার চোখের প্রশস্ততা তার হাঁসিকে আরও সৌন্দর্যমন্ডিত করে। লাবিবের সকল চাঞ্চল্য মেয়েটা উপভোগ করে। তাদের ঘনিষ্ঠতা কেবলমাত্র ক্লাসরুম, খেলার মাঠ অথবা কখনো কখনো বাড়ির ছাদে আর রোজ সকালে জানালায় তাদের ক্ষণিকার দৃশ্যালাপ—এটুকুই অন্তরঙ্গতা। 
কলিং বেল স্পর্শেও আগেই মা দরজা খোলে। 
‘লাবিব, তোমার পরীক্ষা দুইদিন পিছিয়ে দেয়া হয়েছে।’
‘তাই নাকি! কীভাবে জানলে?’
‘স্কুল থেকে ফোন এসেছিল। পরীক্ষা ব্যাবস্থাপনায় কি একটা সমস্যা হয়েছে বলল।’
লাবিব যেন একটু হাফ ছাড়ল। কেননা আজকে তার প্রস্তুতি তুলনামূলক কমই হয়েছে। আনন্দিত সে। তবে পরীক্ষা পেছানোর মানেই হলো পরীক্ষার চাপটুকু আরও কিছুদিন জিয়িয়ে থাকা। বাসায় ঢুকতে ঢুকতে তার চেহারায় এসব চিন্তার ছাপ দেখা গেল। মায়ের চোখে সেটা আড়াল হলো না। মা বলল,
‘যা হওয়ার হয়েছে, এখন আসো নাস্তা সেড়ে নাও। তোমাদেও জন্য বাদামের ক্ষীর আর তেতুল জুস করেছি।’
‘বাদামের ক্ষীর’! আনন্দে লাবিব উল্লসিত হয়ে ওঠে। 
‘মা তুমি আবার তোমার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমান করলে। কুদসের মাটির মতোই তুমি অনন্যা।’ ছেলের ভালোবাসায় পুলকিত হয়ে ওঠে মা।
চটপট খাবার টেবিলে বসে লাবিব। লাবিবের ছেলে মানুষি দেখে বাবা-মা একে অপরকে একবার তাকায়। তারপর একই ছন্দে দুজনে হাঁসেন। ছেলে তখন বাদামের ক্ষীরে মত্ত। তারপর একসাথে খেতে বসে সবাই। লাবিবের বাবা বলে...
‘এই শুক্রবার আমরা আকসায় (মসজিদুল আকসা) যাব।’
লাবিবের চোখমুখ জ¦লজ¦ল করে ওঠে।
‘সত্যিই আমরা আকসা যাচ্ছি?’
‘আকসার দিব্যি, আমরা যাচ্ছি ইনশাল্লাহ।’
‘সুবহানাল্লাহ বাবা। আল্লাহ তোমাকে আরও সামর্থ্যবান করুন। আমি মনে মনে খুব করে চাচ্ছিলাম পরীক্ষার পর একবার আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করতে যাব। তিনি যেন আমার পরীক্ষার ব্যাপারটা ভালোভাবে সুরাহা করেন। তোমাকে আবারও ধন্যবাদ বাবা।’ ছেলের পরীক্ষাভীতি দেখে বাবা-মা আবারও হাঁসতে থাকে।
খাওয়া শেষ। পরীক্ষা পিছিয়ে দেয়া হয়েছে। পড়তে বসার তাড়া নেই। তাই খাওয়া শেষে সে ছাদে যায়। ছাদে যাওয়ার দুইটি কারণ। প্রথমত ইস্পার সাথে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর দ্বিতীয়ত এবং প্রধান কারণ হলো, ছাদের ওপর থেকে গোটা আক্কা শহর তার কাছে জর্ডান নদীর চেয়েও সুন্দর লাগে। উচু নীচু দৃশ্যমান দানব নানা রঙে মাখা। কি নিদারূণ দৃশ্য! প্রাণের শহর আক্কা। প্রভাত আলোয় শহরটাকে অন্যরকম লাগে। ঠিক নতুন কিনে আনা ঘুড়ির মতোই।তারপর স্বস্তি নিয়ে বিছানায় যায় লাবিব। আজ বিকেলে একটা ফুটবল টুর্নামেন্ট করাই যায়। ফুটবল নিয়ে লাবিবের স্বপ্ন বেশ দীর্ঘ। পুরো আক্কা শহর তার খেলার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে থাকে। বিছানায় শুয়ে ভাবতে থাকে সে—আজ ডিফেন্সে খেলবে সে, যতক্ষণ না ইস্পা মাঠে খেলা দেখতে আসছে। ইস্পা আসলেই উপরে উঠে খেলবে। তার সামনে বহুবার নিজ যোগ্যতা প্রমান করেছে লাবিব। তবু ক্ষান্তি নেই তার। তার উল্লাসে সে ইস্পাকে জড়িয়ে নিতে চায়। হঠাৎ আবার মনে হলো—তারা এই শুক্রবার আকসায় যাচ্ছে। মা’আজ আঙ্কেলকে তাদের সাথে দাওয়াত করা গেলে ইস্পার অনুষঙ্গ পাওয়া যেত। বাবাকে বলতে হবে।
এসব ভাবতে ভাবতে একটা সময় হাওয়াটা ভারী হয়ে আসে। সকালে মসজিদ থেকে ফেরার পথে বাবার কথাগুলো মনে পরে লাবিবের। সত্যিই জীবনের একটা অধ্যায় পার হয়ে এসেছে সে। এ বছর হাই স্কুলের পর্ব শেষ। তারপর সে কলেজে যাবে। নতুন মানুষ, নতুন জায়গা, নতুন জ্ঞান, নতুন এক জীবন। তার মায়ের ইচ্ছা সে আযহার বিশ^বিদ্যালয়ে পড়বে। ক্লাসে জাবের স্যারের কাছেও সে আযহারের কথা শুনেছে। তাই তারও স্বপ্ন—সে আযহারে যাবে একদিন। জগতের সবচেয়ে বড় ইসলামী জ্ঞানের প্রাণকেন্দ্র। সেই থেকে তার পড়াশোনার মনযোগ বেড়েছে। 
সামনে তার দীর্ঘ জীবন। অনেক বড় যে স্বপ্নের পথচলা তার—তা শুরু হতে যাচ্ছে খুব শীঘ্রয়র্ই। তাকে অনেক অধ্যাবশয় করতে হবে। উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে মন। চোখ বন্ধ করে লাবিব। পত্রিকায় দেখা আল আযহার, মা-বাবা আর ইস্পার মুখ ভেসে ওঠে। তারপর একটা দীর্ঘশ^াস মিলিয়ে যায় তার রুমে।
হঠাৎ তার বিছানা কেঁপে ওঠে। বিকট আওয়াজ শুনতে পায় সে। মানুষের আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে!২.
ঘুম ভাঙে লাবিবের। কোথায় সে! আশে-পাশে সব আহত মানুষের কান্না। জ্ঞান হারাবার অবস্থা। কিছুই বুঝে উঠতে পারে না সে। এখানে সে কি করে এলো? জানালা দিয়ে বাইরে তাকায় সে। আগুন আর ধোয়া ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তার প্রিয় আক্কা, প্রাণের শহর!
এমন সময় সে দেখতে পায় তার বাবা তার দিকে ছুটে আসছে। বাবার মাথায় 


অপরূপ দুঃস্বপ্ন
আকিবুর রহমান

১.
“আস্ সলাতু খইরুম মিনান নাওম”!
নামাজের আহ্বানে বিছানার ওপর লাফিয়ে ওঠে লাবিব। তখনও চারিদিকে স্পষ্ট অন্ধকার। কিন্তু তবুও লাবিবকে বেশ উদ্বীগ্ন মনে হচ্ছে। আজ রাতে তার পড়তে বসার রুাটিন ছিল। গভীর ঘুমে সেটা আর হলো না। আজ তার শেষ পরীক্ষা। 
পড়তে না পারার অনুশোচনা নিয়ে বিছানা ছাড়ে লাবিব। নামাজের প্রস্তুতি নেয়। অজু সেড়ে নিয়ে বাবার সাথে নামাজে যায়। পাখিদের সকাল বেলার গান তার মুখস্থ। ভোরের বিভায় আলিঙ্গন তার স্বভাবসুলব ব্যাপার।
ফজরের নামাজ শেষ। আলোর প্রথম রঙ তখন আক্কার মিনার ছুয়েছে। লাবিবের পরীক্ষার কথা তার বাবা জানে। তাই অন্যান্য দিনের মতো মসজিদে আর বিলম্ব করা হয়না তাদের। দুজনেই মসজিদ থেকে বেড়িয়ে আসে। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য দেখা যাচ্ছে তখন—বাবা ছেলে একসাথে হাত ধরে মসজিদ থেকে ফিরছে। নীরবতা ভাঙে লাবিবের বাবা...
‘লাবিব, আজ তো তোমার পরীক্ষা শেষ’ (?)
‘নিশ্চয়ই’
‘কেমন লাগছে?’
‘বাবা আমার জীবনটা যেন এই পরীক্ষা কারণে থমকে ছিল। মাঝে মাঝে দমবন্ধ লাগত। আজ অবশেষে সমাপ্তি, মুক্তি।’ লাবিবের উত্তরে তার বাবা মুচকি হাসে। ভাবনাচ্ছন্ন হাসি।
‘শোনো লাবিব, আমাদের জীবনটা এই সকাল আর সন্ধ্যার মতোই সংকীর্ণ। আর তুমি তোমার জীবনের যে সময়টা পার করছ তা এই সকালের মতোই অপরূপ, প্রাণবন্ত। তবে একটা কথা মনে রাখবে লাবিব, আমরা কেবল আমাদের জীবনের সকালবেলাটাকেই নির্ণয় করতে পারি; বাকি দুপুর, বিকেল, রাত সবই অনির্ণেয়। যেকোনো সময় বেলা ফুরিয়ে যাবে।’
কথাগুলো খুব ভারি। আর বাবার কাছ থেকে এ কথাগুলো লাবিবের অপরিচিত। সব সময় তার বাবা তার কাছ থেকে তার বন্ধু-বান্ধব, ফুটবল ম্যাচ, স্কুলের সারাদিন আর নানান রকম গল্প নিয়ে আলাপ করে। কিন্তু আজকের কথাগুলো লাবিব তার হৃদয়ের চোখ দিয়ে অনুধাবন করছে। সে খেয়াল করল; জীবনের একটা পর্ব সে অতিক্রম করে ফেলেছে। সামনে তার নতুন জীবন। বাবার কথাগুলো আয়নার কাজ করছে। সে নিজেকে দেখতে পাচ্ছে যেন।
মানুষ কখনোই তার নিজেকে অনুভব করার জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। সে একা একা নিজেকে অনুভব কিংবা নির্ণয় করতে পারে না। মানুষ সবসময়ই অন্যের ওপর নির্ভরশীল। নিজেকে চেনার ক্ষেত্রেও। মানুষ জীবনে প্রথমবার নিজেকে চেনে তার বাবা-মা অথবা অভিভাবকের চোখে। আজ লাবিবও নিজেকে চিনতে শুরু করল।বাসার কাছাকাছি চলে এসেছে তারা। এতক্ষন লাবিব ভাবনায় মগ্ন ছিল। মোড়ের নীল বিল্ডিংটা পার হতেই এতক্ষণের জীবনবোধকে উপেক্ষা করে দোতলার জানালায় তাকায়। দুইটা চোখ তাকিয়ে আছে। সকালের সমস্ত মুগ্ধতা যেন লিপ্টে আছে সেই চেহারায়। মলিন ঠোঁটে খুব সামান্য সময়ের দৃশ্যালাপ হয় তাদের।
ইস্পা। লাবিবের হৃদয়ে এই মেয়েটার জন্য আলাদা একটা জায়গা তোলা আছে। খুব সাধারণ মেয়ে ইস্পা। গোল-গাল ভরাট চেহারা। চোখ দুটো তুলনামূলক বড় বড়। তবে তার চোখের প্রশস্ততা তার হাঁসিকে আরও সৌন্দর্যমন্ডিত করে। লাবিবের সকল চাঞ্চল্য মেয়েটা উপভোগ করে। তাদের ঘনিষ্ঠতা কেবলমাত্র ক্লাসরুম, খেলার মাঠ অথবা কখনো কখনো বাড়ির ছাদে আর রোজ সকালে জানালায় তাদের ক্ষণিকার দৃশ্যালাপ—এটুকুই অন্তরঙ্গতা। 
কলিং বেল স্পর্শেও আগেই মা দরজা খোলে। 
‘লাবিব, তোমার পরীক্ষা দুইদিন পিছিয়ে দেয়া হয়েছে।’
‘তাই নাকি! কীভাবে জানলে?’
‘স্কুল থেকে ফোন এসেছিল। পরীক্ষা ব্যাবস্থাপনায় কি একটা সমস্যা হয়েছে বলল।’
লাবিব যেন একটু হাফ ছাড়ল। কেননা আজকে তার প্রস্তুতি তুলনামূলক কমই হয়েছে। আনন্দিত সে। তবে পরীক্ষা পেছানোর মানেই হলো পরীক্ষার চাপটুকু আরও কিছুদিন জিয়িয়ে থাকা। বাসায় ঢুকতে ঢুকতে তার চেহারায় এসব চিন্তার ছাপ দেখা গেল। মায়ের চোখে সেটা আড়াল হলো না। মা বলল,
‘যা হওয়ার হয়েছে, এখন আসো নাস্তা সেড়ে নাও। তোমাদেও জন্য বাদামের ক্ষীর আর তেতুল জুস করেছি।’
‘বাদামের ক্ষীর’! আনন্দে লাবিব উল্লসিত হয়ে ওঠে। 
‘মা তুমি আবার তোমার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমান করলে। কুদসের মাটির মতোই তুমি অনন্যা।’ ছেলের ভালোবাসায় পুলকিত হয়ে ওঠে মা।
চটপট খাবার টেবিলে বসে লাবিব। লাবিবের ছেলে মানুষি দেখে বাবা-মা একে অপরকে একবার তাকায়। তারপর একই ছন্দে দুজনে হাঁসেন। ছেলে তখন বাদামের ক্ষীরে মত্ত। তারপর একসাথে খেতে বসে সবাই। লাবিবের বাবা বলে...
‘এই শুক্রবার আমরা আকসায় (মসজিদুল আকসা) যাব।’
লাবিবের চোখমুখ জ¦লজ¦ল করে ওঠে।
‘সত্যিই আমরা আকসা যাচ্ছি?’
‘আকসার দিব্যি, আমরা যাচ্ছি ইনশাল্লাহ।’
‘সুবহানাল্লাহ বাবা। আল্লাহ তোমাকে আরও সামর্থ্যবান করুন। আমি মনে মনে খুব করে চাচ্ছিলাম পরীক্ষার পর একবার আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করতে যাব। তিনি যেন আমার পরীক্ষার ব্যাপারটা ভালোভাবে সুরাহা করেন। তোমাকে আবারও ধন্যবাদ বাবা।’ ছেলের পরীক্ষাভীতি দেখে বাবা-মা আবারও হাঁসতে থাকে।
খাওয়া শেষ। পরীক্ষা পিছিয়ে দেয়া হয়েছে। পড়তে বসার তাড়া নেই। তাই খাওয়া শেষে সে ছাদে যায়। ছাদে যাওয়ার দুইটি কারণ। প্রথমত ইস্পার সাথে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আর দ্বিতীয়ত এবং প্রধান কারণ হলো, ছাদের ওপর থেকে গোটা আক্কা শহর তার কাছে জর্ডান নদীর চেয়েও সুন্দর লাগে। উচু নীচু দৃশ্যমান দানব নানা রঙে মাখা। কি নিদারূণ দৃশ্য! প্রাণের শহর আক্কা। প্রভাত আলোয় শহরটাকে অন্যরকম লাগে। ঠিক নতুন কিনে আনা ঘুড়ির মতোই।তারপর স্বস্তি নিয়ে বিছানায় যায় লাবিব। আজ বিকেলে একটা ফুটবল টুর্নামেন্ট করাই যায়। ফুটবল নিয়ে লাবিবের স্বপ্ন বেশ দীর্ঘ। পুরো আক্কা শহর তার খেলার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে থাকে। বিছানায় শুয়ে ভাবতে থাকে সে—আজ ডিফেন্সে খেলবে সে, যতক্ষণ না ইস্পা মাঠে খেলা দেখতে আসছে। ইস্পা আসলেই উপরে উঠে খেলবে। তার সামনে বহুবার নিজ যোগ্যতা প্রমান করেছে লাবিব। তবু ক্ষান্তি নেই তার। তার উল্লাসে সে ইস্পাকে জড়িয়ে নিতে চায়। হঠাৎ আবার মনে হলো—তারা এই শুক্রবার আকসায় যাচ্ছে। মা’আজ আঙ্কেলকে তাদের সাথে দাওয়াত করা গেলে ইস্পার অনুষঙ্গ পাওয়া যেত। বাবাকে বলতে হবে।
এসব ভাবতে ভাবতে একটা সময় হাওয়াটা ভারী হয়ে আসে। সকালে মসজিদ থেকে ফেরার পথে বাবার কথাগুলো মনে পরে লাবিবের। সত্যিই জীবনের একটা অধ্যায় পার হয়ে এসেছে সে। এ বছর হাই স্কুলের পর্ব শেষ। তারপর সে কলেজে যাবে। নতুন মানুষ, নতুন জায়গা, নতুন জ্ঞান, নতুন এক জীবন। তার মায়ের ইচ্ছা সে আযহার বিশ^বিদ্যালয়ে পড়বে। ক্লাসে জাবের স্যারের কাছেও সে আযহারের কথা শুনেছে। তাই তারও স্বপ্ন—সে আযহারে যাবে একদিন। জগতের সবচেয়ে বড় ইসলামী জ্ঞানের প্রাণকেন্দ্র। সেই থেকে তার পড়াশোনার মনযোগ বেড়েছে। 
সামনে তার দীর্ঘ জীবন। অনেক বড় যে স্বপ্নের পথচলা তার—তা শুরু হতে যাচ্ছে খুব শীঘ্রয়র্ই। তাকে অনেক অধ্যাবশয় করতে হবে। উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে মন। চোখ বন্ধ করে লাবিব। পত্রিকায় দেখা আল আযহার, মা-বাবা আর ইস্পার মুখ ভেসে ওঠে। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস মিলিয়ে যায় তার রুমে।
হঠাৎ তার বিছানা কেঁপে ওঠে। বিকট আওয়াজ শুনতে পায় সে। মানুষের আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে!

২.
ঘুম ভাঙে লাবিবের। কোথায় সে! আশে-পাশে সব আহত মানুষের কান্না। জ্ঞান হারাবার অবস্থা। কিছুই বুঝে উঠতে পারে না সে। এখানে সে কি করে এলো? জানালা দিয়ে বাইরে তাকায় সে। আগুন আর ধোয়া ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তার প্রিয় আক্কা, প্রাণের শহর!
এমন সময় সে দেখতে পায় তার বাবা তার দিকে ছুটে আসছে। বাবার মাথায় ব্যাণ্ডেজ আর গায়ে মুখে রক্ত। চোখ দুটো অস্বাভাবিক রকম ফুলে উঠেছে। বাবাকে বড্ড অচেনা লাগছে তার।
‘লাবিব, বাবা আমার। তোমার এখন কেমন লাগছে? ডাক্তার তোমাকে ঘুমের ঔষধ দিয়েছিল। তুমি ঘুমাচ্ছিলে।’
আসতে আসতে লাবিবের সব মনে পরে। এতক্ষন সে স্বপ্নে বিভোর ছিল। তাই তো! সে তো প্রায় গত দুইবছর স্কুলে যায় না। খেলার মাঠ, স্কুল, ইস্পা সেসব সে ছেড়ে এসেছে আজ বহুদিন। 
পাশের বেডে একটা শিশু মা...মা... বলে কাঁদছে। লাবিবেরও মায়ের কথা মনে হয়। তার মা কোথায়? লাবিব স্মৃতি ফিরে পায়। তার মা-তো তাদের বিল্ডিংয়ের সাথে ধুলো-বালি আর ইটের নীচে চাপা পড়ে প্রাণ হারিয়েছে। মায়ের লাশই নিয়ে যাচ্ছিল সে। পথেই তাদের পাশে একটা গ্রেনেড বিদ্ধস্ত হয়। তারপর তার আর কিছুই মনে নেই। লাবিবের হৃদয়টা হু হু করে ওঠে।
তার এক চোখসহ প্রায় গোটা শরীরেই ব্যাÐেজ করা। সে মৃদু স্বরে মা বলে ডাকে। জানে কেউ নেই। তবু তার হৃদয় মা বলে কাঁদে। ছেলের মুখে মৃত মায়ের ডাক শুনে কান্নায় ভেঙে পড়ে বাবা। মূহুর্তেই লাবিবের গোটা নিপীড়নের জীবন ভেসে ওঠে স্পষ্টভাবে। কী ভীষণ অত্যাচার সে সহ্য করে আসছে এতকাল। অথচ এতক্ষন কী গোছানো একটা জীবনের স্বপ্ন দেখছিল সে। কি অপরাধ তার? কেন এমন একটা নৃশংস জীবন যাপিত হচ্ছে তার?
নিজেকে সে শক্ত করার চেষ্টা করে। জীবন এখনও তার শেষ হয়নি। সে এখনো জীবিত। সময় একদিন বদলাবে। আবার স্কুলে যাবে সে। ফুটবল খেলবে। আর নিশ্চয়ই সে একদিন আযহারে যাবে। মায়ের স্বপ্ন সে পূরণ করবে।
এসব ভেবে নিজেকে সামলে নেয় লাবিব। তার বাবা তার বুকের ওপর মাথা রেখে কাঁদছে। সে তার বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে শান্তনা দিতে চায়। 
কিন্তু একি! তার হাতটা কোথায়? ভালো করে সে এবার নিজেকে খেয়াল করল। তার বাম হাতটা ঝোলানো। পা নাড়াতে পারছে না। মনে হচ্ছে পা-টাও নেই। করুন সুরে সে বাবাকে জিজ্ঞেস করে...
বাবা, আমার হাতটা কোথায়? আমি পা নাড়াতে পারছি না কেন?
 আর গায়ে মুখে রক্ত। চোখ দুটো অস্বাভাবিক রকম ফুলে উঠেছে। বাবাকে বড্ড অচেনা লাগছে তার।
‘লাবিব, বাবা আমার। তোমার এখন কেমন লাগছে? ডাক্তার তোমাকে ঘুমের ঔষধ দিয়েছিল। তুমি ঘুমাচ্ছিলে।’
আসতে আসতে লাবিবের সব মনে পরে। এতক্ষন সে স্বপ্নে বিভোর ছিল। তাই তো! সে তো প্রায় গত দুইবছর স্কুলে যায় না। খেলার মাঠ, স্কুল, ইস্পা সেসব সে ছেড়ে এসেছে আজ বহুদিন। 
পাশের বেডে একটা শিশু মা...মা... বলে কাঁদছে। লাবিবেরও মায়ের কথা মনে হয়। তার মা কোথায়? লাবিব স্মৃতি ফিরে পায়। তার মা-তো তাদের বিল্ডিংয়ের সাথে ধুলো-বালি আর ইটের নীচে চাপা পড়ে প্রাণ হারিয়েছে। মায়ের লাশই নিয়ে যাচ্ছিল সে। পথেই তাদের পাশে একটা গ্রেনেড বিদ্ধস্ত হয়। তারপর তার আর কিছুই মনে নেই। লাবিবের হৃদয়টা হু হু করে ওঠে।
তার এক চোখসহ প্রায় গোটা শরীরেই ব্যাণ্ডেজ করা। সে মৃদু স্বরে মা বলে ডাকে। জানে কেউ নেই। তবু তার হৃদয় মা বলে কাঁদে। ছেলের মুখে মৃত মায়ের ডাক শুনে কান্নায় ভেঙে পড়ে বাবা। মূহুর্তেই লাবিবের গোটা নিপীড়নের জীবন ভেসে ওঠে স্পষ্টভাবে। কী ভীষণ অত্যাচার সে সহ্য করে আসছে এতকাল। অথচ এতক্ষন কী গোছানো একটা জীবনের স্বপ্ন দেখছিল সে। কি অপরাধ তার? কেন এমন একটা নৃশংস জীবন যাপিত হচ্ছে তার?
নিজেকে সে শক্ত করার চেষ্টা করে। জীবন এখনও তার শেষ হয়নি। সে এখনো জীবিত। সময় একদিন বদলাবে। আবার স্কুলে যাবে সে। ফুটবল খেলবে। আর নিশ্চয়ই সে একদিন আযহারে যাবে। মায়ের স্বপ্ন সে পূরণ করবে।
এসব ভেবে নিজেকে সামলে নেয় লাবিব। তার বাবা তার বুকের ওপর মাথা রেখে কাঁদছে। সে তার বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে শান্তনা দিতে চায়। 
কিন্তু একি! তার হাতটা কোথায়? ভালো করে সে এবার নিজেকে খেয়াল করল। তার বাম হাতটা ঝোলানো। পা নাড়াতে পারছে না। মনে হচ্ছে পা-টাও নেই। করুন সুরে সে বাবাকে জিজ্ঞেস করে...
বাবা, আমার হাতটা কোথায়? আমি পা নাড়াতে পারছি না কেন?
 

Comments

    Please login to post comment. Login