পোস্টস

গল্প

আমার জীবনে দোলনচাঁপা

১৩ জুন ২০২৪

মাহবুব মোর্শেদ

মূল লেখক মাহবুব মোর্শেদ

গত সাত বছর ধরে আমি মিরপুরে থাকি। আর এই সাত বছর ধরে আমার অফিস কারওয়ান বাজারে। অফিস শেষ হলে আমি কারওয়ান বাজার মোড় থেকেই বাসে উঠি সাধারণত। তবে অন্যদের মতো বাসে ওঠার তাড়া আমার কখনো থাকে না। ভীড়ের বাস দেখলে আমি মোড়ে দাঁড়িয়ে বাদাম খাই। বাস, গাড়ি, ট্রাক দেখি। মানুষ দেখি। বাদামের দাম বাড়ছে। আগে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তিন টাকার বাদাম খেলেই ফাঁকা বাস পেতাম। এখন দেখা যায় দশ টাকার বাদাম খেতে হয়। কোনো কোনো দিন বাদাম খেতে খেতে আমি ফাঁকা বাস পাবার আশায় উল্টোদিকে বাংলামোটর কি শাহবাগের দিকে রওয়ানা হই। হতাশ থাকলে দেখা যায়, ফার্মগেটের দিকে যাই। কিন্তু এত পথ হাঁটলেও হেঁটে হেঁটে আমি কখনো খামারবাড়ি পর্যন্ত যাওয়ার কথা মনে পড়ে না। অথচ প্রায় দিনই ভাবি, হেঁটে হেঁটে খামারবাড়ি পার হয়ে বিজয় সরণীর মাথা পর্যন্ত আমাকে একদিন যেতেই হবে। কিন্তু সাত বছরেও ঘটনাটা ঘটছেই না। বাস ফার্মগেট হয়ে খামারবাড়ি পেরিয়ে বিজয় সরণীর সিগনালে দাঁড়ালে প্রতিদিন আমার চোখে পড়ে কয়েকটা ছেলে মেয়ে দোলনচাঁপার তোড়া নিয়ে প্রাইভেট কারগুলোর জানালায় জানালায় ঘুরছে। ওরা সাধারণত বাসের জানালায় আসে না। বাসের জানালার দিকে তাকায়ও না। পাশ দিয়ে যাওয়া দোলনচাঁপা বিক্রেতা ছেলেমেয়েদের মাঝে মাঝে ডাক দেবার কথা চিন্তা করি। কিন্তু, ডাক দিলে যদি ওরা না শোনে, কিংবা বাসযাত্রীর কাছে যদি ফুল বিক্রি করতে না চায়, এই চিন্তায় আমার আর দোলনচাঁপা ফুল কেনা হচ্ছে না। দোলনচাঁপা অবশ্য আমার প্রিয় ফুল নয়। সত্যি বলতে আমার প্রিয় কোনো ফুলই নেই। যে কোনো একটা ফুল প্রিয় হবার মতো সৌখিন আমি না। আমি খুব বাস্তববাদী, বৈষয়িক লোক। যে ফুল আজ কিনলে পরের দিন শুকিয়ে বাসি হয়ে যায়। যত্নে কেনা ফুলগুলো ডাস্টবিনে ফেলে দিতে হয় সে ফুল কেন লোকে এত দাম দিয়ে কেনে, আর মেয়েরাই বা ফুল কেন এত ভালোবাসে আমি ভাবি। বাসে বসে প্রায় দিনই খামারবাড়ি পার হয়ে মিরপুর যেতে যেতে একটা কথাই চিন্তা করি, এক তোড়া দোলনচাঁপার দাম আসলে কত। আগে আমার মনে হতো, হয়তো বিশ টাকা হবে। এখন মনে হয় দুইশ টাকার কমে দেবে না। মাঝে মাঝে ভাবি, বাসের সহযাত্রীদের সামনে বিব্রত হওয়ার বদলে আমি বরং নেমে যাই। নেমে গিয়ে এক তোড়া দোলনচাঁপা কিনি। সে কাজটাও করা হয়ে ওঠে না। নামলে পরের বাসে উঠতে পারবো কি না এ নিয়ে একটা চিন্তা কাজ করে। আবার মনে হয়, মোড়ে দাঁড়ানো লোকগুলোর মধ্যে হয়তো ছিনতাইকারী থাকতে পারে। কাজটা হয়ে ওঠে না। কিন্তু মাঝে মাঝে সত্যি মনে হয়, ফুল কেনা দরকার। অন্তত একদিন ফুল হাতে, বিশেষ করে দোলনচাঁপা ফুল হাতে বাসায় ফিরলে কী অবাক কাণ্ড ঘটবে সেটা আমি মনে মনে কল্পনা করি। পৃথা ভীষণ অবাক হয়ে যাবে। ভাববে আমি হয়তো নতুন করে কারো প্রেমে পড়েছি, তার জন্য ফুল কিনে ভুলে বাসায় নিয়ে এসেছি। পৃথা ও আমার মধ্যে দোলনচাঁপা নিয়ে একটা জটিলতা আছে। ও যে দোলনচাঁপা ফুল পছন্দ করে সেটা আমি ওর সাথে প্রেমের অনেক দিন পরে জানতে পারি। আমি এও জানতে পারি, প্রত্যেক মেয়েরই একটি করে প্রিয় ফুল থাকে। আর একটি করে প্রিয় রঙ থাকে। পৃথা দোলনচাঁপা ফুল পছন্দ করে সেটা আমি ওর সাথে প্রেমের তিন বছর পর জানতে পারি। তখন পৃথার একটা বিয়ে ঠিক হয়েছে। 

টানা তিন বছর প্রেম করার পর আমি দেখলাম পৃথার সঙ্গে আমার ঠিকমতো ম্যাচিং হচ্ছে না। সব কিছুতেই গোলমাল লেগে যাচ্ছে। এটা অবশ্য আমরাই শুধু মনে হতে থাকে। পৃথার কী মনে হয় সেটা আমি জানতে পারি না। বুঝতেও পারি না। 

বিষয়টা জটিল হতে হতে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছালো যে, নিউ মার্কেটে ফুসকা খেতে খেতে আমি পৃথাকে বলি, তুমি বরং একটা ভাল ছেলে দেখে বিয়ে করে ফেল। 

পৃথা আমার দিকে তাকায় না। ফুচকার মধ্যে টক দিয়ে আশপাশে ছড়িয়ে থাকা ধনে পাতা আর পেঁয়াজ মরিচের কুচিগুলো ফুচকার ভাঙা মুখে জড়ো করতে করতে ভাবলেশহীন চোখে আমার দিকে তাকায়। আস্ত ফুচকাটা মুখের মধ্যে পুরে দিয়ে আমার দিকে তাকিয়েই থাকে। নরমালি পৃথার এই ফুচকা খাওয়ার দৃশ্যটা আমার খুব পছন্দের। তাই আমি ওকে ঘুরে ফিরে নিউ মার্কেটে নিয়ে আসি। আর ফুচকা খাওয়াই। বড় বড় চোখ করে ওর ফুচকা খাওয়া দেখি। কিন্তু এখন আর ওর ফুচকা খাওয়ার দৃশ্যটা আমার তেমন ভাল লাগছে না। আমার জরুরি কথার চেয়ে ফুচকা খাওয়াটা এই মুহূর্তে ওর কাছে অনেক বেশি জরুরি মনে হচ্ছে। আরাম করে ফুচকা খাওয়া শেষ হলে সে আমার সাথে ঝগড়া বাঁধাবে, এটা প্রায় নিশ্চিত, এটা আমি ভাবি। আমি অবশ্য বেশ প্রস্তুতি নিয়ে, অনেক ভেবে এসেছি। পৃথা কী কী বলতে পারে। আমি উত্তরে কী কী বলবো সব বেশ গুছিয়ে এনেছি। 

পৃথা বলে, সম্পর্ক করার আগে তুমি কি বুঝো নাই যে এটা সম্ভব না? আমি তোমাকে কতভাবে বলছি, এটা হবে না। তবু তো তুমি জোর করে সম্পর্কটা আগায়ে নিছো। 

এইজন্যই তো আমি বলতেছি, তুমি ভাল একটা ছেলে দেখে বিয়ে করে ফেল।

পৃথা মনে হলো আমার যুক্তিটা আজকে প্রথমবারের মতো মেনে নিচ্ছে। আপন মনে ঝাল ফুচকা খেতে খেতে সে হয়তো কোনো ভাল পাত্রের কথাই ভাবছে। ফলে আমি অ্যাড করতে থাকি-

সবচেয়ে ভাল হয়, চেনা-পরিচিতদের মধ্যে ভাল ছেলে বেছে নিতে পারলে। অচেনা কারো সাথে কেমনে চলবা। সে কি তোমাকে বুঝবে আর তুমিও কি তাকে বুঝবা। তুমি আগে ভাবো। তোমার কী মনে হয় আমাকে বলো। ফ্যামিলির সাথে কথা বলে আমাকে জানাও।

পৃথা আর আমি সারাটা বিকাল নিউ মার্কেট, টিএসসি, ডাস ঘুরি। আমি ওকে বলি, তোমার হাতেই সব সমস্যার সমাধান। 

পৃথা হঠাৎ চুপ হয়ে যায়। ও অবশ্য এমনিতেই খুব চুপচাপ। ওর হয়ে সব কথা আমিই বলি। সব সিদ্ধান্তের জন্য আমার দিকেই তাকিয়ে থাকে। এবারও তার ব্যত্যয় ঘটলো না। 

ওদের পল্টনের বাসায় ওকে নামিয়ে দিয়ে আমি বলি, আজকেই তোমার বাবা-মার সাথে আলাপ করো। খেতে বসে আস্তে আস্তে বলবা। সোজা বলে দিবা, রাসেলকে তো বিয়ে করা যায় না। তোমরা আমার জন্য ছেলে দেখো।

রাত বারোটায় নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে ফিসফাস করে আমাকে ফোন দেয় পৃথা। 

তুমি আমাকে কী বিপদে ফেললা, বলো তো। বাবা তো কিছুই বললো না। মা-ও চুপ। শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আমি আবার আমার বক্তব্য রিপিট করি। বলি, আমাদের আসলে ম্যাচিং হবে না। আমার টাইপটা কত বদখত- তোমার চেয়ে তো ভাল কেউ জানে না। আমাকে বিয়ে করার কোনো যুক্তিই তোমার থাকতে পারে না। 

 

পরদিন বাসা থেকে বেরিয়ে অফিসে যেতে যেতে ফোন দেয় পৃথা। সে একটু উচ্ছ্বসিত। আমি ঘুম ঘুম অবস্থাতেও ওর উচ্ছ্বাসটা টের পাই।

শোনো, বাবা আমার কথা শুনে খুব খুশী। কিন্তু মা মনে হলো একটু চিন্তিত। বাবা ফ্যামিলির সবাইকে ফোন দিচ্ছে। পৃথার জন্য একটা ছেলে দেখো। ফৌজিয়া খালাকেও ফোন দিছে। ওনার হাতে নাকি একটা পাত্র আছে। মাদারিপুরের এসিল্যান্ড। 

গ্রেট। তুমি ঢাকার বাইরে যাওয়া নিয়ে চিন্তা করো না। তোমার তো সরকারি ব্যাংক। ঢাকার বাইরে পোস্টিং নিয়ে ঝামেলা হবে না। আর ছেলে যদি ঢাকা আসতে চায় তাও সম্ভব। একটু তদবির করতে হবে। জনপ্রশাসনে আমার চেনা লোক আছে। বোঝাই যাচ্ছে, ছেলে বেশ মেধাবী। কোথা থেকে পাশ করেছে?

এসব কিছুই জানি না এখনও। আমার ধারণা, খালা আজকেই আমাকে ফোন দেবে। ফোন দিলে সব জেনে নেব।

অফিস শেষ করে তাহলে নিউ মার্কেটে চলে আসো। আপডেটগুলো নিয়ে বসি।

দুই তিনদিনের মধ্যে ছেলের আপডেট পাওয়া গেল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বোটানিতে পাশ করে প্রথম বিসিএসেই টিকে গেছে। তবে রাজশাহীর ছেলেদের যে সমস্যা হয়, এই ছেলেরও তাই। পানিতে আয়রন বেশি বলে চুল অনেক পড়ে গেছে।

আমি বললাম, চুল একটা ক্ষণস্থায়ী ব্যাপার। তোমার আমার সবার চুলই একদিন পড়ে যাবে। দুইদিনের দুনিয়া। কারো চুল যদি আগে পড়ে তবে সেটা নিয়ে নেগেটিভলি ভাবা যাবে না। সবচেয়ে বড় কথা, কারো মাথায় চুল বেশি কারো মাথায় টাক এসব দেখে কাউকে বিবেচনা করাটা বর্ণবাদ।

টাক নিয়ে পৃথার মৃদু আপত্তি আর ধোপে টিকলো না। 

ফৌজিয়া খালা বেশ কামেল মহিলা। কীভাবে ম্যাচ করতে হয় তিনি খুব ভাল জানেন। সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে ছবি আদান-প্রদান করে, দুই পরিবারের সম্মতি নিয়ে ছেলেকে ঢাকায় এনে পৃথার সঙ্গে চাইনিজ রেস্টুরেন্টে বসার ব্যবস্থা করে ফেললেন। ফোনে বেশ কথাবার্তাও শুরু হয়েছে। পৃথা আমাকে সব আপডেট দিয়ে যাচ্ছে। ছেলে বেশ কেয়ারিং, তবে এখনও আপনি করে বলছে। পৃথাও গ্যাপটা রাখছে ইচ্ছা করে। মেয়েদের খুব সম্মান করে। এক কথায় জেন্টেলম্যান।

সব ঠিকমতো এগুচ্ছিল, কিন্তু ধানমন্ডির জিনজিয়ানে চাইনিজ খাবার পর পৃথা মোটামুটি বিলা হয়ে গেল। আমি তো অধীর অপেক্ষায় বসে আছি, দেখা হওয়ার পর কী ঘটলো তা জানার জন্য। 

কিন্তু পৃথা ফোন করে বললো, আচ্ছা রাসেল, তুমি তো আমার সাথে তিন বছর প্রেম করতেছো, নাকি?

অবশ্যই।

বলো তো, আমার প্রিয় ফুল কী?

আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। বললাম, এর সাথে পাত্রের সম্পর্ক কী? 

না বলো, তোমাকে বলতেই হবে। 

আমি কোনোদিন পৃথাকে জিজ্ঞেস করিনি ওর প্রিয় ফুল কী? তবু ঘুরতে ঘুরতে ওর কখনো কোনো ফুলের প্রতি আলাদা আকর্ষণ দেখেছি কি না মনে করার চেষ্টা করলাম।

ইউ ফিলথি ডগ। ইউ নেভার ইভেন আস্কড মি অ্যাবাউট মাই ফেভারিট ফ্লাওয়ার। তুমি কেমনে বলবা। অথচ দেখো, দুইদিন ধরে যার সাথে আমার পরিচয় হয়েছে- সে ঠিকই আমার প্রিয় ফুল নিয়ে এসেছে। তার মানে কি জানো? তুমি আমাকে কোনোদিন ভালোবাসোনি। আমার পছন্দ, ভাল-মন্দ তোমার কাছে কোনোদিন গুরুত্ব পায়নি। সত্যি করে বলো তো তুমি কি আমাকে ভালোবাসো? বেসেছো কখনো?

পৃথার গলা ভারী হয়ে এসেছে। এরপরই সে কাঁদবে। একবার কাঁদতে থাকলে সে দেড় ঘণ্টা ধরে শুধু আমাকে বকাবকি করতে থাকবে।

আজকে তুমি আমাকে সত্যি কথাটা বলো। প্লিজ, আমাকে সোজা করে বলো তো, আমাকে তুমি যে ভালোবাসো না সেটা গোপন করছো কেন এতদিন। আমি তোমার কী ক্ষতি করছি।

না। বাসি তো।

তুমি আমাকে ভালোবাসো? ভালোবাসা কী জিনিশ তুমি জানো। মুহিদের কাছ থেকে তোমার শেখা উচিত। এত জেন্টেলম্যান। প্রথম দেখাতেই আমার জন্য আমার প্রিয় ফুল নিয়ে আসছে। তুমি ভাবতে পারছো কোনোদিন?

কিন্তু আমি তো জানি না তোমার প্রিয় ফুল কী?

জিজ্ঞেস করলে না জানবা। তুমি তো কোনোদিন জিজ্ঞেসই করোনি। জানবা কীভাবে। ইউ ব্লাডি লুজার। আই হেট ইউ।

এখন বলো। তোমার প্রিয় ফুল আসলে কোনটা। 

আই ওন্ট টেল ইউ। নো, নেভার। আমার প্রিয় ফুল জেনে তোমার কোনো কাজ নেই। আই জাস্ট হেট ইউ। সত্যি করে খোদার কসম দিয়ে বলো তো সত্যিই কি তুমি আমাকে ভালোবাসো?

হা, সোনা, পৃথামণি সত্যি তোমাকে আমি খুব ভালোবাসি। 

ভণ্ড কোথাকার। হিপোক্রেট। ভালোবাসলে কেউ তার প্রেমিকার বিয়ে দিতে চায়?

ভালোবাসি বলেই তো বিয়ে দিতে চাচ্ছি। দেখছো না, আমাদের মনের কোনো মিল নেই। তুমি এক রকম আমি একরকম। তোমার প্রিয় ফুল কোনটা আমি এতদিনেও জানি না। তোমার ফ্যামিলিও আমাকে মেনে নিতে চাচ্ছে না। দেখা হলেই শুধু ঝগড়া হচ্ছে, বুঝতেছো না? 

এইগুলা সলভ করার চেষ্টা তুমি কখনো করেছো? প্যাথোলজিকাল লায়ার। তুমি এখন নতুন একটা প্রেম করবা। তাকে ছেড়ে আরেকটা ধরবা। আমি জানি না তুমি কী? পারভার্ট একটা। 

আচ্ছা বলো, তোমার প্রিয় ফুল কী? কালকেই আমি তোমাকে কিনে দেবো। 

তোমাকে কিনে দিতে হবে না। আমি দেখছি। লেট মি সি, হাউ ফার ইউ ক্যান গো।

পরদিন সকালে আমি অফিসে ঢুকেছি এমন সময় পৃথার ফোন।

শোনো, সকালে বাবাকে আমি বলে দিছি, রাসেলকেই বিয়ে করবো। তুমি আজকে সন্ধ্যায় এক প্যাকেট মিষ্টি নিয়ে আমাদের বাসায় আসবা। বনফুলের শাদা মিষ্টি কিনবা, দুই কেজি।

কিন্তু আমি তো আজকে শেভও করি নাই। ইস্ত্রি করা শার্টও পরি নাই। মিরপুর গিয়ে আবার পোশাক বদলে আসবো কেমনে। আজকে বাদ দাও। তাছাড়া জুতাও তো নাই। 

ইহজন্মেও আর এগুলো তোমার ঠিক হবে না। তুমি যেমন আছো তেমনই আসো। আমার ফ্যামিলি মেম্বাররা দেখুক, কেমন একটা ফিলথি ছেলেকে আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি। আমি কত বোকা। তোমার পাতা ফাঁদে পা দিয়েই ফেলছিলাম। ওহ গড। তুমি কীরকম একটা লোক ভাবতেই আমি বিস্মিত হয়ে যাচ্ছি। আই ওয়ান্ট টু সি ইউ এট আওয়ার হোম রাইট অ্যাট সেভেন ও ক্লোক। 

সন্ধ্যায় পল্টন যাবার পথে জ্যাম পড়বে বলে মনে হয় না। আমি চলে আসবো।

পৃথাদের বাসায় যাবার আগে আমি ভাবছিলাম ওর জন্য ওর প্রিয় ফুল নিয়ে যাই। কিন্তু সারাদিন ভেবেও আমি কোনো কুল পেলাম না। আসলে ওর প্রিয় ফুল কী?

পৃথাদের বাসায় গিয়ে আমি ওদের ড্রয়িংরুমে বসে থাকলাম আধঘণ্টা। পৃথা ওর বাবা-মার সাথে ভেতরে ঝগড়া করছে।

আমি শুনতে পাচ্ছি না। কিন্তু টের পাচ্ছি, ও চাপা স্বরে নিচু গলায় ঝগড়া করছে। আর পুরনো ডায়ালগগুলো দিচ্ছে। তার মধ্যে একটা হলো, লেট মি লিভ মাই ওন লাইফ। আই নো হিম। ডোন্ট বি জাজমেন্টাল। ও খারাপ হলেও আমি ওকেই বিয়ে করবো।

বেশ কিছুক্ষণ পর পৃথার বাবা এলো। পেছন পেছন ওর মা। ওনারা বসলো আমার সামনে। আলাপ পরিচয়ের পর পৃথার বাবা বললো, তা কী মনে করে এদিকে এলে? 

পৃথা আমাকে এই প্রশ্নের উত্তর আগেই কয়েকবার বলে দিয়েছে। 

অ্যাকচুয়ালি, আই ওয়ান্ট টু ম্যারি ইওর ডটার। 

এই কথার সাথে সাথে পৃথা ঢুকলো। ঘরে একটা নিরবতা নেমে এলো।

ফেরার পথে আবার পৃথার ফোন। খুব ভাল হয়েছে। মা এখন আমার পক্ষে। বললো, ছেলেটা জেনুইন। কোনো ভান-ভণিতা নাই। বিয়ের পর তুমি প্রতিদিন অফিস থেকে ফেরার পথে আমার জন্য একতোড়া করে দোলনচাঁপা নিয়ে আসবা। লুজার, আমার প্রিয় ফুল এটা।

পৃথার প্রিয় ফুল দোলনচাঁপা। এটা তো খুব সহজ। 

আমি বললাম, আগে বলবা না। খামারবাড়িতেই তো পাওয়া যায়। কিন্তু দোলনচাঁপা ফুল কি ভাল? কেমন একটা তিঁতা গন্ধ না?

পৃথার সঙ্গে বিয়ের চার বছর হয়ে গেল। আমি কোনোদিন ওর জন্য দোলনচাঁপা ফুল নিয়ে বাসায় ফিরিনি। তবে এটা সত্যি প্রতিদিনই বাসায় ফেরার সময় আমি দোলনচাঁপা কেনার কথা ভাবি। যারা ফুল বিক্রি করে তাদের কথা ভাবি। ঢাকা শহরে বিজয় সরণীর আশপাশেই কেন বেশি বেশি দোলনচাঁপা পাওয়া যায় সে কথা ভাবি। আমার মনে হয়, হয়তো মনিপুরি পাড়ায় দোলনচাঁপার বাগান আছে। নয়তো সংসদ ভবনের আশপাশে কোথাও।

আমি নিজেকে নিয়েও ভাবি কখনো কখনো। আমি কেন এমন এক উদ্যমহীন লোক হয়ে গেলাম। দশ টাকার বাদাম কিনে একদিন একশ টাকা পকেটে নিয়ে হেঁটে খামারবাড়ি পর্যন্ত আসতে পারলেই তো দোলনচাঁপা নিয়ে বাসায় ফিরতে পারি। পৃথার হাতে তোড়াটা দিলে পৃথা হয়তো কেঁদেই ফেলতো আনন্দে। দৃশ্যটা কল্পনা করে আমার মন খুশী হয়ে ওঠে।

দিন যায়, কিন্তু আমার আর দোলনচাঁপা কেনা হয় না। 

এরই মধ্যে একদিন নাজিয়ার সঙ্গে আমার আলাপ হয়। অফিসে নাজিয়া আমার পাশের ডেস্কে বসে। নতুন করে যে বসতে শুরু করেছে তা নয়। নাজিয়া আমার পাশের ডেস্কে বসে তাও পাঁচ বছর হয়ে গেছে। আমার কোনোদিন মনে হয়নি, নাজিয়ার প্রিয় ফুল কী? আমি কখনো জিজ্ঞেস করিনি। কিন্তু একদিন হঠাৎ আমি খেয়াল করি, নাজিয়ার গলায় একটা গভীর লালচে কালো দাগ। 

আমি নাজিয়াকে জিজ্ঞেস করি, আপনার গলায় দাগ কেন? 

নাজিয়া বলে, আপনি তো কখনো খেয়াল করেন না- তাই জানেন না, আমার গলায় এই দাগটা শুরু থেকে আছে। 

কিন্তু আমার তো মনে হচ্ছে, এই দাগটা নতুন। কিছু একটা দেবে গিয়ে দাগটা তৈরি হয়েছে। 

নাজিয়া বলে, চা খাবেন?

নাজিয়া আর আমি ফুটপাতের পাশে চায়ের দোকানে দুপুর বেলা চা খেতে যাই। নাজিয়ার চোখের নিচে কালসিটে দাগ। ফর্সা বলে দাগটা বেশি চোখে পড়ে। চোখ লাল। মনে হয় জ্বরও আছে। 

আপনার কি জ্বর গায়ে?

আমি আলতো করে নাজিয়ার হাতে হাত ছোঁয়াই। 

আরে আপনার তো শরীর পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। বাসায় চলে যান। আন্দালিব ভাইকে আমি বলে দেবো, জ্বর বলে আপনি আগে চলে গেছেন।

কোথায় যাবো?

বাসায় চলে যান। 

বাসা তো নাই। আমার গলায় যে দাগটা দেখছেন, এটা কাল রাতে তৈরি হয়েছে। আমার স্বামী গলায় দড়ি চেপে মারতে এসেছিল। ওই বাসায় কি আর ফিরে যাওয়া যায় বলেন? সত্যি বলতে, অফিস ছাড়া আমার আর কোনো জায়গা নেই যাবার।

আমি চুপ করে থাকলাম। 

নাজিয়া একটু হাসলো।

একটা কথা বলবেন? আপনি তো কোনোদিন আমার দিকে খেয়াল করেন না। আজকে হঠাৎ করে গলায় চোখ গেল কীভাবে?

আমি নাজিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকি। 

নাজিয়া শুকনো পাউরুটি চায়ে ভিজিয়ে খেতে থাকে। জানেন, আজকে সারাদিন এই একটা কথাই ভাবছি। কেউ যদি জিজ্ঞেস করতো, তুমি সকালে খেয়েছো কি না। রাতে খেয়েছো কি না। কাল রাতের পর এই একটা কিছু খেলাম। নাজিয়ার চোখ ভিজে যাচ্ছে। আমার শুধু মনে হচ্ছে, যদি কেউ দেখে ফেলে। যার সাথে আজকেই প্রথম এমন করে কথা হচ্ছে, সে কেন আমার সামনে বসে কাঁদছে কোনো ঘটনাক্রম ছাড়া এটা কেউ বিশ্বাস করবে না। কেন কাঁদছে, এ কথার কোনো জবাব নেই। চাঅলা মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে। চেনা লোক। বুঝতেই পারছে না হঠাৎ করে এই দুজনের মধ্যে কী হচ্ছে।

নাজিয়া হয়তো বুঝলো। একটু হাসলো। বললো, চোখে কী একটা পড়েছে। মামা একটু পানি দেন তো ধুয়ে ফেলি।

নাজিয়া ও আমি উঠে পড়ি। অফিসে বাকী সময়টা খুব অস্থির কাটে আমার। বারবার একটা প্রশ্ন ঘুরে ফিরে মনে আসে। নাজিয়ার প্রিয় ফুল আসলে কী? পৃথার তত্ত্ব অনুসারে কেউ কারো প্রেমে পড়লেই শুধু জিজ্ঞেস করে, আপনার প্রিয় ফুল কী?

অফিস শেষে নাজিয়া তার ব্যাগপত্র নিয়ে বের হয়। আমিও কিছু না ভেবেই ওর সাথে সাথে বের হই। কাওরানবাজার মোড় পর্যন্ত একসাথে আসার পর নাজিয়া বলে, আপনি তো বাসায় যাবেন, নাকি বন্ধুদের সাথে আড্ডা?

আমার কোনো বন্ধু নেই। ছাপোষা কেরানী বলতে যা বোঝায় আমি সেরকমই। আপনি কোথায় যাবেন?

আমার তো বিকল্প নেই। সেই ঘরেই ফিরতে হবে।

আমার মনে হয়, ওই ঘরে না ফেরাই ভাল। আজকে রাতে হয়তো আপনাকে মেরেই ফেলবে।

নাজিয়া আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি ভাবি নাজিয়া কোথায় ফিরবে। নাজিয়াও হয়তো ভাবে। পান্থপথের দিকের সিগন্যালটা ছেড়ে দিলে অনেক গাড়ির হর্নের শব্দে সবকিছু চাপা পড়ে।

ঢাকায় আর কেউ নেই?

টঙ্গীতে বাবার বাড়ি।

চলেন তাহলে টঙ্গীর বাসে উঠি। দেরি না করে আমি বলে ফেলি।

আমি নাজিয়ার সঙ্গে টঙ্গীর বাসে উঠে পড়ি। চুপচাপ বনানী পর্যন্ত যাই। প্রচণ্ড জ্যাম রাস্তায়। বনানী পার হওয়ার পর নাজিয়াকে আমি জিজ্ঞেস করি, আপনার প্রিয় ফুল কী?

নাজিয়া বলে, দোলনচাঁপা।

একটা সময় ছিল। নাজিয়া মুখ চাপা দিয়ে বলতে থাকে। শাহেদ প্রতিদিন আমার জন্য একটা করে দোলনচাঁপা ফুল নিয়ে বাসায় ফিরতো। একটাই ফুল। কোথায় পেত, কে জানে। খুব ভাল বাসতো আমাকে। দোলনচাঁপার গন্ধটা আমার এত প্রিয়। রাতে ঘরের বাতি নেভানোর পর সারা ঘরে গন্ধটা ছড়িয়ে যেত। 

হু হু করে কাঁদতে থাকে নাজিয়া।

ফেরার দেরি দেখে পৃথা আমার ফোনে কল দেয়। টঙ্গীতে বাস থেকে নামছি তখন। নাজিয়াকে ওর বাবার বাসার গলিতে নামিয়ে ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায়। পৃথাকে গল্পটা বলার খুব ইচ্ছা হয় আমার। গল্পটা কীভাবে বলবো ভাবি। এভাবে বলতে পারি, জানো নাজিয়ারও প্রিয় ফুল ছিল দোলনচাঁপা। প্রতিদিন রাতে বাড়ি ফেরার সময় শাহেদ....

কিন্তু গল্পটা আমি শুরুই করতে পারি না। ক্লান্ত অবসন্ন হতাশ অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়ি।

গভীর রাতে আমার ঘুম ভেঙে যায়। দোলনচাঁপার মিষ্টি গন্ধ এসে নাকে লাগে। আমার মনে হয় আমি যেন শাহেদ ও নাজিয়াদের ঘরে শুয়ে আছি। শাহেদের আনা ফুলই গন্ধ ছড়াচ্ছে। বিছানা থেকে উঠে ড্রয়িংরুমে যাই আমি। গিয়ে দেখি ফুলদানিতে একগুচ্ছ দোলনচাঁপা। আমি তো আজ দোলনচাঁপা কিনি নাই। কোনোদিনই কিনি নাই। তবে কীভাবে এই ফুল ঘরে এলো? মাদকতা ছড়িয়ে গন্ধটা আমাকে হতবিহ্বল করে দেয়।