পোস্টস

নন ফিকশন

আ বার্নিং

২০ মে ২০২৪

ওয়াসিম হাসান মাহমুদ

মূল লেখক ওয়াসিম হাসান মাহমুদ

বুক রিভিউ

আ বার্নিং
লেখক : মেঘা মজুমদার
অনুবাদক : নাহিদ খান
প্রথম প্রকাশ : ডিসেম্বর ২০২১
প্রকাশক : বাতিঘর
প্রচ্ছদ : সব্যসাচী হাজরা
জনরা : সামাজিক উপন্যাস, থ্রিলার
রিভিউয়ার : ওয়াসিম হাসান মাহমুদ


তিন। রহস্যময় এবং শক্তিশালি একটি সংখ্যা। ত্রিভুজ, ত্রিমুর্তি, ট্রিনিটি, আমি, তুমি ও সে। যেকোন প্রতিযোগিতা শুরুর সময় ১...২...৩ এখানেও ৩ শুনার আগে দৌড় শুরু হয় না। এই সামাজিক আখ্যানে অনেক চরিত্রের মাঝে মূল চরিত্র আছেন তিনজন।

তিনজন মানুষ। এই উপন্যাসে কিভাবে যেন এক বিন্দুতে এসে মিশে গেছে তাদের জীবন। আবার বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। জীবন নামের মুসলমান মেয়েটি, তাঁর পিতৃতূল্য পিটি স্যার এবং লাভলি নামের এক হিজড়া যে কিনা জীবনের কাছে ইংরেজি শিখতো। সবার জীবন একসূত্রে গাঁথা হয়ে যায় যখন উগ্রবাদীদের আক্রমণে এক ট্রেন মানুষ জ্বলে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যান।

এই গল্পের টাইমলাইন ভারতবর্ষে দূর্ভাগ্যজনক ডানপন্থী রাজনীতির উত্থানের সাথে সাথে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প সবদিকে যখন মহামারীর মত ছড়িয়ে পড়ছে। গরীব ঘরের মেয়ে, স্কুলে পিটি স্যারের প্রিয় ছাত্রীদের মধ্যে একজন জীবন। পেটের দায়ে ম্যাট্রিকের পর লেখাপড়া আর না এগিয়ে চাকরির দিকে ঝুঁকে পড়েন। নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তে উত্তরণের স্বপ্ন দেখে সে কিন্তু ঐ ট্রেন হামলায় সন্ত্রাসী সন্দেহে চলে যান কারাগারের পিছনে।

লাভলি স্বপ্ন দেখে একজন জনপ্রিয় ফিল্মস্টার হ‌ওয়ার। এজন্য বেশ পরিশ্রম করে যাচ্ছে সে। দেবনাথবাবুর ওখানে রিহার্সাল থেকে শুরু করে দল বেঁধে ভিক্ষাবৃত্তির মধ্য দিয়ে যেতে হয় তাকে। শুধুমাত্র হিজড়া হ‌ওয়ার কারণে সমাজে অচ্ছু্ৎ সে। লাভলি অবশ্য এই গল্পে বারবার স্বপ্নভঙ্গের পর‌ও হার মানতে রাজি নয়। জীবন যে নির্দোষ তা লাভলি জানে। ঐ ব্যাগে বোমা ছিলনা।‌ ছিল নির্দোষ কিছু পাঠ্যব‌ই। লাভলি কি পারবে আদালতে সাক্ষ্য দিয়ে জীবন‌কে নির্দোষ প্রমাণ করতে?

পিটি স্যার একজন নীতিবান এবং অবহেলিত শিক্ষক। স্কুলের মেয়েদের পিটি করানো এবং শিক্ষিকারা মাইকে কথা বলার সময় সমস্যা হলে মাইক ঠিকঠাক করার কাজে নিয়োজিত তিনি। ঘটনাচক্রে রাজনীতির সাথে ভালোভাবে জড়িয়ে পড়েন স্যার। দেশপ্রেমে যতটা না তিনি উদ্বুদ্ধ তার চেয়ে অনেক গুন বেশি পিটি স্যারের মধ্যে কাজ করছে উচ্চাকাঙ্খা। ডানপন্থী রাজনীতির লিফটে চরে বহু উপরে উঠে যাচ্ছেন তিনি। নিচে রেখে যাচ্ছেন অনেক সত্য। রাজনীতিতে তো সত্য তৈরি করা যায়। নিজের অজান্তেই তিনি পরিণত হচ্ছেন এক অন্য মানুষে। ক্ষমতা যার চাই-ই চাই। যেকোন মূল্যে।

গল্প অত্যন্ত দ্রুত গতির। সামাজিক এই উপন্যাসে অত্যন্ত গতিশীল কিছু বিষয় লেখক তাঁর লেখনীর মাধ্যমে এক‌ইসূত্রে গেথেছেন এক সুস্থির উপায়ে। এই ব‌ই এক বসায় পড়ে ফেলার মত। লেখক মেঘা মজুমদার প্রথম উপন্যাসেই নিউ ইয়র্ক টাইমস বেস্টসেলার রাইটারে পরিণত হয়েছেন। বিদেশে বসে নিজ দেশে ভয়ানক বৈষম্য এবং মৌলবাদের জয়জয়কারে ব্যথিত হয়ে এই আখ্যান লিখেছেন তিনি। অনুবাদক নাহিদ খান এমন এক কাজ করেছেন যে পুরো ব‌ই পড়ার সময় একবারের জন্যেও মনে হবে না এটি একটি অনুবাদকর্ম। যেন "আ বার্নিং" বাংলাতেই লেখা হয়েছিল। অনেকদিন পর এক দুর্দান্ত অনুবাদের মধ্য দিয়ে গেলাম।

সমাজের বিভিন্ন বৈষম্য, অনাচার, সকল পরিস্থিতি নিজের প্রতিকুলে থাকার পর‌ও জীবন ফাইট দিয়েই যাচ্ছেন জেলের ভিতর থেকে। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার এই ওয়ান সাইডেড ওয়ারে জীবন বড়‌ই একা। কারণ সংগ্রামী লাভলি বা পিতার মত পিটি স্যার দু'জনের সামনেই হাত নাড়ছে অনেক উপরে উঠার সিড়ি। ‌ক্ষমতা এবং স্টারডমের কাছে জীবনের মূল্য কতটুকু? এই খ্যাতির জন্য তাদের একটা বড় স্যাক্রিফাইস করতে হবে। জীবনকে।

দু'টো মূল চরিত্র উত্তম পুরুষে লেখা এই ব‌ইয়ে ভারতবর্ষের চকচকে গ্ল্যামারের দুনিয়ার ঠিক নিচে অসীম দারিদ্র, ক্রমবর্ধমান ডানপন্থার প্রসার এবং অবিচার সব‌-ই কেমন গা স‌ওয়া হয়ে যাচ্ছে সেটা ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক। গল্পে লাভলির একটা মনোলোগ ভালো লেগেছে,

"একেকটা লোকাল ট্রেন একেকটা ফিল্মের মতো।"

অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষার এই অনুবাদে জীবনের ইনোসেন্স, লাভলির জীবনবোধ এবং পিটি স্যারের একধরণের ঘোরের ভিতর দিয়ে ক্ষমতার হাতছানির পিছনে ছুটে যাওয়াটা এসে শেষ হয়েছে এক বিন্দুতে। এরপর আবার বিচ্ছিন্ন হয়ে নতুন শুরু হ‌ওয়া।

আমাদের অনেকের জীবন-ই হয়তো শেষ এক বিন্দুতে হয়। নতুন নতুন শুরুটাও হয়তো বিচ্ছিন্নতা থেকে হয়।

কিন্তু উপন্যাসের নামের মত সেই বার্নিং থেকে আদৌ কি মুক্তি পাওয়া যায়?