জ্বর এর মধ্যেই অক্সিমিটার এর রিডিং এ চোখ আটকে গেলো। ৬৫। অক্সিজেন স্যাচুরেশন লেভেল।ঘড়িতে সন্ধ্যা ৭.৩০ । যেখানে ৯৫-১০০ থাকতে হয় সেখানে আমার আছে ৬৫। ডাক্তার এর পরামর্শ নিলাম। ডাক্তার হাসপাতালে এডমিট হতে বললেন। এর কিছুদিন আগে লাজফার্মায় অক্সিমিটার কিনতে গিয়েছিলাম । অবশ্য অক্সিমিটার কিনার সময়েই একই ঘটনা ঘটেছিলো। ঘটনাটা বলি ।
"একটা ভালো ব্র্যান্ড এর অক্সিমিটার দেন "
কিছুক্ষন অপেক্ষায় থাকার পরে একজন একটা অক্সিমিটার নিয়ে হাজির।
"কত দাম ?"
"১০০০"
"প্যাকেট খুলে চেক করে দেন "
প্যাকেট খোলা হলো । খুলে দোকানের লোক নিজের আঙ্গুল বাদ দিয়ে আমার আঙ্গুল নিয়ে বললেন টেস্ট করতে। আমি তখন পুরোপুরি সুস্থ। অক্সিমিটার অন করে টেস্টিং প্রসেস শুরু হলো। ৭০ এ রিডিং উঠার পরে, অক্সিমিটার বিপবিপ করছে। দুইবার চেক করলাম, দুইবার ঘটনা একই ঘটলো। তখন কোরোনার প্রকোপ চারিদিকে কেবল শুরু হয়েছে। । আমার মুখে মাস্ক পরা । লাজফার্মায় ঢুকার সময় দুই একবার হাঁচি কাশিও দিয়েছিলাম ।
"ভাই, আপনি বসেন, এতটা অসুস্থ হয়ে দোকানে আসলেন কেন ?"
"আমি তো সুস্থ"
"সব করোনা রোগীরাই নিজেদেরকে প্রথমে সুস্থ ভাবে, আপনি বসেন"
দোকানে আমার সাথে আমার ওয়াইফ তানজিলা ছিল।
"আপনি একটা এম্বুলেন্স ডাকেন, উনাকে এখন -ই হাসপাতালে নিতে হবে "
যাই হোক, হাসপাতালে সেদিন যেতে হয় নি। কারণ অক্সিমিটার এর টেকনিক্যাল প্রব্লেম ছিল। নতুন একটা চেঞ্জ করে দেয়ার পরে বাসায় চলে আসি।
কিন্তু এবারের ঘটনা ভিন্ন ।
অক্সিমিটার এ রিডিং ৬৫ উঠার আগের চার দিনের কথা বলি। এই চারদিন টানা ১০৪ ডিগ্রি জ্বর নিয়ে আমি কাতর। ওষুধে কাজ হচ্ছে না। সাবসিটর দিলে জ্বর চলে যায় এবং আসে। জ্বরের চতুর্থ দিনে মামনি সকালে বাসায় আসলো। গায়ে হাত দিয়ে বললো - করোনা টেস্ট করতে। করলাম। করোনা পজিটিভ ধরা পড়লো।
সন্ধ্যায় ফিরে আসি। ডাক্তার যেহেতু বলেছে hospitalized হতে সুতরাং শুভস্য শীঘ্রম। দেরি করলাম না।কিন্তু কপাল খারাপ। আমি যেই সময়ের কথা বলছি - সেই সময়ে ঢাকায় হাসপাতালের রুমের তীব্র সংকট। চারদিকে কোরোনার রোগী। এদিকে রাত বাড়ছে। সাথে বাড়ছে আমাকে নিয়ে মৃত্যু ভয়। মৃত্যু ব্যাপারটা অবধারিত, তবুও সেটা নিয়ে আমরা কেন এতো ভীত থাকি ? এর কারণ মৃত্যুর অভিজ্ঞতা অজানা। যা কিছুই অজানা, তাই আমাদের ভয়ের কারণ।
হাসপাতালের রুমের তীব্র সংকটের মাঝেই হাসপাতাল খোজা শুরু হলো। যেখানেই ফোন করি সেখানেই -খালি নাই খালি নাই । এখানে সেখানে ফোনের একটা পর্যায়ে Impulse হাসপাতালে একটা সিট্ পেয়ে গেলাম। হাসপাতালের যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু। সাথে আমার ওয়াইফ তানজিলা ।
হাসপাতালে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে বাসা থেকে নিচে নামলাম। কেউ যদি তখন আমাকে এসে বলতো - তোমার শেষ ইচ্ছা কি ? আমি বলতাম - আমি আমার মামনি কে একবার জড়িয়ে ধরতে চাই। গাড়িতে উঠে বসলাম । গাড়ি চলতে শুরু করেছে। দুর্ভাগ্য আমার শেষ ইচ্ছা পূরণ না করেই ,আমি চলে যাচ্ছি । মামনি ,আব্বু আস্তে আস্তে চোখের আড়াল হয়ে যাচ্ছে। রাস্তায় এতো গাড়ি, এতো মানুষের মধ্যে দিয়ে গাড়ি চললেও - সেদিন আমি বুঝে গিয়েছিলাম মানুষ আসলে খুব নিঃসঙ্গ। একা।পৃথিবীতে মানুষের আগমনও একা, তাকে চলেও যেতে হবে খালি হাতে। একা হয়ে।
অনেক কিছু চিন্তা করতে করতে চলে আসি হাসপাতালে। নিচের রিসিপশনে বসলাম।
এবার হাসপাতালের একটা বর্ণনা দেই -পুরো হাসপাতালে ভীতিকর অবস্থা। করোনা রোগীরা মাস্ক পরে, শিল্ড লাগিয়ে হেটে বেড়াচ্ছে। তাদেরকে ধরে আছে রোগীর আত্মীয়স্বজন। একটা সিটের জন্য হাহাকার। সিট্ না পেয়ে অনেকের কান্নাকাটি অবস্থা। কিছুক্ষন এর জন্য মনে হলো আমি এক অন্য পৃথিবীতে। আমার হাতে সময় বেশি নেই।
এর মধ্যেই একজন ব্রাদার আমাকে এমার্জেন্সি তে নিয়ে গেলেন। আমাকে বেডে শোয়ালেন।
"কিছু বলবেন ? "
"আমাকে কি এখন ICU তে নেওয়া হবে ? "
ব্রাদার হেসে বললেন - "চাইলেও পারবো না, জায়গা নাই , একজন যদি আজকে রাতে খোদা হাফেজ হয়ে যায়, তখন হয়তো জায়গা পেতে পারেন "
কঠিন এক অবস্থা। ভর্তির যাবতীয় ফর্মালিটিস শেষ। ১১ তলায়, একটা কেবিনে আমার জায়গা হলো। ক্যানুলা লাগানো হলো। টেস্টের জন্য রক্ত নেওয়া হলো। দুঃসংবাদ বাতাসের গতিতে ছড়ায়। আমার ক্ষেত্রে সেটি ছড়ালো আলোর গতিতে। ফোনের পর ফোন । হাতের একটা আঙ্গুল নাড়ানোর মতো শক্তি আমার ছিল না, কথা বলা তো দূরের কথা।
শুরু হলো আমার হাসপাতালের জীবন।
রাতে প্রচন্ড কাশি। সাথে ঘাম। শরীর প্রচন্ড দুর্বল। সকালে ঘুম ভেঙে দেখি সিস্টার ইনজেকশন, স্যালাইনে নিয়ে রেডি। যেহেতু ১৪ দিনের মধ্যে প্রথম ৭ দিন রিস্কি জোন এবং আমার শরীরে অবস্থাও খারাপ তাই ডাক্তার ছাড়তে চাইলেন না। ইন্টারেষ্টিং ব্যাপার হচ্ছে এই ৭ দিনের রিস্কি জোনের প্রথম ৫ দিন আমি কাটিয়ে ফেলেছি বাসায়। সকালে কোনো একরকম ভাবে সময় কেটে গেলেও, খারাপ লাগে রাতের বেলা। পুরো হাসপাতাল যেন হঠাৎ করেই চুপ মেরে যায়। চুপ মানে একদম চুপ। Pindrop Silence - পিনপতন নিস্তব্ধতা। হঠাৎ হঠাৎ আসে পাশের Cabin থেকে কাশির শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে যায়। একবার ঘুম ভেঙে গেলে চারপাশ অন্ধকার। এই অন্ধকার অন্যরকম। ঘুম ভেঙে গেলেই মনে হতো সারা পৃথিবীতে আমি একা বেঁচে আছি। আর কেউ নেই। ভয়াবহ এক অনুভূতি।
কোরোনা পরিস্থিতি কতটা খারাপ ছিল তার একটা ঘটনা বলি। আমার পাশে কেবিনে প্রথম শুনতাম পুরুষ লোকের কাশির শব্দ। পরবর্তীতে -এক ই কেবিনে শুনলাম পুরুষ এবং মহিলা কণ্ঠের কাশির শব্দ। তার একদিন পরে শুনি তিনজন মানুষের কথা বলার শব্দ। ঘটনা হচ্ছে এরকম - প্রথমে বাবা করোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন , তারপরে মা। বাবা এবং মা এর জন্য আলাদা Cabin পাওয়া যায় নি , তাই দুইজনে এক কেবিনেই জায়গা করা হয়েছে । তাদের দেখার কেউ নেই, সুতরাং সন্তানের আগমন। গভীর রাতে, এই দুইজনের কাশির শব্দে যখন আমার ঘুম ভেঙে যেত, আমার নিজের যতটা খারাপ লাগতো তার থেকে বেশি খারাপ লাগতো এই দুইজন বৃদ্ধ -বৃদ্ধার জন্য। যেই আমি - আমার শেষ ইচ্ছা -আমার বাবা মা কে শেষ স্পর্শ করা ছাড়াই হাসপাতালে চলে আসলাম, সেই আমি আবার দেখলাম -কিভাবে করোনা আক্রান্ত বাবা মার পাশে সন্তান এসে দাঁড়িয়েছে। জীবনের মায়া নেই, পৃথিবী একদিকে মা -বাবা একদিকে। আহারে জীবন !
আমি যেই ডাক্তার এর আন্ডারে ভর্তি হয়েছে সেই ডাক্তার এর নাম শুভ্র ঘোষ। প্রতিদিন রাত ১১ টায় উনি দলবলসহ নিয়ম করে দেখে যান। যেদিন আমাকে রিলিজ দিয়ে দিবে তার আগের দিন রাতের বেলা। শুভ্রা ঘোষ উনার ব্যাটালিয়ন ফোর্স নিয়ে হাজির। স্যাচুরেশন মাপলেন। মেপে দেখলেন মোটামুটি ১০০ এর কাছাকছি। আমাকে কানে কানে বললেন - "এতো বেশি স্যাচুরেশন দিয়ে কি করবেন , আশেপাশের কেবিনে কিছু দিয়ে দেন" ,বলেই হেসে চলে গেলেন।
কোরোনার এই কঠিন সময়েই শুভ্র ঘোষ আমাকে হাতে দিয়ে ছুঁয়ে দেখেছেন। হাত দিয়ে উনি ছুঁয়েছেন ঠিক -ই কিন্তু ডাক্তার জানেন না, এই স্পর্শ ওষুধের থেকেও ভালো কাজ করেছে। কি কারণ ? আক্রান্ত হবার ভয়ে সেই সময়ে, অনেক কাছের মানুষ -ই আমাকে হাসপাতালে দেখতে আসে নি। আমি নিজেও চাইতাম না তারা আসুক। নিজে ফিরে যেতে পারবো কি না সেই গ্যারান্টি নেই, অন্যদের আমার সাথে নিয়ে যাওয়ার কি দরকার ?
এই সবটা সময়ে আমার সাথে আমার স্ত্রী তানজিলা ছিল। একদিন সাহস করে বলেই ফেললাম।
"তোমাকে অনেক কঠিন একটা সময়ের মধ্যে ফেলে দিলাম"
"মোটেও না, আমি তো অনেক আরামে আছি"
"কেন ?"
"বুয়ার ঝামেলা নেই, বাসার কাজের ঝামেলা নেই, সাংসারিক কোনো ঝামেলা নেই। বাসায় থাকলে তো অনেক ঝামেলার মধ্যে থাকতে হতো। এখানে তো শুধু খাওয়া আর ঘুম। আমার আর কি কাজ ?"
ছোট্ট একটা মজার তথ্য দিয়ে রাখি, এই পুরোটা সময় যেহেতু তানজিলা আমার সাথে ছিল, ওর করোনা পজিটিভ থাকার কথা। যতবার -ই টেস্ট করিয়েছি সবসময়েই করোনা নেগেটিভ ছিল। ঘটনা অবিশ্বাস্য হলেও -সত্যি। আরেকটা কথা। ইম্পাল্স হাসপাতালের খাবার আসতো অন্য একটি হোটেল থেকে। সেই হোটেলের খাবার অতি উপাদেয়। বলতে লজ্জা নেই - আমি মনে মনে অপেক্ষা করতাম কখন লাঞ্চ এবং ডিনার টাইম আসবে। হয়তো রোগীর খাবার বলেই খাবারটা অনেক যত্ন নিয়ে তৈরী হতো।
বাঘে আঁচড় দিলে সেই ঘা শুকাতে সময় লাগে। করোনা নেগেটিভ হলেও আমি শারীরিক এবং মানসিকভাবে বেশ লম্বা সময় অসুস্থ ছিলাম। ছোট একটা উদাহরণ দেই। কোনো বদ্ধ জায়গায় (যেমন বাথরুমে) থাকতে আমার অনেক সাফোকেশন হতো ।
অপেক্ষায় আছি কোনো এক বৃষ্টিঝরা দুপুরে নাতি নাতনিদের নিয়ে খাওয়ার টেবিলে বসবো। গল্প করবো। করোনা নামের এক মহামারীর গল্প। হয়তো তারা বিশ্বাস করবে না। কিন্তু আমি তো জানি আমি মিথ্যা বলছি না।
মাসনুন আহমেদ
২৪ অক্টোবর ২০২৩
রাত ১২:০০ টা