“সেই রাতে আমার আর মূর্তজার মধ্যে ওইসব হয়ে গেল। ওইসব মানে আবার সবকিছু না। চুমুটমু আর কী! খুব শকিং ছিল এটা দুজনের জন্যই। মা বাবা আমাদের দুই বোনকে রেখে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিল। মূর্তজা ভাই সেটা না জেনেই আমাদের বাড়িতে এসেছিল সেদিন। পাশের পাড়ায় বাড়ি ওদের। পনের বিশ মিনিটের হাঁটাপথ। প্রায়ই আসত তখন। আমার সাথে মারামারি করত। আমি দুই চোখে ওকে দেখতে পারতাম না। সেদিন ও এসেছিল ঝড় মাথায় নিয়ে। বাড়িতে পা দিতেই তুমুল বেগে বাতাস ছাড়ল। অল্প দূরের পথে হলেও আর ফিরে যাওয়ার উপায় ছিল না ওর। তার উপর হলো লোডশেডিং, অন্ধকারের ভয়ে আমি ওকে যেতে দিলাম না। পিয়াশা ঘুমিয়ে কাদা। আমি কেবল পনেরো, মূর্তজা ভাই মনে হয় আঠারো পেরিয়েছে। মোম জ্বালিয়েছিলাম। টাইম পাস করতে লুডুর কোর্ট পেতেছিলাম। আমার জোড়াগুটি কেটে দিলো ও। আমি রেগে গিয়ে কোর্ট এলোমেলো করে দিলাম৷ মূর্তজা ভাই আমাকে ঠেসে কোর্টের উপর চেপে ধরল। আমি হাচড়পাচড় করে উঠতে চাইলাম। তারপর কী থেকে কী যেন হয়ে গেল। এখন পশ্চিমা দেশে বাস করে ওসব দেখে দেখে চোখ আর মন অভ্যস্ত হয়ে গেলেও তখন খুব লজ্জায় পড়ে গিয়েছিলাম দুজনেই। অপ্রস্তুত হয়ে পরদিনই আমরা কাজি অফিসে গিয়ে বিয়ে করে ফেললাম!
তারপর যে যার জায়গায়।
আমি বাড়িতে, মূর্তজা ভাই বিশ্ববিদ্যালয় হোস্টেলে।
আমরা আর কেউ কারো সাথে যোগাযোগ করলাম না।
পারিবারিক অনুষ্ঠানে কদাচিৎ দেখা হয়ে যেত। রাস্তাঘাটেও দেখা হয়ে পড়ত। এমন ভাব করতাম যেন দুজন দুজনে কস্মিনকালেও দেখিনি।
বিয়ের কাগজটা তখন দুজনের জন্যই বিরাট ছেলেমানুষী উদাহরণ হয়ে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে আছে মাথার উপর।
মূর্তজা ভাই পড়াশোনা আর রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
আর আমি পরিবারের সাথে আমেরিকায় চলে এলাম।”
মনে মনে ডায়েরি লিখল বিপাশা। মনে মনে ছাড়া এসব কথা কাউকে বলা যায় না। মনে মনে ডায়েরি লিখবার উপকারিতা হচ্ছে, কেউ জেনে ফেলার ভয় থাকে না। যা ইচ্ছা লেখা যায়। আর মনও হালকা হয়।
মস্ত বিমানের চাকাটা তখন মাটি ছুঁয়ে দিলো, রানওয়েতে ঘষা খেয়ে ঘুষঘুষে শব্দ তৈরি হলো, বিপাশার পেটের মাঝেও লক্ষ প্রজাপতির গুঞ্জন শুরু হলো!
বুকের মধ্যে গান বেজে উঠল, “ও আমার দেশের মাটি!”
এরাইভাল গেট থেকে বের হয়ে থমকে থাকল কিছুক্ষণ।
অচেনা লাগছে সবকিছু। পাঁচ বছরে একটা দেশ এত বদলে যায়?
ট্রলিব্যাগগুলো নিয়ে ট্যাক্সি খুঁজতে শুরু করার আগেই ওর নাম ধরে কেউ ডাকল,
—- “বিপাশা? এই বিপাশা ?”
“মূর্তজা ভাই!”
বিপাশা বিড়বিড় করল।
গায়ে সাদা রঙের টার্টল নেক সোয়েটার জড়িয়ে বিপাশার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ছে লম্বা ছেলেটা।
মুখে চাপদাড়ির জঙ্গল।
শেষবার ওকে দেখেছিল বিপশা, তখন ক্লিনশেভ করত ও৷
দাড়ি, গোঁফের জঙ্গল থেকে ওর উজ্জ্বল চোখদুটো সহজেই চিনে ফেলা যায়।
বিপাশা ট্রলি ব্যাগগুলো এগিয়ে দিতে দিতে বলল,
—- “আমি একাই চলে যেতে পারতাম! এই তো হোটেল!”
—- “আম্মা পাঠাল!”
—- “ওহ! খালামণি ভালো আছে?”
—- “হুম আছে!”
—- “আমি কেমন আছি, জানতে চাইলে না?”
—- “দেখতে তো ফাটাফাটি লাগছে! জার্নি কেমন ছিল?”
বিপাশাও ওর মতো করেই বলল ‘ফাটাফাটি!’
গাড়িতে বসতে বসতে বলল,
—- “গাড়িও কিনে ফেলেছ, বাহ!”
—- “কই গাড়ি কিনেছি? উবারের কার!”
—- “ওহ!”
আর কোনো কথা খুঁজে পেল না বিপাশা।
গাড়ি জ্যামের ভেতর সাতার কেটে ধীরে চলছে।
বিপাশা বলল,
—- “পাঁচ মিনিটের পথ কতকাল লাগাবে কে জানে। দেশের যানজটের যা সুনাম শুনেছি!”
—- “আধা ঘন্টাখানেক লাগবে! থাকবি কতদিন?”
—- “থাকব না। তোমার কাজটা করে দিয়েই চলে যাব! কতদিন লাগবে?”
—- “বেশিদিন লাগার কথা না। উকিলকে কাগজপত্র তৈরি করতে বলে দিয়েছি! তুই বিয়েটা এটেন্ড করে যেতে পারিস!”
কিশোরীর মতো খিলখিল করে হাসলো বিপাশা।
—- “বিয়ের মেন্যু কী? কাচ্চি? আমি রেডমীট ছেড়ে দিয়েছি। ভেগান হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। চিকেন ছেড়ে দিলেই পুরোপুরি শাকাহারী। চিকেন ছাড়তে পারছি না। এদিককার বিয়েতে তো রেডমীটই মেইন ডিশ!”
মুর্তজা চুপ করে গেল।
বিপাশা তাড়া দিলো,
—- “ঢাকার বিরিয়ানির সুনাম শুনেছি খুব। তুমি বরং আমাকে ভালো কোনো রেস্টুরেন্ট থেকে মোরগ পোলাও খাইয়ে দিও। আমি রাজ্যের কাজ ফেলে এসেছি। বিয়ে খাওয়ার দরকার হবে না! তুমি মুখ ঘুরিয়ে রেখেছ কেন? আমার দিকে তাকালে কি পাপ হবে? অবশ্য মেহনাজ অনেক সুন্দরী। ওকে দেখার পরে অন্য কোনো মেয়ের দিকে তাকানোটা গুণাহ! হিহিহি। তোমাদের পানচিনির ছবি দেখেছি। মাকে ফেসবুক পোস্টে ট্যাগ করেছিল খালামণি। খুব সুন্দর মানিয়েছে দুজনকে! কংগ্রাচুলেশনস!”
বিপাশার সাবলীল কথাবার্তায় মূর্তজাও সহজ হয়ে এলো। দশ বছর পরে এসে সেই ঘটনাটার কোনো রেশ থাকবার কথাও না। মূর্তজা শুধুশুধু লজ্জা পাচ্ছিল। ও বলল,
—- “হোটেলে উঠবি কেন? বাসা পরিস্কার করিয়ে রেখেছি আমি। বাসায় থাক?”
—- “নাহ। অল্প কয়েক দিনের মামলা। হোটেলেই ভালো!”
হোটেলের রুম পর্যন্ত বিপাশাকে পৌঁছে দিলো মূর্তজা।
বিপাশা দরজা খুলে ভেতরে যাওয়ার আগে পিছু ডাকল,
—- “মেহনাজ আর আমার এরেঞ্জ ম্যারেজ!”
বিপাশা এক পা এগিয়ে এলো,
—- “এরেঞ্জ ম্যারেজ কি এখন দেশে খুব রেয়ার কেস?”
—- “না। অহরহ হচ্ছে। আমি বলতে চাইছি…
—- “কী, বলো?”
—- “উহু, কিছু না!”
মূর্তজা চলে গেলে বিপাশা রুমে ঢুকল। গোসল করল। ইন্টারকমে কফি আর স্ন্যাকস অর্ডার করল। আমেরিকায় বাবা-মায়ের সাথে কথা বলল। ওর মা নাসরিন সাবধান করলেন,
—- ‘'একা একা ঘুমাতে পারবি?”
—- “চেষ্টা করে দেখি?”
—- “সব মনের ভয় রে, বিপু৷ ভূত বলে কিছু আছে নাকি?”
—- “এবারে একা ঘুমিয়ে যদি বেঁচে ফিরি, তাহলে একা একা ঘুমাব। ইটস আ প্রমিজ!”
—- “বাড়িতে গিয়েই থাকতে পারতিস। আমি মহসীনদেরকে বলতাম কাউকে তোর সাথে রাতে থাকতে দিতে। একা থাকতে হতো না!”
বিপাশা খিলখিল করে হাসলো,
—- “বললাম তো, টেনশন কোরো না। আমি এখন ঘুমিয়ে যাব। রাতে মুভি দেখব। তাহলেই হবে! ঘুমাতে হবে না, ভয়ও পাব না!”
—- “সারা রাত জেগে থাকবি? এটা কোনো কথা?”
—- ‘'মনে করব, আমি স্টেটসে আছি। ওখানের রাত এখানের দিন।”
বিপাশার ভূতের ভয় তীব্র। একা ঘুমাতে পারে না৷ রাতে কাউকে না কাউকে ওর সাথে থাকতেই হয়। কাউকে না পেলে ও বালিশ নিয়ে মায়ের কাছে শুতে আসে।
ভয় কাটাতে ও কিছুক্ষণ টিভি দেখল। তারপর ঘুমিয়ে পড়ল।
ওর ঘুম ভাঙল বেলের আওয়াজে। শুরুতে ভাবল রুম সার্ভিস। ঘড়িতে দেখল দশটা বাজে। এত রাতে রুম সার্ভিস নিশ্চয়ই হবে না। ও জানতে চাইল,
—- “কে?’’
—- “বিপাশা, খোল? আমি মূর্তজা!”
বিপাশা ড্রেসিং আয়নায় নিজেকে দেখল। অবিন্যস্ত চুল মাথা ছেড়ে কপালজুড়ে থাকতে বেশি সুখ পাচ্ছে। গায়ে টিশার্ট আর পাজামা। মুখ ফুলে আছে। ও বলল,
—- “এক মিনিট, অপেক্ষা করো, প্লিজ!”
— “আমি অপেক্ষা করছি…”
বিপাশা তড়িঘড়ি করে একটা কামিজ পরে ফেলল। আমেরিকায় যে পোশাকে ও স্বচ্ছন্দ, সেই পোশাকে দেশে একটা বাইরের লোকের সামনে যাওয়া যায় না। বাইরের লোক শব্দ দুটো নিয়ে ভাবল ও। মূর্তজা কি বাইরের লোক?
বেশি ভাববার অবকাশ নেই। ও মুখে পানি দিলো। লিপবাম ঘষল ঠোঁটে। চুলে ব্রাশ চালাল দ্রুতহাতে। একটা শাল টেনে বুকে কাঁধে জড়িয়ে দরজা খুলে দিলো,
—- “তুমি এত রাতে?”
—- “সকাল নয়টায় উকিল সময় দিয়েছে!”
—- “এখন রাত দশটা বাজে। এখন গিয়ে কি উকিলের চেম্বারে সিরিয়াল দিতে হবে?”
—- “আরে না। ভাবছি, জেটল্যাগ লেগে গেলে তুই যদি সকালে উঠতে না পারিস, রাতে আমি এখানে থাকি? সকালে তোকে নিয়ে একসাথে গেলাম!”
বিপাশা উত্তর দিতে পারল না। সিঙেল রুমের খাটটা বেশ বড়ো। কিন্তু এক ঘরে, এক বিছানায় ওরা কী করে থাকবে?
একবার তো এভাবেই ভুল হয়ে গিয়েছিল…
মূর্তজা যেন বুঝতে পারল বিপাশার মনের ভাবনা। হাত নেড়ে বলল,
—- “আমি ওই সোফাতে থাকতে পারব!”
বিপাশা কিছু বলল না। মূর্তজার তাগিদ বুঝতে পারল। বেচারার বিয়ে কয়েকটা দিন পরেই।
এখন কাগজের সম্পর্ক থেকে ছাড়পত্র না পেলে কীভাবে চলবে?
ডিভোর্সটা কালই হতে হবে!