
ফেসবুক ফটো ক্রিটিক
সোশাল মিডিয়া যখন ছিল না, তখন ফটোগ্রাফারের ছবি দেখতে হতো এক্সিবিশন, ফটোবুক বা পত্রিকায়। অনেক সময় ফটো-স্টুডিওতে, কিংবা কারো বাসায়-অফিসের দেওয়ালে টানানো থাকত আলোকচিত্র। সোশাল মিডিয়া পূর্ব যুগে আলোকচিত্র প্রদর্শন অবাধ ছিল না।
ইন্টারনেট আসার পর আলোকচিত্র প্রদর্শনের সব হিসাবনিকেশ পাল্টে যেতে শুরু করে। ফটোগ্রাফার তার নিজস্ব ওয়েবসাইটের মাধ্যমে তার কাজ দেখাতে পারে। তিনি তার কাজ সোশাল মিডিয়াতেও দেখাতে পারে। তবে সোশাল মিডিয়াই ধীরে ধীরে আলোকচিত্র প্রদর্শনের মূল জায়গা নিয়ে নিয়েছে, অন্তত বাংলাদেশে।
সোশাল মিডিয়াতে আলোকচিত্র স্থান নেওয়ার পর থেকে নতুন ক্রিটিকের জন্ম নেয়, এরা আমজনতা। তারা সোশাল মিডিয়া পূর্ব যুগে এক্সিবিশনে বা ফটোবুকে ছবি দেখত। তাদের রিভিউ প্রকাশ হতো। কিন্তু সেসব অনুচ্চারিত থেকে যেত। ফেইসবুকে/ইন্সটাতে তাদের মতামত আমরা ভাসতে দেখি।
আমজনতা ফেইসবুকে ফটোগ্রাফি সংক্রান্ত আলোচনা সমালোচনা জারি রাখার মধ্য দিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক ক্রিটিকদের সঙ্গে সঙ্গে নিজেরাও ক্রিটিক হয়ে উঠেন।
বিষয়টা এখান থেকেই নতুন মাত্রা পায়। যার যে পেশা না, সেও সেই বিষয়ে তার মতামত দিচ্ছে।
সোশাল মিডিয়াতে যখন কেউ আলোকচিত্র প্রদর্শন করছে, তখন সেই ছবি ফটোগ্রাফার ও ফটো ক্রিটিক শুধু নয় সব পেশার মানুষ দেখছে ও মতামত প্রকাশ করছে। বিভিন্ন মতামত মিলে একটা জগাখিচুড়ি অবস্থা তৈরি হচ্ছে। বিষয়টা এমন নয় যে শুধু ছবির বোদ্ধারা ছবি নিয়ে মতামত দিতে পারবে। তবে আম জনতার ছবিবিষয়ক মতামত সব সময় সঠিক নাও হতে পারে। আম জনতা পাঠান, জওয়ান, বাহুবলির মতো সিনেমা নিয়ে মাতামাতি করে বলেই কিন্তু এই সিনেমাগুলো মাস্টারপিস হয়ে যায় না। বরংচ সিনেমা বোদ্ধাদের কাছে এগুলো আবর্জনা ফিল্মও মনে হতে পারে।
আরও পড়ুন-ফটোগ্রাফি কম্পোজিশন ও তার দর্শন।
সোশাল মিডিয়াতে পাবলিক যেসব বেশি লাইক ও শেয়ার করে, সেসবকে ভাইরাল কন্টেন্ট বলা হচ্ছে। ফটোগ্রাফির ক্ষেত্রেও আমরা মাঝে মধ্যে ভাইরাল ফটো দেখতে পাই। ফেসবুকের অ্যালগরিদম এমন যে, কন্টেন্ট যত বেশি শেয়ার হবে তত বেশি ছড়াতে থাকবে এবং একসময় সেটি ভাইরাল বিশেষণ পাবে। এর সঙ্গে কাজ করে পিয়ার প্রেসার বা দলগত চাপ। মানে, একজনের দেখাদেখি অন্যজন যখন একই কাজ করে। যখন কোন কন্টেন্ট অনেকে শেয়ার করে, সেটা দেখে আরও অনেকে তা শেয়ার করে।
প্রশ্ন হলো- সব সময় কি ভাইরাল ফটো নান্দনিক ছবি? বা, একটা ছবি সোশাল মিডিয়াতে যে পরিমাণে শেয়ার হয়, ছবিটি কি ততটাই নান্দনিক ছবি?
ফেইসবুকে যে ফটো ক্রিটিক শ্রেণি তৈরি হয়েছে তারা ফটোগ্রাফি বিশেষজ্ঞ নয়। তারা যখন কোন ছবিকে লাইক শেয়ার দিয়ে ভাইরাল করে, সব সময় তাদের বিচার সঠিক নাও হতে পারে। যে ফটোগ্রাফারের আইডির রিচ যত বেশি তার ছবি তত বেশি লাইক কমেন্ট ও শেয়ার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। যে আইডির রিচ কম তার ভালো ছবিও ভাইরাল হওয়ার চান্স খুব একটা থাকে না।
ফটোগ্রাফি কম্পোজিশন ও তার দর্শন।
ভাইরাল ছবিকে আমরা বলতে পারি জনপ্রিয় ছবি। যা জনপ্রিয় তা কালোত্তীর্ণ হওয়ার সুযোগ থাকে। তবে সব জনপ্রিয় ছবি কালোত্তীর্ণ হবে এমনও না।
সোশাল মিডিয়া ও তার ভাইরাল সংস্কৃতির সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হচ্ছে, প্রতিষ্ঠানিক ক্রিটিকদের সঙ্গে সঙ্গে আমজনতার ক্রিটিক হয়ে উঠা, এতে ফটোগ্রাফি গণতান্ত্রিক হয়ে উঠে। দ্বিতীয়ত, সোশাল মিডিয়ায় আলোকচিত্রের সর্বোচ্চ প্রদর্শন হওয়া, অন্তত সোশাল মিডিয়া পূর্ব যুগের চেয়ে।
আবার নেতিবাচক দিক হচ্ছে, এই আম জনতার ক্রিটিককে নিয়ন্ত্রণ করার কেউ না থাকা। এর কারণে অনেক নান্দনিক ছবি যথেষ্ট মনোযোগ পায় না। কিন্তু কম নান্দনিক ছবি বেশি মনোযোগ পায়। ফেইসবুক আইডির রিচ ও এর অ্যালগরিদমের কারণে
সোশাল মিডিয়া যুগ, যে যুগ আমরা এখন পার করছি, এই সময়ে কোটি কোটি ছবি তৈরি হচ্ছে এবং প্রদর্শিত হচ্ছে। আমজনতা যে ছবিকে ভাইরাল করছেন সেটা বেশী ভিউয়ার পাচ্ছেন। আর আমজনতা যে ছবিকে কম মনোযোগ দিচ্ছেন সেসব ছবি আড়ালে থেকে যাচ্ছে।
আমজনতার এই ক্ষমতা অভূতপূর্ব, তবে ফটোগ্রাফারদের জন্য সবসময় কল্যাণকর নয়। কারণ যার মার্কেটিং স্কিল দুর্বল ও লাইফ এচিভমেনট লো, তার সোশাল মিডিয়া আইডি দুর্বল বাংলাদেশে। এই দুর্বল সোশাল মিডিয়া আইডি সবল একটা আইডির সঙ্গে সজজেই হেরে যায়। সেখানে আসলে এভাবে হার জিতের প্যারামিটার থাকার কথা নয়।
সোশাল মিডিয়া আইডি ফিজিক্যাল ব্যক্তির ছায়া, তবে মুলব্যক্তি নয়। কিন্তু একটা আইডির অপর সবসময় তাকে মুল বা সত্য বলে মেনে থাকে, যা আসলে সত্য নয়।
তবে একজন ফটোগ্রাফারের ছবি যখন ভাইরাল হয়, যেটা নান্দনিক ছবি। সে একটা উৎসাহ পায় যা তাকে নতুন আলোকচিত্র তৈরিতে সাহায্য করে। তবে সেই ছবি যদি যথেষ্ট নান্দনিক নয় কিন্তু সোশাল মিডিয়ার ইউজাররা তাকে ভাইরাল করে, তাহলে সব চেয়ে ক্ষতি হয় আলোকচিত্রীর। কারণ তিনি একটা ভুল বার্তা পেলেন সোশাল মিডিয়া থেকে, যা তার ভবিষ্যৎ ছবি তৈরিতে বাধাগ্রস্ত করে।
সাইদ সুমন