চট্টলে এলাম বছর চারেক পর। মিথ্যে বলছি না, মধ্যখানে এক ঝাঁপটা এসেছিলাম, তা মাত্র দিন দু'টির জন্যে। যে শহরে আমার বেঁড়ে উঠা, ধূলোয়-পাতায় শৈশব-কৈশরের পদচিহ্ন আঁকা; সেখানে ঝটিকা আসাকে আমি আসবার কায়দায় ফেলি না। সে যাকগে! ভিন্ন কথায় ফিরি। চট্টলে এসে দেখি আমার বহুদিনের একটি ইচ্ছে পূরণ হয়েছে। অপছন্দের সাবেক বাসাটি পরিবর্তন করে নতুন বাসায় উঠেছি আমরা, ডিসি রোড-চকবাজারে। এখান থেকে চকবাজার,চট্টেশ্বরী, প্যারেড কর্ণার, আন্দরকিল্লা, চেরাগি পাহাড় এবং জামালখান এককথায় চট্টল মহানগরীর পছন্দের সবগুলো জায়গা একবারে হাতের নাগালে। খুশির বান নেমে এলো মনে।
প্রথম দু'দিন ছোট্টু নিয়ে বড্ড ঘুরে বেড়ালাম; বাতিঘর, লালদিঘি, আন্দরকিল্লা, নন্দনকানন আর চকাবাজারের অলি-গলি। মাধ্যমিকের দিনগুলোতে ফিরে গেলাম, চকবাজার ছিলো তখন আমার স্বপ্নের নগরী! সকাল-বিকাল ছক্কড় মার্কা গাড়িগুলোতে চেঁপে চলে আসতাম কোচিং আর বন্ধুদের টানে। আজকাল কেউ কোথাও নেই, তবু অলি-গলি ঘুরে পুরনো দিনগুলোকে খুঁজি কালের অরণ্যে। বেলা বিকেলে ছুট্টুকে নিয়ে হাঁটতে বেরুলাম, চট্টেশ্বরী রোডে; তিন পাহাড়ের সন্ধিক্ষণে রোড অবস্থান। পাহাড় কেটে এখানটায় শহুরে আদল তৈরী। এতে প্রকৃতির অঙ্গহানি হয়েছে বটে নগরীর বৈচিত্র্যও ভালোই বৃদ্ধি পেয়েছে। শান্ত-পিচ ঢালা সড়ক ঢেউ খেলানো কিংবা ছুটন্ত সর্পের মতো এঁকেবেঁকে উঁচু হতে ক্রমশঃ নিচু হয়ে নেমে গেছে শহরের প্রাণকেন্দ্রে। চট্টগাম কলেজ, মহসিন কলেজ, মিসকিন শাহ মাজার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটও এবং চট্টেশরী কালি মন্দির সব এর কোল ঘেষে অবস্থিত। আরো আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত বিখ্যাত রণ সমাধিক্ষেত্র। চট্টেশ্বরী রোড়ের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে পাহাড়ি রাস্তার কিছুটা ঢালু আর কিছুটা সমতল ভূমিতে গড়ে উঠেছে এই রণ সমাধি। সম্পূর্ণ সমাধিক্ষেত্র এলাকার পরিবেশ একই সাথে মনোরম, গুরুগম্ভীর এবং শান্ত। রণ সমাধীতে প্রবেশপথের মূল ফটক থেকে সামান্য পথ হেঁটে গেলেই চোখে পড়ে লাল ইটের গাঁথুনির দুটি ছোট গির্জা ও মেটাল গেট, ভেতরে সর্বমোট ৭৩১টি সমাধি সারি সারি। সবুজ প্রকৃতির কোলে খৃষ্টিয়ান রীতিতে গড়া সমাধিগুলো শুয়ে আছেন ইঙ্গ-বার্মা যুদ্ধে নিহত যোদ্ধারা। সমাধিগুলো যেন ইতিহাসের জিবন্ত শিলালিপি, কাছে গেলে নিরব প্রকৃতিতে আনমনে কানে ভেসে আসে সম্রাজ্যবাদীদের সেই যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলার প্রলয় ধ্বনি আর হতাহতদের করুন আর্তনাদ।
বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা আঁধার ছুঁইছুঁই করতেই ফেরার পথে পা বাড়ালাম। বাদশা মিয়া রোড আর চট্টেশরী রোডের তেমোহনা। যেখানটায় তারপাশে কিছু চায়ের দোকান; চা হাতে নিয়ে তেমোহনার দিকে ঘুরে বসলাম। চায়ের ধোঁয়া, সান্ধ্য আলো-আঁধারী আর কাঁটা পাহাড় হতে ক্রমশঃ ঢালু রাস্তার ধূসরতায় মিশ্র ভৌতিক আবহ তৈরী করলো। মনে পড়নলো ছেলেবেলার সহপাঠী তামিমের কথা, যার কথায় এই চট্টেশ্বরী সর্বদা চর্চিত ছিলো; কখনো চট্টেশ্বরীর অপরূপ সৌন্দর্য্য, কখনো আবার লোমহর্ষক নানা ঘটনার বিবরণীতে।
ক্লাস ফাইভ পেরিয়ে সিক্সে উঠেছি সবেমাত্র। আমি একটি ভিন্নধর্মী প্রতিষ্ঠান পড়ছিলাম, যার অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিলো প্রতিবছরই অনেক সহপাঠী চলে যেতো এবং নতুন কিছু যুক্ত হতো। ফলে, প্রতি শিক্ষাবর্ষের শুরুতেই পুরোনো বন্ধুদের কাকে কাকে হারালাম এবং নতুন কে যুক্ত হলো, তা নিজে আমরা প্রচন্ডভাবে উত্তেজিত থাকতাম।
গল্পে ফিরছি! বছরের গোঁড়াভাগে নতুন এক সহপাঠীর আগমন ঘটলো। ফর্সা লম্বাটে ছেলেটির বাবার পুলিশে চাকরী করতো। পুলিশের ছেলে! আমাদের সে ছিলো বিশেষ কৌতুহলের বস্তু এবং গল্পের হাঁড়ি। প্রতিদিনই তাঁর কাছে নিত্য নতুন গল্প, ঘটনা পুলিশি কেস শুনতাম। বন্ধুটির বাসা ছিলো চট্টেশ্বরীর কাছাকাছি কোথাও। তাঁর বর্ণনায় তৎকালীন চট্টেশ্বরীর ভয়াল সন্ধ্যা-রজনীর দৃশ্য ফুটে উঠতো।
২০০৪-৫ এর কথা! সন্ধ্যা নামলে চট্টেশ্বরী তখন ত্রাসের আখড়ায় পরিনত হতো। কাটা পাহাড়ের মধ্য দিয়ে দুই দিক থেকে নেমে আসা রাস্তা দু'টিতে বিকেল নাগাদ চলাচল বন্ধ হয়ে যেতো। ভুলক্রমে কেউ গেলেই হতাহত বা নিঃস্ব হয়ে ফেরতো। মধ্যযুগের বিখ্যাত ঠ্যাঙ্গারেদের নব্য উপনিবেশে পরিনত হয়েছিলো এই সুন্দর অংশটুকু। তৎকালে চট্টেশ্বরীর পাহাড়, বায়জিদের পাহাড়, ফটিকছড়ি সহ নানা গহীন পাহাড়গুলোতে ত্রাসের রাজত্ব ছিলো। শহরে অপহরন, ছেলেধরা, নিখোঁজ এবং মুক্তিপণ অতিপরিচিত শব্দ ছিলো। শহর থেকে প্রায় নিখোঁজ ব্যাক্তিদের লাশ মিলতো দুর পাহাড়ে, অনেকের আবার তাও মিলতো না।
প্রতি সাপ্তাহে তামিম বাসায় যেতো। এক সাপ্তাহে তামিম প্রচন্ড আতঙ্ক নিয়ে ফিরলো। জিগ্যেস করতেই জানলাম, তার পাশের বাসার বন্ধু সাদিমকে পাওয়া যাচ্ছে না। সাদিম তার মায়ের একমাত্র সন্তান! বাড়ি নোয়াখালীর হাতিয়া, বাবা নেই; মা-ছেলে পারিবারিক কোন কারনে হাতিয়া ছেড়ে এখানে বাস করছেন। তারপর সাদিমকে তীব্র খোঁজাখুঁজি শুরু হলো! তামিমের কাছ থেকে মাঝে মাঝেই নানা আপডেট পাওয়ার চেষ্টা করি। সাদিমের মা হন্য হয়ে তাকে খুঁজছে, থানা-পুলিশ দৌড়ে একাকার! অথচ কোন সন্ধান নেই। পরে অপরিচিত নাম্বার থেকে মুক্তিপণ চেয়ে ফোন এলো। তার মা এবং প্রশাসন থেকে বারবার দেন-দরবার চললো যাতে তাকে মুক্ত করা যায়। মুক্তির শর্তে বেশ কিছু টাকা আগামও প্রদান করা হলো।হপ্তা দু-এক পর! তামিম নতুন খবর দিলো। তার বন্ধু সাদিমের খন্ডিত লাশ পাওয়া গিয়েছে চট্টেশ্বরীর কাছের কোন একটি পাহাড়ে। বাসার অনতিদূরের পাহাড়টিতে একঝাক চিল-শকুন উড়ো উড়ি করছিলো দু'দিন ধরে। আশপাশের সম্ভাব্য সকল স্থানে না পেয়ে এবং একটি অনুরূপ পূর্বঘটনায় বিভৎস কিছু আঁচ পেয়ে পুলিশ ও স্থানীয় লোকজন সেদিকে সার্চ চালায়, কাপড়ে বাঁধা এসিডদগ্ধ লাশের খন্ড খন্ড অংশ মিললো, ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা। তামিমের বাবাও সেই সার্চ অভিযানে ছিলেন। পাহাড়ের বেশ কটি স্থান থেকে উদ্বার করা ভিন্ন-বিচ্ছিন্ন লাশ ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে পরিচয় নিশ্চিত করা হয়েছিলো, কারণ এসিডদগ্ধ করে মুখমণ্ডল ও শরীরের নানা অংশ বিকৃত করে দেয়া হয়েছিলো। সাদিমের মা কাঁদতে কাঁদতে শহর ছাড়লেন। তামিম একদিন কানে কানে বললো সাদিমের বাবাকেও দুর্বৃত্তরা ঠিক একই কায়দায় বছর দশেক আগে হত্যা ও গুম করা হয়েছিলো হাতিয়ায়। সম্পত্তি ও স্থানীয় ক্ষমতার দ্বন্দ্বের বলি তারা। সাদিমকে তারা ফেরত দিতে চায় নি, কারন পূর্ব-আক্রোশবসত: তাকে মুক্তিপণ হাতে পাওয়ার আগেই তাকে হত্যা করা হয়েছিলো অধিকন্তু সাদিমও ঘটনায় যুক্ত লোকদের কাউকে চিনে ফেলেছিলো, ফলে তার ফেরার সৌভাগ্য হয় নি সাদিমের।
সময়ের ঘনঘটায় সেই শিক্ষাবর্ষ শেষ হলো। তামিম আমাদের সাথে আর পরবর্তী ক্লাসে আসে নি, ভিন্ন কোথাও ভর্তি হয়েছিলো। তার বয়ানে নানা রহস্যময় এবং লোমহর্ষক গল্প শোনা বন্ধ হয়ে গেলো। কিন্তু চট্টেশ্বরীর সেই গল্প মন থেকে কখনো মোছে নি। উচ্চ মাধ্যমিকের দিনগুলোতেও এদিকে আসা হয় নি। ভার্সিটি ভ্যাকেশনে বন্ধু আবদুল্লাহের সাথে প্রায়ই আসা হতো চট্টেশ্বরীতে, পাশের রণ-সমাধি এবং সংলগ্ন চবির চারুকলায়। ততদিনে চট্টেশ্বরী অনেক উন্নত এবং নিরাপদ হয়েছিলো। তবে, এখনো দিনের সৌন্দর্য চট্টেশ্বরীকে মোহনীয় করে তুললেও রাতে এটি চলাচলের জন্য কিছুটা অনিরাপদ। এখানে, কাটা পাহাড়ের ঢালে নির্মিত স্থাপনাসমূহে যেমন নয়নাভিরাম সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে, ঠিক তেমনি চাপা-আর্তনাদও লুকিয়ে আছে নানা অতীত ঘনঘটার। ঠিক যেন রহস্যের জটে ভরে আছে চট্টেশ্বরীর কাটা পাহাড়ে জেগে থাকা বটের দাঁড়িগুলোয়, আর আছে আমার সেই অবেলার নস্টালজিয়া; আর আছে আমার সেই অবেলার নস্টালজিয়া।