পোস্টস

গল্প

শ্রাবণ সন্ধ্যায়

১৭ মে ২০২৪

নাজমুন নাহার নূপুর

মূল লেখক নাজমুন নাহার নূপুর

শ্রাবণ  মাসের অসহ্য গরম। ক্লান্ত রিমু অফিস থেকে দৌড়ে বের হয়ে আসে,  বাসটা না মিস হয়ে যায়।
 বেশিরভাগ সময়, বস একদম শেষবেলা একটা কাগজ হাতে দিয়ে বলবে, যান দ্রুত কাজটা করে আসেন। তাদের তো কোন অসুবিধা হয় না। নিজেদের গাড়ি আছে, বাড়ি আছে, পিয়ন-বুয়া-দারোয়ান সব আছে। অফিস ছাড়া দুনিয়াবি কোন চিন্তাই করতে হয়। যত চিন্তা করতে হয় তাদের মতো ছা-পোষা চাকরিজীবীদের। ঘরের চিন্তা, পরের চিন্তা,  অফিসের ভাবনা সব একাই সামলাতে হয়। রাগে গজগজ করতে করতে বেরিয়ে এসে দেখে বাসটা ছেড়ে দিয়েছে আর চলাও শুরু করেছে। হাত ঘড়িতে সময় পাঁচটা পঁচিশ মিনিট । যদিও স্টাফ বাস এত দেরি করে না তবুও আজ কোন কারণে হয়তো দেরি হয়েছে। একটা ফোন দিলে দাঁড়াতে পারে আর সেও যেতে পারবে। ব্যাগের পকেটে মোবাইলটা হাতড়াতে হাতড়াতে সামনে এগুতে থাকে রিমু। 
রাস্তার এধারে ওধারে দুপুরের বৃষ্টিতে জমে থাকা পানি। 
অন্যমনস্ক রিমু না দেখেই হঠাৎই কাঁদা পানিতে পা হড়কে পড়ে যায়। পাজামাসহ জামার পিছনের অংশে কাদাপানিতে ছড়াছড়ি।  রিমুর বুক ফেটে কান্না আসে। বাসটাও চলে গিয়েছে। এমন বেখাপ্পা অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতেও লজ্জা লাগছে।  
ইতস্তত ভাবতেই একটা হোন্ডার হর্ণ কানে আসে। হোন্ডাটা পাশে এসে দাঁড়ায়।  হেলমেটটা খুলতেই ছেলেটাকে চিনতে পারে রিমু। আগেও দেখেছে কয়েকবার, কিন্তু ভালো করে খেয়াল করা হয় নি। অফিসের কাছেই সম্ভবত তার বাসা। মাঝেমধ্যেই অফিসের শেষ মাথায় আড্ডা দিতে দেখে।  ছেলেটা রিমুকে বাসায় পৌঁছে দিবে বলতেই আগপাছ না ভেবেই রিমু উঠে বসে। ব্যাগটা বুকে নিয়ে কাদাপানি জামটা সামলে ধীরলয়ে হোন্ডায় বসে সে। বসতেই নিজের বুকের ভেতর ধুকপুক শব্দ শুনতে পায়। অদ্ভুত অনুভূতি হয়। 
মেঘ কালো আকাশে আঁধার ঘনিয়ে আসে। হোন্ডাটাও দ্রুত চলতে শুরু করে। সাতরাস্তা পার হয়ে বিজয়স্মরণী রোড হয়ে শ্যামলী । খানাখন্দভরা শ্যামলীর পরের রোডটুকুতে নিজেকে সামলে রাখার জন্য ছেলেটার কাঁধে হাত রাখে রিমু। ঘাড়ের নিচে কোকড়ানো একরাশ চুলের গুচ্ছ যেন অপলক দৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে আছে।  রিমুর মনটা টনটন করে। ছোটবেলার বন্ধু রিফাতের কথা মনে হয়। রিফাতেরও এমন কোকড়ানো চুল ছিল আর ঘাড়ে একটা কালো তিল। তার বাবা সরকারি চাকরি করত, তাই বছর কয়েক পরপরই  বিভিন্ন স্থানে পোস্টিং হত এবং পরিবার নিয়ে সেখানেই চলে যেত। তিন বছর তাদের গ্রামে ছিল, রিফাতের সাথে সেসময় ভালোই বন্ধুত্ব হয়েছিল। কত কথা ছিল তাদের, গল্প ফুরাত না। কিন্তু হঠাৎ বদলির অর্ড়ার হওয়ায় রিফাত আর ওর পরিবার শহরে চলে যায়। এরপর আর তাদের কোন খোঁজ পায়নি রিমা। কোন মোবাইল নম্বর বা ফোন নম্বর, ঠিকানা কিছুই জানা ছিল না।  কতদিন যোগাযোগ নেই কিন্তু এখনো মনের কোণে তার বেদনা ঠিকই অনুভব করে সে। ফেসবুকে, ইন্সট্রাগ্রামে কত খুঁজেছে কিন্তু রিফাতকে খুঁজে পায় নি। 
গাড়ির হর্ণ শুনে রিমু বাস্তবে ফিরে আসে। আরেহ, তাদের বাসায় যাওয়ার গলিটা পেরিয়ে এসেছে। সামনেই খোলা মাঠ। এখন আবার মাঠ ঘুরে খানাখন্দ পেরিয়ে বাসায় যেতে হবে। সেপথে হোন্ডা গেলে কাদায় মাখামাখি হবে। ছেলেটা এতদূর নিয়ে আসলো, খামোখা আর তাকে এত কষ্ট দেওয়ার মানে হয় না।  এই ভাবনা থেকেই সে ছেলেটাকে দাঁড়াতে বলে। ছেলেটা মাঠের পাশে হোন্ডা দাঁড় করায়, হেলমেটটা খোলে, রিমু কালো তিলটা দেখে থমকে দাঁড়ায়। শরীরটা অবশ লাগে। অদ্ভুত শিহরণে আচ্ছন্ন হয় মন। চোখে নেশা লাগে, রিফাতের অবয়বটা ভেসে উঠে। 
 হঠাৎ আকাশ ভাংগা ঝরঝরে মুক্তোদানা পড়তে থাকে। মূহুর্তেই চারপাশ অন্ধকার হয়ে যায়, বিদ্যুৎ চমকায়, বাজ পড়ে। ছেলেটা মেয়েটার হাত ধরে, বকুলে গাছের নিচে দাঁড়ায়। বৃষ্টি পড়ে, সাথে বকুল ফুল ঝরে পড়ে তাদের মাথার উপর। ছেলেটার ঠোঁট রিমুর কান ছোঁয়ায়, তপ্ত নি:শ্বাসের সাথে ভেসে আসে একটা নাম, একটা শব্দ 'মিতা'। রিমু ঠিক শুনতে পায়, এই নামে শুধু একজনই ডাকত, সে রিফাত। গল্পের ছলে একদিন বলেছিল 'মিতা' তার খুব প্রিয় নাম। এরপর যখনই দুজনে একসাথে খেলাধুলা করত তখন একে অপরকে মিতা বলে ডাকত। এই মিতা নামটি রিফাত ছাড়া কেউ জানে না। 
দমকা হাওয়া বয়, বিদ্যুৎ চমকায়, মুখে আলো পড়ে। রিমু অচেনা ছেলেটার বুকে মাথা রাখে। না ছেলেটা অচেনা কেউ নয়, তার সবচেয়ে চেনা মানুষ, রিফাত। যাকে সে এতদিন মনেমনে ভালোবেসেছে,  খুঁজে এসেছে। খুশিতে রিমুর চোখে জল আসে। শ্রাবণ বৃষ্টির ধারায় চোখের জল মিশে যায় প্রকৃতির মাঝে। শক্ত করে দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে যেন কেউ কোন দিন আর হারিয়ে না যায়। দূর থেকে ভেসে আসে 
 'এ শ্রাবণ সন্ধ্যায়,
আমার উদাসী মন চায় আরও কাছে যেতে
তুমি এসো মেয়ে।।
আমি জনম জনম তোমারই ছিলাম
জনম জনম তোমারই রইব
প্রসন্ন বা বিষন্ন কণ্ঠে 
ভালোবাসি বলে যাব......