Posts

গল্প

কুয়াশার অন্তরালে

January 13, 2025

Abdullah Al Siam

30
View

কুড়িগ্রামের শীতের রাত। কুয়াশা এত ঘন যে মনে হয়, এক চাদর চারদিকে মেলে দিয়েছে। বাতাসে ভেজা মাটি আর কাঠ পোড়ার গন্ধ। মাটির প্রদীপের ক্ষীণ আলো ঝাপসা হয়ে যায় সেই কুয়াশার ভিতর।

রংপুর থেকে স্কুলশিক্ষক আমজাদ এসেছেন কুড়িগ্রামের এক গ্রামে, তার চাচাতো ভাই রশীদের সঙ্গে দেখা করতে। রশীদ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, এক দুর্লভ বাংলা লোকগল্পের বই দেবে। গ্রামের বাইরে, গভীর জঙ্গলের কাছাকাছি রশীদের বাড়ি। রশীদের দেওয়া পথনির্দেশনা অমান্য করে আমজাদ শর্টকাট নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। আত্মবিশ্বাসী তিনি, পথ চিনে নিতে পারবেন।

জঙ্গল গভীর আর স্তব্ধ। মাঝে মাঝে শুকনো পাতার মচমচ শব্দ ছাড়া কোনো শব্দ নেই। আমজাদ শীতের চাদর ভালো করে জড়িয়ে নিলেন। কুয়াশা আরও ঘন হলো। ছায়াগুলো কেমন যেন চোখে ধোঁকা দেয়। একাধিকবার মনে হলো কেউ তাকে অনুসরণ করছে। নিজেকে সাহস দিয়ে বললেন, "মনগড়া ব্যাপার।"

অনেকক্ষণ হাঁটার পর, তিনি পৌঁছালেন এক পুরনো বটগাছের কাছে। গাছের শিকড়গুলো যেন মাটির বুক চিরে বেরিয়ে আসা হাড়ের মতো। শিকড়ের পাশে এক বৃদ্ধ বসে আছে। তার গায়ে জীর্ণ চাদর, হাতে এক মাটির চুরুট। কুয়াশার মধ্যে তার মুখ স্পষ্ট দেখা যায় না।

“হারিয়ে গেছ, তাই তো?” বৃদ্ধ বলল, মাথা না তুলে।

আমজাদ একটু থমকে গেলেন। “রশীদের বাড়ির পথ খুঁজছি। খুব বেশি দূরে নয়।”

বৃদ্ধ হেসে উঠল। তার হাসি কেমন যেন কানে কাঁপুনি ধরায়। “পথ অদ্ভুত এদিকে। বাঁক নেয়, ঘুরে যায়। তুমি তোমার রশীদকে পাবে, নাকি… অন্য কাউকে?”

আমজাদের বুকের ভেতর অস্বস্তি জমে উঠল। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি রশীদকে চেনেন?”

বৃদ্ধ কোনো উত্তর দিল না। শুধু আঙুল তুলে এক সরু পথে দেখাল। “এই পথ ধরে যাও। ঠিক পৌঁছাবে।”

আমজাদ সন্দেহ সত্ত্বেও পথ ধরলেন। কিন্তু হাঁটতে হাঁটতে তিনি বুঝলেন, কুয়াশা যেন আরও ঘন হচ্ছে। চারপাশের গাছগুলো আরও কাছে এসে যাচ্ছে। তার কানে কেমন ফিসফিস আওয়াজ আসছে। শব্দগুলো যেন গাছের ফাঁক থেকে ভেসে আসছে।

একসময় পথ শেষ হলো। সামনে একটি পরিত্যক্ত বাড়ি। দেয়ালগুলো ফাটল ধরা, মসজদে ঢাকা। জানালাগুলো অন্ধকার। যেন ঠান্ডা হাওয়া চারপাশে জমে আছে।

আমজাদ দ্বিধায় পড়ে গেলেন। ভাবলেন, এটাই হয়তো রশীদের বাড়ি। সাহস করে দরজায় ঠকঠক করলেন। দরজা খুলে গেল, আপনা-আপনি। ভেতরে একটি মিটমিটে লণ্ঠনের আলো। তার আলোয় দীর্ঘ ছায়া নড়তে থাকে দেয়ালে।

“রশীদ? তুমি আছো?” আমজাদ ডাকলেন। তার গলা কাঁপছিল।

কেউ উত্তর দিল না। হঠাৎ দরজাটি ভীষণ শব্দে বন্ধ হয়ে গেল। ঘরের ভেতর ফিসফিসানি বেড়ে গেল। শব্দগুলো যেন ঘুরে ঘুরে তার চারপাশে বাজছে। তিনি চারদিকে তাকালেন, কিন্তু দরজার জায়গায় এখন একটি শক্ত দেয়াল।

“রশীদ! তুমি কি আছো?”

লণ্ঠনের আলো একবার ঝাঁকি খেয়ে প্রায় নিভে গেল। এবং তখনই তিনি তাদের দেখলেন। ঘরের দেয়াল থেকে বেরিয়ে আসছে pale আর ছায়াময় কিছু অবয়ব। তাদের চোখ ফাঁকা, গভীর শূন্যতায় ভরা। মুখগুলো হা করে আছে, কিন্তু কোনো শব্দ বেরোচ্ছে না।

একটি অবয়ব তার কাছে এগিয়ে এলো। তার হাতটা যেন বাতাসের মধ্য দিয়ে বাড়িয়ে দিল। আর সেই চোখে আমজাদ দেখলেন একাধিক চেনা মুখ—তার চাচাতো ভাই রশীদ, বটগাছের সেই বৃদ্ধ, এবং সবচেয়ে ভয়ংকরভাবে, নিজের মুখ।

সবকিছু ঘোর অন্ধকার হয়ে গেল।

পরদিন সকালে রশীদ খুঁজে পেলো আমজাদের চাদর, পুরনো সেই বটগাছের শিকড়ের কাছে। গ্রামবাসীরা বলল, "জঙ্গলের অভিশাপ, এখানে গেলে কেউ ফিরে আসে না।" রশীদ বিশ্বাস করত না এইসব গল্প—যতক্ষণ না এক শীতের রাতে নিজেই শুনল সেই ফিসফিসানি, তার নিজের দোরগোড়ায়।

Comments

    Please login to post comment. Login