🍂 নীরার দুঃস্বপ্ন 🍂

হঠাৎ খুব ভয় পেয়ে ঘুম ভাঙ্গে নীরার; কিছুক্ষন বসে থেকে কি জানো ভাবছে নীরা। বেশ কয়েকদিন হলো নীরা কেমন জানি উলট পালট স্বপ্ন দেখছে। আগের স্বপ্নগুলো ভয়ঙ্কর ছিলো না কিন্তুু ইদানিং সে প্রতিরাতে অথবা সকালে স্বপ্নে ভয় পাচ্ছে; নীরা খুব ঘামছে। ধীরে ধীরে সে সব স্বপ্ন গুলো বুঝে উঠতে পারছে। হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ায় নীরার পাশে শুয়ে থাকা নীরার হাসবেন্ড অনীল জেগে উঠে। কী হয়েছে নীরা.?

নীরা প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে বসে থাকে। অনীল পেশায় একজন সরকারি চাকরিজীবী, খুব সকালেই তাকে অফিসে যেতে হয় আবার রাতে এসে সে বিশ্রাম ছাড়া আর কিছু চিন্তা করে না। তাই নীরার উত্তরের আশায় বসে না থেকে অনীল আবার ঘুমিয়ে যায়। 
এদিকে নীরা ভাবতে থাকে,

 যে অতীত থেকে সে অনেক আগেই দুরে সরে এসেছে, সে অতীত এখন দুঃস্বপ্ন হয়ে তাকে খুব জ্বালাতন করছে। এমনিতেই নীরা সারাদিন সাংসারিক কাজে ব্যস্ত থাকে, তারওপর তার ছোট্ট একটা বাচ্চা আছে তাকেও সামলাতে হয়। এখন প্রতিরাতেই তার ঘুম হয় না। দিনের বেলাও সে কাজে ঠিকমত মনোযোগ দিতে পারছে না। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে নীরা আবার ঘুমিয়ে যায়। সকালে ঘুম ভেঙ্গে দেখে অনীল অফিসে যাবার জন্য তৈরী হয়ে গেছে। নীরা অনেকটা ভীত হয়ে বললো, অনীল আমাকে ডাকলে না যে.? অনীল নীরার কথার জবাব না দিয়েই নীরাকে বললো অফিসে যাচ্ছি নীরা, আজ আসতে দেরি হবে। নীরা বললো তুমি সকালে খাবে না.?

অনীল বললো এখন খাবার সময় নেই, বাহিরে খেয়ে নিবো। এই বলে অনীল চলে গেলো। নীরা খুব ভয়ে আছে কারণ আজ তার ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেছে, তাই অনীল না খেয়ে অফিসে গেছে। ঘরে নীরার শ্বাশুড়ি নিশ্চই নীরার সাথে আজ রাগারাগি করবেন। নীরা অনেকটা ভয়ে ভয়ে সকালের নাস্তা নিয়ে শ্বাশুড়ির ঘরে গেলো, শ্বাশুড়ি মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। নীরা ঘরে ঢোকার পর তাকে প্রশ্ন করছে, অনীল না খেয়ে অফিসে গেছে.? নীরা বললো জ্বী আম্মা। কেনো অনীল না খেয়ে গেছে নীরা.? নীরা প্রতিউত্তরে বললো আম্মা আমার আজকে ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরি হয়ে গেছে। নীরার শ্বাশুড়ি অনেকটা মুখ কালো করে বলছেন এটা নতুন কিছু নয়। তুমি বাবার বাড়িতে দেরি করে উঠো কোনো সমস্যা নেই, কিন্তুু এ বাড়িতে তোমার জন্য আমার ছেলে না খেয়ে অফিস করবে তা আমি মেনে নিবো না। নীরা মাথা নিচু করে বলে জ্বি আম্মা। আড়াই বছর হয়েছে নীরার বিয়ে হয়েছে, কিন্তুু এ বাড়িতে এ সংসারে নীরার তেমন কোনো মূল্য নেই। কাপড়-চোপড়, খাওয়া দাওয়ায় নীরার কোনো কষ্ট নেই। কিন্তুু এ আড়াই বছরে মাত্র একবার সে বাবার বাড়িতে গিয়েছে, অনীল কোথাও ঘুড়তে যেতে তেমন পছন্দ করে না, তাই নীরার আনন্দ বা সুখের দিন গুলো অতীতের দেয়ালেই বন্ধী থেকে যায়। অনীল এমনিতে ভালো, কিন্তুু অনীলের অনেক রাগ তাই নীরা অনীলের সাথে কথা বলে ভয়ে ভয়ে। এইতো গত বছরেই অনীল নীরার উপর হাত তুলেছিলো সামান্য একটা ভুলের জন্য। 
আড়াই বছর আগে নীরার বাবা-মা অনেক ভালো ভালো সমন্ধ খুঁজে নীরার জন্য এই পরিবারে সম্পর্ক ঠিক করে। নীরা অনেকটা ভয়ে ভয়ে পরিবারের কাছে বলেছিলো সে একজনকে পছন্দ করে, কিন্তুু নীরার বাবা তার পছন্দকে এতটুকু মূল্যায়ন করেন নি, বরং বলেছেন;

যে পরিবারের কাছে তোমাকে বিয়ে দিচ্ছি, সে ছেলে অনেক ভালো চাকরী করে এবং ছোট পরিবার, তুমি সেখানে সুখে থাকবে। বাবা-মা সন্তানের সুখের জন্য সব কিছু করে। তাই আমি তোমাকে এমন একটা ছেলের সাথে অবশ্যই বিয়ে দিবো না যে বেকার
তোমার অযোগ্য। নীরা এমন পরিস্থিতি তে বাবা কে মুখ ফুটে আর কিছুই বলতে পারলো না। অবশেষে খুব ঘটা করে নীরার বিয়ে হয়ে যায় অনীলের সাথে। প্রথম প্রথম নীরার সাথে হাসি মুখেই কথা বলতো নীরার শ্বাশুড়ি কিন্তুু আস্তে আস্তে নীরার ছোট খাটো ভুল গুলোও অনেক বড় রকমের ভুল বলে গণ্য হতো। অনীল মাঝে মাঝেই নীরার সাথে ভালো করে কথা বলে না। নীরার এই বাড়িতে সব রকম সুখ আছে, শুধু ভালোবাসা নেই। তবু নীরা তার সন্তানের দিকে তাকিয়ে সব কিছু মুখ বুঝে সহ্য করে যায়। কিন্তুু সে সব সময় স্বপ্ন দেখে, কোনো একদিন তার শ্বাশুড়ি তাকে ডেকে বলবে নীরা আমার কাছে এসে বসো গল্প করি। স্বপ্ন দেখে অনীল তাকে হাসি মুখ করে বলছে নীরা চলো আজকে আমি তুমি আর বাবু বাহিরে ঘুড়ে আসি। কিন্তুু নীরার স্বপ্ন গুলো শুধু স্বপ্নই থেকে যায়।

অনীল খুব রাত করে বাড়িতে আসে আজ, নীরা তাকে প্রশ্ন করতেও ভয় পাচ্ছে কেনো দেরি হলো আজ। অনীলের জন্য খাবার গুছিয়ে রাখে ডাইনিং এ। নীরা সবাই ঘুমিয়ে পরেছে.? হ্যাঁ, ঘুমিয়ে পরেছে। মাকে ঠিক মত খাবার আর ঔষধ দিয়েছো.? হ্যাঁ, দিয়েছি। তারপর অনীল একরকম চুপচাপ বসেই খাবার খায়। নীরার কাছে এই সংসার একরকম যান্ত্রিক মনে হয়। সে নিঃশ্বাস নিতে পারে না। তার অসহ্য লাগে কিন্তুু সে কারো কাছে কিছু বলতে পারে না।
আজ রাতে নীরা স্বপ্নে দেখছে- একটা ছেলে ছাদের সিলিং ফ্যানে ঝুলছে। নীরা অনেক চেষ্টা করেও ছেলেটার মুখ দেখতে পেলো না। কিন্তুু ছেলেটার পরনে পাঞ্জাবীটা ঠিক চিনতে পেরেছে। নীরা মুখ না দেখলে আজ ঠিকই স্বপ্নের মানুষটাকে চিনতে পেরেছে।

ছেলেটা আবির ; আড়াই বছর আগে একটা ছেলে  নীরাকে প্রচন্ড রকম ভালোবাসতো। নীরাও অনেক ভালোবাসতো আবির কে। কিন্তুু আবিরের কোনো ভালো চাকরী না থাকায় আবিরের কোনো যোগ্যতা না থাকায় নীরা অনেক চেষ্টা করেও পরিবারকে রাজি করতে পারে নি। 
তারপর, তারপর আজ অনেক টা বছর কেটে গেলো আবিরের কোনো খোঁজ নেয় নি নীরা। আবিরও কখনো খোঁজ করে নি নীরার। আজ আবারো ঘুম ভেঙ্গে যায় নীরার। কিন্তুু নীরা আজ ভয় পায় নি ; নীরার মনে আজ ব্যাকুলতা, কেমন আছে আবির.? কোথায় আছে আবির.? একটু যদি দেখতে পারতাম আবিরকে। আজ সারা রাত নীরার ঘুম হলো না। শুধু আবির কে ভাবছে সে। কত সুন্দর ছিলো সেই দিন যেদিন আমি আর আবির নিজের অজান্তেই দুজন দুজনকে ভালোবেসে ফেললাম। একটা দুটো করে সাজানো হয়েছিলো আমাদের তিন বছরের ভালোবাসার অতীত। আবির আমাকে বড্ড ভালোবাসতো, আমার ছোট খাটো কিছু হলেই ও অস্থির হয়ে যেত। আমি আর আবির হাত ধরে অনেকটা পথ হেঁটেছি। এ পৃথিবীর পথে আমার আর আবিরের পদচিহ্ন আঁকা। আমার সামান্য অভিমান হলে আবির কত কিছু করে আমার অভিমান ভাঙ্গতো। কত রাত পার করেছি আবিরের সাথে ফোনে কথা বলতে বলতে।

একটা সময় মনে হতো আবির কে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না। আবির আমাকে নিয়ে খুব পাগলামি করতো। আমি মাঝে মাঝে খুব অসহ্য হয়ে যেতাম ওর পাগলামি দেখে। আবির আমার সব কথা শুনতো। ও আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসতো। যেদিন আবিরের সাথে শেষ দেখা হয়েছিলো, সেদিন ও এত কেঁদেছিলো যার কষ্ট আমি আজ টের পাচ্ছি। আচ্ছা, আবির এখন কেমন আছে.? 
সকালে অনীল কে নাস্তা দিয়ে নীরা রান্নাঘরে আবীরকে নিয়ে চিন্তা করছে। আবিরকে কী সে একবার কল দিবে, ওর নাম্বারটা এখনো মুখস্ত আছে নীরার। কল দিলে কী আবির আমার সাথে কথা বলবে..? আজ কতদিন হয়ে গেলো নিশ্চই এতদিনে আবির বিয়ে করেছে। আমার ওপর হয়তো আবিরের কোনো রাগ নেই এখন। হঠাৎ নীরার শ্বাশুড়ি পেছন থেকে আচমকা ডাক দেওয়ায় নীরার হাতে থাকা গরম পানির পাতিল মাটিতে পরে যায়। এতে কিছুটা গরম পানি নীরার শ্বাশুড়ির গায়ে ছিটকে পরে, নীরার শ্বাশুড়ির হাত-পায়ের কিছুটা অংশে ফোসকা পরে যায়। ঘটনা শুনে অনীল অফিস থেকে তখনি আসে। এক কথা দুই কথা বলতে বলতে অনীল নীরাকে চড় মেরে বসে, নীরা কিছু বলতে চাইলে আরো দুটো চড় মারে অনীল। নীরার হাতপা কাঁপছে ভয়ে। অনীল অসভ্য ভাষায় অনেক গালাগালি করে। নীরা চুপ করে তার রুমে চলে যায় বাচ্চা কে বুকে জড়িয়ে বসে থাকে কিছুক্ষন। নীরার চোখে আজ অনেক জল গড়িয়ে পরছে। এত কষ্ট কেউ কখনো দেয় নি নীরা কে। নীরা কাউকে কিছু বলতে পারে না। আজ রাতে আবির তার স্বপ্নে এসেছে; আবির বলছে নীরা আমি আবির আমাকে চিনতে পেরেছো.? নীরা চুপ করে থাকে কিছু বলে না।

আবির আবার প্রশ্ন করে তোমার বাচ্চাটার নাম কী নীরা.? নীরা কোনো উত্তর দেয় না। নীরার ঘুম ভেঙ্গে যায়, সে ঘামতে থাকে। নীরা প্রতিদিন আবীরকে দেখে, প্রতিদিন নীরার ঘুম হয় না। নীরা অসুস্থ হয়ে যায় কিছুদিন পর। অনীল নীরার বাবাকে কল দিয়ে নীরাকে বাড়িতে নিয়ে যেতে বলে। নীরা বাড়িতে যাবার পর সবার আগে পাগলের মত আবিরকে খুঁজে। বাবা-মাকে বলে একটা বার সে আবিরের সাথে দেখা করতে চায়। বাবা-মা আবিরের খোঁজ করে, খোঁজ নিয়ে জানতে পারে আবীর ২১ দিন আগে আত্মহত্যা করেছে। কিছুদিন সে প্রায় পাগলের মত ছিলো। কেনো আত্মহত্যা করেছে আবীর তার কারণ কেউ জানে না। নীরা আরো অসুস্থ হয়ে যায়....

একদিন রাতে আবীর এসেছে নীরার স্বপ্নে, নীরাকে বলছে জানো নীরা সবাই বলে আমি নাকি অত্মহত্যা করেছি.. এটা ভুল। তুমি চলে গেলে আমাকে একা রেখে, তুমি জানো নীরা, আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যেত। একটি বার তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করতো, তোমার পাশে বসতে ইচ্ছে করতো। কিন্তুু তুমি তো আমাকে ছেড়ে চলে গেলে। আমার একা একা ভয় লাগে। আমার এখন সূর্যের আলো ভালো লাগে না। আমার অন্ধকার ভালো লাগে। আচ্ছা নীরা, তুমি না বলেছিলে আমাকে ছাড়া তুমি থাকতে পারবে না.? তাহলে কেমন করে থাকো.? আমি কী তোমাকে কম ভালোবেসেছিলাম নীরা.? নীরা আমাকে ছেড়ে চলে গেলে শুধু আমি বেকার বলে? ছেড়েই যদি যাবে তাহলে ভালোবেসেছিলে কেনো.? নীরা প্রচুর ঘামতে থাকে সে আমতা আমতা করে কিছু বলতে চাচ্ছে কিন্তুু পারছে না। আবির বলছে নীরা তুমি কি বলবে আমি জানি.. বলবে পরিবারের সাথে তুমি পেরে উঠো নি.. আচ্ছা নীরা ভালোবাসতে পারলে আর আমার জন্য অপেক্ষা করতে পারলে না...? আমার জন্য একটু কষ্ট করতে পারলে না.? এই যে দেখো নীরা আমি বলেছিলাম আমার জীবনের থেকেও তোমাকে বেশি ভালোবাসি.. 
এই দেখো আজ তুমি সুখে,
আমার কবরে মাটির স্তুুপ আমার বুকে। 
আমি কিন্তুু তোমাকে ছাড়া থাকতে পারি নাই নীরা। 
নীরা বড্ড ভালোবেসেছিলাম তোমায়। নীরা কাঁপতে কাঁপতে বিছানা থেকে পরে যায়, দুম করে পরার শব্দ পেয়ে ঘরের সবাই নীরাকে দেখতে আসে। নীরা মেঝেতে পরে আছে, ওর মাথা ফেটে গেছে রক্ত ঝড়ছে। 
কিছুদিন পর নীরা সুস্থ হয়ে যায়। কিন্তুু সে আর অনীলের কাছে ফিরে যায় না। অনীল অনেকবার নীরাকে নিতে আসলেও সে আর যায় না। এখনো প্রতি রাতে নীরা আবিরকে স্বপ্ন দেখে। সে স্বপ্ন বড় গভীর... রাত বাড়ছে নীরার স্বপ্ন ফুড়িয়ে যাচ্ছে, নীরার বাচ্চাটা বড় হচ্ছে, দেখতে সে অবিকল আবিরের মত। নীরা পথ হাঁটে, আবীরের স্বপ্ন বুকে।