Posts

গল্প

লেখক রুমানা

May 12, 2024

কাজল শাহনেওয়াজ

Original Author কাজল শাহনেওয়াজ

এই ঢাকা শহরে কিছুতেই আশাবাদী হওয়া যায় না। তবু কোন না কোন ফুল ফুটে ওঠে। তবু কোন কোন দিন এমন মানুষের সাথে দেখা হয় যে, মনে হয় কিছু একটা ঘটতে চলেছে।
 
১।
ভদ্রমহিলার সাথে পরিচয় ডিবি অফিসে। ডিবি’র কর্মকর্তা আরিফ আমার ছোট বেলার বন্ধু। তার অফিসে একদিন গল্প করছিলাম দুপুরে। আর লাঞ্চ খাচ্ছিলাম। তখন তিনি আসলেন। মাঝারি হাইট, পচিশ/ছাব্বিশ বয়স। হিজাব ও আনুষঙ্গিক পোষাকে আবৃত। তবে কথা বলছিলেন স্বচ্ছন্দে, জড়তামুক্ত। কথায় মৃদু একটা আঞ্চলিকতার টান আছে। খানিকটা টিভির নতুন পারফর্মারদের মত, হালকা করে ভুল উচ্চারণ করছে, বানানো ভঙ্গি। 
 
আমি একটা অনলাইন পোর্টালে লেখালিখি করি। সাহিত্য, রাজনীতি, বিজ্ঞান যখন যে বিষয় পাই, তাই লিখি। বিখ্যাত মানুষদের স্ক্যান্ডাল নিয়ে লিখতে চাই। কিন্তু তা আর হৈতেছে না। ডিবি বন্ধুর কাছে অনেকটা সেই জন্যেও আসা।
 
পরিচয় হবার পর সেই সূত্রে মহিলা তার ব্যাগ থেকে একটা বই বের করে দেখাল। তারই লেখা উপন্যাস। এ’বছর বইমেলায় বের হয়েছে। বলল, মেলার মঞ্চ থেকে মোড়ক উন্মোচন করেছেন বিখ্যাত কবি আজাদ চৌধুরী। বিজয় কণ্ঠ প্রকাশনী থেকে। এতক্ষণ উনি কথাবার্তায় ম্লান ছিলেন, এবার মনে হল একটু সাবলীল হলেন। আমি আগ্রহ দেখিয়ে বললাম, আমাদের পোর্টালে তো বইয়ের আলোচনাও হয়। একটা কপি দিতে পারেন। বইটা দিলে হাতে নিলাম। বেশ মোটাসোটা বই। আড়াইশ পৃষ্ঠার।
 
কয়েক মিনিট কথা বলার পর শে চলে গেলে আরিফ বলল, ‘ওর নামে প্রতারণার অভিযোগ আছে।’ চোখ নাচায়ে আরিফ আরো বলে, ‘উনি পার্টটাইম দেহব্যবসায়ী! যদিও ব্যাপারটা তদন্তাধীন।’
 
- বল কি! খুব আশ্চর্য তো। ওনার ফোন নম্বরটা দাও তো। একটা সাক্ষাৎকার নিব নে!
আরিফ বলল, ‘তুমি সাংবাদিক মানুষ, তবুও বলি, সাবধানে ডিল করিও। এরা কিন্তু খুব ঘাগু হয়।’
 
২।
বলেছিল, ‘আসেন একদিন চা খাই ধানমন্ডিতে।’ আমি ভাবলাম বেশ নামকরা কোন কফি হাউসে দেখা হবে। এসে দেখি ধানমন্ডি ১৫ নম্বরে, ডায়মন্ড হোটেলে। মূল রাস্তা থেকে একটু ভিতরে, মহল্লার সাদামাটা রেস্তোরা, সাধারণ টেবিল চেয়ার। আলুপুরী, মোগলাই পরোটা, মাছের তরকারি, ভাত বিক্রি হচ্ছে। তবে লোকজন আসছে, খেয়ে চলে যাচ্ছে। খুব একটা ভিড় নাই। কিছুক্ষণ বসা যাবে।
 
রুমানা দেখতে শুনতে মন্দ না। হিন্দি সিনেমার আলিয়া ভাটের মত লম্বাটে মুখ। হাসি মাখা। চোখে দুষ্টুমি ও কপট উদাসিনতা। হালকা ফিরোজা রঙের হিজাবে তাকে ভাল মানাচ্ছে। আজকে শে মাথায় ডাবল প্যাচ দিয়ে এসেছে, বেশ আকর্ষণ ফুটেছে তাতে। বা হাতের উল্টাদিকে খুব হালকা একটা দাগ ছাড়া সারা শরীরে কোন খুঁত নাই। ডায়মন্ড হোটেলের এক কোনায় বসে আমরা মোগলাই পরোটা আর জিরো-ক্যাল ড্রিংকস খেতে খেতে গল্প করি।
 
ডায়মন্ড হোটেলটা এই মহল্লার একটা রেফারেন্স পয়েন্ট। এদেরকে অনলাইনেও অর্ডার করা যায়। একটা কশাইর দোকানের পাশে। যেখানে তন্দুর রুটি শেঁকা হয়, তারপাশেই আরেকটা দোকানে ঝুলছে গরুর রান। অনেক দূর থেকেই রানটা চোখে পড়ে। কোন রেস্তোরাঁর সাথে গোস্তের দোকান সাধারনত দেখি না। প্রথমবার ঢুকতে গিয়া দেখে ভালই লাগল।
 
আমি জিগাই: ‘রুমানা, এটাই তো আপনার প্রথম বই? ১৭ ফর্মার এত বড় লেখা কেমনে লিখলেন? আগে কোন অভিজ্ঞতা ছিল?’
 
ও বলে, ‘বইটা পড়ছেন? আমি যা লিখছি তা কি নতুন কিছু? আমার ছোট বেলার গ্রামে থাকার দিনের কথা। আত্মীয়স্বজন, চেনা লোক। ভাল মানুষ, বদ মানুষ। ক্রিমিনাল, নেতা… সবই তো জানা মানুষ। বানাইয়া তো কিছু লিখি নাই। তাহলে আলাদা অভিজ্ঞতা লাগবে কেন?’
 
‘তাও তো… সাজাইতে হয় না? কেমনে লিখলে পাঠক নিবে, সমালোচক প্রশংসা করবে… এইসব ভাবেন নাই?’
 
‘আরে নাহ। প্রকাশক আমার বন্ধু মানুষ, উনি বললেন, অতো ভাবতে হবে না। লেখেন লেখেন। আমিও তাই লিখলাম। ভাবাভাবির কিছু নাই। যা সত্য তাই লিখছি। সব আমার জীবনের কথা।’
 
প্রথম দিন এটুকুই। 
 
বিদায় নেবার সময় বললাম: ‘কথা কিন্তু শেষ হয় নাই। আমার আরো কয়েকটা সিটিং লাগবে।’
ও বলল, ‘ব্যস্ত থাকিতো। আবার যেদিন সময় পাবো সেদিন বসবো। তবে এখন থেকে আমিই সময় মত আপনাকে ফোন দিব। আপনার ফোন দিতে হবে না।’
 
কথা বলতে বলতে অনেক বার ওর ফোন বেজেছে। কোনোটা ধরেছে, কোনোটা ধরে নাই - সেটা চোখে পড়ল।
 
৩।
‘আমার জীবনটা খুব কষ্টের। জানেন, সবচে বড় কষ্ট ছিল, আমাদের পরিবারে সুখাদ্য বলে কোনদিন কিছু ছিল না। ঠিক মত না খেতে পেরে ছোট বেলা থেকে সবাইকে ভয় পেতাম। তাই সবাই মিলে মজা করতো আমার উপর।’
 
‘তাই হয়ত একদিন দেহটাকে প্রতিশোধের অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা শুরু করলাম।’ 
 
আমার সাথে রুমানা দ্বিতীয়বার দেখা করল বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ছাদে। পূর্ণিমা দেখার জন্য ওখানে মাসে একবার উৎসব হয়। বলল, ‘এইসব জায়গায় অনেকবার এসেছি বিভিন্ন জনের সাথে, তাই আর আসতে চাই না। মুখচেনা হয়ে গেছি।’
 
‘প্রথম দিকে পরিচিতদের কাছ থেকে গিফট পেতাম শোওয়ার সময়। তখন কতগুলি গৎবাঁধা কৌশল ছিল। যাদের বৌ একটু কম সুন্দর বা বয়স হয়ে গেছে তাদের সাথে ভাব জমাতাম। তাকে মনোযোগ দিয়া দুচারটা কথা বলতাম, জন্মদিনটা মনে রাখতাম। আর মনে মনে যা চাইতো, তাই করতাম।’
 
আমি বললাম: ‘মনের কথা জানতেন কেমনে?’
বলে: ‘সেটা তো বলা যাবে না। মেয়েরা এমনিতেই তা পারে। আর আমি তো অনেকের সাথে মিশছি। তাদেরকে লক্ষ্য করি। কে কিভাবে কি চায়, তা দেখি। মনেও রাখি। এটা আমার একটা গুণও বলতে পারেন।’
 
স্টার কাবাবের দোকানের লোকটা গতকাল ল্যাম্বলেগ তৈরি করছিল পশুটাকে হত্যা করে। পশু হত্যায় সমস্যা নাই, কিন্তু কেউ যখন তা কোথাও প্রকাশ্যে ঝুলাইয়া রাখে, তখন মনে হয় এই এলাকাটা আমার না। আমার নিজেরেই পশুর চেয়ে রিক্ত মনে হয়। রাত হয়, তারপর সকাল, তারপর পূর্বাহ্ন, দুপুর… তারপর অপরাহ্ন এসে ঢুকে পড়ে আমার ভিতর। যেন একটা মহাজাগতিক ঘটনা ঘটছে… বা ঘটেই ছিল, ঘটনাটার দৃশ্য খুলে যাচ্ছে। ঘটনাটা ছোট একবিন্দু হয়ে ছিল, কুড়ি থেকে ঘটনা ফুলফোঁটার মত ফুটে উঠছে। মনে হয় সৃষ্টিকর্তা আমার মধ্যে নটঘট শুরু করে দিছে।’
 
‘তখনই লেখালিখির কথা মাথায় আসে আমার।’
 
‘নতুন কারো সাথে পরিচিত হলে তার সাথে গল্প করা শুরু করলাম। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তার প্রতিদিনকার কথা শুনতাম। সকালে কি করে, কি খায় কি খায় না। কি সিনেমা দেখে। বৌয়ের সাথে কেমনে ঝগড়া হয়। কথা বন্ধ হইলে কে আগে শুরু করে। তখন কি বলে। এক সময় তার সেই হঠাৎ পাওয়া গল্পের সাথে আমিও ঢুকে যেতাম। আমার ও মনে পড়ে যেত গ্রামের বাড়ির কথা। অঘ্রাণ মাসে সেখানে জিন আসতো।’
 
‘আমি তখন আমার সেই কল্পনার কথাগুলি লিখে রাখতাম।’
 
৪।
৩য় বা ৪র্থ দেখা হওয়ার পর বুঝতে পারলাম শে আমারে তার গল্পের ফাঁদে ফেলতে চাচ্ছে। সামনে ক্লাসিক্যাল মিউজিক ফেষ্ট হবে আর্মি স্টেডিয়ামে। ফোনে ম্যাসেজ দিলাম: আসতেছেন তো? দেখা করতে চাই। উত্তরে বলল: যাবো। তবে সাথে লোক থাকবে!। দ্বিতীয় রাতে কোন এক সময় কিছু সময় দিতে পারবো। ম্যাসেজ দিলে আসবেন।
 
দ্বিতীয় রাতে ছিল কৌশিকী’র শো। রাত তিনটার দিকে ম্যাসেজ দিল: ১ম গ্যালারির সবোর্চ্চ ধাপের ডান দিকে। ৩:৪৫ এ। সময় ২০ মিনিট। তারপর বিদায় নেবেন।
 
আমার আসল উদ্দেশ্য ছিল ওর সাথে কথা বলতে বলতে সাহিত্য মহলের কোন স্ক্যান্ডালের খোঁজ পাওয়া। সেজন্যেই এতসব লেগে থাকা। কিন্তু যে হারে দৌড়াইতেছে, কি যে হয়! আমাদের পোর্টালের অবস্থা খুব খারাপ। লোকজন পড়তেছে না। হিট বাড়ানো খুব দরকার।
 
গিয়ে দেখি মাথায় চে ক্যাপ পড়ে বসে আছে, চেনার উপায় নাই। বাদামী চাদর গায়ে মনে হচ্ছিল একটা স্লীম পাখি। মাঝে মাঝে দূর মঞ্চ থেকে ছিটকে আসা রঙিন আলো তার মুখমণ্ডলে এসে পড়ছে। তাতে তাকে খুব বিপ্লবী আর একা লাগছিল। পাশে একটা ফাঁকা জায়গা। বললো, একজন বসছে। আধাঘন্টা পর সে আসবে।
 
বললাম ‘কেমন লাগছে।’ বলে, ‘গান শুইনা খুব কান্না লাগতেছিল, তাই আপনারে আসতে বললাম। যার সাথে আসছি, সে এইসব পছন্দ করে না। শুধু আমার জন্য আসছে। কিছুক্ষণ পর তার বাসায় গিয়া ঘুমাবো।’ 
 
‘আপনার বন্ধুদের সাথে তো পরিচয় হৈল না।’
ও বলে, ‘ঐগুলি বাদ দেন তো। আজকে আমার উপন্যাসের নায়িকার মন খারাপ। তার খুব শৈশবের কথা মনে হইতেছে। ছোট বেলায় শে নদীতে ঝাপাঝাপি করতে খুব পছন্দ করতো। মায় ধইরা কত পিটাইছে। চৈত্র মাসে ৫৬ প্রহর কীর্তন হৈতো ৭ দিন ধরে। প্রহরে প্রহরে সুরের রাগ চেন্জ হৈতো। হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ শুনতে শুনতে রাতে ঘুমের ঘোরে কই যেন চলে যেতাম। একবার ঘুম ভাঙলে ঘুম আর আসতে চাইতো না।’
 
আমি বলি: ‘তাতে কি, এখন ক্ল্যাসিক্যাল শুনতেছেন। দেখবেন পূরা শুনলে মন আবার ভাল হৈয়া যাবে। ওদের গায়কির কত কায়দা। কত বিচিত্র যন্ত্রপাতি। কত সুন্দর বাজনা।’
ও বলে: ‘এই জন্যেই আপনার সাথে কথা বলে ভাল লাগে। আপনে কত সুন্দর করে তুলনা করতে পারেন। যান, ‌আপনার বরাদ্দ টাইম শেষ। আরেকদিন দেখা হবে।’
 
৫।
রুমানা ফয়জুন্নেহা’র ব্যাপারে ডিবি বন্ধু আরিফ কে একদিন জিজ্ঞেস করি। তার ফাইলটার কি খবর? আগাইলো কিছু?
 
আরিফ বলে: ‘আরে এইটা কোন ভ্যালিড অভিযোগই না। অভিযোগকারি এক ব্যবসায়ী, সে অমুকের আত্মীয়। তাই আমরা ইনকোয়ারি করতেছি। আসলে সে ইমোশনাল ভিক্টিম। ফ্রডের কোন শক্ত প্রমান নাই। ভাবছিল সত্যিকারে প্রেম করতেছে। বেশ টাকা পয়সাও খরচ করছে মেয়েটার জন্য। সে জন্য মেয়েটারে শাস্তি দিতে চাইতেছে।’
 
আমি বললাম: ‘আমারো মনে হয়, শে তেমন কোন ক্রিমিনাল না। বরং আমাদের উচিৎ তাকে উপন্যাস লিখতে দেয়া।’
 
আরিফ বলে: ‘ক্যান দোস্ত, তুমিও কি তার প্রেমে পড়ছো? শুইছো নাকি দুচার দিন?’
আমি একটা অব্যক্ত শব্দ করে ডিবি’র জেরা থেকে নিজেকে সরাইয়া নিলাম। ওর সাথে এত কথা বলা যাবে না।
 
 
৬।
একদিন সত্যি সত্যি রুমানারে চাইপা ধরলাম। কথার প্যাঁচে ফেলাইলাম আর কি। বললাম, ‘এইভাবে বিপদজনক কাজ করতেছ, ভবিষ্যত কি হবে?’ বলে, ‘আসলেই আমি বেশি টাকা পাইতেছি না। উপন্যাস লিখতে গিয়া এখন গল্পের বাইরে যাইতেই পারি না। বন্ধুবান্ধব কমে গেছে। আমার এখন শরীর থেকে মনের দিকে ঝোঁক বাড়তেছে। ভাবছিলাম কিছু টাকা জমাবো ভবিষ্যতের জন্য। কিন্তু ভাইয়ের পড়ালেখার ফি আর সংসার চালাতে সব চলে যায়। আমার আয়ুর বিনিময়ে। কাউকে যে বিয়া করবো, সেই ভরসাও পাইতেছি না। ঢাকা শহরে সেরকম বিশ্বাসী লোক কই?’
 
-‘ফেরার সময় নিজের বাসার কাছাকাছি এসে প্রায়ই টাকা তুলি এটিএম বুথ থেকে। তখনই মনে হয়, আচ্ছা, আজকের দিনটা কি আমি ভবিষ্যত থেকে খরচ করলাম না তো? ক্রেডিট কার্ডে। একদিন তো সুদে আসলে ফেরত চাইবে। সেদিন যদি আমি খুব ধনী না থাকি?। আবার মনে হল, খুব বেশি তো নিলাম না। ঈশ্বরের মত অন্তরীক্ষ্য থেকে একটা চোখ কি আমাকে দ্যাখতেছে না? সে কি জানে না, আমি কী কষ্ট করতেছি!’ 
 
 -‘দেখ, আমার তো কোন পুরুষের মুখই মনে থাকে না। তাইলে তো পাগল হয়ে যেতাম। মানুষের মুখটা হলো যন্ত্রণা। আমি তো পুরুষকে সৌন্দর্য দিয়ে বিচার করি না। তার রুচি, টাকা পয়সা, তার উদারতা দেখি। কে কোথায় বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছে, তার মধ্যেই সব বুঝা যায়। এরই মধ্যে যারা একটু প্রেমিক ভাবের, পছন্দ হলে তাকে বলি, আসো, আমার উরুতে আদর কর তো! আমার পায়ের পাতা চাটো। চোখ বন্ধ করে থাকলে আমার ভিতরে গল্পের বান বয়ে যায়। কে যেন জোরে জোরে আমার কানে গল্প বলে। ‘তারপর তো ওদের লঞ্চ ডহরি খালে ঢুকলো। কিছুদূর গেলে বালিগাও ঘাট। দুই পাড় উঁচু, সেখান থেকে ছোট ছোট মাটির টুকরা ঝুরঝুর করে পড়ে। লোকজন হৈ চৈ করে কোথায় যেন যাচ্ছে। একটা টিয়া আরেকটা টিয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যায়। মা একটা বড় পাউরুটি কিনে আমাদের সবাইকে ভাগ করে দিচ্ছে।’ 
 
-‘নতুন উপন্যাসের পৃষ্ঠাগুলি আমার মাথায় সারাক্ষণ কিরকির করে। আমি আর তোমাদের জগতে থাকিনা। আমি উড়াল দিয়া অন্য ডালে গিয়া বসি।’
 
৭।
-‘আমি সত্যি সত্যি একটা কল্পনার জীবনে বসবাস করতে শুরু করেছি। সেখানে আমার কেউ নাই। একজন প্রেমিক আছে, সে নারী না পুরুষ জানিনা – তার মুখটা কখনো দেখা হয় নাই। তবে মনে হয় সে/শে আমারই সমান। 
 
আমাদের ফ্যান্টাসি একটা সারোগেট শিশুকে নেয়া নিয়া। আমিতো মা হতে চাই না, তবে একটা শিশু আমার স্বপ্ন! আমি শিশু চাই। খুব গর্ব করে বলি: জানো, আমি হচ্ছি সুপার উর্বরা। বীজ পড়লেই সুন্দর ফসল দিতে পারি। দেখ, আমার পেটে কোন কাটা দাগ নাই। কোন ভাঁজ নাই। আমার শরীর খুব নমনীয়, কোন ঝামেলা হবে না জন্ম দিতে। 
তখন সে বলে: ‘ঠিকাছে, একবার আমার জন্য দাও একটা বছর। পারবা না?’
‘হবে হবে। তবে খরচ পাতি আছে কিন্তু।’
‘কতো?’
‘মেলা খরচ। ৯ মাস বাছা বাছা খাবার লাগবে। আঙুর, বেদানা, বাদাম, কবুতরের স্যুপ। শোবার ঘরটা সাজাইতে হবে, এসি করতে হবে। ভাল একটা কুক-কাম বুয়া লাগবে। কয়েক বার সুন্দর জায়গায় বেড়াতে নিয়া যাইতে হবে। মনটা আমিরী রাখতে যা যা লাগে আর কি!’
‘আঙুর বেদানা কেন?’
‘বাচ্চার গায়ের রং পরিষ্কার হবে। স্বাস্থ্যবান হবে। বাদামে বুদ্ধি হবে।’
‘তাহলে তোমার তো পূরা সময়টা অংক করতে হবে। আর ভায়োলিন শুনতে হবে। ইহুদি মায়েরা যেমন করে। বাচ্চাটা বুদ্ধি শানাইয়া আসবে পেটের ভিতর থেকেই। দরদি হবে, গভীর অনুভূতি হবে।’
‘আচ্ছা খরচ কেমন হবে বলে মনে হয়?’
‘৮ থেকে ১০ লাখ। তারপর আমার পোষানি আছে না। টাইমের মজুরি?’
 
মনটা দমে গেল। এত খরচ করে যদি বাচ্চাটা ঠিকমত রূপ আর বুদ্ধি না পায়, তাইলেই হৈছে। একটা কামুক-অবিশ্বাসি-অতিরূপসী দেখতে চালাক বাচ্চাকে নিয়া কি করবো? তার যদি কোন আত্মা না থাকে? 
প্রজেক্ট বেশি দূর আগায় নাই, তবে তার ফ্যান্টাসিটা রয়ে গেছে।
 
একদিন ক্যাপ ছাড়া মিলনের সময় সে যদি বলে, ‘কি গো, আজ বীজ বুনে দিবো নাকি?’
তখন আমি বলবো: ‘চেকটা দাও আগে!’
 
·         ‘সে’ ও ‘শে’ দ্বারা পুরুষ ও নারী বুঝানো হয়েছে

Comments

    Please login to post comment. Login