পোস্টস

প্রবন্ধ

কুরবানী মৌলিক চিন্তা

১৬ জুন ২০২৪

জিসান আকরাম

মূল লেখক জিসান আকরাম

পশু কুরবানি মানুষের অর্থনীতিক ক্ষমতার স্মারক বহন করে। গণতন্ত্র যেখানে দুর্বল, সেখানে অর্থনীতিক ক্ষমতাই রাজনীতিক ক্ষমতার মূল চালিকাশক্তি। বাংলাদেশে যে-আবহাওয়া বিরাজ করছে, তাতে মনে হয় না কুরবানি একটি ধর্মীয় প্রথা। বরং কুরবানির মাধ্যমে কীভাবে অর্থনীতিক ক্ষমতার প্রচার চালানো যায়, সেটিই কুরবানিওয়ালাদের মূল লক্ষ্য। ফলে তৈরি হচ্ছে প্রতিযোগিতা। সামাজিক প্রতিযোগিতার একটি ধর্ম হলো— এটি শ্রেণী-সংক্রামক। কোনো নির্দিষ্ট অর্থনীতিক শ্রেণীতে এ প্রতিযোগিতা সীমাবদ্ধ থাকতে চায় না। কারণ ধনীর আচার, একসময় হয়ে ওঠে গরিবেরও আচার। পশু কুরবানি ঐতিহাসিকভাবেই বিত্তবানদের আচার। যিনি পশু কুরবানি দেন, তার অর্থনীতিক ক্ষমতা, যিনি পশু কুরবানি দেন না, তার চেয়ে বেশি— এমন মনস্তাত্ত্বিক প্রচারণা সমাজে আছে। যেহেতু ধন-সম্পদের সাথে সামাজিক মর্যাদার সমানুপাতিক সম্পর্ক, তাই গরিব মানুষরাও চায় ধনী হয়ে বা ধনী হওয়ার ভান করে সামাজিক মর্যাদা আদায় করতে। এ কারণে অনেক গরিব, ধনীর চরিত্রে অভিনয়ের অংশ হিশেবে পশু কুরবানি দিচ্ছেন। মধ্যবিত্তরা তো যেকোনো মূল্যে বজায় রাখতে চাইছে সামাজিক মর্যাদা। কারণ কুরবানি না দিলে সমাজে রটে যাবে— লোকটির টাকা-পয়সা কম, তার দিন কাটছে অভাব অনটনে। মেয়েদেরকে শ্বশুরবাড়িতে জিগ্যেস করা হচ্ছে, তোমার বাবা কী কুরবানি দিয়েছে? এ ধরনের প্রশ্ন মেয়েদের জন্য বিব্রতকর। সব মেয়েই চায়, বাবার মুখটি শ্বশুরবাড়িতে উজ্জ্বল থাকুক। বাবারাও এটি বোঝেন। এ জন্য মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে হলেও তিনি কুরবানি দেন। যিনি ভাগে বা শরিক হয়ে কুরবানি দিলে পারতেন, তিনি ধান বিক্রি করে, ধার-কর্জ করে, কিনে আনেন আস্ত গরু। কারণ মানুষ টের পেয়েছে, একা একটি গরু কুরবানি দেয়ার যে-সামাজিক মর্যাদা, তা সাত জনের শরিকানা কুরবানির চেয়ে বেশি। ঈদের দিন যে-প্রশ্নগুলো শোনা যায়, সেগুলো থেকেও এটি অনুমান করা যায়। গরু কতো টাকা দিয়ে কিনেছেন? কয়টি গরু কুরবানি দিয়েছেন? কুরবানি একা দিয়েছেন নাকি ভাগে দিয়েছেন? এই হলো কুরবানির বিসিএস প্রিলি।

আমি বলছি না যে সবাই প্রশ্নগুলো ভিন্ন মতলবে করে, কিন্তু প্রশ্নকর্তাদের একটি বড় অংশই যে কুরবানিদাতার আর্থিক সক্ষমতা যাচাই করতে প্রশ্নটি ছোঁড়ে, তা অস্বীকার করা যাবে না। আমার পাশের গ্রামে দুই পরিবারে খুব রেষারেষি ছিলো। এক ঈদে, প্রথম পরিবার একটি গরু কিনে আনার পর দ্বিতীয় পরিবার দুইটি গরু কিনে আনে। সেটি দেখে প্রথম পরিবার কিনে আনে আরও তিনটি গরু, এবং এনে লুকিয়ে রাখে এক আত্মীয়ের বাড়িতে। ঈদের দিন প্রথম পরিবারের কর্তা যখন দুইটি গরু জবাই করে বীরদর্পে হেঁটে বেড়াচ্ছিলেন, তখন খবর আসে যে দ্বিতীয় পরিবার জবাই করছে চারটি গরু! ব্যস, সংবাদ শুনে প্রথম পরিবারের কর্তা ঘোষণা দেন— ঈদের তিন দিন পর্যন্ত কুরবানি আদায় করা যায়; আগামীকাল ইনশাল্লা আরও কয়েকটি গরু জবাই করবো। এই হলো আল্লাহর নৈকট্য লাভের বঙ্গদেশীয় প্রদর্শনী। অর্থাৎ কুরবানি এখানে ‘দেখিয়ে দেওয়া’-র উপলক্ষ হিশেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

অনেকে বলবেন, “এতে ক্ষতি কী? ধনী মানুষ প্রতিযোগিতা করে বেশি গরু কুরবানি দিলে গরিব মানুষেরই লাভ!” এগুলো মাথামোটা চিন্তা। সম্পদ ধনীর হাত থেকে গরিবের হাতে গেলে অর্থপ্রবাহ তৈরি হয়, এ কথা সত্য, কিন্তু কুরবানির মাংস সমাজে কোনো কার্যকর অর্থপ্রবাহ তৈরি করে না। এটি পচনশীল দ্রব্য, এবং অকারণে অধিক মাংস খাওয়া শরীরের জন্য ভালো নয়। আমি লক্ষ করেছি, এ দেশে মানুষ মাংসের জন্য হাহাকার করে রমজান মাসে। কিন্তু চড়া দামের কারণে ওই সময় তারা মাংস খেতে পারে না। এ জন্য প্রস্তাব করেছিলাম, সব পশু ঈদুল আযহায় কুরবানি না দিয়ে, কিছু পশু রোজার মাসে, এবং কিছু পশু ঈদের পর কুরবানি দিতে। এর নাম রেখেছিলাম আমি ‘আগাম কুরবানি’ ও ‘সাসপেন্ডেড কুরবানি’। অর্থাৎ কোরবানির ঈদে একসঙ্গে এতো গরু কোরবানি না দিয়ে কোরবানিকে আমি ৩৬৫ দিনে স্প্রেড করে দিতে বলেছি। এতে গরিব মানুষ সারা বছর মাংস খেতে পারবে। মাংসের দামও বাজারে কম থাকবে। কেবল জিলহজ্ব মাসের ১০, ১১, ও ১২ তারিখে কোরবানি দিতে হবে, এমন নিয়ম সমাজবান্ধব নয়। একজন মুসলিম তার কোরবানিকে বছরের যেকোনো দিনের জন্য ‘সাসপেন্ড’ করে রাখতে পারেন। যিনি ঈদুল আযহায় বিশটি গরু কুরবানি দিচ্ছেন, তিনি যদি একটি গরু ওই দিনের জন্য রেখে উনিশটি গরু রমজান মাসে কুরবানি দিতেন, তাহলে গরিব মানুষ উপকৃত হতো। এ প্রক্রিয়ায় ‘বেস্ট ইউজ অব রিসোর্স’ নিশ্চিত হতো।

কিন্তু তা না করে মাংসের বন্যা লাগানো হচ্ছে ঈদুল আযহায়। কারণ এতে রাজনীতি আছে। প্রতিবেশীকে দেখিয়ে দেওয়ার আনন্দ আছে। ধনী মানুষদের একটি ইনস্টিঙ্কটিভ আচরণ হলো— তারা সবসময় গরিব দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকতে চায়। কোনো উপলক্ষে কেউ এসে তাদের কাছে মুখ কাঁচুমাচু করে কিছু চাইবে, এটি তারা কামনা করে। এতে অল্ট্রুইজমের সুখ তো আছেই, ক্ষমতা চর্চার সুখও আছে। পুকুরে মাছের খাবার ছিটানোর সময় যে-দৃশ্য তৈরি হয়, সেরকম দৃশ্য মানবসমাজে তৈরি করা গেলে, তা খুব উপভোগ্য ব্যাপার হয়। ধনীরা নানা উপায়ে এ ধরনের ক্রীড়াকর্ম সৃষ্টি করেন, এবং আয়েশ করে উপভোগ করেন। পশু কুরবানিও একধরনের ক্রীড়া। রিলিজাস স্পোর্টস। এ স্পোর্টস ধনী কর্তৃক গরিবের ওপর রাজনীতিক প্রভাব বিস্তারে সাহায্য করে। রাজনীতিক ক্ষমতার প্রধান খাদ্য ‘সিগন্যাচার অব ওয়েলদ’। পশু কুরবানি মানুষের সম্পদের সামাজিক স্বাক্ষর বহন করে।"

.

—মহিউদ্দিন মোহাম্মদ
পৃষ্ঠা ৯১-১০৫, বই: মূর্তিভাঙা প্রকল্প