পোস্টস

উপন্যাস

মানবী - অধ্যায় এক

১১ জুন ২০২৪

আহনাফ রাফি

কিরির ঘুম ভেঙে গেল।  

চোখ খোলার পর কয়েক মুহূর্ত কিছুই দেখল না সে। অন্ধকার। মাথায় একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হচ্ছে শুধু। হাত পা অসাড় হয়ে রয়েছে যেন। এখন কোথায় আছে তা বুঝে উঠতে পারছে না সে। কিছুক্ষণ ওভাবেই পড়ে রইলো।  

তারপর আস্তে আস্তে মনে পড়তে লাগল সব। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। চিনচিনে ব্যথাটা চলে গিয়ে এখন ভারী ভারী লাগছে মাথা। অন্ধকারে নিজের রুমের অবয়ব আস্তে আস্তে পরিষ্কার হতে শুরু করেছে এখন। 

কিরি উঠে বসার চেষ্টা করল। উঠতে গিয়ে বুঝল বেডশিটের সাথে পা জড়িয়ে গিয়েছে। বেশ ভালোভাবেই জড়িয়েছে। তার চেয়ে বড় কথা সে এখন তার বিছানাতেই নেই— মেঝেতে শুয়ে আছে।

উঠতে উঠতে কয়েকবার হোঁচট খেল। মাথার ব্যথাটা আরো প্রকট হচ্ছে। গড়িয়ে মেঝেতে পড়েছে একদম— ভাগ্যিস এর থেকে বেশি কিছু হয় নি! 

উঠে বেডশিটটা বিছানায় রেখে ঘুরতেই সে আঁতকে উঠল। দুটো চোখ অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছে। চাপা গোঙানোর শব্দ আসছে। মনে হচ্ছে কোন হিংস্র জন্তু শিকারের জন্যে ওঁত পেতে আছে।  

ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে কিরি টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে দিল। বিড়ালটা তার বিছানার নিচেই শুয়ে থাকে সবসময়। আজকেও নিশ্চয় শুয়েছিল। একদম বিড়ালটার গায়ে পড়েছে গড়িয়ে। হাড়গোড় কটা ভেঙেছে কে জানে!  

‘এদিকে আয় স্কার্লেট… দেখি...’  

বিড়ালটা কিরির দিকে বিষদৃষ্টি নিক্ষেপ করে মুখ ফিরিয়ে নিল। তারপর হেঁটে জানলার কাছে গিয়ে এক লাফে বাইরে চলে গেল।  

কিরি আর আঁতকে উঠল না। হঠাৎ হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া এই বিড়ালের স্বভাব। আবার ফিরে আসবে কদিন পরেই। তবে আজকের নিয়ার-ডেথ এক্সপেরিয়েন্সের পরে কবে ফিরে আসে সেটা এখন ভাববার বিষয়।

জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল সে। দিগন্তে কমলা রঙের হালকা রেখা দেখা যাচ্ছে এখন। আর ঘুম আসবে না। স্কুল শুরু হতে অনেকটা সময় বাকি। বাকি সময়টা অন্যভাবে কাটাতে হবে। কিংবা আগেভাগে স্কুলে চলে যাওয়া যেতে পারে।

লাইট জ্বালাল সে। নিজের ঘরের এই ছিরি দেখে সে নিজেই শিঁউরে উঠল। এখন এটাই যেন ঘরের স্বাভাবিক অবস্থা হয়ে গিয়েছে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাথরুমে চলে গেল। মাথা আরো ভারী হয়ে গিয়েছে মনে হচ্ছে ওর— এখন এক কাপ কফি না হলে যেন মরে যাবে সে।

***

কিরি স্কুলের ক্যাফেটেরিয়ার জানালার ধারে বসে আছে। সকালের নরম আলোয় ওর ঘন কালো চুলগুলো সোনালি লাগছে। খোলা জানলা দিয়ে বাতাস বইছে মৃদু-মন্দ। কয়েক গোছা চুল কপালের সামনে দুলছে বাতাসের সাথে— সরাতে ইচ্ছা করছে না। ঘনঘন চোখের পাতা পড়ছে। নিঃশ্বাস দ্রুত হয়ে গিয়েছে। চিন্তার জগতে হারিয়ে গিয়েছে সে।

ও ভাবছে দাদুর কথা। দাদু! কে এই লোক, কোথা থেকে এল— সে কিছুই জানে না। শুধু জানে তিনি যা যা বলেছেন ওসব মিথ্যা। অন্তত ও সেটাই বিশ্বাস করতে চাইছে। কিন্তু যদি সত্য হয়? যদি সত্যি হয় তাহলে... তাহলে ওর সমস্ত জীবন ওলট-পালট হয়ে যাবে। ওর মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে, আর ভাবতে পারছে না। না ভেবেও থাকতে পারছে না। কি আছে ঐ ফাইলে? দম বন্ধ হয়ে আসছে ওর।

মাথার ভোঁতা যন্ত্রণাটা এখনো আছে। দুঃস্বপ্নের রেশ রয়ে গিয়েছে এখনো। দুঃস্বপ্নের কথা ভাবতেই শীতল একটা স্রোত বয়ে গেল মেরুদন্ড দিয়ে। 

সকাল সকাল বলে ক্যাফেটেরিয়া বেশ ফাঁকাই আছে। এখানে সেখানে কয়েকজন বসে নিজেদের মধ্যে গল্প করছে। কেউ হোমওয়ার্ক করে নিচ্ছে। আর কেউবা কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে ম্যাগাজিন পড়ছে। নিজেকে বড় একা লাগছে ওর এখন। 

কিরি উঠে যাবে যাবে করছে এমন সময় খাটো ছিপছিপে গড়নের একটা ছেলে ওর টেবিলে এসে বসল। গায়ের রঙ ফর্সা। মাঝারি করে ছাঁটা চুলগুলো খুব নিপুণভাবে আঁচড়ানো। চোখের চশমাটা মোটা ফ্রেমের— ভারী পাওয়ারের কারণে চোখ দুটো অস্বাভাবিক রকম বড় লাগছে। তবে চোখে মায়া আছে— ডাগর ডাগর করে তাকিয়ে থাকলে চোখ ফেরানো দায়। ইউনিফর্মটা খুব সম্ভবত ইস্ত্রি করা। কিরি একটু অপ্রস্তুত বোধ করল।

‘কিরি! তোমাকেই খুঁজছিলাম এতক্ষণ। একা একা বসে কী করছ?’

‘কিছু না নিনিত। কেন খুঁজছিলে?’

নিনিত উত্তর না দিয়ে কিরির দিকে তাকিয়ে থাকল। আরো বেশি অপ্রস্তুত বোধ করতে লাগল সে।

‘তোমার কি কিছু হয়েছে?’ নিনিত অবাক হয়ে বলল।

‘না, কেন?’

‘চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। চোখদুটোও লাল। ঘুম কম হচ্ছে?’

‘না, না,’ কিরি জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল। একটু হাসার চেষ্টা করল। ‘অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে একটু চাপের মধ্যে আছি— তাই হয়তো…’

কিরির গাল লজ্জায় লাল হয়ে গেল। অ্যাসাইনমেন্টের কাজ বেশি বটে তবে রাতে ঘুম না হওয়ার মত না। ও মিথ্যা বলছে নিনিত ঠিকই বুঝেছে নিশ্চয়! নিনিতের চেহারা দেখে কিছু বুঝা গেল না। সে আর কিছু জিজ্ঞাসা না করে ব্যাগপ্যাকটা খুলে কতগুলো খাতা বের করতে লাগল। 

‘এই যে… আমার পার্টটা আমি প্রায় শেষ করে ফেলেছি। তোমার পার্টটুকু জমা দিলে আমরা গ্রাউন্ড রিপোর্টে যেতে পারি। এই হপ্তার মধ্যে শেষ করলে খুব ভাল হয়, পরের হপ্তা থেকে আমার ফুটবল প্র্যাকটিস শুরু হয়ে যাবে।’

‘হ্যাঁ, নিশ্চয়,’ কিরি বলল। ‘আমার পার্টটুকুও প্রায় শেষ হয়ে আসছে। আজ কালকের মধ্যে হয়ে যাবে আশা করছি।’

‘অসাধারণ!’ নিনিত হেসে বলল। হাসলে ওর সামনের দাঁতের পেছনে ছোট্ট আরেকটা দাঁত দেখা যায়। কিরির নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসল। ‘তাহলে কাল দেখা হচ্ছে… পার্টনার!’ কাগজগুলো ব্যাগে গোছাতে গোছাতে বলল সে।

‘নিশ্চয়!’ 

নিনিত ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে উঠে পড়ল। কয়েকজন ছেলে আর মেয়ে ওর পিছু পিছু গেল ওর সাথে কথা বলতে। খুব সম্ভবত জুনিয়র। ফুটবল নিয়েই জানতে চাইছে হয়তো… অথবা কেবল ওর সাথে কথা বলতে চাইছে… কে জানে! নিনিত এদেরকে ভদ্রভাবে এড়িয়ে ক্যাফেটেরিয়া থেকে বের হয়ে গেল।

কিরির আবার অপরাধবোধ হল। সে তার অ্যাসাইনমেন্ট তো শুরুই করেনি। কালকের মধ্যে শেষ করা তো অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু নিনিতকে কীভাবে বলে! নিনিত ওকে অ্যাসাইনমেন্ট পার্টনার হিসেবে নেবে এটা ও কখনো কল্পনাও করেনি। যখন জানলো নিনিত ওকে পার্টনার করেছে তখন আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিল। এখন মারাত্মক লজ্জার মধ্যে পড়ে গেল। কী ভাববে ও এখন?

ভাবতে ভাবতে ঘণ্টা বেজে গেল। ক্লাস শুরু হয়ে গিয়েছে। কিরি তড়িঘড়ি করে উঠে পড়ল। ফাইনালের আগে এখন একদম শেষ পর্যায়ের ক্লাস চলছে। অ্যাসাইনমেন্ট আর গ্রাউন্ড রিপোর্ট জমা দেওয়ার পর শুরু হবে আসল পরীক্ষা। এখন ক্লাস মিস দেওয়া যাবে না।

হলরুমের করিডরের ভীষণ ভিড় ঠেলে কিরি ক্লাসে ঢুকে পড়ল।

***

কিছুক্ষণ আগেই এক পশলা বৃষ্টি হয়েছে। এখন বৃষ্টির তেজ কমে এসেছে— ফোঁটা ফোঁটা পড়ছে কেবল। কিরি এর মাঝেই পার্কিং-এর দিকে হেঁটে চলল। মাটির ভেজা গন্ধ এখন নাকে লাগছে ওর। এই গন্ধটা কিরির বেশ ভালোই লাগে। পরিবেশটা বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা হয়েছে বৃষ্টির পর। শার্টের গোটানো হাতার ভাঁজ খুলে দিল সে।

পার্কিং এর কনক্রিটের মেঝে বেশ পিচ্ছিল হয়ে গিয়েছে। খুব সাবধানে হাঁটতে হচ্ছে ওর। পার্কিং-এ খুব বেশি মানুষজন নেই এখন। বৃষ্টি পুরোপুরি থামার জন্যে অপেক্ষা করছে হয়তো। ও নিজের সাইকেলের লক খুলে পেছনের গেট দিয়ে বের হয়ে আসল। 

পেছনের এদিকে খেলার মাঠ। বৃষ্টির মধ্যে বেশ কিছু ছেলে ফুটবল খেলছে। অন্য পাশে মেয়েরা খেলছে হ্যান্ডবল। সাইকেল চালিয়ে যাওয়ার সময় কয়েকজন হ্যান্ডবল খেলা মেয়ে ওকে দেখে হাত নাড়ল— সেও হেসে হাত নাড়ল ওদের দিকে। 

সে যখন রাস্তায় উঠতে যাবে তখন দেখল একটা লম্বা ছেলে রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে। গায়ের রঙ বেশ শ্যামলা, চুলগুলো কোঁকড়ানো। সাইকেল হাতে ধরে রেখেছে। দেখে মনে হচ্ছে বেশ অধৈর্য নিয়েই অপেক্ষা করছে সে। কিরি বেশ শব্দ করেই একটা নিঃশ্বাস ফেলল। পেছন দিয়ে এসেও পার পাওয়া গেল না! 

‘জুন জুন! কি অবস্থা! বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছিস যে? কাক ভেজা হয়ে গেলি পুরো।’

জুন কোনো উত্তর দিল না। নাক দিয়ে ঘোঁত করে একটা শব্দ করে সাইকেলে উঠে বসলো। 

‘সরি! তোর সাথে দেখা করার কথা আমার মনেই ছিল না। ভেবেছিলাম স্কুল শেষ হওয়ার পর দেখা করি, কিন্তু শরীর খারাপ করছিল তাই আর অপেক্ষা করি নি। খুবই দুঃখিত!’

জুন এবারো কোনো উত্তর দিল না। দ্রুত প্যাডেল মেরে এগিয়ে গেল সে।

কিরি কি বলবে খুঁজে পেল না। নীরবতা ভাঙার জন্যেই বলল, ‘ফুটবল টিমে সিলেকশান হয়েছে তোর?’

জুন উত্তর না দিয়ে কিরির দিকে তাকাল কেবল। কিরির একটু মন খারাপ হল। আবারো নিশ্চয় সিলেকশান হয়নি। স্কুলের সবচেয়ে লম্বা না হলেও স্বাভাবিকের চেয়ে বেশ লম্বা জুন। গোলকিপার হিসেবে বেশ ভালোই খেলার কথা। কিন্তু কোনো এক কারণে ছোটবেলা থেকেই ওর সিলেকশান হচ্ছে না। কোচের সাথে ওর বাবার বনিবনা না থাকাও একটা কারণ হতে পারে।

কিরিকে অবাক করে দিয়ে জুন বলল, ‘হয়েছে।’

আচমকা ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়লো কিরি। নিজের কানকে সে বিশ্বাস করতে পারছে না সে এখনো। ‘কি বললি?’ 

‘সিলেকশান হয়েছে,’ সাইকেল থামিয়ে বলল জুন।

কিরি কথা খুঁজে পেল না। ইতস্তত করে বলল, ‘কিন্তু… কিন্তু…’

‘না, কোচ আমাকে সিলেক্ট করতে চায় নি। বাইরে থেকে কয়েকজন সিলেক্টর এসেছিলেন, ওঁদের সামনেই ট্রায়াল হয়। সব চেয়ে বেশি সেইভ আমি করি। ওঁরাও খুব প্রশংসা করছিলেন আমার খেলার। তাই কোচ ব্যাটা কিছু বলতে পারেনি। নিতে হয়েছে।’

কিরির আনন্দে জুনকে জড়িয়ে ধরল। ‘আমাকে আগে বলিস নি কেন?’

জুন আবার নাক দিয়ে ঘোঁত করে একটা আওয়াজ করল। ‘তোকে বলতে চেয়েছিলাম, তাই তোকে ছুটির পর দাঁড়াতে বলেছিলাম। কিন্তু তুই দাড়াসনি।’

কিরি লজ্জায় লাল হয়ে গেল। ধুর… আজ দিনটাই খারাপ!

ও কিছু বলতে যাবে এ সময় পেছন থেকে একটা ছেলে সাইকেল চালিয়ে এসে ওদের মাঝখানে দাঁড়াল। নিনিত। কিরি অবাক হয়ে গেল। 

‘অভিন্দন জুন!’ হেসে বলল সে। ‘অবশেষে আমরা একই টিমে খেলতে পারব। কি মজা!’

নিনিতের কথা শুনে কিরির উপর রাগ ঝাড়তে ভুলে গেল জুন। হেসে বলল, ‘তা ঠিকই। তবে স্পোর্টসে কিছু নম্বর পেলেই আমি খুশি, টেনেটুনে পাস এসে যাবে। আর কিছু নিয়ে চিন্তা করছি না।’

কিরি মনে মনে হাসল। সে জানে তার ছোটবেলার বন্ধুটার কত ইচ্ছে ফুটবল টিমে খেলার। এখন সুযোগ পেয়ে নিশ্চয় আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছে ও। কিন্তু নিনিতের সামনে ভালো সাজছে। 

নিনিত আরো কিছুক্ষণ জুনের সাথে কথা বলে ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। যাওয়ার সময় কিরিকে বলে গেল— কাল দেখা হচ্ছে। কিরি শুধু বলল, ‘নিশ্চয়!’

‘দেখেছিস আমার কি প্রশংসা করল ও?’ কিরিকে বলল জুন। ওর উপর যে রাগ করেছিল তা ভুলে গেছে ইতোমধ্যে। 

‘হুঁ,’ হেসে বলল কিরি। ‘পাস করলেই তো খুশি তুই। তা এখন এতো খুশি হওয়ার কী আছে?’

জুন কিছু না বলে হাসল। 

কিরিও হাসল। কিছুক্ষণ পর বলল, ‘বিকেলে আমার বাসায় আসবি একটু? কাল অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে হবে, কিন্তু আমার একার পক্ষে আজ সব শেষ করা সম্ভব না।’

জুন চোখ বড় বড় করে কি যেন বলতে চাইছিল কিরি ওকে থামিয়ে দিল। ‘তোকে কাল অরিনের বাসায় কেক খাওয়াবো। সেলিব্রেশন!’

জুন কিছুক্ষণ চিন্তা করার ভান করল। তারপর বলল, ‘শুধু কেক?’

‘আর কি চাস?’

‘ভেবে বলতে হবে।’

‘আচ্ছা ভেবে বলিস। আসবি?’

জুন হেসে বলল, ‘আসা যায়। কালকেই ডেডলাইন?’

‘হ্যাঁ,’ কিরি বলল। ‘নিনিতকে বলে দিয়েছি কালকেই জমা দিতে পারব।’

‘তাহলে তো আসতেই হয়,’ জোরে জোরে হেসে বলল জুন। ‘ফুটবল টিমের ক্যাপ্টেনের সামনে বেইজ্জতি হয়ে যাবে না হয়।’

কিরি ওকে লাথি মারবার জন্যে এক পা সামনে বাড়াল। সে পাশ সরে গিয়ে জোরে প্যাডেল চাপল। ‘বিকেলে দেখা হচ্ছে…’

কিরি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।

***

গেট খুলে ভেতরে ঢুকল কিরি। 

‘কেমন আছো, কিরি?’ বাগানে পানি দিতে দিতে অরিন বলল। 

অরিন ওদের পাশের বাসায় থাকে। বেশ বয়স হয়েছে— কিন্তু বাসার সব কাজ এখনো নিজ হাতে করতে ভালোবাসে। কিরির মতো একাই থাকে। সময় পেলেই কিরি অরিনের বাসায় চলে যায়— কিরিকে নিজের মেয়ের মতোই আদর করে, অনেক কিছু খেতে দেয় সে।  

বৃষ্টির দিনে গাছে পানি কেন দিচ্ছে তা জিজ্ঞাসা করার ইচ্ছা থাকলেও কোনো এক কারণে জিজ্ঞাসা করলো না কিরি। ‘ভালো, অরিন! তুমি কেমন আছো?’

‘খুবই ভালো। তবে গাছ’কটা মরে গেল দেখেছো! নতুন কীটের আমদানি হয়েছে নিশ্চয়!’

‘তাই হবে,’ বলতে বলতে বাসার দরজার নবে হাত রাখল কিরি।

‘কিরি!’

‘কি হয়েছে অরিন?’

‘তোমার বাসায় কি কেউ আসার কথা আজ?’

‘না তো,’ কিরি অবাক হল। ‘কেন বলছো?’

‘দুটো লোক দেখলাম একটা লাল গাড়ি করে আসলো। বেশ কিছুক্ষণ বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকল। আমি যখন জিজ্ঞেস করলাম কি কাজে এসেছে, ওরা আমার কথার উত্তর না দিয়ে মুখের উপর ধোঁয়া ছেড়ে চলে গেল! কত বড় অসভ্য দেখেছ?’

কিরি খুবই অবাক হল। কোন লাল গাড়ি? কোন দুটো লোক? ও তো এ ব্যাপারে কিছুই জানে না। হঠাৎ ও কিছু একটা ভাবল। এক দৌড়ে বাসায় ঢুকে পড়ল। 

‘আজ দেখি কেউ আমার কথার কোনো পাত্তাই দিচ্ছে না। যাক্‌গে বাবা, আমার কি!’ অরিন পেছন থেকে বলে উঠল। 

কিরি দৌড়ে ওর পড়ার রুমে চলে আসল। জুতোও খুলে নি এখনো। পড়ার টেবিলের সব গুলো ড্রয়ার খুলে চেক করতে লাগল সে। নেই! কোথাও নেই! সে আরো বেশ কিছু জায়গায় খুঁজে নিশ্চিত হল— ফাইলটা নেই। ওর ঠিক ঠিক মনে আছে, শেষবার ও চিঠিটার সাথে  ফাইলটা এই টেবিলের প্রথম ড্রয়ারে রেখেছিল। কিন্তু এখন চিঠিটাও নেই ফাইলটাও নেই। হাওয়ার সাথে মিশে গেছে একদম। বাসায় ও একাই থাকে। তাহলে কি… তাহলে কি সেই লোকদুটোই নিয়েছে? কিন্তু কেন? 

দাদু নামে লোকটা ওকে দিয়েছিল চিঠি আর ফাইলটা। চিঠিতে দাদু লিখেছিলেন ফাইলটা খুবই সাবধানে রাখতে, ওখানেই সব উত্তর লুকিয়ে আছে। চিঠিটা পড়েই সে খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল। পরে আর সে ফাইলটা খোলার সাহস সঞ্চার করতে পারেনি। কোনো একদিন খুলে দেখবে ভেবেছিল। কিন্তু এখন তো ওটা নেই!

মেঝেতে বসে পড়ল কিরি। মাথা ব্যথাটা এখন ফিরে এসেছে আবার। ওর মনে হচ্ছে এখন অজ্ঞান হয়ে গেলেই ভালো হয়— প্রথমে দাদুর ওসব উদ্ভট কথা আর এখন ফাইলটা নেই। কি বিপদে পড়ে গেল সে!

 

(চলবে)