রোববার
১৭ জুলাই ২০১১ খ্রি.
সন্ধ্যা
গাবতলী
বগুড়া।
শুভ্র
তোমাকে আবার চিঠি লিখবো এটা আমি কখনো ভাবিনি। ভাবার কোনো কারণও ছিলো না। কিন্তু লিখছি। তবে এটা চিঠি কিনা বুঝতে পারছি না। গত সপ্তাহে তোমার একটা চিঠি পেলাম। সেটাকে চিঠি না বলে একটা চিরকুট বলা ভালো। আমি যে শুভ্রকে চিনতাম সেই শুভ্র এই চিরকুটটা পাঠিয়েছে কিনা বুঝতে পারছি না। এতো দরদ দিয়ে লিখছি বলে ভাবার কোনো কারণ নেই যে তোমাকে আমি ক্ষমা করে দিয়েছি। তোমাকে আমি কখনোই ক্ষমা করতে পারবো না। আমার শরীরের প্রতিটি পশমও তোমাকে ক্ষমা করবে না। তুমি তো নিজেকে অনেক চালাক ভাবো। কিন্তু একটা প্রশ্ন করো নিজেকে। তুমি কি খুব জিতে গেছো? আমি জানি তুমি হাসতে হাসতে বলবে ‘হ্যাঁ আমি জিতে গেছি।’
কিন্তু তুমি কখনোই জিততে পারবে না। যে মানুষ নিজের কাছে হেরে যায় সে আর কখনো জিততে পারে না।
ঠক-জিত নিয়ে তোমার সাথে তর্ক করার জন্য আমার এই লেখা নয়। আসলে কয়েকদিন থেকে আমার তেমন কোনো কাজ নেই। সে জন্য তোমাকে লিখছি। সত্যি বলতে সব কথাই মানুষ কাউকে না কাউকে বলে। আর তুমি জানো আমার বলার মতো কেউ নেই। অনেক মানুষ আছে যারা আমার চারপাশে ঘ্রাণ নেয়। হা করে থাকে আমার শরীরের কোনো অংশ দেখে চোখ জুড়াবার জন্য। কিন্তু এমন কেউ নেই যে শরীরের লোভাতুর অংশ ভেদ করে মনের ঘর পর্যন্ত পৌঁছতে পারে। অবশ্য সেই অধিকারও এখন আর আমি কাউকে দিতে চাই না। কাউকেই না। মানুষ এক ভুল বারবার করে না। কিন্তু আমি একই ভুল দুই বার করে ফেলেছি। তৃতীয় বার আর সেই ভুল করতে চাই না।
একটু আগে অফিস থেকে ফিরেছি। তুমি হয়তো জানো না রাতুল আমার কাছে থাকে না। ওকে হোষ্টেলে দিয়ে দিয়েছি। যত বড় হচ্ছিলো ততই আমাকে খুব জ¦ালাচ্ছিলো। আমি একা থাকতে থাকতে এমন একটা অবস্থা হয়ে গেছে যে এখন কাউকেই আর সহ্য করতে পারি না। এই যে দেখো নিজের ছেলে—একদিন যার জন্য আমি সুইসাইড করতে গিয়েও করিনি। তার মুখের দিকে তাকিয়ে বেঁচে থেকেছি। অনেক দৌড়ঝাঁপ করে তার জন্য একটা চাকুরী নিয়েছি। সেই ছেলেটিকে আমি হোষ্টেলে দিয়ে একা একা থাকছি।
আমার লেখার মধ্যে কোনো দীর্ঘশ্বাস খুঁজে তুমি স্মৃতিকাতর হও এটা আমি চাই না। আমি যে কি চাই সেটাও ঠিক আমি জানি না। সামনের বৈশাখে আমার আটত্রিশ হবে। কিন্তু আমি নাকি পঁচিশেই আছি। এই কথা যখন কম বয়সী ছেলে বন্ধুরা বলে তখন মনে মনে খুব হাসি পায়। তারা তো জানে না শরীরের সব স্ক্রু ঢিলেঢালা হয়ে গেছে। আগের মতো আর জোয়ার আসে না। আগের মতো ঢেউ খেলে না সময়-অসময়। তারপরও মুখটা একটু শাদা বলে অনেক চোখ মুখে-বুকে আটকে থাকে। রাস্তায় হাঁটতে গেলে সেটা খুব টের পাই।
তোমাকে জান ডাকতাম মনে করে হাসি পাচ্ছে। জান কেনো যে ডাকতাম সেটা আসলে আমিও জানি না। হয়তো বন্ধুদের দেখতাম তারা প্রিয় মানুষকে জান জান বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলেছে। সেটা আমাকে প্রভাবিত করেছিলো। তোমার প্রতি আগ্রহ কমিয়ে নিয়েছি সে তো অনেক দিন হলো। কমিয়ে নিয়েছি মানে কমাতে বাধ্য হয়েছি। এছাড়া আর কিইবা করার ছিলো? তোমার ছন্নছাড়া জীবন। আমিই তখন নিজেকে টানতে পারছিলাম না। সাথে আবার সাত বছর বয়সী ছেলে। তাও আবার আনফিট। যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে রবীন্দ্র উপন্যাসের নায়িকার মতো আমি তখন একা একা কাঁদি। সেখানে হুমায়ূন আহমদের নায়িকারাও থাকে। সেখানে বেশি থাকে রূপা। আমি রূপার পায়ে ধরে মুক্তি চাই। নিজের পায়ে ধরে মুক্তি চাই।
আমি কি অপরাধ করেছিলাম শুভ্র? আল্লাহ আমাকে এই রকম একটা পরীক্ষার মধ্যে কেনো ফেললেন বলো। ছেলেটাকে এখন ক্রাচ কিনে দিয়েছি। ক্রাচে ভর দিয়ে একটু একটু করে হাঁটতে পারে। ওর দিকে আমি তাকাতে পারি না। তাকালেই আমার চোখ ভিজে ওঠে। ওর কি দোষ বলো? ওর তো কোনো দোষ নেই। ওর একজন মা আছে। একজন বাবারও দরকার ছিলো। কিন্তু আমি গলা উঁচু করে ওর বাবার পরিচয় দিতে পারি না। এই যে নিজের এলাকা থেকে এতো দূরে এসে চাকুরী করছি তা কেবল ওর বাবার পরিচয়টা গোপন করার জন্যই হয়তো।
তুমি জানো আমার পরিবারের সাথে যোগাযোগ নেই অনেক বছর। বাড়িতে যাওয়ার সুযোগও নেই। বাড়িতে ফিরে কার কাছে যাবো? শুনেছি ভাইয়েরা বাবা-মাকে ভাগ করে রাখতো। দুজন দুই ভায়ের কাছে! মা-বাবা কি ভাগ করার বিষয়? কিন্তু এই দুঃখের কথা আমি কাকে বলবো? মানুষ তার দুঃখের কথা স্বামীর সাথে শেয়ার করে। আমার তো স্বামী নেই। কখনো ছিলো না। আর কখনো হবেও না। আমার সন্তানকে কেউ জারজ বলে গালি দিবে সেই জন্য... সেই জন্যেই নিজের এলাকায় ভালো চাকুরীর সুযোগ থাকার পরও এই বগুড়ায় এসে থাকছি। না এখানে বেতন আমি খারাপ পাই না। যা কিছু ইংরেজি শিখেছিলাম সেটা এখানে কিছুটা কাজে লাগছে। কিন্তু তোমার তো জানার কথা না আমি বগুড়ায়-ই আছি। তুমি জানলে কেমনে? তোমাকে জিজ্ঞেস করলে সেই স্বভাবসুলভ জবাব দিবে।
‘আরে দুনিয়ার যেখানেই থাকো আমি ঠিকই জেনে যাই।’
‘এখনো কি সেই রকমই আছি তোমার কাছে? এখনো শতশত মাইল দূর থেকে আমার শরীর তোমার নাককে আবেগী করে দেয়? দেওয়ার তো কথা না। তোমার এখন সেইরাম একটা বউ আছে। টাকাওয়ালা বউ। আবার শুনলাম সে নাকি ভালো গানও করে। তুমিও আমাকে প্রশ্ন করতে পারো এতো কিছু আমি জানি কেমনে! তাহলে আমাকেও তোমার মতো হেসে উত্তর দিতে হবে—‘আরে ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়।’
আমি তোমাকে দূরে ঠেলে দিতে চাইনি। আমি চেয়েছিলাম তুমি যেন আমার সাথে বেশি জড়িয়ে না যাও। জড়ালে বরং একসময় তোমার নিজের প্রতি নিজের ঘৃণা লাগতো। আর সেই ঘৃণার ভাইরাস আমার মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েতো। তার থেকেই এই তো ভালো আছি। সকাল হলে রীন্দ্রনাথ। বিকেল হলে নজরুল। আর রাত হলে জীবন বাবু। মাঝে মধ্যে বিনয়। কি হাসছো যে! হাসো হাসো। তুমি তো বলেছিলে—মেয়েদের আসলে কবি হওয়া সম্ভব না। আমি কবি হতে চাইনি। আমি নিজেকে লিখতে চেয়েছি। তাই বলে তসলিমার মতো নেংটা হয়ে মানুষকে দু’পায়ের ভাঁজগুলো গোনাতে চাইনি। নিপলের ক্ষত দেখাতে চাইনি। শুধু বলতে চেয়েছি আমার বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কথা। নিজের অপমানের কথা। আর সেই সাথে মানসিক অবদমনগুলো লেখার মধ্যে ঝড়িয়ে ফেলতে চেয়েছি। খুউব কান্না পাচ্ছে শুভ্র। কাঁদলে কি তোমার মেজাজ খারাপ হবে? তাহলে জোর করে কান্নাটা থামিয়ে রাখবো। কতো কান্নাই তো থামিয়ে রাখি।
বারো পার করে তেরোর প্রথমে পিরিয়ড হলো। আমি তখন সেভেনের ছাত্রী। তখনো শরীরের বুঝটা অলৌকিক ভাষার মতো। সেই মাসেই আমার শরীরকে খুটেখুটে চিনে নিলো মেঝো কাকার শালা। সে আমাদের বাড়িতেই লজিং থাকতো। মাদ্রাসার ছাত্র। মুখে গোছা দাঁড়ি। পাঁচ ওয়াক্ত বাড়ির পাঞ্জেগানা মসজিদে আজান দিয়ে নামাজ পড়ে। আমার দাদি বলতো ‘ইস ছেলেটার গলায় সুর আছে। এক্কেবারে বেলালের মতো আজান।’ আমার দাদি তো জীবনে মক্কা-মদীনা যায়নি। আর গেলেও সেই সাহাবী বেলাল যে মায়াবী সুরে আজান দিতো তাতো শোনার কথা না। তার গলা চেনারও কথা না। তারপরও মুয়াজ্জিনের গলার সুরের ভক্ত হয়ে দাদি তাকে বেলালের সনদ দিয়েছিলো।
মায়ের কাছে ধরা খেয়ে গেলাম। বাবা ইচ্ছে মতো মারলো। আমার কি দোষ? আমাকে ছুরি দেখিয়ে বলেছিলো ‘কোনো শব্দ করলে মেরে ফেলবো।’
আমি তো কিচ্ছু বুঝি নি।
একটা অজগর সাপের ফোঁসফাঁস আমাকে দংশন করতে করতে আমার মধ্যে বমি করে দিলেছিলো।
আমি রান্না ঘরের খড়ের মধ্যে রক্তমাখা পাজামা নিয়ে অনেকক্ষণ শুয়ে ছিলাম। সেই বেলাল ভক্ত দাদীই যখন শুনলো আমার চার মাস তখন তার পীর সাহেব মুয়াজ্জিন হয়ে গেলো ইয়াজীদের চেয়েও খারাপ। বাড়িতে কোনো হইচই হলো না। খন্দকার বাড়ীর একটা মান সম্মান আছে তো! আস্তে করে বেলালকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হলো। আমাকে নিয়ে মা-বাবা আর কাকার দৌড়ঝাপ শেষে ঢাকায় বড় কাকার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। বেলাল চলে গেলো। কোথায় গেলো জানি না। কিন্তু আমার মধ্যে আরেক বেলাল বাড়তে লাগলো। ডাক্তারের পরামর্শে আমার পরিবার সেই বেলালকে স্বর্গে অথবা নরকে পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করলো। এখন আর লিখতে পারছি না। চোখ কথা শুনছে না। তুমি হয়তো অবাক হচ্ছো। আমি কাঁদি! হ্যাঁ আমিও কাঁদি...
সোমবার
১৮ জুলাই ২০১১
শেষ রাত। একটু আগে রুবী ফোন করেছিলো। রূবীকে মনে আছে তোমার? ওই যে শাহবাগে একদিন পরিচয় হয়েছিলো। ওহ এরপরও তো দু-তিন দিন দেখা হয়েছে তোমার সাথে। ওর শাশুড়ী মারা গেছে। ওর কথায় কোনো শোকের আভাস পেলাম না। বরং মনে হলো খুশিই হয়েছে। বেশ কয়েক বছর থেকে বিছানায় পড়ে ছিলো। শেষ দিকে বিছানায় পায়খানা করতো। সেগুলো পরিষ্কার থেকে শুরু করে তাকে খাওয়ানোর সব কাজ ওকেই করতে হতো। রুবীর স্বামীর কথা তো তোমাকে বলেছি। শহরের পরিচিত সাংস্কৃতিকর্মি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজীতে পাস করা বউকে দিয়ে নিজের মায়ের গু-মুত পরিষ্কার করিয়েছে। এই হলো শালার লুচ্চা বাঙালি পুরুষ। ধোনের জ্বালা মেটাতে বউয়ের পা ধরে। আবার সেই বউকেই চোখ রাঙিয়ে নিজের মায়ের গু-মুত পরিষ্কার করায়। এসব কথা যে তোমাকে শোনাচ্ছি তারও একটা মানে আছে। তুমিও তো কতো উদারতা আমাকে দেখাইতা! ‘না না ছেলে আছে তো কি হয়েছে ও তো আমার ছেলের মতোই থাকবে। আমি ওসব বিলিভ করি না।’
বিকলঙ্ক শুনে একটু থতমত খেয়ে গেছিলা।
তারপরও আমতা আমতা করে বলেছিলে ‘না না সমস্যা নাই আমরা দু’জনে মিলে ওকে দেখবো।’
কি দেখতে সেটা এখন আমি ভালো করেই বুঝতে পারছি। আমার অবস্থাও রুবীর মতোই হতো। অবশ্য আমি ওমন মুখ বুঝে সহ্য করতে পারতাম না। তোমার সাথে মারামারি লেগে যেতো।
ও হ্যাঁ তোমার বউকে কি মারো? একদিনও মেরেছো? কি হাসছো? হাসো আর যাই করো। আমার মনে হয় তুমি বউকে মারো। না হয় সে তোমাকে মারে। সেটা স্বীকার করো আর নাই করো। কারণ এই দুনিয়ায় দখলদারিত্বই সব চেয়ে বড় বিষয়। কে কাকে দখল করে রাখতে পারছে সেটাই মূল ব্যাপার। সেই জন্যই একা পাখি একা থাকি। কেউ দখল করতে পারে না।
অনেক কিছুই করতে মনে চায়। পারি না। পারাটা আমাদের এই সমাজ সহ্যও করবে না। এই যে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছি প্রায় তের বছর। কই পরিবারের কেউ তো আর আমাকে টেনে তাদের মধ্যে জড়িয়ে রাখতে চায়নি। আর এখন তো আরো দূরে ঠেলে রাখতে পারলে ভালো হয়। বাবা-মা দুজনেই পটল তুলেছে। জায়গা-জমির ভাগ বাটোয়ারা হবে। আমাকে সরিয়ে রাাখতে পারলে তাদের ভাগে বেশি পড়বে।
অনেক ক্ষোভের কথা বললাম শুভ্র। আমি জানি তুমি রাগ করোনি। তুমিও জানো—আমি যত হইচই করি ভেতরে ভেতরে এই আমি ততোটাই একা। অসহয়। এই অসহয় মানুষটাকে রেখে তুমি চলে গেলে! কেনো গেলে বলো? আমি কি তোমাকে ভালো রাখতে পারতাম না? আমি কি ফুরিয়ে গেছি? আমার মধ্যে কি কোনো মন নেই? আমি কি কাউকে ভালোবাসতে পারি না? ভালোবাসা কি দুনিয়ার সব সাধু মানুষের জন্য? প্লিজ বলো। আমি কি নিজের ইচ্ছায় নিজেকে এই অসহ্যের মধ্যে ঠেলে দিয়েছি? আমার কি দোষ ছিলো? আমি কি কুমারী মাতা হতে চেয়েছিলাম? আমার স্বপ্নটা এখন আর আমার সাথে কথা বলছে না। তার চোখেও পানি। সে আমাকে সারা জীবন ধরে হতাশ করেই গেছে। সে কি বলবে আমাকে। আমিও আর তার কাছে কিচ্ছু চাই না। আল্লার কাছেও চাই না। আমি যে পাথরের গলিতে জীবন আটকে রাখছি সেটা কি সে দেখে না! আমার শরীর নাই! আমার জীবন কেনো এমন হলো! একবার বলো। প্লিজ একবার বলো!
মঙ্গলবার
১৯ জুলাই ২০১১ খ্রি:
এখন শেষ বিকেল। বিদায়ী সূর্যের সাথে আমার মন লুকোচুরি খেলছে। একটু আগে একজন ফোন করেছিলো। নাম বললে তুমি চিনবে। নাম বলা যাবে না। দুই বছর ধরে এই বুড়ো আমার পিছনে ঘুরছে। কয়েকবার বিয়ের অফার দিয়েছে। বুড়ার টাকার কোনো অভাব নেই। আমেরিকায় থাকে। ওখানে একটা বউ আছে। বছরে দু তিন মাস দেশে থাকে। এখানের ব্যবসা দেখতে আসে। এখানে একটা বিয়ে করতে চায়। গোপনে।
লোকটার প্রতি আমার খুব মায়া হলো জানো। কিন্তু কেনো মায়া হলো জানি না। তবে লোকটাকে আমি হ্যাঁ বলতে বলতে পারলাম না। আমার ছেলেটার কথা চিন্তা হলো। আমাকে তো সে দেখবে কিন্তু আমার ছেলেটা। তাকে তো ছুঁড়ে দিতে চাইবে। আমি ছেলের কথা বললে বলবে—ওই ছেলেটার তো কোন বাপ নাই। শেষে আমাকেও গাল দিবে। সামনে না দিলেও মনে মনে দিবে। শেষমেষ এখানেও ধাক্্কা খেতে হবে। আর কতো হোঁচট খাবো বলো। তার থেকে ছেলেটা আছে। আমার কবিতা আছে। এই জগত নিয়ে বাকী সময়টা কাঁটাতে চাই। তুমি দোয়া তো করবে না। তবে বদদোয়াও করিও না। মাঝে মাঝে মনে হয় কি জানো? সব ছেড়ে ছুঁড়ে নামাজ-রোজা শুরু করি। কিন্তু যে আল্লাহ আমার এই ফুলের মতো জীবনটাকে একজন বেলালকে দিয়ে নষ্ট করে দিয়েছে। সেই আল্লাকে সিজদা দিতে গিয়ে কেমন যেন গা ঘিন ঘিন করে ওঠে।
বেলালের খোঁজ নিতে ইচ্ছে করে। হয়তো সে এখন কোনো মসজিদের ইমাম। মক্তব পড়ায়। মক্তবে পড়তে আসা মেয়েদের সদ্য গজিয়ে ওঠা বুকে হাত দেয়। আর বছর বছর দেশের জনসংখ্যা বাড়ায়। আরে চুদিরপুত কন্ডম ব্যবহার যদি হারাম হবে তাইলে তামাম দুনিয়ার সব মেয়েদের ভোদায় তোর মাল ঢাল। তাতেও যদি তোর ধোনের খিদা না মেটে তাহলে পুরো দুনিয়াডাই ভাসাইয়া দে। সরি শুভ। আমার মুখ খারাপ হলে গালি দিতেই থাকি এটা তুমি জানো। তোমার কান গরম করে ফেলেছি মনে হচ্ছে। কিন্তু কি করবো বলো? মাথাটা ব্যথা করছে। একটু ঘুমাই। এখন লিখলে চ, ছ ছাড়া আর কিচ্ছু আসবে না।
ঘুমটা ভেঙে গেলো। এখনো সন্ধ্যা হয়নি। আজকের আবহাওয়াটা কেমন যেন। মনটাকে বাউল করে দিচ্ছে। এই দ্যোতনা হয়তো ভালো না আবার খারাপও না। কেমন যেন রহস্যময়। আবহাওয়ার যদি কোনো রঙ থাকতো তাহলে এই রঙটা নিশ্চয়ই আমার অপছন্দের রঙের মতোই হতো। আমার প্রিয় রঙ দুটি। একটি নীল। আরেকটি কালো। আর ঠেকায় পড়লে কখনো কখনো গোলাপিকেও প্রিয় রঙ বলি। এই তিন রঙ বাদে যে কোনো রঙের হতে পারে আজকের আবহাওয়াটা। যে রঙটাকে আমি আবিষ্কার করতে পারছি না। তবে সে রঙটা আমার প্রিয় সব রঙের থেকে অন্য রকম। তাকে যেমন গালি দিতে ইচ্ছে করছে না। আবার মাথায় হাত বুলিয়ে সান্তনাও দিতে ইচ্ছে করছে না। ইচ্ছে করছে না প্রথম প্রেমিকের ঠোঁটে চুমু খাওয়ার মতো বুকে জড়িয়ে তার শরীরের উত্তাপ নিতে। তাহলে কি করবো এই নিরাবরণ আবহাওয়া দিয়ে!
যদি সে পাখি হতো তাকে পাঠিয়ে দিতাম জীবন বাবুর ধানসিড়িতে। বেদেদের নৌকায় ঘুরে ঘুরে ইলিশের গন্ধ নিয়ে আসতো। বহুদিন প্রাণ ভরে ইলিশের গন্ধ খাওয়া হয় না। আহা ইলিশ। আহা আমার মধুখাখি! তোমারও সেইসব দিনগুলো দেখার ইচ্ছে জাগে? আমাকে দেখার ইচ্ছে জাগে! জাগলে রাত-দিন তুমি ওমন রাতের সিঁথিতে হাঁটো কেনো! তুমি তো তোমার মতোই একা একা বৃষ্টির নখে। দাঁতে আঁচর নিয়ে ঘুমাতে পারো। তোমাকে কেউ জাগাবে না। কেউ তোমাকে ঘুম ভাঙিয়ে জিজ্ঞেস করবে না। ‘আচ্ছা বাবু বলো তো এখন ক’টা বাজে?’
দেখো টাইমের ব্যাপারে আমার কোনো তোয়াক্কা নেই। তুমি তোমার মতো মেঘের ফাঁকে—রোদ্দুরের জঙ্গলে নিজেকে শানিয়ে নিতে পারো। আর আমি এই মর্মের ফ্ল্যাপে থাকা আবহাওয়ায় গোলাপের কথা ভাবি। মিষ্টি আলুর কথা ভাবি। খ্উুব খই খেতে ইচ্ছে করে। হেঁসেলের ওম নিয়ে শরীরে একটু তাগুত আনার ইচ্ছে হয়। শহরের বনবাসে নিজেকে কেমন খাঁচাবন্ধী প্রাণীর মতোন তুচ্ছ লাগে।
একেকটা দিন-রাত ঠোঁট বাঁকিয়ে গালি দিয়ে যায়। আমি কিচ্ছু বলতে পারি না। চুপ করে থাকি। চুপ করে থাকাটাই এখন আবার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। এই অভ্যাসটা আমি একদিন কিনতে চেয়েছিলাম। তখন আমি হইরই করে কথা বলতাম। গাছ-পাখি-নদী সব বিরক্ত হতো। এখন আমি খাঁচা দেখি। মদের গন্ধ নাকে নিয়ে নিজের গন্ধ তাড়াতে চেষ্টা করি। নিখুঁত চিন্তায় আরেকবার ডুব মারতে ইচ্ছে হয়। হোতা খালের বাড়শিতে নিজেকে গেঁথে দিলে কেমন হয়? কেউ তো আর দেখছে না। আমি এই স্যাঁতস্যাঁতে অযোগ্যতার ভেতরে কতোটা ঘামছি। কতোটা ক্ষয়ে যাচ্ছি শীতল ঈর্ষায়...
তোমার দিকে দূরবীন হাতে দাঁড়ানো পথিক...
সেতু