পৃথিবীর জন্য ভালবাসা
(১)
লাউয়ের মাঁচাটায় আগে দোয়েল পাখি শিষ দিত। প্রতিদিন সকালে নিয়ম করে। সারা দিন কিচির-মিচির করত দুরন্ত চড়–ই পাখির দল। এখন ওরা নেই। নেই ওদের চঞ্চল ওড়াওড়ি, নেই একটুও কলরব। চারদিকে শুনসান নীরবতা। শুধু সিরসির শব্দ করে কলাপাতা বাতাসে নড়ে। উড়ন্ত বুনোহাঁসের ডানার মত। মাঁচার নিচে কচি কিছু লাউ দোল খেতে থাকে। শুষ্ক, প্রাণহীণ। বেড়ে ওঠার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই।
একচিলতে এই সবুজের মধ্যে কোনরকম একটি কুঁড়েঘর। প্রথম দেখায় মনে হবে ছোট একটা হাতি আলুথালি বসে গেছে সবুজটার মধ্যে। মতিন এই জবুথবু কুঁড়েঘরে থাকে। সেও প্রায় ছ’মাস হতে চলেছে।
মাঝে মাঝে হালকা দমকা বাতাস বয়। সে বাতাসে ভেসে আসে ঝাঝালো কটূ একটা গন্ধ। মতিন নাক দুটো চেপে ধরে তখন। তীব্র একটা শঙ্কা টের পাই ভিতর ভিতর। বুকটা কুকড়ে আসে। মনটা বাধা দেয় শক্তভাবে। মনে হয় এই বুঝি তার ছোট মণি তার বুকে ফেরত আসবে। হাত ধরে তার সাথে ফিরবে তার স্ত্রীও। ওরা আসলে দোতলা বাড়িটাই আবার উঠবে তারা। সবকিছু আগের মত হবে। বারান্দায় জিবুর ছোটাছুটি দেখবে সারাদিন। বিকেলে ছাদে বড় লেজওয়ালা ঘুড়ি ওড়াবে।
নিঃসঙ্গ সময়। আগের মতই সূর্য পশ্চিমাকাশ লাল করে অস্ত যায়। আঁধার নামে কালো করে। বিষন্ন সে আঁধারে চিন্তাভাবনা গুলো ধোয়াশে হয়ে আসে মতিনের। মাত্র বছরখানেকের মধ্যে চেনা পৃথিবী উল্টে গেছে।
স্মৃতিরা খুব ধীরে নিস্তরঙ্গ পানির ¯্রােতের মত বয়ে চলে মতিনের সমস্ত সত্ত¡ায়। নির্মীলিত চোখের তারায়।
(২)
আমি ‘জ্যাকেল-১২’ এর সম¥ুখভাগে দাড়িয়ে অনন্ত শূণ্যতার দিকে তাকিয়ে থাকি। জাহাজে চড়লেই আমার তীব্র সু² অনুভূতি গ্রাস করে ফেলে। প্রতিবারই এমন হয়। এই বিশাল মহাশূণ্যে নিজের অস্তিত্বের বিন্দুসম ক্ষুদ্রতা টের পাই। নিষ্পাপ অর্থহীনতায় বুক ভরে ওঠে। প্রতিবারই আমি সিদ্ধান্ত নেয়- ‘আর না। আর কখনও জাহাজে চড়ব না। মহাকাশে কোন এক্সপিডিশনে বের হব না।’
কিন্তু কোন অভিযানে ডাক পড়লেই আমার রক্ত চঞ্চল হয়ে ওঠে। স্থির থাকতে পারি না তখন। দৌড়ে সেন্ট্রাল কমান্ড সেক্টর ভবনে গিয়ে রেজিট্রেশন করে আসি। আর ডেস্কের মহিলা প্রতিবার আমার দিকে এগিয়ে এসে মুখ টিপে হাসে। ‘এক্সটিঙ্ক সার্চ ০১’ অভিযানের জন্য রেজিস্ট্রেশনের জন্য গেলাম। একইভাবে মহিলা মুখ টিপে হেসে টিপ্পনী কেটে দিল- ‘মহাশয়ের কি এটি শেষ অভিযান?’
আমি এ কথার মধ্যে হিউমারটুকু আমলে নিয়ে মুচকি হাসি দিলাম। বললাম- ‘যদি এর পরেরবার আপনি সঙ্গে যান, তাহলে না!’
কোৎ করে মহিলা একটু শব্দ করল। বোধ হয় হঠাৎ আসা দমকা হাসি ঠেকানোর চেষ্টা করল। আমার পাল্টা হিউমারটুকু সে গ্রহন করল কষ্টসাধ্যে। ‘খুব পেকে গেছ, ছোকরা।’ বলে আমার রেজিস্ট্রেশন শেষ করে হলোগ্রাফিক আইডি কার্ডটা আমার হাতে ধরিয়ে দিল। মুখের দুপাশে বেঢপ আকারে ঝুলে পড়া কান দুটো দুবার নেড়ে আমাকে অভিবাদন জানাল।
একবার নাড়লে সে হতো শুধু ভদ্রতা। দুবার কান দুলানো অর্থ মন থেকে কাউকে শুভকামনা জানানো। আমার হৃদয় প্রসন্ন হয়ে গেল। মহিলাটা তাহলে অত খারাপ নয়।
ভাবতে ভাবতে আমি ভবন থেকে বের হয়ে বড় রাস্তায় বের হয়ে আসলাম। হঠাৎ মনে হল মহিলাটা পিছন থেকে আমার কাধে হাত রাখল। আমি চমকে ওঠতেই দেখি, না আমার পিছনে নিঃশব্দে এসে দাড়িয়েছে ত্রি। আমি এত চিন্তামগ্ন হয়ে গিয়েছিলাম যে ওর হাতকে মহিলার হাত বলে ঠাওর করে ফেলেছি।
ত্রি আমার দিকে তাকায় শুষ্ক মুখে । আমি বুঝতে পারি ত্রির মন খারাপ। কিছু জিজ্ঞাসা করি না। তাকিয়ে থাকি। আমি জানি ও নিজেই বলবে।
‘বাচ্চাটা খুব কাঁদছে’, ত্রি আগের মত মুখ শুষ্ক রেখে বলে। গলায় কাঁদো কাঁদো একটা ভাব।
আমাদের ছায়াপথের একটা গ্রহে বাচ্চাটি আমরা পেয়েছি। ওর বাবা-মা মারা গেছে আমাদের চোখের সামনেই। তারপর পুরো গ্রহটি আমরা খুজেছি। ছোট গ্রহটি ধ্বংসপ্রায়। পুরো গ্রহজুড়ে বিষাক্ত পদার্থের ছড়াছড়ি। পাথুরে ভূমি ফুটে ফুটে জায়গায় জাযগায় আগুন বের হচ্ছে। নদীগুলো শুকনো। এ গ্রহে আর কেউ জীবিত নেই নিশ্চিত হয়ে আমরা আমাদের অনুসন্ধান শেষ করেছি।
মৃত গ্রহ থেকে বিলুপ্তপ্রায় প্রানীদের সন্ধান করে তাদের শেষ প্রজন্মকে উদ্ধার করাই আমাদের ‘এক্সটিঙ্ক সাচর্- ০১’ অভিযানের উদ্দেশ্য। সে জন্য আমরা ‘জ্যাকেল ১২’ জাহাজে চড়ে লক্ষ লক্ষ আলোকবর্ষ মাইল চষে বেড়াচ্ছি। ত্রি, ¯্রি আর আমি ¤্রং। অধিবাসীরা বাস করে এরকম গ্যালাক্সি থেকে অন্য গ্যালাক্সি ছুটছি আমরা তিনজন। অবশ্য জাহাজ চালানোর জন্য কিছু ক্রু আছে। আর অভিযানের দায়িত্ব আমাদের তিনজনের।
বাচ্চাটি তাদের প্রজাতির শেষ বংশধর। তাকে বাচিয়ে রেখে তার জন্য উপযোগী একটা গ্রহ আবাস খুঁজে দেওয়ার গুরুভার এখন আমাদের।
আমি ত্রির হাত ধরে বলি, ‘চলো দেখি’।
(৩)
সবকিছু কত দ্রæত ওলটপালট হয়ে গেল। মতিন ভাবে। কিছুদনি আগেও মোবাইলের এফএম রেডিও দিয়ে সে খবর পেত শহরগুলোর। এখন এফএম রেডিও চলে না । শুধু শো শো শব্দ ভেসে আসে স্টুডিও থেকে। মতিনের আশংকা হয়, স্টুডিও চালানোর মত কেউ আর বেচে আছে কিনা!
বছরখানেক আগেও ঠিকঠাক ছিল সবকিছু।
সহজ-সামাজিক ছবির মত জীবন ছিল। শহরের দূষণ আর কদর্যতা এ দূরের গায়ে লাগেনি কখনও। তবে ফি বছর আগে তারা টেলিভিশনে দেখল শহরগুলোতে শ’য়ে শ’য়ে মানুষ মরা শুরু হয়েছে। ভাইরাসের সংক্রমণ। এক জন থেেেক আরেকজন। অল্প সর্দি কাশি। তারপর শ^াসকষ্টে মারা যাচ্ছে নিমিষে। আজব গজব। ঠিক ভয় না, প্রকৃতি-রহস্যময়তায় সবার বুক থেকে দীর্ঘশ^াসই বেরিয়ে আসত শুধু। তারপর জীবনের স্বাভাবিক ছন্দে এগিয়ে চলত সবকিছু।
প্রথম প্রথম ভয় না পেলেও গায়ের লোকেরাও শঙ্কিত হয়ে উঠতে থাকল ধীরে ধীরে। টেলিভিশনে খবর হয় রোজকার। তারা জানতে পারল মানুষ মরা থামেনি। বেড়েছে দ্বিগুন হারে। শহরের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ছে ভাইরাস। ভাইরাস-২০২০।
মতিনের স্ত্রী তাকে একদিন জিজ্ঞাসা করল- ‘আমাদের গায়ে আসবে না এ ভাইরাস, কি বল?’ অজানা একটা শঙ্কা স্ত্রীর গলায় টের পাই মতিন। সেও কয়েকদিন ধরে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে।
জিবুকে সে আগলে রাখতে শুরু করল। কিসের থেকে, সে তখনও ঠিক জানত না। জানলে বুঝত, ভাইরাস-২০২০ এসেছে সাক্ষাৎ শয়তানের মুখ গহŸর থেকে। কোন কিছু দিয়েই আর আগলে রাখা যাবে না প্রিয়জনকে।
চারপাশের ভয় শিশুদের মাঝেও সংক্রামিত হয়। বাবার অতিমাত্রার সতর্কতাও টের পেল জিবুর ছোট্ট মন। বাবাকে সে বলেছিল একদিন- ‘বাবা ভাইরাস কি আমাকেও মেরে ফেলবে?’
মতিনের বুকটা করুণ আর্তনাদ করে ওঠেছিল সেদিন। কিন্তু মেয়েকে কিছু বুঝতে দিতে চাইনি সে। মতিন জবাব দিয়েছিল, ‘আমি থাকতে কেউ তোমাকে মেরে ফেলতে পারবে না, মা। কেউ না।’
‘বাবা, ভাইরাস কি?’
‘হাতের ময়লা, মা। ধুয়ে ফেলতে হয়।’
এই বলে মেয়েকে বুঝিয়ে রাখত মতিন।
জিবু তার একমাত্র মেয়ে। মতিনের বয়স প্রায় ষাটের কাছাকাছি। নিঃসন্তান ছিল সে। বৃদ্ধ বয়সে এসে যখন সে সন্তানের আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল, তখন তার স্ত্রী গর্ভবতী হল। সেদিন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আনন্দ সে পেয়েছিল। জিবু ভূমিষ্ঠ হওয়ার সাথে সাথে তার স্ত্রী মেয়েকে মতিনের কোলে দিতে বলেছিল। মতিন কাঁপা কাঁপা হাতে কোলে নিয়েছিল জিবুকে- যেন এক টুকরো নরম মাংসপিন্ড। চোখদুটি খুলে যখন মতিনের দিকে পিটপিট করে জিবু চেয়েছিল, মতিনের মনে হয়েছিল, এক টুকরো বেহেশতখানা বুঝি তার কোলে নেমে এসেছে।
এই যক্ষের ধন, আনন্দধারা, প্রিয় কন্যার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে মন। করোনা যদি মানুষের কথা বুঝত, মতিন তাহলে তাকে গিয়ে বলত, আমার প্রাণ আমার সব নিয়ে যাও, শুধু আমার জিবুর দিকে তাকিয়ো না।
গায়ের মানুষও মরতে থাকল কিছুদিন বাদেই। প্রথমে মারা গেল দবীর চাচা। বয়োবৃদ্ধ। মতিনের গ্রামের সবথেকে বয়স্ক ব্যক্তি। মতিনের মনে একটু আশা জাগল জিবুর বয়স অল্প। ভাইরাস নিশ্চয় তার কাছে আসবে সবার শেষে। তাতে কিছুকাল সময় পাওয়া যাবে। এরমধ্যে শহরের বড় বিজ্ঞানীরা যদি প্রতিষেধক আবিষ্কার করে ফেলে, তাহলে জিবুকে সে যেভাবেই হোক বাচিয়ে রাখতে পারবে।
কিন্তু সপ্তাহখানেকের মধ্যে গ্রামের অর্ধেক মানুষ শেষ হয়ে গেল। শহরের হাসপাতালগুলোতে কোন জায়গা নেই। কিছু বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, কিছু হাসপাতাল নিজেই পরিণত হয়েছে মৃত্যকূপে- নেই ডাক্তার নেই ওষুধ। শুধু রোগী আর রোগী।
স্ত্রী যেদিন মারা গেল. মতিনের সব আশা এক ফুৎকারে নিভিয়ে দিল কেউ। জিবুকে বুকে চেপে সে পালিয়ে এল গাঁ থেকে। কিন্তু যাবে কোথায়? চারদিকে মৃত মানুষের দুর্গন্ধ। আকাশের শকুনেরা ডানা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে।
গাঁ থেকে খানিকটা দূরে বনের ধারে সে থাকা শুরু করল মেয়েকে নিয়ে। পাশেই দিগন্তজোড়া তার সবুজক্ষেত। এই সবুজটুকুর মধ্যে সে ছোট একটা কুঁড়ে ঘর বানিয়েছিল। ভাবত, জিবুকে যেন কিছুতেই ভাইরাস খুজে না পায়।
পরের সপ্তাহেই মারা গেল জিবু। মতিনের আর কিছু রইলা না। মেয়েকে বুকে চেপে সে আকাশ পাতাল কাঁপিয়ে রোদন করতে থাকল।
এখন পুরো গাঁ খালি। কেউ নেই বেচে। মতিন ধুকছে মৃত্যুপ্রতীক্ষায়। কে জানে, শহরগুলোতে মতিনের মত কেউ বেচে আছে কিনা।
(৪)
পৃথিবীতে নামি আমরা তিনজন। আমি, ত্রি আর ¤্রং। পৃথিবীতে এই প্রথম ভিনগ্রহের কোন অধিবাসী পা রাখল। আমরা পৃথিবীর ইতিহাস ঘেটে দেখেছি। আমাদের আগে আর কোন এলিয়েন এসে পৌছায়নি।
কিন্তু পৃথিবীর বুকে পা দেওয়ামাত্র আমাদের অনুভূতি হয়, বড্ড দেরি করে ফেলেছি আমরা।
অক্ষাংশ-দ্রাঘিমা ঠিক করে আমরা এগুতে থাকি। একটু এগোতেই একজন মানুষকে বসে থাকতে দেখি ছোট একটা কুঁড়েঘরের পাশে। ক্ষীণকায় দেহ। চোখদুটি কোটরে ঢুকে গেছে।
আমরা দেখতে পৃথিবীর মানষের মত না। গোলাকার দেহের সাথে চারজোড়া পা। দেহের ওপর চারকোণা বর্গাকার মনিটরে আমাদের মাথা, মুখ, চোখ। চারপাশেই লাগানো। একজায়গায় স্থির দাড়িয়ে চারপাশে আমরা সমানভাবে যোগাযোগ রাখতে পারি। বিশাল কান দুটো ঝুলে থাকে দুপাশে। পৃথিবীর যে কোন মানুষের কাছেই এ চেহারা কিম্ভূতকিমার ভয়ংকর লাগার কথা।
কিন্তু মানুষটি আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। কোন বোধ হয় না। যেন খুব পরিচিত কেউ এসেছে মানুষটির সামনে। পৃথিবীতে নামার আগে মানুষের সাথে কিভাবে যোগাযোগ করেতে হয়, সম্ভাষণ জানাতে হয় জাহাজের হিস্টোরি মেমোরি প্যানেল থেকে শিখে এসেছি। কিন্তু মানুষটিকে দেখে আমার ভেতরটা দমে যায়। ত্রি এগিয়ে যায়। বরাবরের মত স্বতস্ফূর্ত সে।
‘হে পৃথিবীর মানুষ, আমরা এসেছি দিব্রাং গ্রহ থেকে। পৃথিবীর ছায়াপথ থেকে অনেক দূরের গ্যালাক্সিতে আমাদের বাস। দিব্রাং গ্রহের পক্ষ থেকে আপনাকে জানাচ্ছি সম্ভাষণ।’ ত্রি বলে একটু থামে।
মানুষটি নির্বিকার চেয়ে থাকে। ত্রি একটু থেমে আবার বলে- ‘আমি ত্রি, আর এরা আমার বন্ধু, ¯্রি এবং ম্রং’। মানুষটি চোখ তুলে আমাদের দিকে তাকায়। কিছু বলে না।
‘আপনার নাম কি?’ আবার জিজ্ঞসা করে ত্রি।
‘মতিন’। আস্তে করে জবাব দেয় মানুষটি।
‘আপনি আমাদের সাথে যেতে পারেন। আমাদের গ্রহে। পৃথিবীতে আপনি আর বাচতে পারবেন না।’
‘তাই? শহরের মানুষেরা কি সব শেষ?’ ক্ষীণ স্বরে জিজ্ঞাসা করে মতিন।
‘হ্যা, সব শেষ। আমাদের অনুসন্ধান যন্ত্র বলছে, আপনি পৃথিবীর শেষ মানুষ। আর কেউ বেচে নেই পৃথিবীতে।’ আমি বলি।
হালকা দীর্ঘশ^াস ছাড়ে মানুষটি। আমার মনে হয় সে অনুভব করতে পারে না এই খবরের নির্মমতা।
‘আমার শরীরে ভাইরাস।’ মানুষটি বলে আমাদের দিকে তাকায়।
‘আমাদের কাছে প্রতিষেধক আছে। আপনাকে আমরা সুস্থ করে তুলব।’
এই প্রথম মানুষটিকে চরম উত্তেজিত হতে দেখি। টলতে টলতে সে উঠে দাড়ায়। তারপর শরীরটা কেঁপে ওঠে। হুড়মুড় করে পড়ে যেতে থাকে। ত্রি পাশ দিয়ে তাকে ধরে ফেলে। তীব্র কান্নায় চিৎকার করতে থাকে। একটু সংযত হতে বলে-‘আর কিছুদিন আগে আসেন নি কেন, আপনারা? জিবুকে তাহলে বাচাতে পারতাম। জিবু আমার জিবু।’
আমরা কিছু বলি না। মানুষটাকে ধাতস্থ হতে সময় দেই।
আমাদের সাথে থাকা একটু পানীয় মানুষটাকে খেতে দিই। মনে হয় তাতে সে একটু হালকা বোধ করে। ত্রি মানুষটাকে ধীরে ধীরে বুঝিয়ে বলে আমাদের অভিযানের উদ্দেশ্য। বিলুপ্তের দ্বারপ্রান্তে থাকা কোন জীবজাতিকে বাচানোই আমাদের একমাত্র অভিপ্রায়। মানুষটি যদি যেতে চায় আমাদের সাথে, তাহলে হয়ত তার ডিএনএ কেøানিং করে নতুন বংশধর তৈরি করে দিতে পারব আমরা। তারপর কোন একটা গ্রহে নামিয়ে দিবো তাদের, যেখানে নতুন করে মানব সভ্যতা শুরু করতে পারবে।
মানুষটি সব শুনে আমাদেরকে একটা উঁচু ডিবির কাছে নিয়ে যায়। দেখিয়ে বলে, ‘আমার জিবু এখানে শুয়ে আছে। আমি জিবুর পাশে থাকতে চাই। যে মাটিতে জিবু আশ্রয় নিয়েছে, সে মাটি ছেড়ে কোথাও যেতে চাই না।’
নিশ্চিত জীবনের সম্ভাবনা সত্তে¡ও মানুষটি বিলুপ্তির পথেই হাটতে চাই। আমাদের খুব অবাক লাগে। মানুষটির মস্তিষ্কে আমরা স্ক্যান করি। জিবুকে দেখতে পাই। আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে থাকি সেদিকে। সন্তানের জন্য মস্তিষ্কের নিউরনে নিউরনে যে আবেগ ভালবাসা দেখি, বিশ^ব্রক্ষান্ডের কোন গ্রহের অধিবাসীদের মধ্যে সেটা দেখিনি আর।
আমি আর ত্রি নিঃশ^াস নেওয়া প্রায় ভুলে গেছি। জিবুর জন্য মায়া লাগে। কি সৌভাগ্য ছিল তার। আমরা তো বড় হয় ‘রিয়ারিং সেন্টারে’। আমাদের প্রত্যেকের বাবা মা আছে। রেজিস্ট্রার বই দেখে জানতে পারি। আমাদের বাবা মারা তাদের শুক্রাণু ডি¤বানু দিয়ে দেয় সরকারী ল্যাবে। সেখানে টিউবে সন্তান ফোটানো হয়। বড় করা হয় হয় একদল দক্ষ রোবট দ্ব্রা রিয়ারিং সেন্টারে। তারপর বড় হলে বাবা মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
আমাদের হাতে ধরা ছোট হলোগ্রাফিক ইমেজিং ট্যাবে ভেসে ওঠা জিবুর ছবির দিকে তাকিয়ে থাকি। কি সুন্দর দেখতে। নরম তুলতুলে গাল। মিষ্টি ঠোট। আমি ত্রির দিকে তাকাই। ত্রি আমার মনের ভাষা হয়ত বুঝতে পারে। বলে, ‘হুমম্। আমরা দ্রিবাং গ্রহে ফেরত গিয়ে ‘বার্থ কাউন্সিলে’ আবেদন করব, আমাদের যেন জিবুর মত একটা মেয়ে বানিয়ে দেই।’
মানুষটিকে কোনভাবে রাজি করাতে না পেরে আমরা বিদায় জানিয়ে জাহাজে ফিরে আসি। নিয়ে আসি পৃথিবীর মানুষের বুকে জমে থাকা সন্তানের জন্য অফুরান ভালবাসা।
(৫)
ভিনগ্রহের অধিবাসীরা যখন বিদায় নিয়ে চলে যায়, মতিন তাদের গমন পথের দিকে চেয়ে থাকে শুধু। পৃথিবীর শেষ মানুষ সে । আর কেউ বেচে নেই কোথাও। নিঃসীম নিসঙ্গতা হঠাৎ থমকে দাড়ায়। অল্প আঁধারে মানুষ দেখতে পাই না, কিন্তু অসীম আঁধারে চোখ সয়ে যায়। মতিনেরও তাই হয়।
মতিনের শুধু এখন অপেক্ষা। এখন সে আর ভয় পাই না। জিবুর সাথে খুব শীঘ্র তার দেখা হবে। শঙ্কাহীন-দুঃখহীন তার মন।
সে শুধু ভাবে, তার সাথে সাথে শেষ হতে চলেছে এই মানব প্রজাতি। কি দম্ভ আর অবিমৃষ্যকারিতায় বেচে ছিল তারা! কাচের টুকরোর মত ভেঙে পড়ল চোখে না দেখতে পাওয়া কত ক্ষুদ্র অনুজীবের আক্রমনে!
দার্শনিকতা ভর করে মতিনের করোটিনে। পৃথিবীর শেষ মানুষ বলে কথা। পুর্বপুরুষের দার্শনিক স্বত্তা জেগে ওঠে করোটিনের ভেতর।
আকাশে গোল পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। মিটিমিটি জ¦লছে লক্ষকোটি তাঁরা। সব থাকবে, থাকবে না শুধু কোন মানুষ, থাকবে না সে। ভাবতেই বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। আবার ভাবে, হয়ত বিবর্তনের ধারায় অন্য কোন প্রজাতি উঠে আসবে এই পৃথিবীতে। তারা চাঁদ দেখবে। জ্যোন্সায় ¯œান করবে। পৃথিবীকে ভালবাসবে আপন করে।
জিবুর কথা মনে হতেই মতিনের শ^াসকষ্ট শুরু হয়। বুকটা শক্ত হয়ে আসতে থাকে। হঠাৎ প্রচন্ড ঘুম পায় তার। হ্যা, ঘুম আসছে। জিবু তাকে শোনাচ্ছে ঘুম পাড়ানি গান। ‘আয় আয় চাঁদ মামা, টিপ দিয়ে যা, চাদের কপালে চাদ, টিপ দিয়ে যা।’ অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে সে কন্ঠ। জিবু তাকে আদর করে ঘুমিয়ে যেতে বলছে।
হ্যা, ঘুমিয়ে পড়বে সে। সে এই পৃথিবীর মাটির বুকে ঘুমাবে। তার আদরের জিবুর পাশে।
বুকে থাকবে জিবুর জন্য পৃথিবীর সকল পিতার বুকে কন্যার জন্য যে ভালবাসা, সে ভালবাসা। বুকে থাকবে যে পৃথিবীতে সে জিবুকে পেয়েছে, সে পৃথিবীর জন্য ভালোবাসা।