কোন কোন সময় কিছু বইয়ের নাগাল পাওয়া যায়, পড়ে শেষ করার পর এক ধরণের মুগ্ধতা কাজ করে। যে মুগ্ধতায় পূর্ণ বইয়ে ফিরে আসা যায় বারবার।
Tuesdays with Morrie অনেকাংশে এরকম এক গ্রন্থ।
আপনার কি কখনও মনে হয়েছে নিজের প্রিয় শিক্ষকের কাছে প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি বয়সে আবার লেখাপড়া শুরু করতে? Mitch Albom সেটাই করেছেন। জীবনের নানামুখি ইঁদুর দৌড়ে ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত Mitch ক্রমাগত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া শিক্ষক Morrie Schwartz কে দেখতে যান, কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে একজন কৃতজ্ঞ শিক্ষার্থীর সাথে শিক্ষাগুরুর এই সাক্ষাৎ প্রকৃতপক্ষে সেই ছাত্র-শিক্ষকের কুড়ি বছর আগে শেষ করা কোর্স নয়।
নব্বইয়ের মাঝামাঝি সময়কালে Morrie এর কাছে Mitch এসেছেন জীবন নামের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা নিতে।
আমরা অনেকে বেড়ে উঠি কিন্তু গড়ে উঠি না। চল্লিশের কাছাকাছি বয়সে এসে অনেকেরই মনে হয় এক অস্থির ঝড়ে সে যেন লাটাইছিন্ন এক ঘুড়ি। Mitch এর ভালো ক্যারিয়ার আছে ক্রিড়া সাংবাদিক হিসেবে, প্রচন্ড ব্যস্ততা আছে, বিবাহিত জীবন আছে, কিন্তু প্রায় মধ্যবয়সে এসেও তাঁর মাঝে নেই অনেক প্রয়োজনীয় জীবনবোধ। পাঠক, আপনি যে বয়সি হন না কেন, নিজেকে কি এই পরিস্থিতির সাথে রিলেট করতে পারেন?
কালজয়ী বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং এর মতো ALS হয়েছে Morrie Schwartz এর। নিদারুণ শারীরিক যন্ত্রণার মাঝে এই প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি ইতিমধ্যে হয়ে গেছেন Nightime শো এর বরাতে একজন বিখ্যাত মানুষে। তাঁর ঘরভর্তি হয়ে আসছে বিভিন্ন পেশার মানুষজনে। সবাই এক নজর তাঁকে দেখতে চান। Morrie এর কথাবার্তা যখন অ্যাফোরিজমে পরিণত হয়ে যাচ্ছে প্রায়, সেই জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা মানুষটি বেছে নিয়েছেন Mitch কে, প্রতি মঙ্গলবারের ক্লাস কিংবা শিক্ষার জন্য।
জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ আসলে তো জীবনের মতোই। বাঁচতে হলে মরতে জানা লাগবে এবং মরতে হলে বেঁচে থাকার মর্মার্থ থাকা লাগবে উপলব্ধির রাডারে। কোন এলাস্টিক যদ্দুর সম্ভব টেনে ধরলে যে চাপ তৈরি হয় জীবন তো অনেকটা সেরকমই। এই প্রচন্ড প্রেসারের মাঝেই যেন আমাদের জীবন, Morrie এরকম মতামতই ধারণ করেন। মাত্র নয় বছর বয়সে মাতৃহারা শিশু, পরবর্তিতে নিজ পিতার সাথে কখনও সহজ সম্পর্ক তৈরি না হওয়া এই শিক্ষক আবার যৌবনে চাকরি করেছেন মেন্টাল লজে। সেখানে বিভিন্ন ধরণের মানসিক রোগীর প্রতি তিনি দেখিয়েছেন অসাধারণ অ্যাম্পেথি।
Mitch এর জীবনেও আছে বহু প্রশ্নের খোঁজ। নিজের ক্যান্সার সার্ভাইভর ভাইয়ের সাথে তাঁর সম্পর্ক সহজ নয়। তাছাড়া ভোগবাদী জীবনযুদ্ধে প্রতিনিয়ত নয়া নয়া বস্তু ক্রয়ের মাঝে সুখের ব্যর্থ সন্ধান করতে করতে সে নিজেও ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত। মঙ্গলবারে প্রিয় শিক্ষাগুরুর সেবাকল্পে হাজির হলে Mitch জানতে পারে মানুষের দরকার ভালোবাসা, ম্যাটেরিয়ালিস্টিক লাইফে প্রতিটি নতুন জিনিস কিনার পর ( যা তাঁর আদৌ প্রয়োজন নেই ) মানুষ মনস্তাত্ত্বিকভাবে সেই ভালোবাসার Hug কেই খুঁজে ফেরে।
জীবন কোন রেসলিং ম্যাচ হলে জয়ী হয় ভালোবাসা। প্রতি মঙ্গলবার হাজিরা দিলে Mitch Albom এরকম সারসত্য পেয়ে যান। Morrie Schwartz এর জীবনে কোন আত্মস্লাঘা নেই। কারণ তিনি সুখী। কীভাবে সুখী? কারণ তিনি বর্তমান কালচারকে গোনায় ধরেন না। সেই কালচার যা আপনাকে কখনও সুখানুভুতি দিতে চায় না। ক্রমাগত আপনার মনে কী একটা "নাই, নাই।" "আরো লাগবে।" ধারণা আপনার অজান্তেই ঢুকিয়ে দেয়। তাই Morrie এর এই বিষয়ে কথা হলো যে সংস্কৃতি আপনাকে সুখী করে না তাতে সাবস্ক্রাইব করার কিছু নেই।
মানুষ অর্ধ-জাগ্রত। ভুল জিনিসে পিছনে ছুটে চলা, অগুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে সময়ক্ষেপন করা, তাকে মানবিক বোধে আকীর্ণ জীবনের দিকে নেয় না। Morrie এর এক্ষেত্রে খুব সাধারণ কিন্তু অসাধারণ এডভাইস আছে। নিজেকে ক্ষমা করলে শেষ পর্যন্ত অন্যদের ক্ষমা করা যায়। ভালোবাসো, ভালোবাসো ভালোবাসো। নিজেকে, অন্যদের, নিজের কমিউনিটিকে। যে অনুভুতি আপনাকে নিজের ব্যাপারে যদ্দুর কেয়ার করেন ঠিক ঐরকম কেয়ার অন্যদের ক্ষেত্রে করায়, সেটাই প্রকৃত ভালোবাসার বোধ।
হঠাৎ চাকরি চলে যাওয়ায় মিচ দেখতে পান কত সহজ-স্বতস্ফূর্ততায় তাকে ছাড়া-ই সব ঠিকঠাক চলছে, ক্যারিয়ার লাইনৈ। মোরি কাউকে অর্থ উপার্জন করা, ক্যারিয়ারে শাইন করা থেকে নিবৃত করেন নি। শুধুমাত্র মনে করিয়ে দিয়েছেন আমাদের যার যার অগ্রাধিকার দেয়ার জায়গা এবং থামার জায়গাটা সেই আমরা-ই কীভাবে খুঁজে নিবো।
নিজের সাথে নিজের একটা বোঝাপড়ার বিষয়ের দিকে মোরি অনেকবার ইঙ্গিত করেছেন মঙ্গলবারে। মিচ একজন মিউজিশিয়ান হতে চেয়েছিলেন। তাঁর নিজেরও আছে ডিপ্রেশন, হতাশা, মৃত্যুভয়, বার্ধক্যভীতি। গুরু মোরি প্রায় পঙ্গু অবস্থায় প্রিয় শিক্ষার্থীর সাথে কথোপকথনে এইসব বিষয় তিনি কীভাবে ডিল করেন তা শিখিয়েছেন।
নিজ মানসিক-শারিরীক দুঃখ-কষ্টের সাথে মোরির বুঝাপড়া আসলেই ইনসাইটফুল। শিক্ষক মোরি দিনের নির্দিষ্ট সময়ে বিভিন্ন মানসিক কষ্টকে বরণ করে নেন। তাঁর যন্ত্রণাকে সম্পূর্ণরূপে বুকে ধারণ করেন, সেই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যান এবং এক সময় তিনি সেই সেল্ফ-পিটি থেকে নিজেকে আলাদা করে ফেলেন। এই পদ্ধতি কিংবা জীবনাচরণ তাকে শোক থেকে সেড়ে উঠতে সাহায্য করে। বয়স বেড়ে যাওয়াটা মোরিকে আতঙ্কিত করে না, কারণ অল্পবয়সিদের পর্যন্ত তিনি দেখেছেন কত মানসিক স্ট্রেস বহন করে চলতে। তাছাড়া ঐসব বয়স তো তিনি নিজেই কাটিয়েছেন।
মানুষকে পূর্ণ মনোযোগ দেয়া, যে কথোপকথন মিচ নিজের ভাইয়ের সাথে চালাতে পারেন নি তা মোরির কাছে সহজাতভাবে পেয়ে যাওয়া মিচ এলবমকে প্রিয় শিক্ষাগুরুর প্রতি আরো কাছে টেনে নেয়।
বইজুড়ে আছে প্রতি মঙ্গলবারে নিদারুণ শারিরীক কষ্টে থাকা শিক্ষক মোরি এবং ছাত্র মিচের মধ্যকার চমৎকার অ্যাম্পেথীপূর্ণ আলাপচারিতা, যা আমাদের অনেকের জীবনের সাথে প্রাসঙ্গিক এবং অনেককেই হয়তো প্রয়োজনীয় ফিলসফিক্যাল দিকনির্দেশনা দিতে পারে। বইটি মোরির বিপুল হসপিটাল বিল মিটাতে লিখা হলেও শেষ পর্যন্ত বিশ বছর পূর্তি এডিশনে আমরা বিস্ময়ের সাথে খোদ লেখকের কথায় দেখতে পাই বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন পাঠ্যকারিকুলামে ৩১টি ভাষায় ৩৬টি দেশে ছড়িয়ে পড়ার কথা।
Book Review
Name : Tuesdays with Morrie
Writer : Mitch Albom
First Published : 1997
Publisher : Doubleday
Reprinted by Sphere on 2017
This Edition published by Sphere
Reviewer : Wasim Hasan Mahmud