পোস্টস

গল্প

গল্প অ্যাকসিডেন্ট

১৭ জুন ২০২৪

জালাল উদ্দিন লস্কর

মূল লেখক জালাল উদ্দিন লস্কর

অ্যাকসিডেন্ট

 

জালাল উদ্দিন লস্কর

 

ডানবাম কোনোদিকে না তাকিয়ে সভাপতি আদনান খানকে সাথে নিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে হলরুমে ঢুকে নিজের নির্ধারিত চেয়ারটায় বসে ততোধিক গম্ভীর গলায় দফতরি নিতাইকে ডেকে হেডমাস্টার  মানিক আলী জিজ্ঞেস করলেন, 'কবির সাহেব কোথায় দেখ তো।'
সভাপতি আদনান খানের মুখেও আজ হাসি নেই।
হলরুমে পিনপতন নিস্তব্ধতা।

 

কবির সাহেব কেরানিপাড়া হাইস্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক।হলরুম ভর্তি অভিভাবক।টেস্ট পরীক্ষায় ফেল করা ৯৮ জন ছাত্রছাত্রীর অভিভাবকদের ডাকা হয়েছে।হেডমাস্টার তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে বেজায় চিন্তিত।তাই অভিভাবকদের সাথে কিছু জরুরী পরামর্শ করতেই আজকের এই সভা।

এগারোটার সময় মিটিং শুরুর কথা।এখন ১১ টা বেজে দশ।অথচ কবির সাহেব নেই।হেডমাস্টার অন্য জেলার মানুষ।সবাইকে ঠিকমতো সেইভাবে চিনেন না।কেরানীপাড়া হাইস্কুলে ৮ বছর আগে যোগ দিয়েছিলেন সেই সময়ের সভাপতির অনুগ্রহে কিংবা দয়ায়।পাঁচজন প্রার্থীর মধ্যে মানিক আলীই পরীক্ষায়  সবচেয়ে কম  পেয়েছিলেন।লোকমুখে প্রচলিত আছে আগে থেকেই সভাপতি করিম খানের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করছিলেন তিনি।মোটা টাকা উৎকোচ দেওয়ায় প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ও ইউনিয়ন চেয়ারম্যান করিম খান কমিটির আর কারো মতামতের তোয়াক্কা না করেই মানিক আলীর নিয়োগ কনফার্ম করেছিলেন।


করিম খান সাহেব মারা যাওয়ার পর স্থানীয় এমপির অভিপ্রায়ে তার ছেলে আদনান খান সভাপতি হয়েছেন।আদনান শিক্ষিত ও সদালাপী মানুষ।রাজনীতির সাথে আছেন।ক্ষমতাসীন দলের থানা কমিটির একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন।এমপি সাহেবের কা়ছের লোক বলে পরিচিত।এলাকার সব প্রোগ্রামে এমপির ডানহাত হিসাবে কাজ করেন।পিতার অভ্যাসটা পেয়েছেন।টাকা ছাড়া কিছুই বুঝেন না।

আজকে গুরুত্বপূর্ণ একটা মিটিং এটা কবির সাহেবও জানেন।কিন্তু ঠিক সময়ে তার না আসাটা চিন্তায় ফেলে দেয় হেডমাস্টারকে।কবির সাহেব স্থানীয় মানুষ।আগামীতে ইউনিয়ন চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করতে চান।গত রমজানের ঈদের আগে এলাকার লোকজনকে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে লোকাল পত্রিকায় শুভেচ্ছা বিজ্ঞাপন দিয়েছেন।পোস্টারও সাঁটিয়েছেন নিজের লোকজন দিয়ে।আদনান খানের জন্য কবির খান বড় রকমের হুমকি এটা আদনান খানও জানেন।

 

কিছুটা অসহিষ্ণু সুরে আদনান খান হেডমাস্টার সাহেবকে বললেন, 'গুরুত্বপূর্ণ সভা।অনেক কাজ ফেলে আমি যথাসময়ে আসলাম।কবির সাহবের খবর নাই।ঘটনা কী?কবির সাহেবের শরীরে তেল জমেছে মনে হচ্ছে।দশ মিনিটের মধ্যে শোকজ লেটার রেডি করে আমাকে দেখান।দেখি কবির সাহেব কি জবাব দেয়।একটা বিহিত করা দরকার।এভাবে একটা শিক্ষা প্রতিষ্টান চলতে দেওয়া যায় না।'

হেডমাস্টার মনেমনে প্রমাদ গুনলেন।কি মুসিবতেই না পড়া গেল।কবির সাহেব তো সচরাচর এমন করেন না।আজ কি এমন হল।আদনান খান চোটপাট দেখাতে লাগলেন।

সভায় উপস্থিত সবাই একে অন্যের দিকে তাকাচ্ছেন।
আদনান খান হেডমাস্টারকে সভা শুরু করতে বললেন।
হেডমাস্টার মানিক আলী সমবেত অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে স্বাগত বক্তৃতা টাইপের কিছু কথাবার্তা বললেন যার সারকথা হচ্ছে হেডমাস্টার হিসাবে টেস্টে ফেল করা ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে তার চিন্তার শেষ নেই।কি করে তাদের পরীক্ষাটা ভালো করে দেওয়ানো যায় তার একটা বিহিত করতেই আজকের আয়োজন।সভাপতি মহোদয় এ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত জানাবেন বলেও উল্লেখ করলেন।

কোনোপ্রকার আলোচনা না করে,কারো মতামতের তোয়াক্কা না করে অনেকটা একতরফা ধরনের এ মিটিং এর মধ্যমণি আদনান খান অতঃপর নিজের অন্যত্র ব্যস্ততা আছে উল্লেখ করে বক্তৃতা শুরু করে দিলেন।এর আগে কষ্ট করে ও মূল্যবান সময় নষ্ট করে সভায় যোগ দিতে আসা সম্মানিত অভিভাবকদের জন্য চা-নাস্তার ব্যবস্থা করতে বললেন হেডমাস্টারকে।

কোনোরকম ভূমিকা না করে আদনান খান বিদ্যালয়ের সুনাম ধরে রাখার স্বার্থে টেস্ট পরীক্ষায় ফেল করা সবাইকে ফাইনাল পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়ার কথা ঘোষণা করলে অভিভাবকদের মুখের খুশীর ঝিলিক খেলে গেল।টেস্টে খারাপ ফলাফলের বিষয়টা একট অ্যাকসিডেন্ট বলতেও ভুললেন না।
তবে এজন্য পরীক্ষার আগের মাস চারেক সময় অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের ধৈর্যের সাথে পরিশ্রম করতে হবে বলে জানিয়ে দিলেন।শুধু বাড়িতে পড়াশোনা করলেই চলবে না।কোচিং ক্লাশে বাধ্যতামূলকভাবে অংশ নিতে হবে।সবার কথা চিন্তা করে বোর্ড ফি'র সাথে বাড়তি ৩ হাজার টাকা ফি নির্ধারন করা হয়েছে।বললেন চারমাসের জন্য তিন হাজার টাকা বেশী কিছু না।শিক্ষককেরা পরিশ্রম করবেন।তাদের একটা সম্মানী দিতে হবে না?
সবাই মোটামুটি রাজী হয়ে গেলেন নিজেদের ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে।

হেডমাস্টার এতোক্ষণ চোখ বন্ধ করে সভাপতির বক্তৃতা শুনছিলেন।মাঝেমাঝে হাততালিও দিচ্ছিলেন। এতক্ষণে তার খেয়ালে আসলো, কিছুদিন আগেই সভাপতি হেডমাস্টারের মাধ্যমে বিদ্যালয় তহবিলের টাকা থেকে পাঁচ লাখ টাকা তুলে নিয়েছেন জরুরী কি এক দরকারের কথা বলে।কোচিং বাবদ যে টাকাটা আসবে তার সিংহভাগও সভাপতি আদনান খানের পকেটেই যাবে এটা তো জানা কথা।স্যারদের নামকাওয়াস্তে কিছু টাকা ধরিয়ে দেওয়া হবে।তারা হয়তো ভগ্নহৃদয়ে কোচিং করাবেন ছাত্রছাত্রীদের।কাঙ্খিত ফলাফল না আসলে অভিভাবকদের কি জবাব দেবেন তিনি।কারন অভিভাবকেরা তো তার কাছেই ছুটে আসবে তখন।

হেডমাস্টারের মোবাইল ফোনে একটা কল আসলো।ও প্রান্থ থেকে জানানো হলো,কবির সাহেব মোটরসাইকেল  অ্যাকসিডেন্ট করে গুরুতর অবস্থায় জেলা হাসপাতালে।
উপজেলা সদরে গিয়েছিলেন কি একটা জরুরী কাজে।ঠিক সময়ে মিটিং এ যোগ দিতে তাড়াহুড়ো করে মোটরসাইকেল চালাচ্ছিলেন তিনি।মিটিং এ কি হয় এ নিয়ে কিছুটা দুঃশ্চিন্তাও ছিল মনে।আনমনা অবস্থায় মোটরসাইকেল চালাচ্ছিলেন।পিছন থেকে একটা পিকাপভ্যান ধাক্কা মারলে ছিটকে পড়েন মোটরসাইকেল থেকে।

আদনান খান দ্রুত সভা মুলতবি করে দিলেন। সবার উদ্দেশ্যে বলরেন, 'আমরা কবির সাহেবকে দেখতে এক্ষুনি রওয়ানা হয়ে যাবো।কবির সাহেবের জন্য সবাই দোয়া করবেন।'