Posts

গল্প

পাশের সিটের যাত্রী

May 6, 2024

এইচ এম নাজমুল আলম

Original Author এইচ এম নাজমুল আলম

থিওরি অফ প্রোবাবিলিটি সব ক্ষেত্রে খেটে গেলেও দূরের যাত্রাপথে বাসে পাশের সিটে রূপসী কোন মেয়ের বসার ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হয় না৷ সারাজীবনে যতবার দূরের পথে যাত্রা করেছি কখনই আমার পাশের সিটে কোন সুন্দরী মেয়ে বসে নাই। উঠতি বয়সে বিষয়টি নিয়ে আক্ষেপ থাকলেও পরিনত বয়সে এ সংক্রান্ত সমস্ত আশাবাদ জলাঞ্জলী দিয়ে শেষমেশ বাসে উঠেই পড়লাম। 

ঢাকা থেকে বাগেরহাট যাবো। সায়েদাবাদ থেকে বাসে উঠতে হবে। আমার সিট জানালার পাশে না হলেও বাসে উঠে সেখানে কি ভেবে বসে পড়লাম। ব্যাগ থেকে এয়ারফোন বের করে কানে লাগিয়ে গান শুনতে শুনতে অন্যমনস্ক হয়ে গেলাম কিছুক্ষণের মধ্যেই। বাস ছাড়ার মিনিট দুই আগে ট্রাভেল ব্যাগ নিয়ে এক তরুণী টিকিটের সাথে মিলিয়ে নিজের সিট খুঁজতে খুঁজতে থিওরি অফ প্রোবাবিলিটিকে ভুল প্রমাণ করে আমার সিটের পাশে এসে দাঁড়াল! 

-এক্সকিউজ মি ভাইয়া, এই সিটটা আমার!

মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আমি ক্ষণিকের জন্য পরবাস্তব জগতে হারিয়ে গেলাম। স্বর্গের অপ্সরা কেন বাসে চলাচল করবে এ সংক্রান্ত বিশেষ গবেষণায় নিজেকে নিয়োজিত করবো ভেবেছিলাম কিন্তু বেশিক্ষণ হারিয়ে গেলে চলবে না। 

- ও আচ্ছা, সরি৷ পাশের সিটটা আমার৷ 

মেয়েটা অনেকটা জোর করে একটা ভদ্রতার হাসি হেসে নিজের সিট বুঝে নিলো। আমার বুকের মধ্যে তখন বঙ্গোপসাগরের ঢেউ। হানিমুন সুইজারল্যান্ড করবো না কি কক্সবাজারের কোন ডিসকাউন্ট রিসোর্ট খুঁজবো সেই ভাবনায় বিচলিত হয়ে পড়লাম!

বাস ছেড়ে দিলো। সাই সাই করে বঙ্গবন্ধু এক্সপ্রেসওয়েতে বাস ছুটে চললো। জানালার গ্লাস খুলে দিয়ে মেয়েটা নিজের চুল ছেড়ে দিলো। সে এক স্বর্গীয় অনুভূতি! সম্ভবত সদ্য শ্যাম্পু করে আসা সুবাসকে মেয়েটার চুলের গন্ধ ভেবে আমি মুগ্ধ হলাম। বাতাসে চুল আমার মুখে উড়ে আসতে লাগলো।

মেয়েটার খানিকটা অ্যাটেনশন পাওয়ার জন্য মনের মধ্যে তীব্র আকুতি টের পেলাম। চট করে ব্যাগ থেকে এডিথ হ্যামিলটনের গ্রীক মিথলজি বইটা বের করে মনোযোগী হয়ে পড়ার ভাব ধরলাম।

-ভাইয়া কিছু মনে করবেন না, আপনি মিথলজি পছন্দ করেন?
-হ্যা, বেশ ইন্টারেস্টিং লাগে আমার। 
-আমারও মিথলজি খুব পছন্দের বিষয়।
-আচ্ছা তাই নাকি! 
-হ্যা! গ্রীক মিথলজিতে আমার প্রিয় ক্যারেক্টার "অডিসিউস"
আপনার ফেভারিট কে?

অন্যের বউ ভাগিয়ে নেয়া প্যারিসকে ফেভারিট বলতে গিয়েও গিলে ফেললাম। মেয়েটার সাথে তাল মেলাতে হবে৷ 

-আসলে এক সময় একিলিসকে ভালো লাগত। কিন্তু আমারও এখন  অডিসিউসকে ভালো লাগে। হোমারের অডিসি পড়েছেন?
-হ্যা পড়েছি তো!

মেয়েটার সাথে নর্স মিথলজি থেকে শুরু করে প্রাচীন ভারতীয় মিথলজিতে আলাপ আলোচনা জমতে লাগলো। মনে মনে নিজের সৌভাগ্যকে নিজেরই হিংসা লাগছিল।

কবি বলেছেন, যদি থাকে নসিবে আপনা আপনি আসিবে!

মেয়েটা একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ইংলিশে পড়ছে৷ সেমিস্টার ফাইনালের ব্রেকে বাড়িতে যাচ্ছে। আমাদের আলাপ আলোচনা মিথলজি থেকে শুরু করে ধর্ম, সমাজ, রাজনীতি, প্রেম সবকিছুকেই ছাপিয়ে গেলো। 

সব কিছু স্বপ্নের মত লাগছিল। বাস্তব জগতে আমার অস্তিত্ব ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে আসতে লাগল।

বাসের হার্ড ব্রেকে ধড়মড় করে ঘুম ভাঙল। আমার পাশে বসা ষাটোর্ধ্ব এক গ্রাম্য চাচী। পায়ের কাছে বাজারের ব্যাগে মুরগীর বাচ্চার কিচির কিচির শব্দ শুনতে পেলাম। 

ফেরিওয়ালার কাছ থেকে কেনা দুই নম্বর ইগলু আইসক্রিম খেতে খেতে স্বপ্ন আর বাস্তবতার সংযোগ মিলিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছিলাম । চাচী আমার আইসক্রিমের কাপের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে৷ বেশ খারাপ লাগল। উনার হয়তো আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করছে।

-এ্যা ছ্যামড়া, তোর খাওয়া হইলে বাডি ডা দিস!

আমি আইসক্রিমের কাপ দিয়ে দিলাম। চাচী সেই কাপে ব্যাগ থেকে চাল বের করে রাখল। তারপর বাজারের ব্যাগের মুখ খুলে মুরগীর মাথা বের করে সেই চাল খাওয়াতে লাগল। 

বাস একটা পেট্রোলপাম্পে এসে দশমিনিটের বিরতি দিলো। আপনারা হয়তো ভাবছেন আমি ব্যাগ থেকে হ্যামিলটনের মিথলজি বের করবো আর স্বপ্নের সেই মেয়েটা এসে আমাকে বলবে "ভাইয়া কিছু মনে করবেন না, আপনি মিথলজি খুব পছন্দ করেন, তাই না?"

সব স্বপ্ন সত্যি হয় না রে ভাই...


Comments

    Please login to post comment. Login