আপনি জানেন, আমি জানি, হুমায়ুন আজাদও বলেছিলেন এবং এটা প্রমাণিতও যে- ‘রাজাকার চিরকাল রাজাকার থাকে, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা চিরকাল মুক্তিযোদ্ধা থাকে না।’ কখন, কোনদিন যদি এ দেশের সকল মুক্তিযোদ্ধা আদর্শহীন হয়ে যায়, যদি এ দেশের সকল বীরশ্রেষ্ঠ, বীরউত্তম, বীরবিক্রম ও খেতাবপ্রাপ্তরা দেশের মুক্তিসংগ্রামের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, বিপথগামী হয়ে যায়। যদি এ দেশের সকল রাজনৈতিক দল, মন্ত্রী-এমপি, সকল কর্মকর্তা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে অবস্থা নেয়, বাঙলা-বাঙালির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, তবুও কখনোই কোনোদিন আমি মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে যাব না। বাঙলা-বাঙালির বিরুদ্ধে যাব না। কখনো কেউ যদি ভয় কিংবা আপোষ করে জয়বাংলা উচ্চারণ না করে সেদিনও আমি জয়বাংলা উচ্চারণ করে যাব। কারণ আপোষ-ভয় আমার ইতিহাসে নাই। সুতরাং যতবার তুমি রাজাকার হবে ততবার আমি মুক্তিযোদ্ধা হব। যতবার তুমি অবাঙালির মত আচরণ করবে ততবার আমি বাঙালির মত আচরণ করব। কারণ বাঙলা আমার রক্তে, বাঙলা আমার মননে-মগজে/শিরা-উপশিরা ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে। যদি কখনো এমন হয় মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাদুঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, তবুও আমাকে পাওয়া যাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী হিসেবে। যদি কখনো কেউ ‘আমার সোনার বাংলা’ গাওয়া বন্ধ করে দেয়, তবুও নীরবে আমি গেয়ে যাব। তখনও আমার বদনখানি মলিন হবে।
মহান মুক্তিযুদ্ধ কারো কাছে ব্যবসার সুবিধা হতে পারে, কারো কাছে রাজনৈতিক হাতিয়ার হতে পারে, কারো কাছে গরীব থেকে ধনীর মাধ্যম হতে পারে, কারো কাছে সকাল-বিকাল বিদেশ যাওয়ার সুযোগ হতে পারে, কারো জন্য উচ্চবিলাশী জীবন যাপনের উপায় হতে পারে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ আমার কাছে পবিত্র-প্রার্থনার বিষয়। মুক্তিযুদ্ধ আমাকে পৃথিবীর বুকে আলাদা করে পরিচয় দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ আমার আবেগকে শাণিত করেছে। এ দেশের মা-মাটি ও সাধারণ মানুষ আমাকে আবেগাপ্লুত করেছে। এ দেশের নদ-নদী খাল-বিল আমাকে বিমোহিত করেছে। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ়-শ্রাবণ আমার সৌন্দর্য বাড়িয়েছে। এ দেশের পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-সুরমা আমাকে গৌরবান্বিত করেছে। এই দেশের অবারিত সবুজ প্রান্ত আমাকে ছুঁয়ে দিয়েছে। এ দেশের অবারিত আকাশ ও সবুজ প্রান্তর আমাকে যেমন ভাবুক বানিয়েছে তেমনি আমার সাহস যুগিয়েছে। এ দেশের শীত-গ্রীস্ম-বর্ষা আমাকে খুব যত্ন করে লালন-পালন করেছে। এ দেশের পথ-প্রান্থর আমার মুখে স্বয়ংক্রিয় গায়ক বানিয়ে দেয়। এ দেশের জারি-সারি-ভাটিয়ালী আমাকে মুগ্ধ করেছে। এ দেশের লালন-হাছন-রাধারমণ-রবীন্দ্র-নজরুল-জীবনানন্দ আমার অভিভাবক হয়ে রয়েছেন। এ দেশের জাতীয় সংগীত আমার চোখে অশ্রু নিয়ে আসে। এ দেশের মাটির গান আমার বুক ভাসিয়ে দিয়ে যায়। এ ভাষার বিদ্রোহী কবিতা আমার বুকে যেমন প্রতিবাদের ঝড় তুলেছে, তেমনি শিখিয়ে অগাধ প্রেম।
তাঁদের সামনে সর্বদা আমি মাথা নত করে রাখি- যারা দেশের জন্য জীবন দিয়েছে, যারা ব্র্রিটিশদের তাড়িয়েছেন। যারা পাকিস্তানিদের তাড়িয়েছেন। প্রীতিলতা, দেব রানী, ভবানী পাঠক, তিতুমীর, সিধু লাল, নুরুলদীন, ফকির মজনু শাহ, ফকির মুসা শাহ, মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, কানাইলাল দত্ত, সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, ভাসানী, বঙ্গবন্ধু, শেরে বাংলা, তাজউদ্দিন আমার আদর্শ। আমার হৃদয়টা তাঁদের জন্য- যারা এ দেশের জন্য, এই ভূমির জন্য, এই সংষ্কৃতির জন্য হাসিমুখে জীবন দিয়ে গেছেন। কতিপয় দুর্নীতিবাজ এমপি, কতিপয় অসৎ আমলা, কতিপয় অসৎ ব্যবসায়ীর, কতিপয় ধর্মব্যবসায়ী, কতিপয় আদর্শহীন মুক্তিযোদ্ধার জন্য আমার দেশ খারাপ হতে পারে না। এ দেশ নির্মাণে তাদের কোন অবদান ছিল না। আমি দেখেছি, বরাবরই তারা সুবিধাভোগী। যতবার তাদের সামনে আমাকে মুখোমুখি করবে, ততবার আমি তাদের মুখে থুথু মারব। যতবার আমি তাদের দেখব, ততবার বেইমান বলে ধিক্কার জানাব।
এ দেশের রাজাকাররা তার আদর্শের সঙ্গে বেইমানি করেনি, রাজাকার সারাজীবন রাজাকারই থেকেছেন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা তার আদর্শের সঙ্গে ঠিকই বেইমানি করেছেন, করে যাচ্ছেন। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কাজ করে যাচ্ছেন। হালাল-হারাম ফতোয়া দিয়ে সমাজে বিভেদ জারি রেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধের পর রাজাকাররা যে পরিমাণ ক্ষতি করেনি তারচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে কতিপয় মুক্তিযোদ্ধা। এর চেয়ে বড় দুঃখ, বড় কষ্ট আর কী হতে পারে?
হালাল-হারামের ভিত্তিতে তো দেশ স্বাধীন হয়নি এবং এর ভিত্তিতে কোনো দেশ হতে পারেও না। কারণ হালাল-হারাম একটি সাম্প্রদায়িক মাপকাঠি, কোনো ভূ-খণ্ডের মাপকাঠি নয়। একটা ভূ-খন্ডে শুধু এক সম্প্রদায়ের লোক থাকে না। আপনি চান বা না চান একটা ভূ-খন্ডে বহু পথ বহু মত ও বৈচিত্র চিন্তাধারার মানুষ ছিল, আছে এবং থাকবে। আর্টিলারি বোমা মেরে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে বা ভূ-খন্ড পুড়িয়ে দিলেও সব মানুষের চিন্তা-মতাদর্শ এক করা যাবে না। তবুও হালাল-হারামের বিচার যদি করতে চান, তাহলে সবচেয়ে বড় হারাম আদর্শের সঙ্গে বেইমানি করা। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের সঙ্গে বেইমানি করা। দেশের সঙ্গে বেইমানির চেয়ে বড় হারাম আর কিছুই হতে পারে না। কারণ নামাজ-রোজা-হজ্জ-জাকাত ঈমানের অঙ্গ নয়, দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ। সুতরাং সবচয়ে বড় হারাম দেশের সঙ্গে বেইমানি করা। আপনি না বুঝেন ধর্ম, না বুঝেন রাষ্ট্র। কী হৃদয়বিদারক। আপনাদের কারণে রাষ্ট্রের সামনে ঘোর অন্ধকার।
লেখক: গল্পকার, সাংবাদিক
মহান মুক্তিযুদ্ধ কারো কাছে ব্যবসার সুবিধা হতে পারে, কারো কাছে রাজনৈতিক হাতিয়ার হতে পারে, কারো কাছে গরীব থেকে ধনীর মাধ্যম হতে পারে, কারো কাছে সকাল-বিকাল বিদেশ যাওয়ার সুযোগ হতে পারে, কারো জন্য উচ্চবিলাশী জীবন যাপনের উপায় হতে পারে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ আমার কাছে পবিত্র-প্রার্থনার বিষয়। মুক্তিযুদ্ধ আমাকে পৃথিবীর বুকে আলাদা করে পরিচয় দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ আমার আবেগকে শাণিত করেছে। এ দেশের মা-মাটি ও সাধারণ মানুষ আমাকে আবেগাপ্লুত করেছে। এ দেশের নদ-নদী খাল-বিল আমাকে বিমোহিত করেছে। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ়-শ্রাবণ আমার সৌন্দর্য বাড়িয়েছে। এ দেশের পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-সুরমা আমাকে গৌরবান্বিত করেছে। এই দেশের অবারিত সবুজ প্রান্ত আমাকে ছুঁয়ে দিয়েছে। এ দেশের অবারিত আকাশ ও সবুজ প্রান্তর আমাকে যেমন ভাবুক বানিয়েছে তেমনি আমার সাহস যুগিয়েছে। এ দেশের শীত-গ্রীস্ম-বর্ষা আমাকে খুব যত্ন করে লালন-পালন করেছে। এ দেশের পথ-প্রান্থর আমার মুখে স্বয়ংক্রিয় গায়ক বানিয়ে দেয়। এ দেশের জারি-সারি-ভাটিয়ালী আমাকে মুগ্ধ করেছে। এ দেশের লালন-হাছন-রাধারমণ-রবীন্দ্র-নজরুল-জীবনানন্দ আমার অভিভাবক হয়ে রয়েছেন। এ দেশের জাতীয় সংগীত আমার চোখে অশ্রু নিয়ে আসে। এ দেশের মাটির গান আমার বুক ভাসিয়ে দিয়ে যায়। এ ভাষার বিদ্রোহী কবিতা আমার বুকে যেমন প্রতিবাদের ঝড় তুলেছে, তেমনি শিখিয়ে অগাধ প্রেম।
তাঁদের সামনে সর্বদা আমি মাথা নত করে রাখি- যারা দেশের জন্য জীবন দিয়েছে, যারা ব্র্রিটিশদের তাড়িয়েছেন। যারা পাকিস্তানিদের তাড়িয়েছেন। প্রীতিলতা, দেব রানী, ভবানী পাঠক, তিতুমীর, সিধু লাল, নুরুলদীন, ফকির মজনু শাহ, ফকির মুসা শাহ, মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, কানাইলাল দত্ত, সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, ভাসানী, বঙ্গবন্ধু, শেরে বাংলা, তাজউদ্দিন আমার আদর্শ। আমার হৃদয়টা তাঁদের জন্য- যারা এ দেশের জন্য, এই ভূমির জন্য, এই সংষ্কৃতির জন্য হাসিমুখে জীবন দিয়ে গেছেন। কতিপয় দুর্নীতিবাজ এমপি, কতিপয় অসৎ আমলা, কতিপয় অসৎ ব্যবসায়ীর, কতিপয় ধর্মব্যবসায়ী, কতিপয় আদর্শহীন মুক্তিযোদ্ধার জন্য আমার দেশ খারাপ হতে পারে না। এ দেশ নির্মাণে তাদের কোন অবদান ছিল না। আমি দেখেছি, বরাবরই তারা সুবিধাভোগী। যতবার তাদের সামনে আমাকে মুখোমুখি করবে, ততবার আমি তাদের মুখে থুথু মারব। যতবার আমি তাদের দেখব, ততবার বেইমান বলে ধিক্কার জানাব।
এ দেশের রাজাকাররা তার আদর্শের সঙ্গে বেইমানি করেনি, রাজাকার সারাজীবন রাজাকারই থেকেছেন। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা তার আদর্শের সঙ্গে ঠিকই বেইমানি করেছেন, করে যাচ্ছেন। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কাজ করে যাচ্ছেন। হালাল-হারাম ফতোয়া দিয়ে সমাজে বিভেদ জারি রেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধের পর রাজাকাররা যে পরিমাণ ক্ষতি করেনি তারচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে কতিপয় মুক্তিযোদ্ধা। এর চেয়ে বড় দুঃখ, বড় কষ্ট আর কী হতে পারে?
হালাল-হারামের ভিত্তিতে তো দেশ স্বাধীন হয়নি এবং এর ভিত্তিতে কোনো দেশ হতে পারেও না। কারণ হালাল-হারাম একটি সাম্প্রদায়িক মাপকাঠি, কোনো ভূ-খণ্ডের মাপকাঠি নয়। একটা ভূ-খন্ডে শুধু এক সম্প্রদায়ের লোক থাকে না। আপনি চান বা না চান একটা ভূ-খন্ডে বহু পথ বহু মত ও বৈচিত্র চিন্তাধারার মানুষ ছিল, আছে এবং থাকবে। আর্টিলারি বোমা মেরে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে বা ভূ-খন্ড পুড়িয়ে দিলেও সব মানুষের চিন্তা-মতাদর্শ এক করা যাবে না। তবুও হালাল-হারামের বিচার যদি করতে চান, তাহলে সবচেয়ে বড় হারাম আদর্শের সঙ্গে বেইমানি করা। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের সঙ্গে বেইমানি করা। দেশের সঙ্গে বেইমানির চেয়ে বড় হারাম আর কিছুই হতে পারে না। কারণ নামাজ-রোজা-হজ্জ-জাকাত ঈমানের অঙ্গ নয়, দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ। সুতরাং সবচয়ে বড় হারাম দেশের সঙ্গে বেইমানি করা। আপনি না বুঝেন ধর্ম, না বুঝেন রাষ্ট্র। কী হৃদয়বিদারক। আপনাদের কারণে রাষ্ট্রের সামনে ঘোর অন্ধকার।
লেখক: গল্পকার, সাংবাদিক