নতুন পৃথিবীর খোঁজে
মোঃ বজলুর রশীদ
১৫/০৯/২০২৪
পর্ব -১
.................
সাল ২১২৫, পৃথিবী ক্রমশ বসবাসের অনুপযোগী হয়ে
পড়েছে । জলবায়ু পরিবর্তন, দূষণ, আর প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহারের কারণে মানব জাতি আজ ধ্বংসের মুখে। বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে নতুন বাসযোগ্য গ্রহ খুঁজে বের করার জন্য।
সেজন্য বিজ্ঞান কাউন্সিলের প্রধান ঈশান সিদ্ধান্ত নেন ইভা ও অয়ন দম্পতি এই ভ্রমণে অংশগ্রহণ করবে। এই দুইজনকে সিলেক্ট করার একটা কারণ আছে সেটা হচ্ছে পৃথিবীতে গর্ভধারণের ক্ষমতা অধিকাংশ নারী হারিয়ে ফেলেছে । কিন্তু ইভা এর ব্যতিক্রম তাই ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে যেন তারা বংশবৃদ্ধি করতে পারে ,সে জন্য তাদের এই পরিকল্পনা ।
বিজ্ঞান কাউন্সিলের প্রধান ঈশান : ইভা, অয়ন, তোমরা জানো পৃথিবী আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। জলবায়ুর পরিবর্তন, প্রাকৃতিক সম্পদের ধ্বংস সবকিছুই আজ আমাদের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। তাই এখনই সময় নতুন পৃথিবীর খোঁজ করার। আমাদের মানবজাতিকে রক্ষা করার দায়িত্ব তোমাদের হাতে ।
অয়ন : আমরা প্রস্তুত কিন্তু নতুন পৃথিবী কি সত্যিই আমাদের জন্য অপেক্ষায় করছে ? যদি এরকম পৃথিবী খুঁজে না পাই ?
বিজ্ঞান কাউন্সিলের প্রধান ঈশান : এই মিশনটি জটিল, তবে আমাদের হাতে এই মুহূর্তে বিকল্প নেই। তোমাদের ওপর আমাদের বিশ্বাস আছে। এই অভিযান শুধু আমাদের প্রজন্মের জন্য নয়, পরবর্তী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তোমাদের সফলতার ওপর।
ইভা: এত বিশাল মহাকাশে আমরা কোথায় খুঁজব?
এত বিশাল মহাকাশে মানুষের উপযোগী কোন গ্রহের সন্ধান তো বিজ্ঞানী এখনও পায়নি ।
বিজ্ঞান কাউন্সিলের প্রধান ঈশান : আমাদের গবেষণা ও প্রযুক্তি অনেক দূর এগিয়েছে। কিছু সম্ভাব্য গ্রহ চিহ্নিত করা হয়েছে। তোমাদের মূল কাজ হবে সেই গ্রহগুলো পর্যবেক্ষণ করা এবং সেখানে জীবনধারণের জন্য উপযোগী কিনা তা যাচাই করা।
অয়ন : আমাদের নিরাপত্তার বিষয়ে আপনি কি কিছু ভেবে রেখেছেন ?
বিজ্ঞান কাউন্সিলের প্রধান ঈশান : মহাকাশের যাত্রা খুবই বিপদজনক , আমার মনে হয় দুজনেই এ কথা জানো। তবে তোমাদের মহাকাশযানকে সর্বোচ্চ প্রযুক্তি দিয়ে সাজানো হয়েছে। কোনো বিপদ দেখা দিলে, তোমরা কেন্দ্রীয় কম্পিউটার "সিসি"এর সাহায্য নিতে পারবে ।তবে তোমাদের মিশনটি গুরুত্বপূর্ণ, তাই প্রতিটি সিদ্ধান্ত তোমাদের নিতে হবে দ্রুত এবং সচেতনভাবে।"
অয়ন : আমরা প্রস্তুত,পৃথিবী ও মানবজাতিকে রক্ষার জন্য যা করণীয়, তা আমরা অবশই করব।
বিজ্ঞান কাউন্সিলের প্রধান ঈশান : আমার আস্থা তোমাদের দুজনেরই প্রতি আছে । নতুন পৃথিবী যদি কোথাও থাকে, তোমরাই তাকে খুঁজে বের করতে পারবে । তোমাদের সফলতা কামনা করছি ........
পর্ব - ২
.....................
ইভা এবং অয়ন মহাকাশযানে বসে অসীম শূন্যতার দিকে তাকিয়ে আছে । তারা জানে, পৃথিবী আর তাদের বাসযোগ্য নেই। এখন তাদের সামনে যে পথ, তা অজানা এবং অনিশ্চিত, তবুও তারা আশা নিয়ে ছুটে চলছে কোন এক বসবাসযোগ্য পৃথিবীর দিকে ।
ইভা হালকা শ্বাস ফেলে অয়নকে বলল, তুমি কি কখনো ভেবেছ, আমরা আদৌ একটা নতুন পৃথিবী খুঁজে পাবো?
অয়ন একটু সময় নিয়ে উত্তর দিল, জানি না। তবে আমার একটা বিশ্বাস আছে একদিন খুঁজে পাবো ,এখন অন্তত চেষ্টা করা উচিত। পৃথিবীতে আর কিছু বাকি নেই। যুদ্ধ, দূষণ সবকিছু শেষ করে দিয়েছে।
ইভা জানালার দিকে তাকিয়ে বলল, তবুও সেটা ছিল আমাদের প্রথম বসবাসযোগ্য বাড়ি । যতই ধ্বংস হয়ে যাক, পৃথিবীই আমাদের নিজের জন্মভূমি।
অয়ন তার কাঁধে হাত রেখে বললো ,শুরু হোক, বা শেষ হউক আমরা হয়তো নতুন একটা পৃথিবী পাবো। সেখানে তো আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হবে ।
ইভা হেসে বলল, হয়তো! কিন্তু আমি ভাবছি,নতুন পৃথিবীটা কি আমাদের জন্য ততটা আপন হবে, যতটা পৃথিবী ছিল?
অয়ন একটু হাসল, আপন ব্যাপারটা আমরা নিজেরাই তৈরি করি। আমাদের ভালোবাসা, আমাদের স্মৃতি নতুন পৃথিবীতেও থাকবে। আমাদের হাতে নতুন ইতিহাস গড়ার সুযোগ আছে।
ইভা তাকিয়ে রইল দূর মহাকাশের অন্ধকারে দিকে তারপর অয়নকে বললো হয়তো তুমি ঠিক। নতুন পৃথিবী খুঁজে পেতে আমাদের অনেক কষ্ট করতে হবে ।
অয়ন সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ,সেখানে আমরা আবার নতুন করে শুরু করবো ।
মহাকাশযানটি ধীরে ধীরে দূরে চলে গেল, সামনে কেবল অসীম মহাকাশ, আর পিছনে পড়ে রইল তাদের পুরনো পৃথিবী।
পর্ব - ৩
............
মহাকাশযানটিতে একটি তৃতীয় শ্রেণীর রোবট রয়েছে যার বুদ্ধিমত্তা খুবই কম , তার কাজ হল মানুষকে আনন্দ দেওয়া ও তাদের জন্য খাবার তৈরি করা। রোবটটির নাম হচ্ছে কিবো।
কিবো : আমার সেন্সর বলছে, অয়ন তুমি আবারও খাবারের স্টকে হাত দিয়েছ!
অয়ন (হাসি দিয়ে) : কিবো, আমি শুধু একটু পরীক্ষা করছিলাম।
কিবো : তোমার খাবারের পরীক্ষাগুলো সবসময়ই কেন মুখের কাছে এসে শেষ হয়?
ইভা (হাসতে হাসতে) : কিবো, হাতটা একটু ছেড়ে দাও। আমরা মহাকাশে আছি, একটু বেশি খাওয়া দোষের কিছু নয়।
কিবো : আমার অ্যালগরিদম বলে, যদি এভাবে চালিয়ে যাও তাহলে মিশন শেষ হবার আগে আমাদের খাদ্যের সংকট দেখা দিবে ।
অয়ন : আরে কিবো, তুমি তো রোবট। তুমি কী জানো খাবারের স্বাদ সম্পর্কে?
কিবো : আমি জানি না, কিন্তু আমার ডেটাবেজে মানবজীবনের টিকে থাকার জন্য নির্দিষ্ট ক্যালোরির কতটা প্রয়োজন তা আছে। তোমার ক্যালোরির মাত্রা ইতিমধ্যেই প্রয়োজনীয় সীমা ছাড়িয়ে গেছে।এবার সত্যিই তোমাদের সতর্ক হওয়া উচিত!
অয়ন : ঠিক আছে, ঠিক আছে! কিবো, তুমি কিছু না খেতে পারলেও, মজা করতে ঠিকই পার।
কিবো : তোমাদের আনন্দ দিতে ,আমাকে প্রোগ্রামিং করা হয়েছে ।
ইভা : (হাসতে হাসতে) : কিবো, তুমি সত্যিই খুব চালাক!
কিবো : চালাকি নয়, আমার যুক্তিটি সঠিক ।
পর্ব - ৪
..............
ইভা এবং অয়ন মহাকাশযানের কন্ট্রোল কক্ষে বসে কাজ করছে। হঠাৎ করেই কেন্দ্রীয় কম্পিউটার সিসির ঠান্ডা কণ্ঠ ভেসে এলো সতর্কবার্তা ৪০৫. ত্রুটি শনাক্ত করা হয়েছে।
ইভা ঘাড় ঘুরিয়ে অয়নের দিকে তাকালো, তার চোখে উদ্বেগ
ইভা : তুমি কিছু বুঝতে পারছো?
সিসি : ইভা, সিস্টেমে একটি ত্রুটি শনাক্ত করা হয়েছে। অক্সিজেন প্রোডাকশন ইউনিটে চাপের মাত্রা বেড়ে গেছে।
ইভা : কতটা গুরুতর, সিসি?
সিসি : গুরুতর মাত্রায় রয়েছে। যদি আগামী ১০ মিনিটের মধ্যে সমাধান না করা হয়, তাহলে অক্সিজেন সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
অয়ন : তাহলে কী করতে হবে, সিসি? তুমি কি ত্রুটি নিজেই ঠিক করতে পারবে?
সিসি : আমি স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রাথমিক মেরামতির কাজ শুরু করে দিয়েছি, কিন্তু ম্যানুয়াল সহায়তার প্রয়োজন হবে। তোমাদের ইঞ্জিন রুমের কন্ট্রোল প্যানেল 'সি-৭' চেক করতে হবে এবং প্রেশার নিয়ন্ত্রণের জন্য ৩৭ ডিগ্রি কোণ ঘুরিয়ে দিতে হবে।
ইভা : ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি।
(ইভা কন্ট্রোল প্যানেলের দিকে ছুটে যায়।)
অয়ন ; সিসি, তুমি কি আগে এমন পরিস্থিতি সামলেছ?
সিসি : হ্যাঁ, তবে এটি একটি জটিল মিশন। মহাকাশে ছোট ছোট ত্রুটিগুলো দ্রুত বড় হয়ে উঠতে পারে।
ইভা : (কন্ট্রোল প্যানেলে কাজ করতে করতে) সিসি, আমি নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করছি। এটা কি কাজ করছে?
সিসি : হ্যাঁ, তোমার ডান দিকের প্যানেলে একটি সবুজ বাতি জ্বলবে, সেটি দেখে নিশ্চিত হও।
ইভা : সবুজ বাতি জ্বলেছে! কাজ হয়েছে!
সিসি : অক্সিজেন সিস্টেম এখন স্বাভাবিক অবস্থায় রয়েছে। কিন্তু ভবিষ্যতে আরও সতর্ক থাকতে হবে।
অয়ন : ( হাসতে হাসতে) সিসি, তুমি আমাদের ছাড়া এ মহাকাশযান সামলাতে পারবে না!
সিসি : তোমাদের শারীরিক ক্ষমতার কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তবে তোমাদের সহযোগিতা আমাদের কাজে লাগে।
ইভা : ধন্যবাদ, সিসি! তুমি ছাড়া হয়তো এই কাজটি আমরা করতে পারতাম না ।
সিসি : তোমরা তো জানো, আমাকে প্রোগ্রামিং করা হয়েছে এই মহাকাশযানটির সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক হিসাবে । কাজেই এই মহাকাশযানকে সচল রাখাই আমার কাজ ।
পর্ব-৫
..........
ইঞ্জিনের সমস্যাটি মেরামত করার পর মহাকাশযান আবার স্বাভাবিক হয়ে আসে। দীর্ঘ সময়ের উত্তেজনাও ক্লান্তির পর ইভা এবং অয়ন কিছুটা স্বস্তি অনুভব করল। কন্ট্রোল কক্ষের পাশে বিনোদনের জন্য রাখা রোবট 'কিবো' তাদের দিকে এগিয়ে এলো, তার কৃত্রিম হাসি মুখে।
অয়ন : কিবো, তুমি কি জানো, রোবটরা কখনই বৃষ্টিতে ভেজে না?
কিবো : জানি, কারণ আমরা ওয়াটারপ্রুফ।
অয়ন : না, কারণ তারা কখনই বাইরে বের হয় না!
ইভা : (হাসতে হাসতে) এই কথাটা তো সত্যিই কিবোর জন্য প্রযোজ্য ।
অয়ন : কিবো, তুমি কি গান গাইতে পারো?
কিবো : অবশ্যই, আমি যে কোনো গান গাইতে পারি, কিন্তু সুর করতে পারি না!
ইভা : তাহলে তুমি আসলেই একটা তৃতীয় শ্রেণির রোবট ।
কিবো : হ্যাঁ, ঠিক আছে, কিন্তু আমি তোমার চেয়ে ভালো রান্না করতে পারে ।
ইভা : (হাসতে হাসতে) কিবো তুমি মনে হয় তর্ক না করে থাকতে পারো না ।
অয়ন : কিবো , একটা সিরিয়াস প্রশ্ন ,তুমি কেন কখনো ঘুমাও না?
কিবো : যন্ত্ররা কখনো ঘুমায় না, আমরা মানুষের জন্য নিবেদিত প্রাণ । মানুষকে বিনোদন ও দেখাশুনা করার জন্য আমাদের প্রোগ্রামিং করা হয়েছে।
পর্ব - ৬
..........
ইভা এবং অয়ন মহাকাশযানে অনেক দিন ধরে ভ্রমণ করছে। মহাকাশের অজানা গন্তব্যের দিকে , আর প্রতিদিনই কোনো না কোনো রহস্যময় ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। তাদের পাশে রয়েছে মহাকাশযানের কেন্দ্রীয় কম্পিউটার সিসি।
একদিন হঠাৎ মহাকাশযানে এক অদ্ভুত শব্দ শুরু হয়, যেটা প্রতিদিনের কোনো যান্ত্রিক শব্দের সাথে মেলে না।
ইভা : অয়ন তুমি কি এই শব্দটা শুনতে পাচ্ছো?
অয়ন : হ্যাঁ, কিন্তু এটা কি হতে পারে? কেন্দ্রীয় কম্পিউটার সিসির মতে কোথাও কোনো ত্রুটি নেই।"
সিসি : তোমাদের ধারণা ঠিক, সিস্টেমের কোন সমস্যা নেই। এই শব্দটা কোনো যান্ত্রিক উৎস থেকে আসছে না।"
ইভা : তাহলে এটা কোথা থেকে আসছে, সিসি? আমরা সামনে কি কোন বিপদের সম্মুখীন হচ্ছি ।
সিসি : শব্দটির উৎস বিশ্লেষণ করে এখনো কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে এটি জীবন্ত কোনো বস্তু বা শক্তি থেকে সৃষ্টি ।
অয়ন : জীবন্ত? আমাদের মহাকাশযানের বাইরে তো কোনো জীবন্ত কোন বস্তু থাকার কথা নয়।
সিরি : মহাকাশে এখনও অনেক কিছুই অজানা ও রহস্যজনক।
অয়ন : সিসি ,তুমি মহাকাশযানের সবচেয়ে নিরাপদ সুরক্ষা ব্যবস্থা চালু কর ।
সিসি : সুরক্ষা ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে, এখন আমরা সবাই নিরাপদ ।
পর্ব -৭
..........
ইভা ও অয়নের দীর্ঘ মহাকাশ যাত্রার একঘেয়েমি ও মানসিক চাপ কাটানোর জন্য তারা মাঝে মাঝে বিনোদন রোবট "কিবো"র সঙ্গে আলাপচারিতায় মেতে ওঠে। কিবো তাদের বিভিন্ন ধরনের মজাদার জোকস ও যুক্তি দিয়ে তাদের মানসিক চাপ ও অবসাদ দূর করতে সাহায্য করে।
কিবো : তোমরা কি জান, সময় আসলে কী? আমরা মহাকাশে কতদিন ধরে আছি, সময়ের ব্যাপারটা তোমাদের কাছে কি রকম লাগছে ?
ইভা : সময় এখানে অন্যরকম। পৃথিবীর মতো দিন-রাতের চক্র নেই, আমাদের ঘড়ি আর কম্পিউটারই বলে দেয় কতক্ষণ পেরিয়ে গেছে।
অয়ন : আমার মনে হয়, মহাকাশে সময় একটা আপেক্ষিক ব্যাপার। যতই সময় পেরিয়ে যাক, তা একসময় একটা শূন্যতার মতো মনে হয়।
কিবো : তোমাদের কথাই ঠিক। সময় একটি প্রবাহিত নদীর মতো, কিন্তু কোথাও না কোথাও সেই প্রবাহ থেমে যায়। মহাকাশের সময় যেন অদৃশ্য হয়ে যায়। হয়তো একদিন আমরা এর উত্তর পেয়ে যাব।
ইভা : আমার মনে হয় সময়ের এ ধরনের ভাবনা আমাদের জীবনের মুহূর্তগুলোকে বেশি করে উপলব্ধি করতে সাহায্য করে।
কিবো : ঠিক বলেছো, সময় সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সেটাই তো আমাদের অস্তিত্বকে চিহ্নিত করে।
পর্ব - ৮
...........
একদিন ইভা ও অয়ন হঠাৎই মহাকাশযানের ভেতরে একটা অদ্ভুত কণ্ঠস্বর শুনতে পায়। যেন কেউ তাদের নাম ধরে ডাকছে।
ইভা : এই কণ্ঠস্বরটা কোথা থেকে আসছে? এটা কি আমাদের মনের ভ্রম?
অয়ন : হয়তো কেউ আমাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করছে?
সিসি : কোনো বাইরের সংকেত নেই। তবে তোমাদের মস্তিষ্কে কিছু তরঙ্গ বিকৃতি হচ্ছে। তোমাদের মানসিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য মেডিকেল সিস্টেম চালু করা হয়েছে।
ইভা : কিন্তু আমরা তো ঠিক আছি, তাই না?
সিসি : তোমাদের শারীরিক অবস্থা স্বাভাবিক, তবে মহাকাশের গভীরতায় মস্তিষ্কে কিছু প্রভাব পড়তে পারে। এ ধরনের সংকেত অন্য কোনো সত্ত্বা থেকে আসতে পারে।
অয়ন : তাহলে আমরা কি আসলেই একা নই?
এইসব রহস্যময় ঘটনাগুলো ইভা ও অয়নকে শুধু ভাবায়ই না, তাদের মধ্যে এক ধরনের ভয়ও কাজ করে। মহাকাশের অজানা রহস্য ক্রমশই ঘনীভূত হয়, আর তারা জানে না সামনে কী অপেক্ষা করছে।
পর্ব -৯
.........
দীর্ঘদিন মহাকাশযানে থাকার ফলে ইভা এবং অয়নের মধ্যে কিছু মানসিক সমস্যার লক্ষণ দেখা দেয় । ফলে তাদের মাঝে একঘেয়েমি, বিষণ্নতা এবং হতাশা ধীরে ধীরে গ্রাস করতে থাকে । কেন্দ্রীয় কম্পিউটার "সিসি" তাদের এই সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে ।
ইভা : অয়ন, আমার কাছে সব কিছু অর্থহীন মনে হচ্ছে ।
তোমারও কি এমনটা মনে হচ্ছে? আমরা এখানে কতদিন থেকে আছি ? ঘুরেফিরে যেন আমরা এক জায়গায় বারবার অবস্থান করছি ।
অয়ন : হ্যাঁ, আমারও ঠিক একইরকম মনে হচ্ছে। সময় যেন থেমে গেছে। মনে হয় অজানা শূন্যতায় আটকে আছি । কখনো কখনো মনে হয় আমরা আর ফিরে যেতে পারব না।
সিসি :আমি লক্ষ্য করছি তোমাদের মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হতে শুরু করেছে। এটি মহাকাশযানের দীর্ঘ ভ্রমণের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া।
ইভা : তাহলে আমাদের কী করা উচিত, সিসি? আমরা কি পুরোপুরি পাগল হয়ে যাচ্ছি ।
সিসি :ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি তোমাদের জন্য একটি মানসিক ভারসাম্যতার প্রোগ্রাম চালু করতে যাচ্ছি, যা মনকে পুনর্জাগরিত করতে সাহায্য করবে। এছাড়াও তোমাদের মন ভালো রাখার জন্য কিছু বিনোদনমূলক কার্যক্রমও যুক্ত করছি।
অয়ন : তুমি কীভাবে আমাদের সাহায্য করবে, সিসি? আমি আর নিজেকে স্বাভাবিক মনে করছি না ।
সিসি : আমার বিশ্লেষণ অনুযায়ী, তোমাদের মস্তিষ্কে ডোপামিন এবং সেরোটোনিনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। আমি তোমাদের জন্য হালকা মানসিক প্রশান্তি ও চেতনা উদ্দীপনকারী সংকেত পাঠাতে যাচ্ছি। এই মুহূর্তে তোমাদের কিছু সৃজনশীল কাজে মনোনিবেশ করা উচিত ।
ইভা : তুমি আমাদের মস্তিষ্কের নিউরণকে পরিবর্তন করতে পারবে?
সিসি : ঠিক তাই, তবে আমি শুধু নিউরন পরিবর্তন করব না, আমি তোমাদের মস্তিষ্কের সেই অংশগুলোকে উদ্দীপিত করব, যেগুলো এখন মানসিক চাপের ফলে নিষ্ক্রিয় হয়ে আছে। এটি ধীরে ধীরে কাজ করবে, তাই তোমরা একটু ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করবে।
অয়ন : সিসি, এখন কিছুটা ভালো লাগছে। মাথার ভেতর থেকে যেন ভারী একটা বস্তু নেমে গেছে। এটা কি তোমার কাজ?
সিসি : হ্যাঁ, আমি তোমাদের মস্তিষ্কে মনোসংযোগ ও সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করার সংকেত পাঠাচ্ছি। তবে তোমাদের স্বাভাবিক রুটিনেও কিছু পরিবর্তন করতে হবে। রোজ একই কাজ না করে নতুন কিছু করার চেষ্টা করো। আমি নতুন বিনোদনমূলক প্রোগ্রামও যুক্ত করেছি, যা তোমাদের মানসিক শক্তিকে ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবে।
ইভা : আমিও কিছুটা স্বাভাবিক অনুভব করছি ,আমার মন আবার শান্ত হতে শুরু করেছে।
অয়ন : সিসি, এখন মনে হচ্ছে আমরা আবার একটু একটু করে স্বাভাবিক হচ্ছি। গতকালের চেয়ে আজকে অনেক হালকা লাগছে।
পর্ব - ১০
..............
ইভা ও অয়নের মানসিক অবস্থা স্বাভাবিক করার জন্য কেন্দ্রীয় কম্পিউটার সিসি বিশেষ একটি যন্ত্রের সাহায্যে তাদের শৈশবে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে ।
ইভা : এই যন্ত্রটা দেখতে খুব অদ্ভুত! সিসি, এটা কীভাবে কাজ করে?
সিসি : এই যন্ত্রটির নাম 'নস্টালগিয়া ১.০'। এর কাজ হল তোমাদের মস্তিষ্কের গভীরে লুকিয়ে থাকা পুরনো স্মৃতিগুলোকে আবার জাগ্রত করা ও শৈশবকালের পুরনো স্মৃতিগুলো আবার মনে করিয়ে দেওয়া । তোমরা সেই মুহূর্তগুলোতে আবার ফিরে যাচ্ছ। প্রস্তুত?
অয়ন : (আবেগে ভরা গলায়) প্রস্তুত! শৈশবের দিনগুলোকে আবার দেখতে পাব, ভাবতেই গায়ে শিহরণ জাগছে !
সিসি : চোখ বন্ধ করো, এবং জোরে নিঃশ্বাস নাও। এখন তোমাদের শৈশবের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্তগুলোতে নিয়ে যাচ্ছি।
(যন্ত্র থেকে হালকা সুরেলা আওয়াজ আসতে থাকে। ইভা আর অয়নের চারপাশের জগত বদলে যেতে থাকে। তারা অনুভব করে, হঠাৎ করেই তারা ছোটবেলার সেই গ্রামের পথে এসে দাঁড়িয়েছে। গোধূলি বেলা, খোলা মাঠ, আর বট গাছের তলায় শীতল ছায়া।)
ইভা : (চমকে উঠে) এটা তো সেই মাঠ! আমাদের খেলার মাঠ! দ্যাখো অয়ন, সব ঠিক আগের মতোই আছে!
অয়ন : (মুগ্ধ স্বরে) হ্যাঁ ইভা, বিশ্বাস করতে পারছি না! বট গাছটা, ছোট্ট পুকুরটা ঠিক যেন চির চেনা ।
(ইভা দৌড়ে চলে যায় বট গাছের নিচে, ছায়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে লুকিয়ে হাসে।)
ইভা : এই গাছের নিচে কতবার লুকিয়েছি! মনে আছে, আমরা যখন লুকোচুরি খেলতাম, তুমি কখনো আমাকে খুঁজে পেতে না?
অয়ন : (হাসতে হাসতে) : হ্যাঁ, মনে আছে! তুমি গাছের পেছনে এমনভাবে লুকিয়ে থাকতে যেন আমি কখনো খুঁজে পাই না। একবার তো তুমি নিজেই লুকোতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিলে, মনে আছে?
ইভা : (মুচকি হেসে) হ্যাঁ, পড়ে গিয়ে খুব কেঁদে ছিলাম, অথচ আঘাতটা তেমন গুরুতর ছিল না! এখন ভাবলে হাসি পায়।
অয়ন : (একটু হেসে) তখন সবকিছুই গুরুত্বপূর্ণ মনে হতো।
(তারা হাঁটতে হাঁটতে , পুকুরের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। পুকুরের পানিতে তাদের শৈশবের প্রতিচ্ছবি দেখা যায়।)
ইভা : (পুকুরের দিকে তাকিয়ে) এই পুকুরের পানিতে কতদিন সাঁতার কেটেছি, স্নান করেছি।
অয়ন : (দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে) আচ্ছা, মনে আছে তোমার সেই ফাগুনের দিনগুলো? আমরা ঘুড়ি উড়াতাম আর ফাঁকা মাঠে দৌড়াতাম? যেন আকাশও আমাদের সাথে সাথে দৌড়াতো ।
ইভা : (হাসি দিয়ে) মনে আছে, তুমি একটা ঘুড়ি এত উঁচুতে উড়িয়েছিলে ,যেন সেটা আকাশ ছুঁয়ে ফেলবে। শেষে, ঘুড়িটা পেঁচিয়ে গিয়ে গাছের ডালে আটকে গেল!
অয়ন : (হাসতে হাসতে) ওটা ছিল আমার প্রথম ঘুড়ি! সেটা হারিয়ে ফেলে আমি কাঁদতে শুরু করেছিলাম। তুমি তখন এসে আমাকে বুঝিয়েছিলে, 'অয়ন, একটা ঘুড়ি হারিয়ে গেলে কি আরেকটা বানানো যাবে না?
সিসি : তোমাদের যন্ত্রের সাহায্যে শৈশবে ফিরে যেতে কেমন লাগছে ?
ইভা : মনে হচ্ছে যেন আমরা এখনো সেই শৈশবে আছি। সবকিছুই ঠিক আগের মতো আছে।
অয়ন : তুমি জানো সিসি, বাস্তব জীবনে হয়তো এসব স্মৃতি ফিকে হয়ে যায়, কিন্তু এখানে এসে আবার মনে হচ্ছে আমি সেই ছোট্ট ছেলেটি, যে আকাশে ঘুড়ি উড়ানোর স্বপ্ন দেখে।
সিসি : তোমাদের এই স্মৃতিগুলো সবসময় সংরক্ষিত থাকবে, যখনই চাইবে, ফিরে পাবে।
পর্ব - ১১
..............
অবশেষে, ইভা ও অয়নের মহাকাশযানটি অনেক বছর পর,পৃথিবী থেকে প্রায় এক হাজার আলোকবর্ষ দূরে একটি গ্রহের সন্ধান পায়, যার নাম 'এল্টেরা'। এই গ্রহের আবহাওয়া, পরিবেশ, এবং আকার পৃথিবীর সঙ্গে প্রায় মিলে যায়।
সিসি : দীর্ঘ পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষার পর আমি নিশ্চিত হয়েছি, এই গ্রহটি মানুষের বসবাসের জন্য উপযুক্ত। এখানে সবকিছু রয়েছে অক্সিজেন, পানি, এবং সহনশীল তাপমাত্রা।
ইভা : (আবেগাপ্লুত হয়ে) অবশেষে!আমরা নতুন পৃথিবী খুঁজে পেয়েছি!
অয়ন : এটা সত্যিই অবিশ্বাস্য! কিন্তু আমরা কিভাবে পৃথিবীতে এই খবর পৌঁছাব?
সিসি :-আমি ইতিমধ্যেই যোগাযোগ সিগন্যাল প্রস্তুত করছি। আমাদের শাটল থেকে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সিগন্যাল পাঠানো হবে, যা পৃথিবীতে পৌঁছাবে। সেখানকার বিজ্ঞানীরা এই তথ্য ব্যবহার করে পৃথিবীকে বাসযোগ্য গ্রহ করার উপায় খুঁজে বের করতে পারবে।
ইভা : সিসি, তুমি কি নিশ্চিত যে পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা এই তথ্য পেয়ে তা কাজে লাগাতে পারবে?
সিসি : হ্যাঁ, আমি সমস্ত তথ্য পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করেছি। এই গ্রহের উপাদান এবং পৃথিবীর বর্তমান পরিস্থিতির মধ্যে সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে আমি দেখিয়েছি কীভাবে পৃথিবীর পরিবেশ নতুন করে তৈরি করা সম্ভব।
অয়ন : তাহলে তুমি বলতে চাও, আমরা শুধু এই গ্রহকেই খুঁজে পাইনি, পৃথিবীকে বাঁচানোর উপায়ও পেয়েছি?
সিসি : ঠিক তাই, অয়ন। পৃথিবীতে বায়ুমণ্ডলের ক্ষতি বন্ধ করা এবং পরিবেশ ঠিক করা এখন সম্ভব। আমি সমস্ত প্রয়োজনীয় ডেটা পাঠাচ্ছি।
অয়ন : সিসি, তুমি যদি না থাকতে, আমরা কখনো এই মিশনে সফল হতে পারতাম না।
সিসি : এখনো অনেক কাজ বাকি, অয়ন। পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা এই তথ্যের ভিত্তিতে কাজ শুরু করলেই পৃথিবীকে বাঁচানো সম্ভব হবে ।
ইভা : আমি জানি,আমরা পৃথিবীতে ফিরে যেতে পারব না, তবে আমাদের মিশন সফল হয়েছে ।
সিসি : তোমাদের জন্য পৃথিবী আরেকবার বাসযোগ্য হবে। তোমাদের প্রজন্মের জন্য না হলেও, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য পৃথিবী আবার বসবাসের উপযোগী হবে ।
অয়ন : এটাই তো চেয়েছিলাম, সিসি। আমাদের সন্তান, তাদের ভবিষ্যৎ এই গ্রহে হোক বা পৃথিবীতে তারা বাঁচতে পারবে।
সিসি : মানব ইতিহাসে তোমাদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। সিগন্যাল পাঠানোর প্রক্রিয়া এখন শুরু হচ্ছে।
(কিছুক্ষণ নীরবতা)
অয়ন : পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা খবর পেয়েছে?
সিসি : হ্যাঁ, সিগন্যাল সফলভাবে পৌঁছেছে। পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা এখন কাজ শুরু করবে।
অয়ন : (মৃদু হাসি দিয়ে) অবশেষে, আমরা আমাদের কাজ শেষ করলাম।
সিসি : এটা শুধু শুরু, অয়ন.............সমাপ্ত ।