Posts

গল্প

কুকরি বনের অভিশাপ

January 1, 2025

Subit Baran Mallick

23
View
কুকরি বনের অভিশাপ।

গ্রীষ্মের এক উজ্জ্বল সকালে, পাঁচজন বন্ধু—অর্পিত, সমীর, অঞ্জলি, সুকুমার এবং তন্ময়—দক্ষিণ বঙ্গের এক প্রত্যন্ত গ্রামে বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা করল। তাদের ছুটির দিন কাটানোর জন্য ছিল অনেক সুযোগ, কিন্তু তারা একটি একেবারে অস্বাভাবিক স্থানে, যেখানে ভৌতিক গল্পের গল্প শোনা যেত, সেখানেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। গ্রামটির নাম ছিল "চাঁদপুর", আর এই গ্রামের পাশে ছিল এক বিশাল অরণ্য—কুকরি বন। গ্রামবাসীরা বিশ্বাস করত, বনের গভীরে লুকিয়ে রয়েছে কিছু অদৃশ্য, অশুভ শক্তি। তবে, এরকম কোনো ভয় তাঁদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেনি। তারা সেই অদ্ভুত বনের রহস্য উদঘাটন করতে চেয়েছিল।


 

তাদের জগৎ ছিল এক অন্য রকম—আধুনিক, উদ্যমী, অথচ তারা ছিল একেবারে অজ্ঞ। গ্রামবাসীরা তাদের নানা ভাবে সতর্ক করেছিল, কিন্তু তারা উপেক্ষা করেছিল সব সতর্কতা। অর্পিত, সুকুমার, এবং তন্ময় পুরোপুরি প্রস্তুত ছিল। অঞ্জলি এবং সমীর একটু দ্বিধায় ছিল, তবে বন্ধুত্বের জন্য তারা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

গ্রাম থেকে খুব বেশি দূরে ছিল না কুকরি বন। বনটি এমন একটি জায়গা ছিল যেখানে সূর্যের আলো ঠিকমত পৌঁছাত না। প্রাচীন গাছপালা, তাদের শাখাগুলো এত ঘন যে, কখনো কখনো একে অপরকে ছাপিয়ে যেত, যেন অন্ধকারের গভীরে হারিয়ে যাচ্ছে। গাছের পাতায় এক অদ্ভুত ছায়া, তাদের চারপাশে যেন কিছু গোপন চোখের মতো দেখতে হতো।


 

কুকরি বনে ঢোকা মাত্র তাদের মনে হলো, কিছু একটা এখানে ঠিক নেই। আশেপাশে কোনো পাখি বা পশু ছিল না, নিঃসঙ্গতা ভরপুর। বাতাসের মাঝে অদ্ভুত এক গন্ধ ছড়াচ্ছিল—মাটি ও পুরনো পাথরের গন্ধ, যেন এই বন এক অজানা পৃথিবী থেকে এসেছে। সুকুমার হাসতে হাসতে বলল, "এটা তো পুরনো বন, এখানে পাখি-প্রাণী কিছুই থাকবেই না।"

তবে অঞ্জলি কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তার মনে হচ্ছিল, যেন কিছু তাদের অনুসরণ করছে। "আমি এখানে থাকতে চাই না," সে বলল, "মনে হচ্ছে কিছু খারাপ ঘটতে চলেছে।"

"ভয় পাওয়ার কিছু নেই, অঞ্জলি। এটা শুধু একটি পুরনো বন," সমীর তার হাত ধরে বলল। কিন্তু অঞ্জলির মনে সেই অশুভ অনুভূতি ক্রমেই তীব্র হচ্ছিল।

তারা আরও গভীরে প্রবাহিত হলো। বনটা শুধু ঘন নয়, এর গাছগুলোর গুঁড়ি এত পুরনো, যেন এক মহাকালের সাক্ষী। কখনো কখনো, দূর থেকে কান্নার মত আওয়াজ শোনা যেত, কিন্তু যখন তারা কান্নার দিকে মনোযোগ দিয়েছিল, তখন কিছুই দেখা যেত না। এ যেন এক অদৃশ্য শক্তি তাদের চোখের সামনে উপস্থিত হচ্ছিল।


 

এরপর, সুকুমার একটি পুরনো পাথরের মূর্তির সামনে এসে দাঁড়াল। মূর্তিটি অদ্ভুতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ছিল—শরীরের কিছু অংশ ভেঙে গেছে, তবে এর চোখ গুলি তখনও মদ্যপ আগুনের মতো জ্বলছিল। "এটা কি?" সুকুমার বিস্মিত হয়ে বলল।

"এটা এক প্রাচীন মূর্তি," তন্ময় উত্তর দিল, "এটা একটি দেবতার প্রতীক, তবে এর আশেপাশে অনেক অন্ধকার শক্তির আশ্রয়।"

তখনই, অঞ্জলি আর সমীর দুজনেই ঘন ঘন পিছনে তাকাচ্ছিল, যেন তারা বুঝতে পারছিল, এখানে কিছু ঠিক নেই। তারা হাঁপাচ্ছিল, যেন তাদের বুকের মধ্যে চাপ আসছে।

"আমরা ফিরে চল," অঞ্জলি শেষমেশ বলল। "এটা বিপদজনক।"

তবে তন্ময় দৃঢ়ভাবে বলল, "এটা ভয় পেয়ে ফিরে যাওয়ার বিষয় নয়। আমাদেরকে সামনে এগোতে হবে।"


 

তাদের আরও কিছুটা এগোতে, হঠাৎ অদ্ভুত কিছু ঘটল। চারপাশে যেন বাতাসের দিক বদল হতে শুরু করল, এবং আশেপাশের গাছগুলি যেন অদৃশ্য কোনো শক্তির দ্বারা টানাহিঁচড়া হচ্ছিল। এক মুহূর্তের মধ্যে গাছের পাতাগুলি উড়তে লাগল, এবং ঝড়ের আওয়াজ পুরো বনকে এক অদ্ভুত সুরে ভরিয়ে দিল।

তাদের দৃষ্টি হঠাৎ সরে গিয়ে সামনে একটা অদ্ভুত সৃষ্টি দেখল—এক অদ্ভুত, দানবীয় আকৃতির ছায়া। সেই দানবের চোখ ছিল আগুনের মতো, আর তার শরীর ছিল এক ধরনের পাথর-লুপ্ত প্রাণী, যা যেন শুধুমাত্র অন্ধকারে জন্ম নিয়েছে।

অর্পিত প্রথমেই চিৎকার করে বলল, "এটা কী ছিল?" তবে তার কথা শেষ হবার আগেই সেই ছায়া তাদের দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করল।

একটু পর, তন্ময় হঠাৎ মূর্তির কাছে গিয়ে সেই রহস্যময় চিহ্নটি স্পর্শ করল, যা তাদের বুঝিয়ে দিল—এটি একটি অভিশপ্ত জায়গা, যেখানকার আত্মারা চিরকাল ধরে পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে।

তারপর, পৃথিবীর মাটি থেকে ঘন অন্ধকার বের হয়ে আসল। অঞ্জলি আর সুকুমারের চোখে আতঙ্ক ঝিলমিল করছিল। একে একে সবাই ভীষণভাবে থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, যেন তারা এক অদ্ভুত শক্তির কাছে বন্দী হয়ে গেছে।


 

শেষমেষ, ভয়ঙ্কর দানবটি তাদের ওপর আক্রমণ করে। তাদের চিৎকার আর কোনো সাহায্য না পেল, কারণ কেউ শুনছিল না। রাত গভীর হয়ে গেল, আর তাদের আত্মা কুকরি বনের অন্ধকারে হারিয়ে গেল।

পরদিন, গ্রামবাসীরা পুলিশ পাঠিয়েছিল। কিন্তু যখন পুলিশ তাদের লাশ খুঁজে পেল, তখন তাদের অবস্থা এমন ছিল, যেন তারা কোনো অভিশপ্ত জায়গায় ধ্বংস হয়ে গেছে। এবং কুকরি বনে আজও ভৌতিক কাহিনীগুলি বাতাসে ভাসছে—যারা সেখানে গিয়েছিল, তাদের আত্মা আর কোনোদিন ফিরে আসেনি।


 

শেষ।

Comments

    Please login to post comment. Login