Posts

গল্প

চ্যানেল কেটিভি

June 12, 2024

নয়ন ইসলাম

Original Author নয়ন

ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত । ঢেলেঢুলে হেটে আসছে জনাব মোখলেসুর রহমান । চারিদিকটা ছমছমে । সরকারি কোয়ার্টারগুলোর  আশেপাশে যেমন ছমছমে থাকে । এদিকে একদল অপেক্ষা করছে জনাব মোখলেসুর রহমানের জন্যে ।

-হ্যালো, চার্লি বলছি । ওভার এন্ড আউট ।

- সিরাজ-উদ-দৌলা  লিসেনিং, চার্লি । খবর বল দ্রুত । ওভার এন্ড আউট ।

- টার্গেট বাসার নিকট আসছে। প্রস্তুত হউ । ওভার এন্ড আউট ।

প্রস্তুতি সেরে গাড়িটা নিয়ে অপেক্ষা করছে সিরাজ-উদ-দৌলা এর দলের সবাই । ওদিকে চার্লিও গাড়ির কাছেই আসছে । মোখলেসুর রহমান যেই গাড়ির নিকট পৌছাল অমনি সবাই হুড়মুড় করে বের হয়ে মোখলেসুর সাহেবকে তুলে নিয়ে গাড়িতে তুলে ফেলল । মোখলেসুর সাহেব কিছু বলার আগেই তার মুখটাকে বেধে দিল একজন সেই সাথে ক্লোরফরম দিয়ে অচেতন করা হল তাকে । মুখ বেধে দেয়ায় কিছু বলতে গিয়েও কিছুই আর বলতে পারলো না মোখলেসুর সাহেব । মোখলেসুর সাহেব হচ্ছেন সরকারি অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা । বাসায় হেঁটে যাবার অভ্যাস করেছেন ডায়বেটিক্সের রোগী হবার পর থেকে । সেটারই সুযোগ নিয়ে নিল সিরাজ-উদ-দৌলা এর দলের লোকেরা ।


 

জ্ঞান ফিরে আসার পরে চোখ খুলে মোখলেসুর সাহেব যা দেখলেন । তিনি একটি রাজদরবারে বন্দি অবস্থায় আছে । তার পাশে দুজন প্রহরি হাতে বল্লম নিয়ে দাড়িয়ে । অন্ধকার চারিদিকে শুধু একটি ঝারবাতির আলো তাতে শুধুমাত্র তাকেই দেখা যায় । অন্ধকারে বাকিদের ছায়া ছাড়া আর কিছুই দেখা যায়না । হঠাৎ করে বাজনা বাঁশি বেজে উঠল আর ধ্বনিত হতে লাগল বাংলার শেষ নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা এর আগমন হচ্ছে রাজদরবারে । পুরানো দিনের বিটিভেতে সিরাজ-উদ-দৌলা বাংলা ছায়াছবিতে যেমন দেখেছিল জনাব আনোয়ার সাহেবকে ধিরে ধিরে আগমন করতে তার রাজদরবারে । সেভাবেই আগমন ঘঠলো এই রাজদরবারেও । নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা এসে তার সিংহাসনে বসলেন । এসেই সব মন্ত্রীমহোদয়, উজির, নাজির, প্রহরীকে দরবার প্রস্থান করার নির্দেশ দিলেন এবং সবাই তা পালন করলেন । দরবারে শুধু নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা এবং মোখলেসুর সাহেব । মোখলেসুর সাহেবের তো চোখেমুখে নবাবকে দেখতে পাওয়ার আনন্দ । নবাব তাকে কিছু বলার আগেই মোখলেসুর সাহেব বলে উঠলেন , নবাবজী আমি আপনার খুব বড় ভক্ত । ছোট বেলায় বইয়ে আপনার ইতিহাস খুব পড়েছি । আপনি যদি সেদিন পরাজিত না হতেন তাহলে কি আর ইংরেজরা আমাদেরকে দুশো বছর শাসন করতে পারতো ? একদমই পারতো না নবাবজী । নবাব হেসে উঠলেন মোখলেসুর রহমান সাহেবের কথা শুনে । জনাব মোখলেসুর রহমান সাহেব ইতিহাস তো খুব ভালভাবে পরেছেন দেখছি । আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম আপনি তো বিসিএস ক্যাডার । আপনার তো ইতিহাস পরতেই হবে এর জন্যে । যাইহোক কাজের কথায় আসি ।

- আপনি কি জানেন আপনাকে এখানে তুলে আনার কারণ ?

- নাহ নবাবজী ।

- আচ্ছা তাহলে বলছি । গত বছর বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে ভাইভাতে টিকেছিল কতজন? ঠিক ঠিক জবাব দিবেন তানাহলে বাহিরে আমার সৈনিকেরা আছে তাদেরকে দিয়ে সত্যি কথা বলাবো কেননা আমার আপনার থেকে সত্য কথা বের করাতেই হবে এবং আমি চাই আপনি সত্যি কথাই বলেন ।

- জী নবাবজী সত্যি কথাই বলব ।

- আমি জানি আপনার মাঝে এখনও কিছু সৎ গুণ আছে তাই আপনাকে তুলে আনা ।

- ভাইভার জন্যে মোট ৩১৫ জন পাশ করেছিল ।

- এদের মধ্যে থেকে কত জনের নেয়ার কথা ছিল ?

- ২০০ জনের নেয়ার কথা ছিল ।

- নেয়া হয়েছিল কত জনকে? মেধায় কতজন ? ভিন্ন ভিন্ন কোটায় কতজন ?

- ২০০ জনকেই নেয়া হয়েছিল তবে ভিন্ন ভিন্ন কোটায় মাত্র ৬৩ জনকে নেয়া হয়েছিল । বাকি সবাইকে মেধায় ।

- খামোশ মহাদয় । মিথ্যে এই দরবারে চলবে না । মিথ্যের ঠাই এই দরবারে হবে না । সত্য বল ।

- মেধায় আসলে কাগজে কলমে তারা মেধায় কিন্তু আসলে টাকায় ।

- সেই টাকা কি সরকার নেয়?

- সেই টাকা সরকার নয় আমার মত আরও অনেক কর্মকর্তা আছে তারা নেয় ।

- তুমি নাওনা?

- লজ্জায় মাথা নত করে বলে ,’জী, আমিও নেই ‘

- লজ্জা লাগছে বলতে?

- জী ।

- আমার সামনে লজ্জা পেতে হবে না তোমাকে । দোষ তোমার নয় । দোষ তাদের যাদেরকে দেখে তুমি শিখেছ । তোমাকে আজ কিছু কথা বলবো তাই এখানে তোমাকে তুলে আনা ।


 

বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব আমিই ছিলাম । আমি আমার আশেপাশের মানুষগুলোকে চিনতে পারিনি । যাদেরকে আমি যা দায়িত্ব দিয়েছিলাম তারা তার যোগ্য ছিল না । তাইতো আমাকে পিছন থেকে ছুরি মেরে ওহ অত্যন্ত দুঃখিত আমাকে নয় পুরো বাংলা, বিহার, উড়িষ্যাকে পিছন থেকে ছুরি মেরে দুশো বছর ইংরেজদের দাস বানিয়ে দিয়েছিল । তুমি আমাকে যেভাবে বললে না যে সেদিন পরাজিত হয়েছি । হুম পরাজিত হয়েছি আমি তবে শুধু ইংরেজদের কাছে নয়, পরজিত হয়েছি আমি বাংলার মানুষদের কাছে । নিজেরই কিছু অকৃতজ্ঞ মানুষের জন্যে । তোমাকে এসব বলার কারন তুমি দেশের যে পদে আছো তোমার, তোমাদের উচিত যোগ্য মানুষদেরকে দেশের রাজকাজে, শাসনকাজে, সকলকাজে নিয়োগ দেয়া । যাতে করে আর কোন মীরজাফরের মত মানুষের ঠাই দেশের গুরুত্বপূর্ণ কাজে না হয় । যাতে করে পিছন থেকে ছুরি মেরে দেশটাকে ছুরিকাঘাত না করে যদিও দেশটাকে তারা এখন সামনে থেকেই লুটেপুটে খায় । এরা নিজেদের লোভে দেশটাকে আবারও দুশো, চারশো বছর পিছিয়ে দিবে । দেশকে পিছিয়ে পরা থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব তোমার, তোমাদের ।


 

এই বলে যতটুকু আলো ছিল রুমে সেটাও চলে গেল । হঠাৎ করে মোখেলসুর সাহেব আবারও অচেতন হয়ে পরেন । জ্ঞান ফিরে আসার পরে নিজেকে আবিষ্কার করল হসপিটালে তার পাশে তার স্ত্রী ও তার কিছু জুনিয়র কর্মকর্তা এবং সেই সাথে পুলিশ । পুলিশ এসেছে ঘটনা জানার জন্যে । মোখলেসুর সাহেব জিজ্ঞেস করলেন তার জুনিয়র কর্মকর্তাদের তোমরা অফিসের কাজ বাদ দিয়ে কেন এসেছ? সবাই বলে উঠল স্যার আপনাকে দেখতে ।

- অফিস বাদ দিয়ে এখানে সময় ব্যায় করার কোন মানেই হয় না । যাও অফিসে যাও এখনই ।


 

সবাই বেরিয়ে যাবার পরে সাংবাদিকরা প্রবেশ করলো আর দুজন পুলিশ সাংবাদিক সবাইকে একটু দূরত্ব রেখে দাড়া করালো । মোখলেসুর সাহেব সবাইকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ঘটনা খুলে বলল । পুলিশরাও ঘটনা জেনে তদন্তে নেমে গেল । একটু পরে ডাক্তার সাহেব এসে সবাইকে রুম থেকে বের করে দিল । তখনই রুমে মোখলেসুর রহমান সাহেবের ছেলের প্রবেশ ঘটলো । বাবাকে জড়িয়ে ধরে কান্নাজুরে দিল ।


 

রুমে এখন মোখলেসুর রহমান সাহেব, তার স্ত্রী, ডাক্তার ও মোখলেসুর রহমান সাহেবের ছেলে । টিভি ছেড়ে দিল ডাক্তার সাহেব । মোখলেসুর রহমান সাহেব শুয়ে শুয়ে টিভির চ্যানেল পালটিয়ে দেখছে আর প্রতিটা চ্যানেলে তাকে নিয়ে দেখাচ্ছে আর উনি আটকে গেলেন কেটিভি-তে । সেখানে উনার নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা এর সাথের কথপকথনের ভিডিও দেখাচ্ছে তবে শব্দ ছাড়া ভিডিও । নিউজটি সারা দিন কয়েক সপ্তাহ চলল ।


 

মোখলেসুর রহমান সাহেব তার ছেলেকে বলছে

- কি এবার তো চ্যানেলটা সামলাতে পারবি? আমার যতটুকু করার আমি করে দিয়েছি ।

- জী বাবা, কেটিভি-কে এখন কই নিয়ে যাই তুমি দেখবা । বাংলাদেশের ১ নম্বর চ্যানেল বানাবো ।

- ঠিক আছে । জলদি আমাকে বাসায় পাঠানের ব্যবস্থা করেন ডাক্তার সাহেব ।

- কি যে বল বাবা । আমাকে তুমি অন্তত ডাক্তার সাহেব বইল না । তোমাকে ডিসচার্জ করে দিয়েছি ।


 

মোখলেসুর রহমান সাহেব ছেলের চ্যানেলকে নতুন করে জন্ম দিল । এই খুশিতে ছেলেদেরকে সাথে নিয়ে বাড়ি চলে গেল । ওদিকে হসপিটালে বেডের নিচে একটি সিডি পরে ছিল । হসপিটালের আয়া ঝাড়ু দিতে গিয়ে সেটিকে কেবিনে থাকা ফ্রিজের নিচে ফেলে দিল এবং টেরও পেল না ।

Comments

    Please login to post comment. Login