Posts

উপন্যাস

মানবী - অধ্যায় তিন

June 12, 2024

আহনাফ রাফি

লেকের পানি স্বচ্ছ। খুবই নীল। ডুব দিলে পানির নিচে সব পরিষ্কার দেখা যায়। কিরি কিছুক্ষণ আগে ডুব দিয়েছে। ডুব দিয়ে মাঝারি সাইজের কয়েকটা পাথর কুড়িয়ে নিয়ে এসেছে। পাথরের গায়ে লেগে থাকা অ্যালগি ওর প্রোজেক্টের জন্য প্রয়োজন। 

মধ্যদুপুর। ও এখন বসে আছে লেকের পারে ঘাসের উপর। পাথরগুলো পরে আছে ওর পাশে। দুপুর হলেও সকালে বৃষ্টি হওয়ায় পরিবেশ বেশ ঠাণ্ডা হয়ে আছে এখন। মাঝে মাঝে বাতাস বয়ে যাচ্ছে মৃদু মন্দ। আকাশে মেঘ এখনো পুরোপুরি কাটেনি। সম্ভবত বিকেলের দিকে বৃষ্টি হবে। সব মিলিয়ে উপভোগ করবার মতো পরিবেশ। 

ঘুম থেকে উঠার পর ওর কোথাও যেতে ইচ্ছে করছিল না। রাতে এখনো ভালো ঘুম হচ্ছে না। চোখ বুজলেই দুঃস্বপ্ন দেখে ও। স্বপ্নগুলো অদ্ভুত। কোনো মানেই খুঁজে পায় না ও। কখনো কখনো ওর বাবা মাকে স্বপ্নে দেখে। আবছা আবছা চেহারা ভেসে আসে। কিন্তু ওর তো বাবা মায়ের কোনো স্মৃতিই যে মনে নেই! আবার মাঝে মাঝে দাদু স্বপ্নে আসে। স্বপ্নে এসে উনি অনেক কিছুই বলেন ওকে। কিছুই মনে থাকে না ওর। শুধু মনে পড়ে চিঠিটার কথা। চিঠিটাই যা লিখা ছিল তা ভেবে ও শিহরিত হয়।

কিরি অনেক জোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এভাবে হারিয়ে গেল ফাইলটা! সে একটু খুলেও দেখতে পারল না। কি ছিল এর ভেতরে সে খানিকটা আন্দাজ করতে পারছে। কিন্তু ওটা দেখতে পেলে অনেক কিছুই ওর কাছে পরিষ্কার হয়ে যেত। কিন্তু ও আবার ভাবে— না দেখেই ভালো করেছে হয়ত। জীবনটা যেভাবে চলছে চলুক না! কেন এই নির্ঝঞ্ঝাট জীবন পালটাতে হবে? সত্য যদি আনন্দের না হয় তাহলে সেটা জেনেও বা কী হবে?

কিরি জোর করে এসব চিন্তা থেকে ওর মন দুরে সরিয়ে রাখতে চাইল। কী সুন্দর একটা দিন! জুন আর ও মিলে গতকাল সব অ্যাসাইনমেন্ট শেষ করে ফেলেছ। আজ তাই নিনিত, জুন আর ও— তিনজন এসেছে গ্রাউন্ড রিপোর্ট করতে। জুনের কোনো কাজ নেই। তাও সে এসেছে। এখন ওরা দুজন গেছে পাহাড়ে। হাইকিং করবে। কিরিকে অনেক করে বলার পরও সে রাজি হয় নি। ওর উচ্চতা ভীতি আছে। তার চেয়ে এখানে একাকী বসে থাকতেই ভালো লাগছে। 

হঠাৎ ওর পেছনে ঝোপে কিছু একটা নড়ে উঠল। কিরি ভাবল হয়তো নিনিতরা ফিরে এসেছে। হেসে বলল, ‘হাইকিং শেষ হলো? এবার প্রজেক্টের কাজ শেষ করে বাড়ি যেতে হবে তো! এভাবে ঘুরাঘুরি করলে পরীক্ষায় ধরাশায়ী হতে হবে যে!’

কিন্তু কোনো উত্তর আসলো না। আবার আওয়াজটা হল। ঝোপের মধ্যে কিছু একটা নড়ছে। কিরি এবার পেছন ফিরে তাকাল। না তো, কিছুই নেই! পেছনে ঝোপঝাড়। ওর খটকা লাগল। উঠে ও ঝোপগুলোর কাছে গেল। যা ভেবেছিল তাই। কিছু একটা গোলমাল আছেই! পাশাপাশি বাকি সব ঝোপের উপর ফড়িং উড়ছে। কিন্তু একটা ঝোপের উপর কোনো ফড়িং নেই। কেউ এখানে দাঁড়িয়ে ছিল বোঝাই যাচ্ছে।

কিরি যখন ভাবছে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে দেখবে কি দেখবে না— তখন হঠাৎ পায়ের শব্দ পেল। ঝোপের মধ্যে কেউ দৌড়ে যাচ্ছে। কিরি আর কৌতূহল সামলাতে পারল না। সেও দৌড় দিল পায়ের শব্দ লক্ষ করে। তারপরই বুঝতে পারল কত বড় ভুলটা করেছে সে!

ঝোপগুলো আসলে কাঁটাঝোপ। দৌড়াতে গিয়ে ছোটবড় কাঁটা লেগে যাচ্ছে পায়ে। কিরি ব্যাথায় গোঙিয়ে উঠল। কিন্তু থামতে চেয়েও থামতে পারল না ও। আরেকটু এগিয়ে গেলেই হয়তো ধরতে পারবে লোকটাকে। পায়ের শব্দের কাছে চলে আসছে ক্রমেই। ঝোপগুলো আরো বড় হচ্ছে। ওর কোমরের সমান হয়ে আসছে এখন। সামনে ঝোপ ছাড়া কিছু দেখাই যাচ্ছে না। কিরি চেঁচিয়ে বলে উঠল, ‘থামুন! কে ওখানে?’ কিন্তু কোনো উত্তর আসলো না। পায়ের শব্দ আরো জোরালো হয়েছে। 

কিরি যখন ভাবছে আর পারবে না দৌড়াতে— হাল ছেড়ে দিবে, তখনই অকস্মাৎ ঝোপ শেষ হয়ে যায়। সামনে একটা নালা। হাঁটু পানিও হবে না। যে দৌড়াচ্ছিল সে নিশ্চয় এতক্ষণে নালাটা পেরিয়ে ও পাশে চলে গেছে। 

কিরি ওর ট্রাউজার হাঁটু পর্যন্ত তুলে পানিতে নামল। পানি কনকনে ঠাণ্ডা। পায়ে কাঁটা বিঁধেছে যেখানে ওখানে এখন সুই ফোঁটার মতো যন্ত্রণা হচ্ছে। কিরি দাঁতে দাঁত চেপে নালাটা পার করল। অন্য পাশে কয়েক সারি ঝাউগাছ। তারপরই রাস্তা। রাস্তায় গাড়ির চাকার কোনো দাগ দেখতে পেল না ও। অর্থাৎ যে-ই ছিল— পায়ে হেঁটে গেছে। এখন সমস্যা হচ্ছে কোন দিকে গেছে সেটা বুঝা যাচ্ছে না। কিরি ভাবছিল কোনদিকে যাবে। তখনই জুন আর নিনিতের মিলিত গলার স্বর শুনতে পায় ও।

‘কিরি! কিরি!’

ও কিছুক্ষণ আগে যেখানে বসে ছিল ওখান থেকেই আসছে আওয়াজ। ও আবার ফিরে আসলো। তবে এবার কাঁটাঝোপ দিয়ে নয়, একটু দুর দিয়ে ঘুরে অন্য রাস্তা দিয়ে যাবে ঠিক করল। আসার সময় ওর হঠাৎ একটা জিনিস চোখে পড়ল। ঝোপের উপরে পড়ে আছে ছোট্ট রিমোট টাইপের কিছু একটা। তবে জিনিসটার কাজটা কী সেটা বুঝতে পারল না ও— আগে কখনো দেখেও নি। এটা কী সে যাকে তাড়া করছিল তার পকেট থেকেই পড়েছে? কে জানে! কিরি জিনিসটা ওর ট্রাউজারের পকেটে পুরে ফিরে আসলো। 

***

‘কোনো জন্তু জানোয়ার ছিল হবে হয়ত,’ স্যান্ডউইচে একটা কামড় বসিয়ে বলল জুন। 

ওরা তিনজন এখন লেকের পারে বসে আছে। ঘাসের উপর একটা চাদর পেতে ওদের লাঞ্চ বক্স খুলেছে। লাঞ্চ বলতে কিরি বাসা থেকে কয়েক পিস স্যান্ডউইচ এনেছে। আর কয়েক পিস কেক— এটা অরিনের বানানো। 

‘জন্তু জানোয়ারের পকেট থেকে এই রিমোট পড়বে কেন?’ নিনিত কিরির কুড়িয়ে পাওয়া রিমোট টাইপের জিনিসটা খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে বলল। 

‘জিনিসটাই বা কী?’ পায়ে ব্যান্ডেজ লাগাতে লাগাতে বলল কিরি। দুই পায়ে মারাত্মক জখম হয়ে গিয়েছে ওর। ভাগ্যিস ঝোপ ওর কোমর পর্যন্ত ছিল তাই পায়ে ছাড়া আর কোথাও খুব একটা কাঁটা বিঁধেনি। 

‘বুঝতে পারছি না,’ নিনিত ওর হাত থেকে জিনিসটা চাদরের উপর আলতো করে ছুঁড়ে মারল। ‘কিন্তু একটা জিনিস বুঝতে পারছি… তোমার ওভাবে কাঁটার মধ্যে দৌড় দেওয়া মোটেও ঠিক হয়নি।’

‘তা আমিও বুঝতে পারছি,’ কিরি অন্য দিকে তাকিয়ে বলল। ঠোঁটের কোণায় এক চিলতে হাসি লেগে আছে। ‘তবে খুব রোমাঞ্চকর একটা ঘটনা ঘটল তাই না? আমার তো মজাই লাগছে!’

‘ওটা যদি ভয়ঙ্কর কোনো মানুষ হত? কিংবা জঙ্গলী কোনো জন্তু হত? কাঁটাঝোপ থেকে তোর লাশ কুড়িয়ে আনতে আমাদের মোটেও “রোমাঞ্চ” লাগত না,’ জুন বলল। ‘তুই ভাবছিলিটা কী?’

‘কিছুই ভাবছিলাম না,’ জুনের দিকে চোখ টিপে বলল কিরি। 

‘কিন্তু…’ নিনিত বলল, ‘ঝোপ তো খুব একটা উঁচু না। কে দৌড়াচ্ছিল তা দেখতে পেলে না কী করে?’

কিরি একটু চিন্তা করে বলল, ‘মনে হয় আমার আসার অনেক আগেই দৌড় দিয়েছে লোকটা— অথবা যেই ছিল সেটা।’

নিনিত নিচের ঠোঁট কামড়াল। ‘কাপড়-চোপড় যদি ভারী হয়ে থাকে তাহলে কাঁটাঝোপের মধ্যে দৌড়ান কঠিন কিছু না। হয়তো জ্যাকেট আর ভারী ট্রাউজার পরে ছিল।’

‘হবে হয়তো,’ কিরি বলল। 

‘যাক্‌গে…’ একটু হাসার চেষ্টা করে বলল নিনিত। ‘তোমার কিছু হয়নি এটা ভেবেই আমরা নিশ্চিন্ত। খাবার-দাবার শেষ করে সেম্পল নেওয়ার কাজটা সেরে ফেলতে হবে। বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে।’

ওরা চুপচাপ লাঞ্চ সেরে নিল। 

কাজ শেষ করতে করতে প্রায় বিকেল হয়ে গেল। আকাশ ঘন কালো মেঘে ভরে গেছে। কেবল বিকেল হয়েছে কিন্তু এখনই সন্ধ্যার মত অন্ধকার হয়ে এসেছে। ওরা যে যার সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। কি মনে করে রিমোট টাইপের জিনিসটা জুন নিজের পকেটে পুরে নিল। এ ব্যাপারে আর খুব একটা আলোচনা উঠল না।

***

কিরি যখন কাপড়-চোপড় ছেড়ে নিজের রুমে ঢুকল তখন বৃষ্টি নেমে গেছে।

জানালা দিয়ে বৃষ্টির পানি ওর রুমে ঢুকে যাচ্ছে। কিরি তাড়াতাড়ি জানালা বন্ধ করে পড়ার টেবিলে ফিরে আসলো। অনেক পড়া জমে গেছে। পরীক্ষা যতই কাছে আসছে ওর ভয় ততটা বাড়ছে।  যদিও ওর পরীক্ষায় খারাপ করার সম্ভাবনা কখনোই থাকে না, তাও ভয়টা পেতে ওর ভালো লাগে। এটাও এক ধরণের রোমাঞ্চকর অনুভূতি। 

তবে অন্যদিনের মতো আজ ওর পড়ায় খুব একটা মন বসছে না। ও ভাবছে— আসলেই কী ওর উপর কেউ নজর রাখছিল? কদিন আগেও একটা গাড়ি ওর বাসার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। তারপর ওর বাসা থেকে ফাইলটা উধাও হয়ে যায়। আজকের ঘটনাটার সাথে কী এর কোনো সম্পর্ক আছে? কিন্তু ওর উপর কেনই বা কেউ নজর রাখবে? ওর তো মূল্যবান কিছুই নেই। আর কারো সাথে শত্রুতাও নেই। তাহলে কেন?

হঠাৎ ওর কি মনে হতে সামনের ড্রয়ারের হাতলে হাত রাখল। আস্তে করে টান মেরে খুলে ফেলল সেটা। কিছু নোটপ্যাড আর বুকমার্ক পড়ে আছে অগোছালো ভাবে। আর তার সাথে আরেকটা জিনিস। চিঠি! দাদুর দেওয়া চিঠিটা। ফাইল হারানোর চিন্তায় ও এটার বিষয়ে ভুলেই গিয়েছিল। কিরি চিঠিটা হাতে নিল।

এ ফোর সাইজের একটা অফসেট প্যাপার। পুরো কাগজ জুড়ে শুধু একটা লাইন লিখা: তোমার বাবা-মা বেঁচে আছে। ফাইলে বিস্তারিত জানতে পারবে। -দাদু 

কিরি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ওর বাবা-মা বেঁচে আছে তাতে কী ওর খুব একটা এসে যায়? এতো দিন কোথায় ছিল ওরা? এতো দিন কেন ওকে একা একা থাকতে হয়েছে? আর এখনই বা এসব জানতে হচ্ছে কেন?

কিরি কাগজটা রেখে দেবে এই সময় ওর একটা জিনিসে চোখ আটকে যায়। কাগজটার একদম নিচের দিকে ছোট্ট করে লিখা: সামারভিউ সেন্ট্রাল লাইব্রেরী। 

কিরি চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। তাহলে এখান থেকেই প্রিন্ট করা হয়েছে এই কাগজ। আগে কেন এই লিখা চোখে পড়ল না! কিরির নিজেকে খুব বোকা মনে হতে থাকে। তাই তো! ওদের এই দ্বীপে তো প্রিন্ট করার জায়গা এই একটাই আছে। এখানে খোঁজ লাগালে হয়তো জানা যাবে কে এই লোক।  

কিরি ঠিক করে ফেলল কাল স্কুল থেকে আসার পথে একবার লাইব্রেরীতে ঢুঁ মেরে আসবে।


 

(চলবে)



 

Comments

    Please login to post comment. Login