পোস্টস

গল্প

সেদিন ছিল অবেলা

২৬ মে ২০২৪

ফাহ্‌মিদা বারী

মূল লেখক ফাহ্‌মিদা বারী

সকাল সকাল গোছল সেরে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিল মাধবি। একটু পরেই ছুটতে হবে রান্নাঘরে। তারপর সকালের নাস্তার পাট চুকিয়ে স্বামী আর ছেলেকে যার যার কাজে বিদায় করেই নেমে পড়তে হবে দুপুরের আয়োজনে। 
 
এসব সারতে সারতেই সারা শরীর আবার ঘামে চিট চিট করতে থাকবে। দুপুরে আরেকদফা গোছল করতে হবে। মাধবির একটু ঠাণ্ডার ধাত। অল্পতেই হাঁচি শুরু হয়ে যায়। কখনো কখনো সেটা বেশ ভোগায়। সজল এটা নিয়েও মজা করে তার সঙ্গে। বলে, ‘তুমি কি ইচ্ছা ব্যাঙ নাকি বলো তো?’
‘ইচ্ছা ব্যাঙ! সেটা আবার কী?’
‘কেন ইচ্ছা নাগিনের কথা শোনোনি? যখন তখন ইচ্ছা হলেই সাপ হয়ে যেতে পারে। তুমিও তেমনি ইচ্ছা হলেই ব্যাঙ হয়ে যাও। সময় নাই অসময় নাই... হ্যাচোত হ্যাচোত!’
মাধবি চোখ পাকায়। ‘হ্যাঁ ইচ্ছা করে হ্যাচোত হ্যাচোত করি তো! তোমার হলে বুঝতা!’
 
চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে আয়নার ফাঁক দিয়ে ঘুমন্ত সজলের দিকে তাকায় মাধবি। বিয়ের আট বছর পূর্ণ হবে এই বছরেই। তবু এখনো নব দম্পতির মতো তার প্রতি রাতেই মনে সোহাগ জাগে! মাধবি রাগ করে মাঝে মাঝে। 
‘ছেলে বড় হচ্ছে এদিকে তোমার হটনেস ফুরায় না!’
‘হোক না বড়! ঐ ব্যাটার বড় হওয়ার সঙ্গে আমার হটনেসের কী সম্পর্ক?’
‘পাশের ঘরে থেকে যদি কিছু বুঝতে পারে?’
‘একটু আধটু বুঝতে দাও! নইলে ও ব্যাটা তো মূর্খ হয়ে বেড়ে উঠবে!’
‘যাও! ছ’বছরের ছেলেকে তোমার এখনই শিক্ষিত বানাতে হবে তাই না?’
 
এরপর সজল গল্প করতে বসে, তাদের ক্লাসে এরকম কিছু মূর্খ ছেলেপুলে ছিল যারা কিছুই বুঝত না। এমনকি ক্লাস নাইনের বায়োলজি বইয়ে শারীরবৃত্তীয় ব্যাপার স্যাপার পড়েও কেউ কেউ বোকার মতো টিচারকে উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করত। আর তা শুনে পুরো ক্লাস কেমন হেসে লুটোপুটি খেতে থাকত! 
 
চুল আঁচড়ে মুখে একটু ময়শ্চারাইজার লাগিয়ে ঘুমন্ত স্বামীর গায়ে একটা রাম টোকা মেরে যায় মাধবি। সজল ‘উঃ’ বলে একটা আওয়াজ করেই আবার পাশ ফিরে শোয়। মাধবি জানে এখনো কমসে কম আরো আধা ঘণ্টা ঘুমাবে সজল। তারপর বাবুমশাই শরীরটাকে বহুকষ্টে উঠিয়ে হেলেদুলে বাথরুমে ঢুকবেন। অবশ্য রেডি হয়ে নাস্তার টেবিলে বসেই তার ব্যস্ত দিন শুরু হয়ে যাবে। তখন ব্যস্ততার চোটে আর মাধবি টাধবি কাউকে চিনবেন না তিনি! 
রান্নাঘরে ঢুকেই মেজাজটা খিচড়ে যায় প্রতিদিন। পরিপাটি মেয়ে মাধবি। অগোছালো নোংরা কিছুই সহ্য করতে পারে না। গত রাতের থালাবাসনগুলো গ্যাঁট হয়ে সিংকে পড়ে আছে। সেগুলো থেকে একটু কটু গন্ধও ছড়াচ্ছে। গরমের দিন। অল্পতেই তরিতরকারি পচে যায়। থালাবাসনে জমে থাকা এঁটো খাবারদাবার এক রাতেই গন্ধ তুলে ফেলে। এখন এই নোংরা গন্ধের মধ্যেই কাজ করতে হবে ভাবতেই খারাপ লাগে মাধবির। 
মন্সুরা আসবে আরো এক ঘণ্টা পরে। এত দেরি হয় দেখে মাধবি মাঝে মাঝে থালাবাটি ধুয়ে ফেলে। নোংরার মধ্যে সে একদম কাজ করতে পারে না। 
 
মন্সুরা পুরোনো কাজের মেয়ে। মাধবি ধুয়ে ফেলেছে দেখলেই সে কিচ কিচ করে, ‘কদ্দিন কইছি আপনারে...  আপনে কিছু ধুইতে যাইয়েন না! আমারে বেতন দিবেন আবার থালাবাসনও নিজেই ধুইবেন... এইটা কুনখানকার নিয়ম হইল?’
মাধবিও সমানে মুখ চালায়। ‘তুই তাহলে একটু জলদি আসতে পারিস না? রোজ দেরি করিস কেন?’
‘বাড়িত ভাত রাইন্ধা আসি। এট্টু দেরি হইবই! আপনে গোছল কইরা আবার থালাবাটি ধোন! আবার ঠাণ্ডা বান্ধাইবেন!’ বলতে বলতেই মন্সুরা মুখ লুকিয়ে হাসে। সেই হাসি দেখেই মাধবির গা জ্বলতে থাকে। এদের চোখ কতদিকে থাকে? এমনিতে একটা কিছু খুঁজে দিতে বললে তো দুনিয়া ঘেঁটেও খুঁজে পায় না! অথচ মাধবি যে গোছল করে রোজ সকালে, এইটা সে ঠিকই খেয়াল করে! 
 
সেদিন মন্সুরা বলছিল, ‘ওহ আপা, দ্যাখছেন নাকি আপনাগো দোতলায় কয়টা পোলারে বাসা ভাড়া দিছে?’
‘পোলাদের মানে? ছেলেদের বাসা ভাড়া দিয়েছে? মানে ব্যাচেলর?’
‘হ ঐটাই! ব্যাচেলর! এইটা নিয়া চার তলার খালাম্মার কী রাগ! কইতাছে এই বাসা ছাইড়া দিব! আইচ্ছা আপা, ব্যাচিলরগো বাসা ভাড়া দিলে কিয়ের সমস্যা?’
চারতলায় সুরমা ভাবিরা ভাড়া থাকেন। মন্সুরা এই বাসার কাজ শেষ করে সুষমা ভাবিদের বাসায় ঢোকে। ভাবির তিন মেয়ে। তিন জনই উঠতি বয়সের। এই বয়সের মেয়ের মা-বাবার একটু চিন্তা তো থাকেই! মন্সুরার কথা শুনে মাধবি হাসতে হাসতে বলে, ‘সেইটা নিয়ে তোর মাথা ঘামানোর দরকার নাই। মেয়ের মা হ আগে, তখন যদি কিছুটা বুঝিস!’
 
মন্সুরার খবরটা দেওয়ার দুইদিন পরের ঘটনা। সেদিন সজল চলে যাওয়ার পরে বারান্দায় বসে বসে চা খাচ্ছিল মাধবি। ছেলের গা টা গরম গরম। ঠিক করেছে সেদিন স্কুলে পাঠাবে না।
হঠাৎ সামনে তাকিয়ে মাধবির পুরো শরীরে হিম খেলে যায়। কে ওটা? আরমান না? ঠিক! সেইরকম মাথা নিচু করে হাঁটার ভঙ্গি। ঐরকম ঋজু দেহের গড়ন, মাথাভর্তি কোঁকড়ানো চুলগুলো এখনো ঠিক আগের মতোই ঘন। একটু পাশ ফিরে কী একটার দিকে দৃষ্টি ফেরাতে দোতলা থেকেই মুখটা পরিষ্কার দেখতে পেল মাধবি। হ্যাঁ আরমান! আর কোনো সন্দেহ নাই! 
পুরো শরীরে কেমন যেন ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। আরমান এই এ্যাপার্টমেন্টের দিকে আসছে কেন? তাহলে কি দোতলার ব্যাচেলরদের মধ্যে আরমানও আছে?
 
সেদিনের পর থেকে একটা চোরা ভয় মাঝেমাঝেই চোরাগুপ্তা হামলা চালায় মাধবির মনে। সজল যদি আরমানের কথা জেনে যায়? ও কি এটা নিয়ে খুব বাড়াবাড়ি করবে? বিয়ের আগে কতজনেরই তো কতরকম এলোমেলো সম্পর্ক থাকে। থাকতে পারে। সেই সম্পর্কগুলো চুকিয়ে বুকিয়ে মন দিয়ে সংসার করার পরেও কি কখনো ঝড় ওঠে আবার?
কতদিন রাতে সজল ঘুমিয়ে পড়ার পরেও মাধবি একা একা জেগে থেকে এসব কথাই ভেবেছে। আচ্ছা, ওর যেমন একটা ছোটখাট ভালোবাসার গল্প ছিল, তেমনি সজলের কি কোনোই গল্প ছিল না? থাকলেই কি মাধবি সেটা জানতে পারবে? সজল ওকে থোড়াই জানাবে!
তাহলে ও কেন এত ভেবে ভেবে হয়রান হচ্ছে? স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বিশ্বাসের বন্ধন কি এতটাই ঠুনকো? তাছাড়া ক্ষণিকের মোহের কি এত ক্ষমতা থাকে যে সেটা আট বছরের পুঞ্জিভূত ভালোবাসাকে এক লহমায় ধ্বসিয়ে দেয়?
এসব ভেবে মনকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলেও মাঝে মাঝে মনটা যে অশান্ত হয় না এমন নয়। উথাল পাতাল কত কিছু যে স্রোতের মতো ভাসিয়ে নিয়ে যায় ওকে! এত বছর পরে আরমানের মুখোমুখি হয়ে গেলে কী একটা বিশ্রী ব্যাপার হবে! মাধবি আজ আর উনিশ বছরের সেই সদ্য তারুণ্যে পা দেওয়া মেয়েটি নয়। সাতাশের টগবগে শরীরে যৌবন এখন আরামসে দাপিয়ে বেড়ায়। আহ্লাদী গর্বিতা বধু এবং একজন বছর ছয়েকের শিশুর দায়িত্বশীলা মা। অল্প বয়সের ঠুনকো কাঁচা আবেগ অনেকটাই থিতিয়ে এসেছে। 
তবু প্রথম প্রেম! তাকে কি একদম মুছে ফেলা যায়? 
 
 
ময়দা ময়ান করতে করতে নিজের অতীত নিয়ে নাড়াচাড়া করে মাধবি। মাত্র উনিশ বছরেই দুম করে বিয়েটা হয়ে গেল! একদিন কলেজ থেকে ফিরেই শোনে ওকে নাকি পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। মা ওকে চট করে সেজেগুজে তৈরি হয়ে নিতে বলে। কলেজের ফাংশানে কত দিন পরতে চাওয়া মায়ের ধুপছায়া রঙের শাড়িটা মা সেদিন নিজেই আলমারি থেকে বের করে দেয়। হাসি হাসি মুখে বলে, ‘যত্ন নিয়ে সাজিস! আজ যেন আমার মেয়েটাকে রাজকন্যার মতো দেখায়!’
মাধবি কিছুই বুঝতে পারে না। কেন এমন হুট করে ওর বিয়ে দিয়ে দিতে চাইছে? মাধবি তো মোটেও এখন বিয়ের জন্য তৈরি না!’
 
শান্তশিষ্ট সুবোধ মেয়েটি সেদিন প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। মাকে জোর গলায় বলে, ‘আমি এখন বিয়ে করব না!’
মা অবাক চোখে তাকায় ওর দিকে। শান্তমুখে বলে, ‘কেন করবি না জানতে পারি?’
‘কেন আবার? এত অল্প বয়সে আমি বিয়ে কেন করব? আমার বান্ধবীরা কি কেউ বিয়ে করেছে?’
‘করেনি কারণ তারা মন দিয়ে পড়ালেখা করছে! তুইও যদি সেটাই করতি তাহলে আমরাও মোটেই তোর বিয়ে নিয়ে ভাবতাম না!’
‘আমি পড়ালেখা করছি না?’
‘না করছিস না! তুই করছিস প্রেম! পাড়ার বখাটে একটা এক নাম্বার মাস্তান ছেলের সঙ্গে প্রেম করছিস! যার বিন্দুমাত্র ভবিষ্যৎ নাই। নিজেও ডুববে তোকেও ডুবাবে!’
 
মাধবি চমকে ওঠে। ওহ আচ্ছা এই কথা! তাহলে আরমানের কথা ওর মা-বাবা জেনে গেছে? কিন্তু কীভাবে জানল? ও তো খুব সতর্ক ছিল। আরমানকেও সতর্ক করে দিয়েছিল যেন ওদের পাড়ার কারো সামনেই মাধবির সঙ্গে কথা না বলে। আরমানও সেই কথামতোই চলত। তারপরেও মা-বাবা জেনে গেল?
 
‘কী? মুখে কথা নাই যে? বল ভুল কিছু বলছি? কলেজে পাঠিয়েছিলাম পড়ালেখা করানোর জন্য। জুটিয়েছিস রোমিও! তাও যে সে রোমিও না! একেবারে মাস্তান রোমিও! নজরটাও ভালো হলে বুঝতাম!’
 
মায়ের শক্ত শক্ত কথাগুলো শুনে আর পারে না। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে মাধবি। মা যেন ইচ্ছে করেই আজ ওকে নিষ্ঠুরভাবে আঘাত করছে! ওকে কাঁদতে দেখেও মায়ের কিছুমাত্র ভাবান্তর হয় না। 
শাড়িটা ওর দিকে একরকম ছুঁড়ে মেরে বলে, ‘বিকেল চারটার দিকে ছেলে দেখতে আসবে। এর মধ্যে রেডি হয়ে থাকবি। চালাকি করে লাভ হবে না। ঐ আরমান নামের মাস্তানের কথা যত তাড়াতাড়ি ভুলে যাবি তত তোর নিজের জন্যই ভালো।’
 
আরমানের কথা ভাবতে ভাবতে প্রিয় শাড়িটা বুকে জড়িয়ে প্রবল কান্নায় ভেঙে পড়ে মাধবি। 
আরমান মাস্তান? মোটেও না! এত নরম শরম একটা ছেলে! ওদের কলেজের পাশেই একটা চায়ের স্টলে আড্ডা মারত প্রতিদিন। সঙ্গে আরো ছেলেপুলে ছিল। বান্ধবীরা বলত, ‘ফিল্ডিং মারছে বুঝলি? তাকাবি না, দেখিস কেমন জুল জুল করে তাকায়ে থাকবে!’
অনেকদিন লক্ষ করেছে মাধবি। আরমানের আশেপাশে থাকা অন্য ছেলেরা ওদের বান্ধবীদের দিকে জুল জুল করে তাকালেও আরমান কখনো কাউকে সেভাবে দেখত না। মেয়েদের যে তৃতীয় চোখ থাকে, সেটা দিয়ে তারা অনেক ছোট বয়সেও অনেক কিছু দেখে ফেলে। আরমানের চোখে সরলতা দেখেছে সে, লাম্পট্য নয়। 
 
কিন্তু একদিন একটা ভুল হয়ে গেল। সেদিন বান্ধবীরা মিলে হইচই করতে করতে হাঁটছে। চায়ের স্টলটার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ একটা ঢিল এসে লাগে সোজা ওদের বান্ধবী লুনার কপালের এক পাশে। ঢিলটা বেশ জোরেই লেগেছিল। লুনা কপাল ধরে ‘উঃ মাগো’বলে বসে পড়ে। ঢিলটা হাতে নিয়ে দেখে একজন চেঁচিয়ে ওঠে, ‘কত বড় বদমাইশ! ঢিলের সঙ্গে চিঠি মুড়ে দিয়েছে দ্যাখ!’
 
ওরা চায়ের স্টলের দিকে তাকিয়ে দেখে সেদিন স্টলে একজন বান্দাই বসে আছে। সে আবার চা খেতে খেতে গভীর মনোযোগের সঙ্গে খবরের কাগজে চোখ বুলাচ্ছে। 
মাধবিই প্রথম এগিয়ে যায় সেদিকে। ঝট করে ছেলেটার হাত থেকে খবরের কাগজটা নিয়ে বলে, ‘ঢং দেখাচ্ছেন তাই না? আমাদের বন্ধুর দিকে ঐ ঢিলটা ছুঁড়ে মারলেন কেন? দেখুন কী হাল হয়েছে বেচারির!’
 
আরমান একেবারে আকাশ থেকে পড়ে কথাটা শুনে। বোকার মতো মুখ করে বলে, ‘কই আমি তো এখানে বসে চা খাচ্ছি আর পেপার পড়ছি। আপনার বান্ধবীকে ঢিল ছুড়লাম কখন?’
আরমানের সঙ্গে সঙ্গে স্টলের চা ওয়ালাও সাক্ষ্য দেয়। ‘হ আপারা, আরমান ভাই তো এইখানে বইসা চা খাইতাছে। তিনি তো কিছু করেন নাই!’
পাশ থেকে মুখরা বান্ধবী ফোড়ন কাটে, ‘এ্যাহ চোরের সাক্ষী গাঁটকাটা!’
 
ঘটনাটা সেখানেই মিটিয়ে ওরা চলে যাচ্ছিল। বাচ্চা মেয়েগুলোর একটা যুবক ছেলের বিরুদ্ধে লড়ার মতো শক্তি নেই। শুধু গজগজ করতে করতেই রাস্তা পেরিয়ে যাচ্ছিল ওরা। হঠাৎ ওদের পেছনে একটা হুটোপুটির আওয়াজ হতে পাশ ফিরে দেখে, সেই আরমান ভাই একটা ছেলের কলার ধরে ওদের দিকে এগিয়ে আসছে। কাছে এসে বলে, ‘এই যে ধরুন, ইনিই হচ্ছেন আপনাদের দিকে ঢিল ছুঁড়ে মারা কালপ্রিট! এবারে আমার ওপর থেকে অভিযোগটাকে উঠিয়ে নিন। এই ছেলেই ঢিল ছুঁড়ে সাইকেলে পালিয়ে যাচ্ছিল। দৌড়ে গিয়ে ধরে এনেছি!’
ওরা দেখে আরমান ভাই হাঁপাচ্ছে। বেচারার ভালোই খাটুনি হয়েছে ছেলেটাকে ধরে আনতে। তারপর ধুপুস ধুপুস করে আরমান সেই ছেলেকে ওদের বান্ধবীর সামনে কয়েকবার কানে ধরে উঠবস করিয়ে জীবনে আর এই রোমিওগিরি করবে না... এই প্রতিজ্ঞাবাক্য জপ করিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। 
ওরা বান্ধবীরা হাসতে হাসতে কুটোপাটি খেতে খেতে বাসায় ফেরে। 
 
সেই শুরু। এরপর থেকে আরমান ভাইয়ের সঙ্গে দেখাটা একটু যেন ঘন ঘনই হয়ে যেতে লাগল। সেদিন মাধবিই যেহেতু আগ বাড়িয়ে তেড়ে গিয়েছিল তার দিকে, তাই মাধবির দিকেই বুঝি দৃষ্টিটা ফেলে রাখত আরমান। যদিও সেটা সে বুঝতে দিত না। কিন্তু ঐ যে তৃতীয় নয়ন! সেই তৃতীয় নয়নই সবকিছু বুঝিয়ে দিত। 
 
কীভাবে কীভাবে যে ওদের সেই ক্ষণস্থায়ী সম্পর্কটা হয়ে গিয়েছিল আজ ভাবলে অবাক লাগে। কলেজের শেষের ক্লাসটা মিস করত মাধবি। সেই চল্লিশ মিনিটই ছিল ওদের ভালোবাসার সময়সীমা।
আরমান খুব কম কথা বলত। বয়সে মাধবির চাইতে কম করে হলেও সাত আট বছরের বড় তো হবেই! প্রায় সময় কী নিয়ে যেন ভাবত। মাধবি কথা বলতে বলতে দেখতে পেত আরমান অন্যমনস্ক। মাধবি অনুযোগ করত, ‘কী এত ভাবো সবসময়?’
আরমান চট করে মুখ ঘুরিয়েই ফিক করে হেসে বলত, ‘কিছু না! চিন্তা করছি! কাজই তো করি চিন্তাভাবনার!’  
কী কাজ সেটা জিজ্ঞেস করলে আর খুলেমেলে বলত না কখনো। তবে মাধবি বুঝতে পারত, আরমান কিছু একটা কাজ করে যা সে বলতে চায় না। 
 
মজার ব্যাপার হচ্ছে আরমানের বাসা ছিল মাধবিদের বাসার খুব কাছেই। এত কাছে থেকেও কখনো দেখা হয়নি কেন জানতে চাইলে আরমান রহস্য করে বলত, ‘দেখা হয়নি কে বলেছে?’
‘তার মানে? তুমি আমাকে দেখেছ?’
এই প্রশ্নের উত্তরেও আরমান রহস্য করে হাসত। কিছু বলত না। ওদের কলেজের স্টলের সামনে বসে কী করত জিজ্ঞেস করলেও বলত, ‘পেপার পড়তাম। খেলার খবর পড়তাম।’  
‘চায়ের স্টল কি পেপার পড়ার জায়গা?’
‘এক কাপ চা খেলে পেপারটা পড়া যায়। পাঁচ টাকায় তো আর পেপার কেনা যায় না!’ আরমানের চটজলদি উত্তর। মাধবি বুঝত আরমানদের অর্থনৈতিক অবস্থা বিশেষ একটা ভালো না। কিন্তু ঐ বখাটে ছেলেগুলোর সঙ্গে তার এত খাতির কীভাবে হলো এটা জিজ্ঞেস করলেও সেই রহস্যময় হাসি আর নীরবতা। ভালো লাগত না মাধবির। অনেক খোঁচাখুঁচিতে একদিন শুধু বলেছিল, ‘বখাটে কি কারো গায়ে লেখা থাকে? আর বখাটের সঙ্গে মিশলেই কি কেউ বখাটে হয়ে যায়?’
 
এই সম্পর্কটার পরিণতি নিয়ে মাধবি ভাবেনি কখনো। অল্পসময়ের উন্মাদনা, ক্ষণিকের মোহ ভালোলাগা … এসবই হয়ত সম্পর্কটাকে ঐ পর্যন্ত টেনে নিয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু সেই উন্মাদনারও ইতি ঘটাতে হয়েছিল। সেদিন পাত্রপক্ষ এসেছিল ঠিক পৌনে চারটায়। মাধবি তখন নিজের ঘরে বসে কাঁদছে। মায়ের ধুপছায়ারঙ্গা শাড়ি পায়ের কাছে লুটোপুটি খাচ্ছে। মা ঘরে ঢুকে এই দৃশ্য দেখে একটুও বকাঝকা না করে শক্তমুখে বলেছিল, ‘ঠিক আছে! সাজতে হবে না চল! এভাবেই দেখা দিবি। ছেলেরা পছন্দ না করে ফিরে গেলে বিয়ে হবে না। তবু দেখা তোকে করতেই হবে!’
 
মাধবিরও জেদ চেপে গিয়েছিল। বাসায় পড়া সুতির থ্রিপিসের ওপরে একটা উদ্ভট রঙের ওড়না পরে আলুথালু বেশেই গিয়েছিল পাত্রপক্ষের সামনে। বাবা ওকে এই বেশে দেখে জিজ্ঞাসুমুখে তাকিয়েছিল মায়ের দিকে। চোখে চোখে তাদের কী কথা হয়েছিল তারাই জানে! বাবা অপ্রস্তুত মুখে পাত্রপক্ষকে বলেছিল, ‘আসলে বুঝতেই পারছেন... বয়স কম। এখনই বিয়ে করতে চায় না। তাই একটু ছেলেমানুষি করছে। আপনারা কিছু মনে করবেন না!’
পাত্রপক্ষ কী বুঝেছিল কে জানে, ওর সঙ্গে নরম সুরে কথা বলেছিল। যাওয়ার সময় ওদের সবাইকে অবাক করে তারা বলে গিয়েছিল... মেয়ে তাদের পছন্দ হয়েছে। 
 
বাবার মুখের ওপরে মাধবি সেদিন বলেছিল, এই বিয়ে সে করবে না। শুনে বাবা একটা কথা না বলে নিচে চলে গিয়েছিল। ফিরে এসে ওর হাত ধরে বলেছিল, ‘চল তোকে কিছু জিনিস দেখাব। এইটা দেখে তুই সিদ্ধান্ত নিস বিয়ে করবি কী করবি না!’
মাধবিকে একরকম টানতে টানতে নিয়ে গিয়েছিল তার বাবা। নিয়ে গিয়েছিল একটা জরাজীর্ণ টিনের চালা দেওয়া বাসার সামনে। ওদের মোটামুটি সুসভ্য পাড়ায় ঐ বাসাটা একেবারেই বেমানান। বাসাটার ভেতরে এক চিলতে উঠান। সেখানে একটা ছাগল বাঁধা আছে। সেটা বাঁশের খুঁটির সাথে বাঁধা কাঁঠাল পাতা চিবুচ্ছে। 
বাসার ভেতরে একটা শোরগোল শোনা যাচ্ছে। একটা পুরুষকণ্ঠ চেঁচিয়ে কিছু একটা গালমন্দ করছে। তার একটু পরে শোনা যাচ্ছে নারীকণ্ঠের চিৎকার আর গালাগাল। দুজন নারীপুরুষ ঝগড়া করছে। 
 
মাধবির বাবা তখনো ওর হাত ধরে রেখেছে। এবারে ওর দিকে স্থিরচোখে তাকিয়ে বলে, ‘এই হচ্ছে আরমানের মা-বাবা। এই পাড়ার বিশিষ্ট ভদ্রলোক। আরমানের বাবা একজন সিএনজি চালক। আর মা কী করে সেটা জানা যায়নি। মানুষের বাসাবাড়িতে কাজ করে জানলেও অবাক হব না! একই পাড়ায় ওরা বাস করছে কথা ঠিক। কিন্তু তোকে এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে ঐ বাসা থেকে এই বাসায় আসার সাহস তোর কতটা আছে?’
মাধবির মুখে কথা সরে না। বাবা তাকে সত্যিই একটা কঠিন প্রশ্নের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। অল্পবয়সের ফিনফিনে আবেগের পর্দাটা তখনো চোখের সামনে কাঁপছিল ঠিকই, কিন্তু বাস্তবতার নিরেট পাথরের জানালাটাও খুলে গিয়েছিল সশব্দে। এইরকম পরিবেশে সে কি আসলেই থাকতে পারবে?
 
বাবা তখনো থামেনি। ওর হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছিল অন্য কোথাও। কিছুদূর হেঁটে একটা রিক্সায় চেপে ওরা আবার রওয়ানা দেয়। মাধবি তখনো জানে না কোথায় যাচ্ছে। একটু পরেই রিক্সা এসে থামে পরিত্যক্ত একটা  এক তলা ঘরের সামনে। খোলা মাঠের একপাশে ছোট একতলা একটি পাকা ঘর। দেখেই বোঝা যায় পরিত্যক্ত। হয়ত একসময় এখানে কিছু একটা ছিল। ক্লাব অথবা অন্যকিছু। কিন্তু এখন আর কিছু হয় না এখানে। 
একটু দূর থেকে মাধবির বাবা তাকে সেই ঘরের দিকে দেখতে বলে। মাধবি দেখে কয়েকজন ছেলেপুলে বসে নেশা করছে। বাবা এখানে কেন নিয়ে এলো তাকে? তবে কী... তবে কী... আরমানও এই ছেলেগুলোর সঙ্গে বসে নেশা করছে? অসম্ভব! এটা কিছুতেই মানবে না মাধবি! আরমান নেশা করলে সে ঠিক বুঝতে পারত!  
 
বাবা হয়ত ওর মনের কথা বুঝতে পারে। বুঝতে পেরে বলে, ‘ওই যে নীল টি শার্ট পরে একটা ছেলে বসে ধোঁয়া উড়াচ্ছে না? ওটা কে জানিস? আরমানের ছোটভাই! স্কুলে পড়ে। এই বয়সেই নেশার জগতে পা দিয়েছে। এরপরে টাকার খোঁজে বাবার পকেটে হাত দিবে। পেলে ভালো। না পেলে মাকে মারধর করাও বিচিত্র কিছু না! এমন একটা পরিবারের সঙ্গে জুড়ে গিয়ে কেমন থাকবি তুই? কখনো ভেবে দেখেছিস?’
 
মাধবি চুপ করে থাকে। এত খবর বাবা কীভাবে জোগাড় করল এই প্রশ্নও মাথায় ঘুরছিল।
ওর বাবা এই নীরবতা দেখে আবার বলে, ‘নাকি ভাবছিস, আরমানকে নিয়ে আলাদা থাকবি? আরমান নিজেই চলে ওর বাপের টাকায়। পড়াশুনার যে অবস্থা তাতে এই বাজারে চাকরি পাবে কোন ভরসায়? শুনতে পাই, ছিঁচকে পকেটমারদের সে নাকি বন্ধু বানিয়েছে। তোদের কলেজের পাশের টি স্টলে বসে থাকে। ভবিষ্যতের আয় রোজগারের রাস্তা খুঁজে বেড়াচ্ছে হয়ত!’
মাধবি কোনো কথাই বলতে পারে না। নতমুখে চুপ করে থাকে। ওর বাবা আবার বলে, ‘দ্যাখ মা, তোকে অনেক বোঝালাম। বাবা হিসেবে নিজের যা দায়িত্ব ছিল করলাম। এখন তুই তোর জীবনের সঙ্গে কী করবি সেটা তোর বিবেচনা।’
 
মা-বাবার পছন্দ করা পাত্র সজলের সঙ্গেই বিয়েটা হয়ে গেল মাধবির। পড়ালেখায় সে তেমন একটা ভালো কখনোই ছিল না। তবু স্বামীর ইচ্ছায় বিয়ের পরে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেই পড়ালেখায় ইস্তফা দিয়েছে। মনকে বোঝাতে সময় লাগেনি মাধবির। বাবার দেখিয়ে দেওয়া সত্যটা খুব নগ্ন ছিল। সেই সত্যকে বরণ করে নিয়ে সেটার সঙ্গে বাস করার সাহস মাধবির ছিল না। 
স্বামী হিসেবে সজল খারাপ না। মাধবির সঙ্গে বয়সের একটা ফারাক আছে বটে, কিন্তু ভালো রোজগেরে স্বামী পেতে হলে ওটুকু তো মানতেই হয়। বড় ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে চাকরি করে সজল। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। দেখতে শুনতে সুদর্শন। ব্যস! একজন মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ের এর চাইতে বেশি কি চাহিদা থাকে?
 
‘কী হলো? আজকে কি নাস্তা টাস্তা কিছু মিলবে না নাকি?’ সজল কখন ডাইনিং টেবিলে বসে পড়েছে, টেরই পায়নি মাধবি। আজ কী মরণ ভাবনায় পেয়ে বসেছে তাকে! 
দ্রুত হাতে পরোটা আর আলুভাজি সাজিয়ে টেবিলে দেওয়ার পরে কলিংবেল বেজে উঠল। সজল উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই হেলেদুলে মন্সুরা বাসায় ঢুকল। টেবিলঘড়িতে চোখ দিয়ে মাধবির মেজাজ শুকনো লংকা হয়ে গেল। আটটা কুড়ি! আজকে কুড়ি মিনিট লেট! 
 
চা বানানোর জন্য রান্নাঘরে ঢুকতে ঢুকতে মাধবি বলল, ‘কী রে মন্সুরা কাজে আসার ইচ্ছা নাই তোর?’
‘কাল কারেন্ট ছিল না আপা। ঘুমাইতে ঘুমাইতে ম্যালা রাত হইছে। সকালে জাগন পাইনি!’
মাধবি গজগজ করতে লাগল, ‘অজুহাত একটা মুখে রেডি হয়েই থাকে!’
‘আপা আইজ বাবলু বাবারে আমি ইশকুলে নিয়া যামু। আপনে রেস্ট নেন।’
‘আচ্ছা তুই স্কুলে নিয়ে গেলে রান্নাঘরের কাজগুলো কে করবে?’
‘আমি আইসা কইরা দিমু নে। আইজ আপনের বাসায় বেশি সময় থাকুম নে যান!’
 
মুখে যাই বলুক, মাধবি মনে মনে খুশিই হয়। স্কুলে না যেতে হলে এই সময়টা সে একটু শুয়ে বসে আরাম করতে পারে। মন্সুরা মেয়েটা একটু ঢিলা হলেও মনের দিক দিয়ে খারাপ না। মাধবির কষ্ট হলে পুষিয়ে দেয়। 
ডাইনিং টেবিল থেকে সজল ডাকল। মাধবি চা নিয়ে যেতে বলল, ‘শুনেছ নাকি, আমাদের এলাকায় নাকি গতকাল পুলিশ এসেছিল,কাকে যেন খুঁজতে। ছেলেটা নাকি অপহরণের কেসে আগে জেল খেটেছে। তারপর জেল থেকে বেরিয়েই আবার কাজে নেমে পড়েছে। কিন্তু এবারে সে গা ঢাকা দিয়ে আছে। নামধাম গোপন করে লুকিয়ে আছে। পুলিশের ধারণা সে এই এলাকাতেই আছে। তার মোবাইল ট্র্যাক করে এই জায়গার লোকেশন দেখাচ্ছে।’
 
অকারণেই মাধবির বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। গা ঢাকা দিয়ে আছে! এই এলাকায় নতুন এসেছে! মনকে ধমক দিলো মাধবি। কত মানুষই তো একটা এলাকাতে নতুন আসতে পারে। এতে এমন আঁতকে ওঠার কী হলো?
 
চা শেষ করে সজল কাজে চলে গেল। মাধবি গেল ছেলেকে রেডি করতে। এখন আর ঘুম ভেঙে গেলেই বিছানা থেকে উঠে পড়ে না বাবলু। সেই সময়টা ঘাপটি মেরে বিছানায় শুয়ে থাকে। বড় হচ্ছে কী না... নতুন নতুন কায়দাকানুন শিখছে। মাধবি পায়ে সুড়সুড়ি কেটে ছেলের ঘুম ভাঙ্গাল।
 
বাবলুকে নিয়ে মন্সুরা বেরিয়ে যাওয়ার পরে মাধবি কিছুক্ষণ বিছানায় এপাশ ওপাশ করল। তারপর এক মগ চা বানিয়ে বারান্দার গাছগুলোর পাশে মোড়া টেনে বসল। গরমটা একটু কমে এখন ঝিরিঝিরি বাতাস দিচ্ছে। বৃষ্টি হবে মনে হয়। মাধবি চুল খুলে বাইরের পানে তাকিয়ে আনমনা হলো। 
এভাবে কতক্ষণ বসে ছিল বলতে পারবে না, হঠাৎ দরজায় দুম দুম আওয়াজে কান খাড়া করল মাধবি। আশ্চর্য! কলিংবেল থাকতে দরজা ধাক্কাচ্ছে কেন?
 
দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিয়ে দেখে, মন্সুরা কাঁদো কাঁদো মুখে দরজায় দাঁড়িয়ে। কাঁদতে কাঁদতে সে যা বলল তা এই, মন্সুরা বাবলুকে নিয়ে স্কুলের দিকে যাচ্ছিল। হঠাৎ বাবলু একটা দোকানের সামনে গিয়ে জেদ করতে শুরু করে যে সে ক্যাডবেরিজ কিনবে। মন্সুরা যত বোঝায় যে তার কাছে টাকা নেই, সে ততই জেদ করতে থাকে। এক পর্যায়ে মন্সুরার হাত ছেড়ে দিয়ে সে দৌড় লাগায়। মন্সুরাও পিছে পিছে দৌড়ায় কিন্তু একসময় মানুষের ভিড়ে বাবলুকে হারিয়ে ফেলে। 
 
মাধবি সব শুনে স্থাণুর মতো চুপ মেরে যায় কিছু সময়। তারপর হঠাৎ পাগলের মতো চিৎকার করতে করতে বলে, ‘তুই আমার ছেলেকে কোথায় রেখে এসেছিস বল? এতদিন ধরে আমি নিয়ে যাই, কই একদিনও তো আমার সাথে এমন করেনি! তুই মিথ্যা কথা বলছিস! বল কার সঙ্গে হাত মিলিয়েছিস! কত টাকা পাইছিস?’
বলতে বলতে মাধবির জ্ঞান হারানোর উপক্রম হয়। এদিকে মন্সুরাও কাঁদতে কাঁদতে সমানে নিজের নির্দোষিতা প্রমাণের চেষ্টা চালায়ে যাচ্ছে। 
মাধবি উন্মাদিনীর মতো সজলকে ফোন করতে যাবে এমন সময় বেল বেজে উঠল। ধড়মড় করে দরজা খুলে দেখে, সামনে একটা অনেকদিনের চেনা মুখ আর তার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে তার ছেলে, বাবলু। মন্সুরা খুশিতে চিৎকার দিয়ে ওঠে আর মাধবি কিছু সময় বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। 
 
সম্বিত ফিরতেই ঝট করে আরমানের হাত থেকে বাবলুকে ছিনিয়ে নেয় মাধবি। ছেলের হাসি হাসি মুখ দেখেও তার ভয় কাটে না। বারবার গায়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে, ‘কই গেছিলি তুই? এভাবে দৌড় দিছিলি কেন?’
আরমান অনাহুতের মতো দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, তবু মাধবির যেন ভ্রুক্ষেপই নেই। সে ছেলেকে নিয়েই ব্যস্ত। মায়ের অস্থিরতা দেখে শেষমেশ বাবলুই বলে, ‘উফ মা! ছাড়ো আমাকে! ঐ মন্সুরা খালা আমাকে ক্যাডবেরি কিনে দেয়নি! তাই ওকে ভয় দেখাইছি! হি হি। আমি কি কোথাও গিয়েছিলাম নাকি? দোকানের পেছনেই তো লুকিয়ে ছিলাম! মন্সুরা খালাটা কী বোকা! আমাকে দেখতেই পায়নি!’
 
আরমান এবারে একটু খুক খুক করে বলে, ‘ভেতরে আসতে পারি? বাবলুর ব্যাপারে একটু কথা বলতাম!’
মাধবি যেন নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে বলে, ‘আসুন।’ তারপর মন্সুরাকে বলে বাবলুকে ওর ঘরে নিয়ে যেতে। 
 
দুজন চলে যেতে আরমান আর মাধবি মুখোমুখি হয়, আট বছর পর!
আরমান জিজ্ঞেস করে, ‘কেমন আছ?’
‘ভালো। আপনি?’
আপনি সম্বোধনটা খট করে কানে এসে লাগে। তবু আরমান শান্তমুখে বলে, ‘ভালো। তোমার বর বাসায় নেই?’ 
‘না ও এখন অফিসে। কাজের মানুষ। এখন কি বাসায় থাকার সময়?’
এই খোঁচাটাও গায়ে মাখে না আরমান। প্রসঙ্গ পাল্টে বলে, ‘বাবলু খুব দুষ্ট হয়েছে। দোকানের পেছনে লুকিয়ে ছিল। কিন্তু আশেপাশে মন্দ মানুষের অভাব নাই। আজকাল শিশু অপহরণের ঘটনাও কিন্তু খুব বেড়েছে। ওকে এভাবে কাজের মেয়ের হাতে পাঠানো হয়ত উচিত হয়নি।’ 
 
মাধবির গা জ্বালা করতে থাকে। শিশু অপহরণের কথা বলে কি নিজের ইনোসেন্সের গ্রাউন্ড মজবুত করে নিলো? চোখমুখে বিরক্তি নিয়েই মাধবি বলল, ‘আপনি জানলেন কীভাবে ও এই বাসায় থাকে? আমাকে দেখেও তো অবাক হননি মনে হচ্ছে!’
আরমান হাসে। মুখ টিপে হাসির সেই ভঙ্গিটা দেখে মাধবির কিছু দুর্বল মুহূর্তের স্মৃতি হুশ করে উঁকি মেরে যায়। আরমান বলে, ‘এখনো প্রশ্নের পরে প্রশ্নের সেই অভ্যাসটা যায়নি তোমার! খুব সন্দেহ করতে আমাকে তাই না?’
‘মানুষ সন্দেহমুক্ত না হলে তো তাকে সন্দেহের আওতাতেই রাখতে হয়!’
‘হুম... তা ঠিক। আজ প্রশ্ন করো আমাকে। দেখি তোমার সন্দেহগুলো দূর করতে পারি কী না!’
‘শেষ প্রশ্নটারই জবাব দিন আগে।’ 
‘ওহ হ্যাঁ, তুমি কী মনে করেছ আমি এই বাসায় আসার পরে তোমাকে একদিনও দেখিনি? শুধু তুমিই আমাকে বারান্দা থেকে দেখেছ?’ 
মাধবি অপ্রস্তুত। তার বারান্দা থেকে তাকিয়ে থাকাও এই লোকের নজর এড়ায়নি। অপ্রস্তুত ভাব কাটাতেই প্রশ্ন করে, ‘কী করা হয় এখন?’
‘ঐ আগে যা করতাম! নাটক বানানোর কাজ।’ 
‘তার মানে?’ মাধবি বিস্মিত। এটা আবার কী নতুন চাল?
‘হুম, আমি একটা ছোটখাট নাটকদলের মূল নির্মাতা ছিলাম। সেই নাটকের প্রয়োজনেই তোমাদের পাড়ার ঐ বাসাটাতে এসে ছিলাম কিছুদিন। বাবা সিএঞ্জি চালক, ছেলে নেশা করে, মা অভাব অভিযোগে ক্লান্ত... ওরকম নিম্ন মধ্যবিত্ত একটা পরিবারকে খুব কাছ থেকে দেখার দরকার ছিল আমার। তাই একজন বন্ধু ব্যবস্থা করে দেয়। বিনিময়ে সেই পরিবারটিও অবশ্য লাভবান হয়। তোমাকে বলতাম একসময়, কিন্তু তার আগেই তো...  ’ 
 
মাধবির মনে হয় পায়ের নিচ থেকে বুঝি মাটি সরে গেল। তাহলে পুরোটাই ভুল ছিল? ওর বাবা ভুল করেছে আর সেও আরমানকে কিছু বলার সুযোগই দেয়নি?
 
‘এখনও কি সেই নাটকের জন্যই এখানে এসেছ?’ নিজের অজান্তেই আপনিটা আবার কখন যে তুমি হয়ে গেছে, মাধবি টের পায়নি! 
 
‘হ্যাঁ এই লাইনেই লেগে আছি। তোমাদের দোতলাটা একটা নাটকের জন্যই তিন মাসের জন্য ভাড়া নিয়েছি। বাড়িওয়ালাকে সবকিছু বলে দ্বিগুণ ভাড়া দিয়ে রাজি করিয়েছি। শুরুতে তো কিছুতেই ভাড়া দিতে চাইছিল না! তিন মাস পরেই চলে যাব। আমাদের নাটকটা কয়েকজন ব্যাচেলরের জীবন নিয়ে। টিভিতে প্রচারিত হবে ‘চ্যানেল ফোর’ এ। সময় পেলে দেখো। আমার পরিচালনার নাটক। 
 
মাধবি চুপ করে বসে আছে। একটু পরে মন্সুরা এসে চা কেক দিয়ে যায়। বাবলু কাছাকাছি ঘুরঘুর করতে থাকে। তার হাতে ইয়া বড় ক্যাডবেরি। সেটার জন্য আংকেলের দিকে সে কৃতজ্ঞতার চোখে তাকাতে চাচ্ছে কিন্তু মায়ের সামনে সহজ হতে পারছে না। 
আরমান আদর করে কাছে টানে বাবলুকে। চুলে হাত বোলাতে বোলাতে বলে, ‘আর অমন দুষ্ঠুমি করো না কেমন? দেখো তো তোমার আম্মু কেমন ভয় পেয়ে গেছে!’ 
বাবলু মায়ের দিকে অপরাধীর মতো তাকায়। কিন্তু মা খুব রেগে আছে এমনটা মনে হয় না তার কাছে। নিশ্চিন্তমনে আবার নিজের ঘরের দিকে যায়। আজকে বোঝা যাচ্ছে স্কুলের হাত থেকে রেহাই পাওয়া গেছে। হঠাৎ ছুটির আনন্দটা সে বেশ উপভোগ করছে।
 
চায়ের কাপে কয়েকটা চুমুক দিয়ে আরমান বলে, ‘উঠি তাহলে। ভালো থেকো। তোমার অনেকটা সময় নষ্ট করে গেলাম!’ 
মাধবি কিছু বলে না। চুপচাপ আরমানকে লক্ষ করে শুধু। ‘আবার এসো’ কথাটা বলতে গিয়েও নিজেকে আলগোছে সামলে নেয়। 
যাকে ছেড়ে এসেছে, তাকে আবার আসতে বলা নিরর্থক। মনে মনে বলে, ‘তুমিও ভালো থেকো।’