Posts

ভ্রমণ

বব ডিলান কি তোমায় দূর থেকে ভালোবেসেছিলেন?

May 24, 2024

Milu Aman

২০১৮ সালের ৪ অগাস্ট সিঙ্গাপুরের উদ্দেশ্যে উড়াল দিলাম আমি আর আমার বন্ধু তুষার। উদ্দেশ্য বব ডিলানের কনসার্ট দেখা। শো ৬ তারিখ। শেষ মুহূর্তে এক বন্ধু যেতে না পারায় আমাদের কাছে ডিলানকে দেখার জন্য একটা অতিরিক্ত টিকেট রয়ে গেল। কনসার্টের টিকেট অনলাইনে কেনার সুব্যবস্থা ছিল। কিন্তু সেসময় আমাদের কারও কাছেই সক্রিয় আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ড ছিল না। পরিচিত অন্য কারও থেকে কার্ড নিয়ে কিনবো, সেই উপায়ও ছিল না। কারন, ভেন্যুতে গিয়ে টিকিট সংগ্রহ করার জন্য ক্রেডিট কার্ড ধারণকারীকে অবশ্যই উপস্থিত থাকতে হবে। সেসময় আমি ভাগ্যক্রমে সন্ধান পাই সিঙ্গাপুরের স্থায়ীবাসিন্দা এক বাংলাদেশি ছেলেকে। আপেল ঠিক সেই মুহূর্তে ঢাকায় তার নানিবাড়ীতে বেড়াতে এসেছিল। একটা কফিশপে বসে আমরা অনলাইনে টিকেট কাটি। আমি তাকে নগদ টাকা বুঝিয়ে দেই। সিঙ্গাপুর পৌঁছে যথারীতি আমি আপেলকে কল দেই। কনসার্ট ভেন্যুতে আমাদের আবার দেখা হবে সেরকমই কথা ছিল।
 

কনসার্টের দিন আমরা স্টার থিয়েটার অফ আর্টস ভবনে উপস্থিত হই। বিশাল এই কালচারাল ভবনের শীর্ষে কনসার্ট হল। আমরা বিকেল থেকে সেখানে ঘুরঘুর করছি। আপেল আসে সন্ধ্যায়। আমরা আমাদের টিকেট তুলে শোয়ের জন্য অপেক্ষা করছি। একটা কফিশপে বসে আমি ছেলেটাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আমাদের সাথে শো দেখবে? আপেল সাথেসাথে বলে উঠে, আরে না! এই কনসার্ট আমার পোষাবে না, শোয়ের মাঝে আমি ঘুমিয়েও যেতে পারি… এই বলে সে হাসতে শুরু করে, আমরাও তার হাসিতে যোগ দেই।
 

একটু পর আমি আবার বললাম, তুমি কি জানো মুক্তিযুদ্ধের সময় বব ডিলান বাংলাদেশের জন্য গান করেন? ছেলেটি অবাক হয়ে বলে, তাই নাকি? জানি না তো ভাইয়া। তুষার বলে, আরে হ্যাঁ ম্যান, ওই কনসার্টটা তখনকার সময়ে সবচেয়ে বড় কনসার্ট ছিল। কনসার্ট ফর বাংলাদেশ। আমি যোগ করলাম, সেটাই ছিল প্রথম কোন এইড কনসার্ট, যা কোন দেশের বিপদের সময় আর্থিক সাহায্যের উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল। তারচেয়ে বড় ব্যাপার ছিল, সেদিন সেই কনসার্টের মাধ্যমে বাংলাদেশের নাম প্রথমবারের মতো বিশ্বের সামনে আসে। আমরা হাটতে হাটতে ঠিক যখন কনসার্ট হলের কাছে আসলাম। ছেলেটি অবশেষে বলে, চলেন দেখি। আপনাদের তো এমনিতেই এই টিকেটটা আর কাজে লাগবে না। প্রথম দুয়েকটা গান দেখে বাড়ি ফিরে যাবো।
 

শো শুরু হবে সাড়ে আটটায়। আমরা আধা ঘন্টা আগেই হলে প্রবেশ করলাম। হলের ধারণক্ষমতা ৫০০০ জনের কিছু বেশি। আমরা যখন প্রবেশ করি তখনও হল বেশ ফাঁকা। একজন একটা প্ল্যাকাড নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেখানে লেখা, ‘কোনপ্রকার ভিডিও করা বা ফটো তোলা থেকে বিরত থাকুন। অনুরোধে- শিল্পী।’ বব ডিলান মনে করেন, এসবে গান শোনার মনোযোগ নষ্ট হয়। এমনকি তাঁর কোন কনসার্টে তিনি ভিডিও স্ক্রিনও রাখতে দেন না। তাই পিছনের সারির শ্রোতারা কেবলই গান শুনতে পারে, সামনে শুধু দেখতে পায় অস্পষ্ট ছোট একটা মঞ্চ। 
 

এই কনসার্ট তাঁর ‘নেভার এন্ডিং ট্যুর’এর একটি অংশ। ১৯৯৮ থেকে ডিলান এই ট্যুর শুরু করেন, আজ আব্দি থামেননি। জিবনের শেষ অব্দি কনসার্ট করে যাবেন। কারন তিনি জানেন তাঁকে দেখার জন্য এখনও আমাদের মতো দর্শক আছে। যারা দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসে তাঁকে শুধু একবার দেখার জন্য।  
 

কনসার্ট হল দ্রুতই ভরে গেল। দর্শকের বেশিরভাগই মনে হল পশ্চিমা দেশের। সবাই মোটামুটি চল্লিশোর্ধ। কম বয়সী কাউকেই তেমন দেখা গেল না। হলের সর্বকনিষ্ঠ দর্শক সম্ভবত আমাদের সাথের সঙ্গী। শো শুরু হতে চলেছে। ব্যান্ড স্টেজে এসে একটা প্রিলিউড ইন্সট্রুমেন্টাল দিয়ে শুরু করে। আমি আমার সঙ্গীদের উদ্দেশ্যে বললাম, হয়তো তাঁর অস্কার বিজয়ী গান ‘থিংস হ্যাভ চেঞ্জড’ দিয়ে শুরু করবে। এবং হলোও ঠিক তাই! তুষার চোখ টিপ দিয়ে ইশারায় আমাকে ছেলেটির দিকে ইঙ্গিত করে। আমি দেখলাম সে হতবাক হয়ে শুনছে। তার দৃষ্টি স্টেজের দিকে ঠিকই, কিন্তু যেন সে কিছুই বুঝতে পারছে না। আসলে সে ডিলানের গানের সাথে আগে থেকে একদমই পরিচিত নয়।
 

তারপর বব শুরু করল ‘ইট এইন্ট মি বেইব’, আর আমি হারিয়ে গেলাম সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জগতে। এক পলকে পুরো হলটি আমার আমার চোখের সামনে যেন খালি হয়ে গেল। আমি আর বব ডিলানের ব্যান্ড ছাড়া আমি আর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। শুনতে পাচ্ছি কেবলই বব ডিলানের কণ্ঠ। গানটি শেষ হলে আমার চোখ ভিজে যায় খানিকটা। তারপর দ্রুতই তিনি ভারী কন্ঠে গান শুরু করে দেন ‘হাইওয়ে সিক্সটিওয়ান রিভিজিটেড’। সে সময় আমি আড়চোখে দেখতে পেলাম আপেলের চোয়াল প্রায় ঝুলে গেছে। তুষার মুচকি হাসছে।
 

প্রতিটি গানের পর খানিকক্ষণের জন্য আলো নিভে যায়। বব তাঁর পিয়ানোর পিছন থেকে শুরু করেন ‘সিম্পল টুইস্ট অফ ফেইট’। কনসার্টে যেভাবে গানগুলি পরিবেশন করা হচ্ছে, তা মূল রেকর্ডিং থেকে প্রায় অচেনা। গানগুলোর কথা শুনে বুঝতে হচ্ছে বব কোন গান গাচ্ছেন। বব ডিলান বরাবরই এটি করে আসছেন। বিভিন্ন সময়ে তিনি ভিন্ন ভিন্ন ভাবে তাঁর গান উপস্থাপন করেন। বব ডিলানের শ্রোতারাও তাঁর কনসার্টে হুবুহু রেকর্ডের মতো পরিবেশনা প্রত্যাশা করে না। শব্দের জাদুকর বব ডিলান। তাঁর গান দিয়ে তিনি একধরণের মাদকতা তৈরি করেন, আর তাতেই সবাই হারিয়ে যায় অন্য এক ভুবনে।
 

এবার তিনি একটি সাম্প্রতিক গান ‘ডুকেইন হুইসেল’ করেন এবং বিখ্যাত গান ‘ওয়েন আই পেইন্ট মাই মাস্টারপিস’ গানটি করেন। আবার কিছু সাম্প্রতিক গান, ‘অনেস্ট উইথ মি’, ‘ট্রায়িং টু গেট টু হেভেন’ করেন। এবং তারপর সবাইকে অবাক করে, তাঁর সুন্দর গায়কি ঢঙ্গে গাইলেন ‘মেইক ইউ ফিল মাই লাভ’ আর তারপর ‘পে ইন ব্লাড’। এরপর তিনি পরপর ‘ট্যাংল্ড আপ ইন ব্লু’, ‘আর্লি রোমান কিংস’, ‘ডেসোলেশন রোও’ এবং ‘লাভ সিক’ পরিবেশন করেন। 

ডিলান এবং তাঁর ব্যান্ড গানগুলো ব্লুজ রক ধাঁচে পরিবেশন করে। বব ডিলান কনসার্ট পরিবেশনের পুরোটা সময় ছিলেন প্রফুল্লচিত্তে এবং প্রতিটি গান করেন পরম আবেগ দিয়ে। পুরোটা সময় জুড়ে মিউজিক্যালি দারুনভাবে সন্তোষজনক ছিল। টনি গার্নিয়ার এবং জর্জ রেসেলি যেন সমস্ত গান গেঁথেছেন তাদের বেইস এবং ড্রামসের অনন্য ব্যাকআপ দিয়ে। স্টু কিমবল তার দৃঢ় গিটারের ছন্দে গানকে নিয়ে যান যেদিকে বব নিয়ে যায়। ডনি হেরন তার প্যাডেল স্টিল, ল্যাপ স্টিল, ইলেকট্রিক ম্যান্ডোলিন, ব্যাঞ্জো, বেহালা ইত্যাদি নিয়ে স্টেজের এক কোণা থেকে তাল মিলিয়ে যাচ্ছেন। আর চার্লি সেক্সটন তার গিটারের মূর্ছনায় ভাসিয়ে নিয়ে যান। 
 

আমি মনে হয় তখন উড়ছিলাম যখন বব ‘ডোন্ট থিংক টুইস, ইটস অল রাইট’ শুরু করেন। তারপর ‘থান্ডার অন দ্য মাউন্টেইন’, ‘সুন আফটার মিডনাইট’ এবং সবশেষে ‘গটা সার্ভ সামবডি’, যা কিনা তারা ‘পিটার গান’ ক্লাসিক থিম মিউজিকের সুরে পরিবেশন করে। 
 

এরপর বব ডিলান দর্শকদের উদ্দেশ্যে কিছু না বলেই মঞ্চ ত্যাগ করেন! গান গাওয়া ব্যতীত তিনি পুরো শো চলাকালীন সময় একটি শব্দও কথা বলেননি। এমনকি গানের নাম কিংবা তাঁর ব্যান্ড সদস্যদের পরিচয় করিয়েও দেয়ারও প্রয়োজন বোধ করেননি। মঞ্চ ত্যাগ করার আগে মাঝখানে দাঁড়িয়ে তিনি শুধু এক মুহূর্তের জন্য সরাসরি তাকিয়ে ভক্তদের মুখোমুখি হন এবং দ্রুত মঞ্চ ত্যাগ করেন।
 

আমরা দর্শকরা তালি দিতে থাকি। কেউ থামছেই না, যেন সবাই মিলে ববকে আবার মঞ্চে ফিরে আসার আহবান জানাচ্ছে। তিনি পুনরায় মঞ্চে ফিরে এলেন। আমি বললাম, এবার হয়তো ‘ব্লোইং ইন দ্য উইন্ড’ করবেন। এবং তিনি সত্যিই আবারো সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে গানটি পরিবেশন করেন। এরপর সবশেষে ‘ব্যালাড অফ এ থিন ম্যান’ দিয়ে শো শেষ করেন। তারপর তিনি সবার চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন!
 

বব ডিলান লাল ট্রিমিংয়ের একটি ডার্ক স্যুট পরে গান করেন। মাঝেমধ্যে হারমোনিকাতে কয়েকটি নোট ফুঁকেছেন মাত্র কিন্তু গিটার হাতে নেননি একবারের জন্যও! অল্প কয়েকটি গান দাঁড়িয়ে পরিবেশন করলেও, দুই ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে কালো গ্র্যান্ড পিয়ানোর আড়ালে বসেই বেশিরভাগ করেন। আসলে তাঁর গানগুলিই সব কথা বলছিল, অন্য কোন কিছুই আর তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না।
 

অন্যদিকে, আপেল নামের সেই ছেলেটি কয়েকটি গানের পরেই বাড়ি ফিরে যায়নি। আমাদের সাথে পুরো শো সে দেখেছিল। শো শেষে সে আর তেমন কথা বলেননি, যেন একটু অন্যমনস্ক হয়ে ছিল শেষ সময় পর্যন্ত। এই দুই ঘণ্টা সময়ে তার জীবন যেন আমাদের চোখের সামনেই পাল্টে গেছে... আর আমার এবং আমার বন্ধুর জন্য এই কনসার্ট দেখা যেন ছিল তীর্থযাত্রা, আজীবনের অভিজ্ঞতা।
 

বব ডিলান তোমায় কুর্ণিশ জানাই। 

১৯৪১ সালের ২৪ মে আমেরিকার মিনিসোটা স্টেটের হিবিং শহরে রবার্ট আল্যান জিমারম্যানের জন্ম। ৫০ দশকের শেষার্ধে সংগীতজগতে প্রবেশ করেন। সেসময় প্রিয় কবি ডিলান থমাসের নামে নিজের নাম বদলে রাখেন- বব ডিলান। তাঁর গানে উঠে আসে মানবতার কথা, বিপ্লবী আর যুদ্ধবিরোধী চেতনা। তিনি হয়ে ওঠেন সংগীত অনুরাগীদের প্রেরণার উৎস। গীতিকার, সুরকার, গায়ক বব ডিলান ১৯৭১ সালে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এ অংশগ্রহণের মাধ্যমে আমাদের মুক্তিসংগ্রামের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। ২০১৬ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন বব ডিলান।

shomoyeralo.com/details.php?id=271396

Comments

    Please login to post comment. Login