সময় তখন শ্রাবণ মাস,নদনদীর জলসীমা উপচে জলমগ্ন হয়ে আছে পারিপ্বার্শিকতা,,খেয়া পারাপারের দৃশ্য উপভোগ করতে নীল নীলিমা বির্দীর্ণকারী বজ্রপাতের এক অপরাহ্নে শান্তির আবাস ছেড়ে বেরিয়ে পরেছিলাম ভরাবর্ষার আবেদনে সাড়া দিয়ে,,রংবেরংয়ের পালতোলা নৌকো,স্বর্পগতিতে ফনা তুলে চরাচর ব্যপ্ত করা তটিনীর দেখা মেলা খুব কঠিন নয় এইসময়,,স্বল্প পরিসরে মানুষের আনাগোনা-জলমগ্ন এক বিশাল এলাকার দিকে ধাবমান হওয়া ব্যতিরেকেই সম্ভব! তবে সব সহজ কাজকে সহজভাবে করলে সহজের মাহাত্ন্য কমে যাবার সূক্ষ আশঙ্কা থাকে,একসময় গিয়ে দেখা যাবে,সহজ শব্দটাই বড্ড মুল্যহীন হয়ে যাচ্ছে,,সহজ শব্দকে এতোটা মুল্যহীন করতে মন সায় দেয়না.তাই তথাকথিত কঠিন পথটাই বেছে নেয়া উচিত ইচ্ছেপূরণে!
পথের হিসেবটা সঠিকভাবে করতে শেখাটা আজো হয়ে ওঠেনি,আমার কাছে আজো ''দুরে/কাছে''এই দুটো শব্দই কোনো স্থানের দুরত্ব পরিমাপে ব্যবহৃত ! তাই কত কি.মি./মাইল/ক্রোশ...পথ পাড়ি দিয়ে এই জলে শোভিত জলপুরিতে এসে পৌঁছেছি.তা স্বাভাবিক নিয়মে বলতে পারছিনা,অনেক দূরে-এটাই একমাত্র উপমা,স্কেলার রাশির মতোই দিকহীন হয়ে গেলো ব্যাপারাটা.তবে স্কেলার রাশিরই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন জীবনে,ভেক্টর দিয়ে সব মিলিয়ে ফেললে মানবমনে সৃষ্ট সুক্ষ অদৃশ্য অনুভূতি অপ্রয়োজনীয় হয়ে যেত,সব মিলিয়ে ফেলার আসলেই কি খুব প্রয়োজন বিদ্যমান?!
শ্রাবণ-কার্তিক-অগ্রহায়ণ-পৌষ-মাঘ,,ক্যালেন্ডারে নির্ভুল হিসেবে আজ মাঘ মাসের ৯ তারিখ,,জলপুরি পরিণত হয়েছে ধূসর মরুভুমিতে,,ধূসর মরুভুমি,এটার কোনো সঠিক ব্যাখ্যা নেই,এটা উপমা মাত্র!পত্রশোভিত চোখ ধাঁধানো স্থান,তবে গাছের পাতার অবস্থান মাটিতে,ঝরে পরা পত্রে শোভিত বর্নিল মাটির নামই ধূসর মরুভূমি!অ্যাস ট্রেতে জমা হয়ে আছে বহুপুরোনো সিগারেটের ভগ্নাংশ!ভগ্নাংশ--ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত,তুমি আমার অংশ হয়েও অংশ নও,ক্ষয়ে যাওয়া অতীতের সজীব পৃষ্ঠার জমা কিছু কথার ভাবস্প্রসারণ,কিন্তু বর্তমানের আবছা পাতাতেও নেই সারাংশ,এক আফসোস,এক স্মৃতি,এক লোমহর্ষক ছন্দপতন,''বিদায় বন্ধু,শব্দটি বলার পরেও '''আমি আছি'' এর যুগলায়ন--এইতো ভগ্নাংশ,,,ভগ্নাংশ বড় অদ্ভুত!!জলপুরি শুষ্কতার অতল গহ্বরে তলিয়ে গেলেও আমার আর বাড়ি ফেরা হয়নি,আলোকবর্ষ সমান দূরত্বে হারিয়ে গেছে বাড়ি ফেরবার টান,বিনিসুতোর টান!ব্ল্যাকহোলে হয়তো আটকা পরেছে বাড়ি ফেরবার টান,!
প্রায় মাস দশেক পরে জীর্নশীর্ন প্রাচীরে ঘেরা আমার নতুন আবাসে খুঁজে পেলাম কিছু স্বীকারোক্তি,স্বচ্ছ কুয়োর মতো স্বীকারোক্তি,যার অতল সন্ধানে পাওয়া যায় কর্দমাক্ত তলদেশ-বহু কাঙ্ক্ষিত অনাকাঙ্ক্ষিত অতীতের গল্প,অথচ উপরের পৃষ্ঠ স্বচ্ছতার মুক্ত প্রতীক-ঘন কালো অন্ধকারেও যেন চাঁদের আলোয় সর্বাঙ্গ অবগাহনে মুক্তোর মতো জ্বলছে,কালো খাপের চারদেয়ালে বর্ণহীন নিজস্বতাহীনতায় ডুকরে কেঁদে ওঠা মুক্তো!আয়নাও স্বচ্ছ স্বীকারোক্তির প্রতীক,তবে আয়নার অপর পাশে পারা লাগানো-যা স্বীকারোক্তির অপর প্রান্ত রুদ্ধ করে দেয়,অতীতের কাব্য ঝলসে ওঠেনা,তাই স্বীকারোক্তি হতে হয় বদ্ধ কুয়োর মতো!
আদি হতে অন্ত--ভুলেই সমাপ্ত(স্বীকারোক্তি)
''''''আমি মানুষ,নামহীন পরিচয়হীন এক সাদামাটা মানুষ,বাহ্যিকতার আড়ালে ঢেকে রাখি অন্তরালকে,অন্তরাল সেটাই,যার পরিচয় স্বাভাবিক মনুষ্যসমাজে প্রকাশ পেলে নির্মম নিশাচর মাংসাশী প্রাণীর তালিকা নতুন করে বানাতে হবে আবার!বর্ণিল এক জীবন হতে আদির সূচনা,হায়নার আঁধারে অন্তের পথের দিশা!আমি মানুষ না!
ছোটবেলায় ভুল করেছি খুব কম ,বিরল প্রজাতির শিশুর মতো বেড়ে ওঠা আমার,বিরল শিশুর তকমা গায়ে লাগিয়ে ঘুরে বেরাতাম রাতের আঁধারে,লোকচক্ষুর অন্তরালে,শিকারের খোঁজে ক্ষিপ্ত ক্ষূধার্থ হয়ে নিরাশ হয়ে বাড়ি ফিরতাম ভোরে-অন্তরালে!শিকারের খোজ চালিয়ে যেতে লাগলাম,তবে আমার বুভুক্ষ মনের স্বান্তনা স্বরূপও পেতাম না কিছুই,আরো হিংস্র হয়ে যাই দিনদিন-এই হিংস্রতা সর্বগ্রাসী,অভাবের মতো হা করে ধেয়ে আসতে লাগলো,আমি খোরাক জোগাতে পারলাম না,অভাবের মতোই গিলে নিলো হিংস্রতা সব,,হয়তো আমাকেও,আমি কি বেঁচে আছি!বেঁচে থাকলে কি মাটির নিচে শুয়ে পৃথিবী দেখার বাসনা করা যায়?আমি তো যুগ যুগান্তর ধরে জোনাকি দেখিনি আমার বাঁশবাগানে,হিমেল বাতাসের স্পর্শও তো পাইনি বহুকাল,শিশিরে ভেজা দুর্বাঘাস মাড়াইনি কতকাল!আমি কি বেঁচে আছি?আমার এই লিখনি কি জীবিত সত্তার,নাকি মৃত!!
কাল পূর্নিমায় জোৎস্নায় অবগাহন করেছিলাম,পূর্ন চন্দ্রের এই তিথিতে তো জোয়ার বইলো না মনে!বান ডেকে গেল না বাইরে এবং ঘরে!দিনদিন অনুভুতিশুন্য হয়ে যাচ্ছি নাতো!এক দুই তিন..উহহ,,না সুই ফোটালে তো ব্যাথা পাচ্ছি..তবে অনুভুতি ঠিকই আছে,শিকারের খোজটাই নেই!
এক দশক পরে আমি শিকার পেলাম,,বহু প্রতীক্ষিত শিকার,রক্তেমাংসে গড়া মানুষ-আনন্দে ভরপুর!বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাস তার,কিসের এত আনন্দ তার কে জানে!এই রংচটা পৃথিবীর বুকেও এক ফোটা জলরং যেন পানিতে গুলিয়ে বিশাল আকার ধারণ করেছে এই মানুষটির জন্য!দুনিয়াটা বড় অদ্ভুত-মায়া-বিশ্বাস-ত্যাগ-প্রস্থান-পুনরাবির্ভাব--এইতো চক্র-এরমধ্য ভালোবাসা শব্দটা যেন কোনঠাসা হয়ে রয়েছে,,তবে এই একটা শব্দই সবকিছুকে বেঁধে রাখতে পারতো,,আমার প্রথম শিকারের জীবনে বুঝি কোণঠাসা হয়ে থাকা শব্দটার মাহাত্ন্যই প্রকট,,অদ্ভুত সুন্দর এক জীবন্ত হাসি দেখে এক দশক পরে ফিরে এলাম বাড়ি-বুভুক্ষ মনকে শীতল পরশ দিয়ে,,আমার শিকার ছিলো সুখী মানুষ,তাদের জীবন্ত হাসি,,আজকালকার এই অভিনয়ের জগতে জীবন্ত কোনোকিছু পাওয়া দুষ্কর হয়ে উঠেছে,সুখ তো আরো বেশি দুষ্প্রাপ্য,,ছোটবেলার সেই বিরল শিশুর তকমা পাওয়া থেকেই বুঝে গিয়েছিলাম সুখ বলতে কিছু হয়না,
বেশিরভাগের কাছেই সুখ আপেক্ষিকতার সূত্র মেনে চলে!প্রস্থান পর্যন্তই আমার জীবনচক্র প্রসারিত,তাইতো দুচোখ ভরে জীবন্ত হাসি শিকার করতে কত পথে-অলিতে-গলিতে-অনন্ত চরাচরে ঘুরেছি..সাঁঝবেলায় মানুষ ঘরে ফেরে,নিত্যদিনের ভালোথাকার আমেজ ওঠে,তাই রাতের আঁধারেই খুজে গিয়েছি প্রকৃতসুখী মানুষ ,,তবে পাইনি,পেলাম এক দশক পরে!
আমার জীবনচক্র সুখ খোজাতেই আটকে থাকলে বেশ হতো!তবে চিরায়ত নিয়মের সাথে আমিও বদলে যাই,সময় বদলায় না,বদলে যায় সময়ের সাথে চলতে থাকা মানুষ,গোলকধাঁধায় আটকে পরা বেঁচে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছেধারী মানুষটির মতোই মানুষ বদলে যায়,সময় তো একটি উপলক্ষ্য মাত্র তাকে সকল ত্রুটি বিচ্যুতি অর্পন করার!
ভালোবাসা এলো,বসন্তের রং এ সবটা উজাড় করে দিয়ে বৈশাখের মতো নতুন অতিথির বুকে হারিয়ে গেলো,বৈশাখের অতলে বসন্ত হারায়-কাল গহ্বরে নি:স্ব হয়ে যায়!খুনের শুরু ওখান থেকেই,,বসন্তকে উদ্ধারে বৈশাখের বুক চিরে ফেললাম..বেরিয়ে এলো কালবৈশাখী-লন্ডভন্ড করে দিলো আমাকে-ক্ষতবিক্ষত হয়ে উঠে দাঁড়ালাম-বৈশাখের বুকে আমার করা ক্ষতচিহ্ন মিলিয়ে গেলো,আমি আবার চিরলাম বৈশাখকে,,তবে আমার ফলা বৈশাখের পাজর স্পর্শ করার আগেই অদৃশ্য হয়ে গেল সে! আমি গোলার্ধেই চক্রাকারে ঘুরলাম কয়েক মিলিয়ন বছর!তবুও বসন্তকে আর পেলাম না!!কয়েক কোটিবার প্রদক্ষিনের পরে কেউ এসে বললো,'''আবার আসছে বসন্ত,নতুন সাজে,চিনে নিতে পারলে আর হারাবে না শতাব্দীতেও,ভুলে গেলে আফসোস করতেই এসে যাবে অন্তের রেশ'''''' আমি দিন গুনলাম,,আমার গোলাকারে পরিভ্রমন শেষ হলে কবে?কাজ তো শূন্য হলো,ফলও কি তবে গোলাকারেই শূন্যই হবে??বসন্ত আসলো ঠিকই ভবিষ্যতদ্বানী সত্য করে,,তবে আমার আর চিনে নেয়ার জন্য খাটুনি করতে হলোনা,কয়েক শতাব্দীও পাওয়া হলোনা,কারণ..বসন্তের আগমনের ঠিক একপক্ষকাল আগেই আমি বর্তমান হতেই বিলীন হয়ে গেলাম!আমার গোলাকারে পরিভ্রমনের ফলটা শূন্যই হলো সূত্র মেনে!'''''''''
..........((স্বীকারোক্তি সমাপ্ত))).......
জলপুরি(ধূসর মরুভূমি) ছেড়ে বেরিয়ে আসলাম গ্রীষ্মের দাবদাহে,সূর্যের প্রখরতায় জনজীবন অতিষ্ট.আমি মৃদু লয়ে ছন্দতান ঠিক রেখে গল্পটা বলে যাচ্ছি শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে বিশাল অডিটরিয়ামে.,স্বীকারোক্তির গল্পটা শুনে চমক লাগা চোখে কেউ তাকিয়ে আছে,কেই অবিশ্বাস আর ঠাট্টার ছলে কৌতুকাভিনয় করতে ব্যস্ত চোখের সংস্পর্শে,,গল্প তো গল্পই হয়--আসলেই কি তাই?!
অডিটরিয়াম ছেড়ে বাড়ি আসলাম,ডাইরি বের করে হিসেব করতে লাগলাম,,গুনতে গুনতে গোনার ইচ্ছেটাই শেষ হয়ে গেল,তবুও গোনা শেষ হলোনা,এই অগুনিত শিকার করে গেছি এই জীবনজুড়ে,রক্তের গন্ধটা আমার ভীষণ প্রিয় হয়ে উঠেছে,,টাটকা রক্ত আরো চমকপ্রদ ব্ষয়,ফিনকি বেয়ে গড়িয়ে পরে রক্ত,সুন্দরতম অবয়বের মানুষগুলো লুটিয়ে পরে কিছুটা সময় নিয়ে,কাটা মুরগির মতো ছটফট করতে করতে অসাড় হয়ে যায়,এরপর. .??আমি হাসি,আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে হাসি,সেই সুখীমানুষটির মতো করে,যে এখন আমার পাশের ঘরের জানালার সোজাসুজি কবরে ঘুমাচ্ছে!জলপুরিতে মানুষের শূন্যতা কি খুব স্বাভাবিক মনে হয়?আবার এই বৈশাখ-কালবৈশাখী-বসন্ত--এগুলো কি শুধুই মাস? সবকিছুর সমাধান করে দিতে নেই-এতে সমস্যার কদর কমে যায়!!
দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ গাঢ় হচ্ছে..চলমান ঘটনার অবতারণা হবার সময় হয়ে গেছে..দরজা খুললাম..হাস্যোজ্জ্বল এক মানুষ দাড়ানো..সম্ভাষণ করে ভেতরে আনলাম..মানুষটি বসে আছে ছোফায়,,আর আমি..রান্নাঘরে ছুরিতে শান দিচ্ছি-মানুষটি কফি খেতে খুব পছন্দ করে-কফি খাওয়ালে মন্দ হয়না..