পোস্টস

গল্প

সালিশ

৬ মে ২০২৪

এইচ এম নাজমুল আলম

মূল লেখক এইচ এম নাজমুল আলম

১.
বজলু মিয়া চেয়ারম্যান বাড়ির পুকুরঘাটে বসে আছে। চেয়ারম্যান আজিজ মোল্লা বেশ টাকাপয়সা খরচ করে ঘাটটি বাঁধিয়েছেন। বিদেশ থেকে আনা মার্বেল পাথর, দামী ইট দিয়ে ঘাটের সিড়ি বাঁধানো। দুপাশে বসার জায়গা বেশ প্রশস্ত। মাথার উপর রঙিন টিনের ছাউনি দেয়া। আজিজ মোল্লা বেশিরভাগ সালিশ বৈঠক পুকুর ঘাটেই করে থাকেন। 

বজলুর হাত পিছন থেকে বাঁধা। তাকে পাহাড়া দিচ্ছে শামসুদ্দিনের বড় ছেলে কাদের। 

এই নিয়ে তৃতীয়বার একই অপরাধের জন্য বজলুর সালিশ বসছে। আগের দুইবার তাকে সাবধান করে দেয়া হলেও সে কথা শোনে নি। এবার সম্ভবত চেয়ারম্যান বেশ বড়সড় শাস্তিই দেবেন। তবে কি শাস্তি দেবেন এখনো বোঝা যাচ্ছে না। 

সালিশ শুরু হবে সকাল আটটার দিকে৷ বজলু সারারাত শামসুদ্দিনের উঠানের পাশে সুপারি গাছের সাথে বাঁধা ছিল। সারা শরীর ব্যাথায় টনটন করছে। দীর্ঘ সময় কিছু খেতে না পেয়ে ক্ষুধায় পেট মোঁচড় দিচ্ছে তার। পেটের মধ্য থেকে গ্রুম গ্রুম আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ মনোযোগ দিয়ে আওয়াজ শুনল সে। বেশ তাল রয়েছে। গ্রুম, গ্রুমম, গ্রুমমম, গ্রুম, গ্রুম গ্রুম....

২.
বজলু মিয়া পাইপের মিস্ত্রী। এলাকার যেসব বাড়িতে বৈদ্যুতিক মোটরে পানি তোলা হয় সেইসব বাড়িতে পানির পাইপের কাজ করে সে। টিউবওয়েলের পাইপের কাজও করে বজলু। গ্রামের সোনাদীঘি থেকে অনেক বাড়িতেই পানির জন্য পাইপ লাইন টানা হয়েছে। এই এলাকায় একমাত্র বজলুই পানির পাইপের কাজ করে। তাই কোন বাড়ির পানির পাইপ কোন পথে টানা, কোন খালের মধ্য থেকে কোন বাড়িতে লাইন গিয়েছে সবই নখদর্পনে তার।

বৈধ পেশার আড়ালে বজলু শেখের গোপন পেশা- তারই লাগানো পানির পাইপ লোক চক্ষুর অন্তরালে কেটে দিয়ে আসা! মাছ ধরার কোচ কিংবা দাঁ, বটি দিয়ে পাইপ কুপিয়ে রেখে আসে সে। কোন বাড়িতে পানির লাইনে সমস্যা হলে ডাক পড়ে বজলুর। নিজের কেটে আসা পাইপ নিজেই মেরামত করে বেশ বড় অঙ্কের মজুরী দাবী করে বসে সে। জঙ্গল, খাল, মজা পুকুরে অন্য কেউ সহজে কাজ করতে চায় না।

আগে দুইবার পাইপ কাটতে গিয়ে ধরা পড়েছিল বজলু। রহিম জমাদ্দার আর এখলাস আলীর বাড়ির পিছনের খালে পাইপ কাটার সময় ধরা পড়ে সে। দুইবারই কান্নাকাটি, হাতেপায়ে ধরে কিংবা কোচ দিয়ে মাছ ধরার অজুহাত দেখিয়ে রক্ষা পেয়ে যায় বজলু মিয়া। এবার ধরা পড়েছে শামসুদ্দিনের বাড়ির পাইপ কাটতে গিয়ে। 

শামসুদ্দিন বেশ অবস্থাসম্পন্ন লোক। সদ্য বিবাহিত ছোটো বউয়ের কষ্টের কথা ভেবে বাড়ি থেকে বেশ দূরের সোনাদীঘি থেকে  টাকা পয়সা খরচ করে পাইপ লাগিয়ে মেশিনে পানি তোলার ব্যবস্থা করে সে। গত দুই মাসে তার চারবার পাইপ নষ্ট হয়। প্রতিবারই বজলু মিয়া কাজ করে, আবার সমস্যা হয়। শামসুদ্দিনের সন্দেহ হয়। সে বাড়ির পাশে নজর রাখে। গতকাল সন্ধ্যায় জঙ্গলের দিকে কারো হাটাচলা টের পেয়ে বড় ছেলে কাদেরকে নিয়ে বজলুকে হাতেনাতে ধরে ফেলে! 

৩.
মন্টু শেখ চেয়ারম্যান বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার পথে বজলুর দিকে তাকায়। 
-কি বজলু মিয়া, কার পাইপে কোপ দিলা এইবার?
-হুনলাম বাড়ি করবেন নাকি, পাইপের কাজ করাবেন না?
চিরিক করে মুখ থেকে একদলা থু থু ফেলে ফিক ফিক করে হাসতে লাগল বজলু।

৪.
সালিশ শুরু হলো সকাল আটটার কিছু সময় পর। এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিরাও সালিশে উপস্থিত। চেয়ারম্যান এসে কাঠের চেয়ারে বসলেন। শামসুদ্দিন সালিশের শুরুতেই হম্বিতম্বি করতে লাগল বজলু মিয়ার হাত পা কেটে ফেলার হুমকি দিয়ে। চেয়ারম্যান ঠান্ডা গলায় বললেন- শামসু মিয়া, বসো । মাথা ঠান্ডা করো। অই ছ্যামড়া কেডা আসোস, যা শামসু মিয়ার জন্য চা নিয়া আয়!

অবস্থা সম্পন্ন বলে শামসুদ্দিনকে বেশ কদর করে চলেন চেয়ারম্যান আজিজ মোল্লা। 

-বজলু! শামসু মিয়া যা কইছে তা কি ঠিক?
-চেয়ারম্যান সাব! আপনে আমার আব্বা লাগেন। মুই গেছি মাছ ধরতে...
হাউমাউ করে কান্নাকাটি শুরু করে দেয় বজলু শেখ। 

"শু*য়া*রের বাচ্চা, জঙ্গলের মধ্যে মাছ ধরোস, ফকিরের পুত!" শামসু মিয়া তেড়েবেড়ে উঠতেই দু-তিনজন তাকে শক্ত করে ধরে ফেলে। 

-তুই এই নিয়া তিনবার আমার আদেশ মানোস নাই। এইবার আমি তোর বিচার করমু না। যা করার পুলিশ করবে। ওই কেডা আসোস, ওসি সাবরে ফোন দে। নিয়া যাক কু*ত্তা*র বাচ্চারে। 

ইতিমধ্যে বজলু মিয়ার বউ নিয়ে সালিশে এসে হাজির। সালিশ বৈঠকে এমনিতেই মেয়েছেলে আসা পছন্দ করেন না আজিজ মোল্লা। সে এসেই চেয়ারম্যানের পা ধরে হাউমাউ করে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়।

-চেয়ারমান সাব! আপনারে বাপ মানি। কদুর বাপরে পুলিশে নিয়া গ্যালে মোগো আর বাচোনের পথ থাকব না। 

বেশ বিব্রত হলেন আজিজ মোল্লা। "সর, সর, ওঠ ওঠ, করোস কি মা*গী, অই বেটিরে তোল!"

৫.
খুক খুক করে কাশি দিয়ে কথা বলতে আরম্ভ করল আলকাস ব্যাপারী। 
"চেয়ারম্যান সাব, এইবারের মত আর পুলিশে দিয়েন না বজলু রে।"
ব্যাপারী উঠে গিয়ে বজলুর গালে ঠাস ঠাস করে দু চারটা চড় মেরে বসল। "কু*ত্তা*র বাচ্চা, আর যদি চেয়ারম্যানের সাবের কথা অমান্য করছোস, পুইত্তা ফেলামু বেজম্নার বাচ্চা!"

ব্যাপারী গত নির্বাচনে আজিজ মোল্লার প্রতিপক্ষ ছিল। নির্বাচনে হেরে গেলেও মাছের ব্যবসা করে সম্প্রতি সে বেশ বড়লোক হয়েছে। শোনা যায় সামনের নির্বাচনে বেশ টাকা পয়সা খরচের প্রস্তুতি নিয়েই মাঠে নামছে। বজলুকে পুলিশে না দেয়ার পিছনে তার স্বার্থ রয়েছে। ব্যাপারীর নতুন বাড়ির জন্য পানির পাইপ টানতে হবে। বজলু ছাড়া এই কাজের জন্য মানুষ পাওয়া যাবে না সহজে।

আলকাস মিয়ার হাতে চড় খেলেও বেশ কৃতজ্ঞ চোখে তার দিকে তাকায় বজলু। 

শেষ পর্যন্ত সালিশে ধার্য হয় বজলুকে পুলিশে দেয়া হবে না। চেয়ারম্যান মনে মনে বেশ অসন্তুষ্ট এবং অপমানিত হলেন। সালিশে ব্যাপারীর নাক গলানো তিনি পছন্দ করেন না। সামনাসামনি কিছু না বললেও সেই রাগ ঝাড়লেন বজলুর উপর। লাঠি দিয়ে ইচ্ছামত পেটালেন বজলুকে। 
প্রচন্ড ঘৃণা নিয়ে চেয়ারম্যানের দিকে তাকিয়ে রইলো সে। মনে মনে চেয়ারম্যান বাড়ির পাইপ কাটার সংকল্প করে বজলু। "জেলের ভাত যখন খামুই, হা*রা*মীর বাচ্চা চেয়ারম্যানের লাইন কাইড্যাই খামু"-বিড়বিড় করতে থাকে সে৷ 

৬.
মাস দুয়েক পরের কথা। চেয়ারম্যান বাড়ির পাশে নতুন বাড়ি করেছে সদ্য বিদেশ ফেরত জমাদ্দার হোসেন। তখন রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা। বাজার থেকে বাড়িতে ফিরছিল চেয়ারম্যানের বড় ছেলে হোসেন মোল্লা। সাথে পাহাড়াদার রুস্তম। হোসেন মোল্লার চোখ আটকে যায় পুকুরের দক্ষিণ দিকে জমাদ্দার বাড়ির পাশের খালে, যেখান থেকে চেয়ারম্যান বাড়ির পানির পাইপের লাইন।
মানুষের নড়াচড়া টের পেয়ে সন্তপর্ণে টর্চের আলো নিভিয়ে এগিয়ে যায় হোসেন মোল্লা। কিছু একটা বুঝতে পেরে রুস্তমকে কানে কানে কিছু বলে বাড়ির ভিতর পাঠিয়ে দিলো সে৷ যা সন্দেহ করেছিল ঠিক তাই। বজলু মিয়া পানির পাইপ কাটছে, তার হাতে বটি। রুস্তম ফিরে আসল দোনলা বন্দুক নিয়ে। 

পরপর দুবার দ্রুম দ্রুম আওয়াজে কেঁপে ওঠে পুরো এলাকা।

বজলু মিয়ার নিথর দেহটা পড়ে থাকে পুকুরের ওইপারে।

৭.
পরদিন সকালে পুলিশ আসে চেয়ারম্যান বাড়িতে। ওসি সাহেব চেয়ারম্যানের সাথে ঝামেলা বাড়াতে চান না। ভরপেট নাস্তা খেয়ে, পকেটে দশ হাজার টাকার বান্ডিল নিয়ে হৃষ্টচিত্তে ফিরে যায় ওসি। 

বজলু মিয়ার লাশ গাড়িতে তুলে নিয়ে যায় দুইজন কনস্টেবল। 

আজিজ মোল্লার কপালে চিন্তার ভাজ। জমাদ্দার হোসেনকে ডেকে পাঠালেন তিনি। জমাদ্দার হোসেন নিরীহ মানুষ। 
-জমাদ্দার, সত্যি কথা বলবা, কাইল রাইতে বজলু কি তোমার ঘরে পাইপের কাজ করছে?
-জ্বে চেয়ারম্যান সাব। আপনের পুকুরের ধরে হেই কামেই পাডাইছিলাম। 
-এই কথা তুমি আর আমি ছাড়া কোন কাকপক্ষীও যেন টেন না পায়!