প্রায় সব মানুষ জীবনের এক পর্যায়ে এসে হয়তো ক্ষণিকের জন্য হলেও ভেবেছে যে জীবনের কোন অর্থ নেই। নিরর্থক জীবনের যাতনা ভুলতে অনেকে করেছেন, করছেন এবং সম্ভবত হাঁটবেন আত্মত্যার মত সমস্যা সমাধানের পথে।
দ্য মিথ অফ সিসিফাস। দেবতাদের দ্বারা অভিশপ্ত সিসিফাস যিনি প্রতিদিন পাহাড়চূড়ায় এক পাথরকে উর্ধ্বে বয়ে নেন। এরপর সেই পাথর গড়িয়ে পড়ে সমতলে। সিসিফাস আবার সেই একই কাজ করতে থাকেন, বাকি জীবন।
সচেতন পাঠক মাত্রই খুঁজে পেয়েছেন সিসিফাসের জীবনের সাথে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অদ্ভুত মিলটি। প্রতিদিনকার ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হওয়া, কাজে যাওয়া, ফিরে আসা, পারিবারিক জীবনযাপন, আকস্মিক খারাপ কিছু জীবনে ঘটে যাওয়া, অসহনীয়তা এবং পুনরাবৃত্তিতে চলা এ জার্নি যেন সিসিফাসের মতই অভিশপ্ত।
জীবনের মানে কী? এ দর্শনগত প্রশ্নের মুখোমুখি কে না হয়েছেন! সেই মানে বুঝতে গিয়ে যুক্তি কিংবা বিশ্বাসের শেষ সীমানায় পৌছে মানুষ দেখা পেয়েছে এক দুই সীমানার মধ্যবর্তী 'নো ম্যানস ল্যান্ড' কিংবা 'এক উষর মরু' অথবা 'মহাশূন্যতা'। অতিরিক্ত যুক্তিকে মনে হয়েছে তাঁর নিরর্থক বা অ্যাবসার্ড বিষয়। অথবা নিজ বিশ্বাসকে।
যাদের জীবন অসহনীয়, তাঁরা কী পরিমাণ যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, এরপর কী পরিস্থিতিতে আত্মহ* করে বসছেন সেটি হয়তো আমরা অনেকে বুঝে উঠতে পারবো না। তবে অনেকের চিন্তা যেখানে শেষ হয়েছে আলবেয়ার কামু শুরু করেছেন ঠিক ওখান থেকেই।
আত্মহ* বর্তমান সময়ে এক অতীব জটিল সমস্যা। কেউ কেউ এ সমস্যাকে সমাধান মনে করে তা মহিমান্বিত করছেন। কিন্তু আত্ম*ত্যা মোটাদাগে এক ভ্রান্ত দর্শনের ফল। আলবেয়ার কামু তাঁর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ সাথে নিয়ে মানবজীবনের প্রাচীন সমস্যাটিকে দেখেছেন। নিচাহ্, দয়েস্তফস্কি, কাফকার বাণী, সাহিত্য থেকে সারকথা সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করেছেন।
মানুষের জীবন ভয়াবহ রকমের অ্যাবসার্ড। এত অ্যাবসার্ড যে বিষয়টি রীতিমতো হাস্যকর। ডিসি কমিক্সের জোকার মনে হয় এ জন্যই এত হাসতে থাকেন।
এই নির্রথবাদ বা অ্যাবসার্ডিজমের সামনে পড়ে গেলে, সেই উষর মরুতে কারো চিন্তা গিয়ে পৌছুলে, চিন্তার সীমানার 'নো ম্যানস ল্যান্ড'এ ঢুকে পড়ার পর করনীয় কী?
আলবেয়ার কামু পুরো বইজুড়ে আলাপ করেছেন অ্যাবসার্ডিজমের সাথে মানুষ কীভাবে সমন্বয় করতে পারে তা নিয়ে। কারণ তাঁর মতে সমন্বয়ই সমাধান। আত্মহ* কোন সমাধানের পথ নয়।
কোন আশার বাণী নয়, নয় কোন মোটিভেশনাল টোটকা, লেখক একজন অ্যাবসার্ড মানবের চিন্তাধারা, দর্শন এবং সৃষ্টিকর্ম নিয়ে ক্ষুরধার বিশ্লেষণ করে গেছেন।
কালজয়ী সাহিত্যের চরিত্র কামুর চমৎকার পর্যালোচনায় এক একটি অ্যাবসার্ড বা নিরর্থক চরিত্র হিসেবে উঠে এসেছে। তিনটি পিলার নিয়ে মানুষের জীবনকে সংজ্ঞায়িত করেছেন কামু।
১) জগতকে মানুষ বুঝতে চায়।
২) মনুষ্যসুলভ নানা সীমাবদ্ধতার কারণে জগতকে মানুষ বুঝে উঠতে পারে না।
৩) মানুষের এই বুঝার প্রচন্ড তাড়নার সাথে জগতকে কখনো পুরোপুরি বুঝে উঠতে না পারার ফলে সৃষ্ট দ্বন্দ্ব বা সংঘর্ষ।
উল্লিখিত তিন স্তম্ভের সমন্বয় করার কালে যে ভয়াল শূন্যতায় মানুষের চিন্তা গিয়ে থামে, সেখান থেকে কী ভাবে শুরু করা যায় সেই পথ দেখিয়েছেন আলবেয়ার কামু। কখনো যুক্তি, কখনো দর্শন আবার কখনো শিল্প-সাহিত্যকে টুল হিসেবে ব্যবহার করে।
প্রচন্ড যাতনায় ভুগা মানুষজনকে বুঝতে কিংবা নিজের বিষণ্নতা, বিপন্নতাকে বুকে জড়িয়ে ধরে নিশ্চিত ব্যর্থতা জানার পরও একজন অ্যাবসার্ড মানব,
১) আত্ম*ত্যা করেন না।
২) মহাশূন্যতায় দেখেন বিভিন্ন সব রং। ঠিক যেমন উষর মরুতে দেখেন একের পর এক লতা-গুল্মের সৃষ্টি।
৩) ক্রমাগত জীবন সংগ্রামে লিপ্ত থাকেন।
কারণ একজন অ্যাবসার্ড মানবের মাঝে লুকিয়ে আছে কিছুটা ঋষিসুভ নির্লিপ্ততা,
সে জানে জীবনের মানে না থাকায় কোথাও ঝাপ দেওয়ার দরকার নেই। জীবনের মানে না থাকায় বরং এত বৈচিত্রের দেখা মেলে।
সিসিফাসের মত পাহাড়চুড়া থেকে পাথর গড়িয়ে সমতলে চলে যাওয়ার সময়ে যে মুহূর্ত একজন মানুষ উপভোগ করে, যে উপলব্ধি তাঁর মাঝে সৃষ্টি হয় তা প্রকৃতপক্ষে জীবনের প্রতিটি সেকেন্ড তাঁকে প্রায় পরিপূর্ণভাবে বাঁচতে শিখায়।
সে জানে জীবনের কোন নিরর্থকতাকে অর্থ দান করার ব্যর্থ প্রয়াস-ই জীবন।
আ ত্ম হ ত্যা বিরোধী দর্শনের এই বইটির সুন্দর অনুবাদ করেছেন তানজীম রহমান। সম্পাদনায় হারুন আহমেদ ভালো কাজ করেছেন।
বর্তমান নানামুখি কনফিউশনের সময়ে আমার মতে 'দ্য মিথ অফ সিসিফাস' বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি গ্রন্থ।
বই রিভিউ
নাম : দ্য মিথ অফ সিসিফাস
লেখক : আলবেয়ার কামু
অনুবাদক : তানজীম রহমান
সম্পাদক : হারুন আহমেদ
প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০২৪
প্রকাশক : প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা
একমাত্র পরিবেশক : অবসর প্রকাশনা সংস্থা
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ : মাহাতাব রশীদ
জনরা : প্রবন্ধ
রিভিউয়ার : ওয়াসিম হাসান মাহমুদ
দ্য মিথ অফ সিসিফাস। দেবতাদের দ্বারা অভিশপ্ত সিসিফাস যিনি প্রতিদিন পাহাড়চূড়ায় এক পাথরকে উর্ধ্বে বয়ে নেন। এরপর সেই পাথর গড়িয়ে পড়ে সমতলে। সিসিফাস আবার সেই একই কাজ করতে থাকেন, বাকি জীবন।
সচেতন পাঠক মাত্রই খুঁজে পেয়েছেন সিসিফাসের জীবনের সাথে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অদ্ভুত মিলটি। প্রতিদিনকার ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হওয়া, কাজে যাওয়া, ফিরে আসা, পারিবারিক জীবনযাপন, আকস্মিক খারাপ কিছু জীবনে ঘটে যাওয়া, অসহনীয়তা এবং পুনরাবৃত্তিতে চলা এ জার্নি যেন সিসিফাসের মতই অভিশপ্ত।
জীবনের মানে কী? এ দর্শনগত প্রশ্নের মুখোমুখি কে না হয়েছেন! সেই মানে বুঝতে গিয়ে যুক্তি কিংবা বিশ্বাসের শেষ সীমানায় পৌছে মানুষ দেখা পেয়েছে এক দুই সীমানার মধ্যবর্তী 'নো ম্যানস ল্যান্ড' কিংবা 'এক উষর মরু' অথবা 'মহাশূন্যতা'। অতিরিক্ত যুক্তিকে মনে হয়েছে তাঁর নিরর্থক বা অ্যাবসার্ড বিষয়। অথবা নিজ বিশ্বাসকে।
যাদের জীবন অসহনীয়, তাঁরা কী পরিমাণ যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, এরপর কী পরিস্থিতিতে আত্মহ* করে বসছেন সেটি হয়তো আমরা অনেকে বুঝে উঠতে পারবো না। তবে অনেকের চিন্তা যেখানে শেষ হয়েছে আলবেয়ার কামু শুরু করেছেন ঠিক ওখান থেকেই।
আত্মহ* বর্তমান সময়ে এক অতীব জটিল সমস্যা। কেউ কেউ এ সমস্যাকে সমাধান মনে করে তা মহিমান্বিত করছেন। কিন্তু আত্ম*ত্যা মোটাদাগে এক ভ্রান্ত দর্শনের ফল। আলবেয়ার কামু তাঁর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ সাথে নিয়ে মানবজীবনের প্রাচীন সমস্যাটিকে দেখেছেন। নিচাহ্, দয়েস্তফস্কি, কাফকার বাণী, সাহিত্য থেকে সারকথা সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করেছেন।
মানুষের জীবন ভয়াবহ রকমের অ্যাবসার্ড। এত অ্যাবসার্ড যে বিষয়টি রীতিমতো হাস্যকর। ডিসি কমিক্সের জোকার মনে হয় এ জন্যই এত হাসতে থাকেন।
এই নির্রথবাদ বা অ্যাবসার্ডিজমের সামনে পড়ে গেলে, সেই উষর মরুতে কারো চিন্তা গিয়ে পৌছুলে, চিন্তার সীমানার 'নো ম্যানস ল্যান্ড'এ ঢুকে পড়ার পর করনীয় কী?
আলবেয়ার কামু পুরো বইজুড়ে আলাপ করেছেন অ্যাবসার্ডিজমের সাথে মানুষ কীভাবে সমন্বয় করতে পারে তা নিয়ে। কারণ তাঁর মতে সমন্বয়ই সমাধান। আত্মহ* কোন সমাধানের পথ নয়।
কোন আশার বাণী নয়, নয় কোন মোটিভেশনাল টোটকা, লেখক একজন অ্যাবসার্ড মানবের চিন্তাধারা, দর্শন এবং সৃষ্টিকর্ম নিয়ে ক্ষুরধার বিশ্লেষণ করে গেছেন।
কালজয়ী সাহিত্যের চরিত্র কামুর চমৎকার পর্যালোচনায় এক একটি অ্যাবসার্ড বা নিরর্থক চরিত্র হিসেবে উঠে এসেছে। তিনটি পিলার নিয়ে মানুষের জীবনকে সংজ্ঞায়িত করেছেন কামু।
১) জগতকে মানুষ বুঝতে চায়।
২) মনুষ্যসুলভ নানা সীমাবদ্ধতার কারণে জগতকে মানুষ বুঝে উঠতে পারে না।
৩) মানুষের এই বুঝার প্রচন্ড তাড়নার সাথে জগতকে কখনো পুরোপুরি বুঝে উঠতে না পারার ফলে সৃষ্ট দ্বন্দ্ব বা সংঘর্ষ।
উল্লিখিত তিন স্তম্ভের সমন্বয় করার কালে যে ভয়াল শূন্যতায় মানুষের চিন্তা গিয়ে থামে, সেখান থেকে কী ভাবে শুরু করা যায় সেই পথ দেখিয়েছেন আলবেয়ার কামু। কখনো যুক্তি, কখনো দর্শন আবার কখনো শিল্প-সাহিত্যকে টুল হিসেবে ব্যবহার করে।
প্রচন্ড যাতনায় ভুগা মানুষজনকে বুঝতে কিংবা নিজের বিষণ্নতা, বিপন্নতাকে বুকে জড়িয়ে ধরে নিশ্চিত ব্যর্থতা জানার পরও একজন অ্যাবসার্ড মানব,
১) আত্ম*ত্যা করেন না।
২) মহাশূন্যতায় দেখেন বিভিন্ন সব রং। ঠিক যেমন উষর মরুতে দেখেন একের পর এক লতা-গুল্মের সৃষ্টি।
৩) ক্রমাগত জীবন সংগ্রামে লিপ্ত থাকেন।
কারণ একজন অ্যাবসার্ড মানবের মাঝে লুকিয়ে আছে কিছুটা ঋষিসুভ নির্লিপ্ততা,
সে জানে জীবনের মানে না থাকায় কোথাও ঝাপ দেওয়ার দরকার নেই। জীবনের মানে না থাকায় বরং এত বৈচিত্রের দেখা মেলে।
সিসিফাসের মত পাহাড়চুড়া থেকে পাথর গড়িয়ে সমতলে চলে যাওয়ার সময়ে যে মুহূর্ত একজন মানুষ উপভোগ করে, যে উপলব্ধি তাঁর মাঝে সৃষ্টি হয় তা প্রকৃতপক্ষে জীবনের প্রতিটি সেকেন্ড তাঁকে প্রায় পরিপূর্ণভাবে বাঁচতে শিখায়।
সে জানে জীবনের কোন নিরর্থকতাকে অর্থ দান করার ব্যর্থ প্রয়াস-ই জীবন।
আ ত্ম হ ত্যা বিরোধী দর্শনের এই বইটির সুন্দর অনুবাদ করেছেন তানজীম রহমান। সম্পাদনায় হারুন আহমেদ ভালো কাজ করেছেন।
বর্তমান নানামুখি কনফিউশনের সময়ে আমার মতে 'দ্য মিথ অফ সিসিফাস' বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি গ্রন্থ।
বই রিভিউ
নাম : দ্য মিথ অফ সিসিফাস
লেখক : আলবেয়ার কামু
অনুবাদক : তানজীম রহমান
সম্পাদক : হারুন আহমেদ
প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০২৪
প্রকাশক : প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা
একমাত্র পরিবেশক : অবসর প্রকাশনা সংস্থা
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ : মাহাতাব রশীদ
জনরা : প্রবন্ধ
রিভিউয়ার : ওয়াসিম হাসান মাহমুদ