পোস্টস

বিশ্ব সাহিত্য

ওয়াচম্যান

২০ মে ২০২৪

ওয়াসিম হাসান মাহমুদ

মূল লেখক ওয়াসিম হাসান মাহমুদ

অক্টোবর ১২, ১৯৮৫। বহুতল ভবন থেকে ছুড়ে ফেলে দেয়া হয়েছে এড‌ওয়ার্ড ব্লেইককে। রোরশ্যাখের দিনলিপি তা-ই বলছে। ডিটেক্টিভরা বিস্মিত। প্রাক্তন সুপারহিরো, ভিয়েতনাম ওয়ার ভ্যাটেরান, ব্ল্যাক অপস থেকে শুরু করে সরকারী বিভিন্ন গুপ্তচরভিত্তিক কর্মকান্ডে জড়িত ছিলেন ব্লেইক। সেইসাথে শারীরিকভাবে ছিলেন দারুন শক্তসামর্থ অবস্থায়। কে এই রহস্যময় হত্যাকারী? রোরশ্যাখ নেমে পড়েন তদন্তে। কারণ খুন হয়েছেন দ্য কমেডিয়ান।

'কিন এক্ট ১৯৭৭' এর মাধ্যমে সুপারহিরো বা মাস্ক ভিজিল্যান্টিদের কর্মকান্ড সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। অথচ 'মিনিটম্যান' থেকে শুরু করে বিভিন্ন মুখোশধারি হিরোদের টিম বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ড থেকে সাধারণ নাগরিকদের রক্ষা করে আসছিলেন। হলিস ম্যাশন নাইট ঔল হয়ে কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছেন। আরো ছিলেন হুডেড জাস্টিস, সিল্ক স্পেক্টর, কমেডিয়ান, ক্যাপ্টেন মেট্রোপলিসের মত বীররা। তবে দিনশেষে সুপারহিরোরা তো মানুষ‌ই। তাদের জীবনের বিভিন্ন অন্ধকার দিক জনগণের সামনে চলে আসলে ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি হয়।

মিনিটম্যানের পরের প্রজন্মের সুপারহিরোরা কিন এক্টের কারণে অসময়েই অবসর নিতে বাধ্য হন। একজন ছাড়া। এমন একজন যে কোন কম্প্রোমাইজ তত্ত্বে বিশ্বাস করেন না। একের পর এক প্রাক্তন মাস্ক ভিজিল্যান্টিদের হত্যাকান্ড ঘটতে থাকে। রোরশ্যাখ তাঁর প্রাক্তন দলের সদস্যদের সাবধান করতে চান। কিন্তু তাঁর কথা কেউ তেমন একটা পাত্তা দিতে চান না।

ড্যান দ্বিতীয় নাইট ঔলের তৎপরতা বাদ দিয়ে বিষন্ন সময় কাটান। মাঝে মাঝে প্রথম নাইট ঔলের সাথে সাক্ষাত করেন। এড্রিয়ান ভেইড কিন এক্টের দু'বছর আগেই খুব সম্মানিত অবস্থাতেই অজিমেন্ডিয়াসের কর্মকান্ড থেকে ইস্তফা নেন। মিস জুপিটার সংসার করছেন চলমান পারমাণবিক শক্তির চেয়েও ক্ষমতাধর দেবতার মত ডঃ ম্যানহাটনের সাথে। তাদের আগের প্রজন্মের সুপাররা বৃদ্ধ বয়সে দূর্বল শরীর নিয়ে শেষ সময়ের অপেক্ষায় আছেন। কিন্তু কি যেন নেই তাদের জীবনে? সেই অ্যাডভেঞ্চার যা শুধুমাত্র ছেলেমানুষি এখন তাদের কাছে, সেসব কি মিস করেন তারা?

তৎকালীন আমেরিকা এবং সোভিয়েত রাশিয়ার মধ্যে ব্যাপক স্নায়ুযুদ্ধ চলছে। সোভিয়েতরা আফগানিস্তানে অভিযান চালাচ্ছে। হয়তো তাদের পরবর্তি টার্গেট পাকিস্তান। নিক্সনের আমেরিকাও বসে নেই। পারমাণবিক অস্ত্র এবং পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর জীবন্ত ওয়েপন ডঃ ম্যানহাটানকে নিয়ে তারা প্রস্তুত। অনেক বিশ্লেষকের মতে যুদ্ধ অনিবার্য। আমেরিকার সমাজ ব্যবস্থায় একধরণের অস্থিরতা এবং ভায়োলেন্স ছড়িয়ে পড়ছে। পৃথিবীর আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি আমুল পরিবর্তনের পথে, নাকি বিলুপ্তির? ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, অর্থনৈতিক বৈষম্য, বিভিন্ন মিডিয়ার বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি, গ্রাফিক নভেলের আখ্যানের ভিতরেই তৎকালিন বিভিন্ন ডার্ক কমিক্সের ব্যাপক জনপ্রিয়তা, বিভিন্ন প্রতিভাধরের গায়েব হয়ে যাওয়া সব মিলিয়ে এক ব্যাপক নৈরাজ্যের মধ্যে রোরশ্যাখ চালিয়ে যেতে থাকেন তাঁর তদন্ত। যেকোন মূল্যে রহস্যময় অপরাধিকে ধরতে হবে তাঁর।

অ্যালান মুর যে লেখক হিসেবে একজন জিনিয়াস তা ওয়াচম্যান পড়লে বুঝা যায়। অনেকে পপ-ফিকশনের শ্রেষ্ঠ কর্ম মনে করেন এই গ্রাফিক নভেলকে। টাইম ম্যাগাজিনের মতে ইতিহাসের সেরা ১০০ টি উপন্যাসের মধ্যে এটি একটি। সাথে ডেইভ গিবনসের মুগ্ধ করে রাখার মত কমিক্স আর্ট‌ওয়ার্ক সমান্তরালে বলে গেছে অনেক জীবনের গল্প। কয়েক স্তরে লিখা এই আখ্যানে প্যানেল থেকে প্যানেলে অনেক ক্লু, অনেক হিন্টস দেয়া আছে। সাহিত্যের মত‌ই জীবন যে অশ্লীল এবং অস্বস্তিকর তার ক্লু, সেসবের হিন্টস। গ্রাফিক নভেল আর্টের সমান্তরালে প্রতি অধ্যায়ের শেষে বিভিন্ন খ্যাতিমান ব্যক্তির উক্তি এবং গানের কলি সেই অধ্যায়ের যেন প্রতিনিধিত্ব করছে। এছাড়া কমিক্স আর্টের পাশাপাশি‌‌ গল্পের মধ্যেই প্রতিটি প্রধান চরিত্রের সাক্ষাৎকার, আত্মজীবনীমূলক লেখা, পুলিশ রিপোর্ট, সাইকোথ্যারাপিস্টের বিশ্লেষণ, বিভিন্ন চিঠি, ছোটখাটো নোটস এত ব্রিলিয়ান্টলি লেখা হয়েছে যে অ্যলান মুরের কিংবদন্তি লেখনী বারবার নক্ষত্রের মত জ্বলে ওঠে।

অ্যালান মুর ভি ফর ভ্যানডেটা, ফ্রম হেল, মিরাকলম্যান এবং সোয়াম্প থিঙের মত দুর্দান্ত সব কাজ করেছেন তবে ওয়াচম্যানের সাথে তিনি চিরস্মরনীয় হয়ে থাকবেন। গ্রিন ল্যান্টার্ণ সিরিজ, সুপারম্যান এবং ব্যাটম্যানের মত ডিসির প্রধান কিছু চরিত্র নিয়ে কাজ করা ডেইভ গিবনসের বেলায়‌ও এক‌ই কথা খাটে। অ্যালান মুরের আমেরিকান ইংলিশে লিখা মহাকাব্যের মতো এই গ্রাফিক নভেলে ডেইভ গিবনস প্যানেল টু প্যানেল যেরকম জাত শিল্পীর মত কাজ করেছেন, যেভাবে মানবজীবনের বিভিন্ন দূর্বলতা, নৃশংসতা, অস্বস্তি, আকার-ইঙ্গিত ফুটিয়ে তুলেছেন তা মনে হয় আর কেউ পারতেন কিনা সন্দেহ। ওয়াচম্যান নিয়ে প্রচুর লেখালেখি এবং সাক্ষাৎকার আছে। অপরাধী ধরার ডিটেক্টিভ অংশ এই উপন্যাসের একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। তবে গুরুত্বপূর্ণ। ভূরাজনীতি কিভাবে য়োর্ক করে, মানবমন কতটা ভঙ্গুর, ক্ষমতার দ্বন্দ্বে মানুষের জীবন কিরকম পাপেটের মত হয়ে যায় সেসবের অনিন্দ্য সুন্দর তবে অস্বস্তিকর বর্ণনা আছে ওয়াচম্যানে। এক‌ইসাথে আছে মহাশুণ্য যাত্রা। পুরো নভেলে মানবজীবনের যে পরস্পর বিরোধী এবং স্ববিরোধী ফিলসফিক্যাল জার্নি দেখানো হয়েছে তা এই গ্রাফিক নভেলকে করেছে অনন্য।

ওয়াচম্যান এমন এক গল্প বলে যা আমুল পাল্টে দিয়েছে একটি মাধ্যমকে এবং সেই সাথে একটি ইন্ডাস্ট্রিকে।

পাঠ প্রতিক্রিয়া
 
ওয়াচম্যান
লেখক : অ্যালান মুর
শিল্পী : ডেইভ গিবনস
প্রকাশনা : ডিসি কমিক্স
প্রথম প্রকাশ : ১৯৮৬
অ্যাডিশনাল কালারিং এন্ড ডিজিটাল ফিনিশিং : জন হিগিনস ( ২০০৫ )
জনরা : মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতা, উপন্যাস, থ্রিলার, সাসপেন্স, সায়েন্স-ফিকশন।
রিভিউয়ার : ওয়াসিম হাসান মাহমুদ