Posts

গল্প

গল্প করিম মিয়ার এইসব দিনরাত্রি

June 27, 2024

জালাল উদ্দিন লস্কর

Original Author জালাল উদ্দিন লস্কর

106
View

করিম মিয়ার এইসব দিনরাত্রি


জালাল উদ্দিন লস্কর

আছিয়া বেগমের মন ভাল নেই।পাঁচ জনের সংসারে আজ চুলা জ্বলবে না।ঘরে চাউল ডাল কিছুই নেই।দুইদিন ধরে আছিয়ার রিক্সাচালক স্বামী করিম মিয়ার শরীর খারাপ।কাজে যেতে পারে না।ডাক্তারের কাছে যাওয়ার চিন্তাও এদের কাছে বিলাসিতা।গ্রাম ডাক্তার  সমীর বাবুর কাছে কাল গিয়েছিল।শরীরে জ্বর ও ব্যাথা গলায় খুশখুশে কাশি নাক দিয়ে অবিরাম সর্দি ঝরছে দেখে সমীর বাবু চিন্তায় পড়ে গেলেন।অভিজ্ঞতা থেকে তিনদিনের  ওষুধ দিয়ে দিলেন।দাম নিতে চাইলেন না।একই গ্রামের মানুষ তারা।করিম মিয়ার অবস্থা সম্পর্কে ভালোই জানেন সমীর বাবু।ওষুধ খেয়েও করিম মিয়ার অবস্থার কোনো উন্নতি হচ্ছে না।এদিকে ঘরে খাওয়ার মতো কিছুই নেই।ছোট ছেলেমেয়েদের মুখে কি দেবেন এই চিন্তায় আছিয়া বেগমের কিছুই ভালো লাগছে না।
দেশে কি এক অসুখ শুরু হয়েছে সেই কয়েকমাস আগে থেকে।দিনদিন অসুখটা ছড়িয়ে পড়ছে সবখানে।শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত।প্রথম প্রথম কিছু দানশীল মানুষ ও সামাজিক সংগঠন গরীব অসহায়দের মাঝে ত্রাণ হিসাবে খাদ্য সামগ্রী ও সামান্য নগদ টাকা বিতরণ করেছে।এখন সেসবও বন্ধ।রিক্সা চালিয়ে করিম মিয়ার যা আয় হতো তা দিয়ে কোনোরকমভাবে সংসার চলতো।দিনের পর রাত আসতো।রাতের পরে দিন।অসুখের মাত্রা বাড়ার সাথে সাথে সরকার নানান রকমের কড়াকড়ি নিয়ম করে দেয়।জনচলাচল কমে যেতে থাকে।সেই সাথে করিম মিয়ারও আয় রোজগার কমে আসে।প্রথম দিকে পাওয়া কিছু ত্রাণ সাহায্য দিয়ে কিছু দিন বেশ ভালোই চলেছিল সংসার।চাল, ডাল, তেল, আলু ও সাবান বেশ কয়েক দফায় পেয়েছিল। 
আছিয়া বেগমের মনে পড়ে যায়, সেদিন 'দিনবদলের স্বপ্ন' নামের একটা সংগঠন স্থানীয় প্রাইমারী স্কুলে দরিদ্র ও অসহায়দের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করতে এসেছিল।খবর পেয়ে আছিয়া বেগমও গিয়েছিলেন সেখানে।চাল ডাল আলু তেলের একটা ব্যাগ জুটেওছিল তার ভাগ্যে। যখনই আছিয়া বেগম ব্যাগটা নিতে সামনে গেলেন ঠিক তখনই দলনেতা আবরার কামাল চিৎকার করে কেউ একজনকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলেনঃ
-ভাল করে বিভিন্ন এংগেলের কয়েকটা ছবি তুলতে হবে সালেহীন। এতক্ষণ যে সব ছবি তোলা হয়েছে খেয়াল করে দেখেছি সেগুলো খুব একটা ভালো হয় নি।
সালেহীন ডিএসএলআর ক্যামেরাটা রেডি করে ক্ষিপ্র শিকারীর মতো ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
অনেকভাবে অনেক ভঙ্গিমায় ছবি তুলেও আফসোস যাচ্ছিল না সালেহীনের।শেষে দলনেতা আবরার কামাল নিজেই আছিয়া বেগমকে কিভাবে ব্যাগটা ধরে ক্যামেরার দিকে হাসিহাসি মুখ করে তাকাতে হবে বুঝিয়ে দিলেন!
আছিয়া বেগমের হাত কাঁপছিল।ক্লান্তিতে হাঁফিয়ে উঠেছিলেন আছিয়া বেগম।কিন্তু ছবি উঠানোয় কোনো ক্লান্তি ছিল না দিন বদলের স্বপ্ন টিমের।ক্লান্ত হলে চলবেই কেন।গ্রামের অনেক গন্যমান্য লোকজন এসেছেন আমন্ত্রিত হয়ে।সবাই চায় তার একটা ছবি নিদেনপক্ষে সোস্যাল মিডিয়ায় হলেও আসুক।সবাই জানুক মহৎ কাজে শরীক হওয়ার সুযোগ পেলে সে সুযোগ তারা হাতছাড়া করেন না।তাদের একটা মনুষ্যত্ববোধ ও দায়িত্ব কর্তব্য আছে না!
সেদিন বাড়ী ফিরে আছিয়া ঠিক করেছিল আর কখনোই ত্রাণ আনতে এতো আগেভাগে যাবেন না।ছবিটবি তোলা শেষ হয়ে গেলে সুযোগ বুঝে পারলে ত্রাণটা নিয়ে আসবেন। না পারলে না আনবেন।এরপর আরও দুএক জায়গায় ত্রাণ আনতে গিয়েছেন।সেভাবে ছবি শিকারীর কবলে পড়তে হয় নি।

চোখেমুখে অন্ধকার নেমে এসছে আছিয়া বেগমের।নিজেরা না হয় উপোস করলেন কিন্তু ছেলেমেয়েদের কি খেতে দেবেন।করিম মিয়ার অসুস্থ শরীরে একটু ভালোমন্দ খাওয়া দরকার।অথচ ঘরে আজ কিছুই নাই। সরকারী সাহায্যও দুএকবার পেয়েছেন।তবে পরিমানে খুব বেশী নয়।আরও সাহায্য দেওয়ার কথা বলে গ্রামের মেম্বার একদিন এসে স্বামী স্ত্রী দুজনের জাতীয় পরিচয় পত্র নিয়ে গিয়েছেন অনেকদিন হয়।এখন পর্যন্ত কিছুই পাওয়া যায় নি।অনেকেই সরকারী প্রণোদনা না যেন কিসের পঁচিশ'শ টাকা পেয়েছেন বলে শুনেছেন।কিন্ত আছিয়া বেগম কিংবা করিম মিয়া পান নি কিছুই।করিম মিয়ার মোবাইল নম্বরও নিয়ে গিয়েছিলেন মেম্বার সাহেব।করিম মিয়া আর খোঁজ খবরও নেওয়ার দরকার মনে করেন নি।ভাগ্যে থাকলে পাবেন এমন একটা বিশ্বাস করিম মিয়ার মনে।
সমীর বাবুর দেওয়া ওষুধে করিম মিয়ার শারীরিক অবস্থার কোনো পরিবর্তন বুঝা গেলো না।জ্বরের মাত্রা বেড়ে গেলো।সাথে কাশিও।

পাশের বাড়ীর সামাদ মাস্টারের কানে গেলো খবরটা।শিক্ষিত,সজ্জন, সদালাপী ও সাদামনের মানুষ সামাদ সাহেব স্থাণীয় হাইস্কুলের অংকের শিক্ষক।প্রাইভেট পড়িয়ে তার অনেক টাকা আয় হয় মাসে মাসে।তবে কয়েকমাস ধরে সরকারী নির্দেশে সারা দেশের মতো সামাদ স্যারেরও প্রাইভেট পড়ানো বন্ধ।সামাদ সাহেব এসে করিম মিয়ার সাথে কথাবার্তা বললেন।করিম মিয়ার রোগ লক্ষণগুলো শুনে ভ্রু-কুঞ্চিত করলেন! আলামত ভালো মনে হলো না সামাদ সাহেবের কাছে।বিদায় নেওয়ার আগে আছিয়া বেগমের হাতে কিছু টাকা দিয়ে গেলেন।আরও সহায়তার আশ্বাসও দিয়ে গেলেন।

পরদিন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে নমুনা সংগ্রহকারী এক লোক এসে হাজির করিম মিয়ার বাড়ীতে।প্রথমে আছিয়া বেগম ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন।নমুনা সংগ্রহকারী লোকটি খুবই ভালো মানুষ।আছিয়া বেগমকে সাহস দিলেন।নমুনা সংগ্রহ শেষে চলে যাওয়ার সময় করিম মিয়ার হাতে  কিছু টাকাও দিয়ে গেলেন।সামাদ সাহেবই উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ মোস্তাক আহমদকে ফোন করে করিম মিয়ার বিষয়ে সবিস্তারে জানিয়েছিলেন।নমুনা সংগ্রহকারীর মাধ্যমে করিম মিয়ার জন্য অর্থ সাহায্যটুকু মূলত ডাঃ মোস্তাক সাহেবই পাঠিয়েছিলেন। 
আছিয়া বেগম সামাদ সাহেবের দেওয়া টাকাটা নিয়ে বাজারে ছুটে গেলেন।দ্রুততম সময়েই চাল, ডাল, আলু, তেল নিয়ে বাড়ী ফিরে এসে রান্নার আয়োজন করতে লাগলেন।
পাঁচদিন পরে করিম মিয়ার নমুনা পরীক্ষার ফলাফল আসলো-করোনা নেগেটিভ।কিন্তু তার শারীরিক অবস্থার কোনো পরিবর্তন কিংবা উন্নতি দেখা গেলো না।আছিয়া বেগম ছুটে গেলেন সামাদ সাহেবের বাড়ীতে।সব শুনে সামাদ সাহেব পরদিনই করিম মিয়াকে নিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ মোস্তাক আহমদের কাছে নিয়ে গেলেন।অভিজ্ঞ মোস্তাক সাহেব দেখে শুনে সন্দেহ করলেন করিম মিয়া টিবি রোগে আক্রান্ত।তবে নমুনা পরীক্ষায় নিশ্চিত হওয়া চাই।পরদিনই নমুনা নিয়ে আসতে বললেন।আর বলেলেন টিবি এখন কোনো রোগই নয়।বিনামূল্যে এর সরকারী চিকিৎসা রয়েছে।নিয়ম মেনে চললে সুস্থ হয়ে উঠবেন।

নমুনা পরীক্ষায় জানা গেলো করিম মিয়ার টিবি রোগই।সামাদ সাহেব তার সাবেক কয়েকজন ছাত্রের সাথে করিম মিয়ার বিষয়টি নিয়ে কথা বললেন।তারা এখন সবাই কর্মজীবনে প্রতিষ্টিত।
সবাই করিম মিয়ার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে চাইলো।এখন করিম মিয়ার ওষুধ ও বিশ্রাম দুটোই প্রয়োজন।ওষুধ সরকারীভাবে পাওয়ার সুযোগ আছে।কিন্তু বিশ্রাম? বিশ্রামে থাকলে খাবেন কি?পেটের কি আর বিশ্রাম আছে?

সামাদ সাহেব তার প্রাক্তন ছাত্ররা করিম মিয়াকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসায় খুশী হলেন।
করিম মিয়া এখন বিশ্রামে থেকে চিকিৎসাটা চালিয়ে যেতে পারবেন-সামাদ সাহেব ভাবলেন।

Comments

    Please login to post comment. Login