- সাবধানে যেও ইভান।
- হুম।
- আর অফিস পৌছেই ফোন দিবা কিন্তু।
- সে তো প্রতিদিনই দেই।
- আমি বলে দেই বলেই দাও।
- আচ্ছা মেনে নিলাম এবার আসি, অনেক দেরী হয়ে যাচ্ছে।
- হুম, এসো।
ইভান চলে যাচ্ছে আর মিমি গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে, কিছুদূর যাওয়ার পর ইভানের মনে পরলো কিছু একটা ভুল করেছে সে, তাই ইভান আবার ফিরে এলো মিমির কাছে, এসে ওর কপালে আলতো একটা চুমো এঁকে দিয়ে বললো "পাগলী একটা", মিমিও একটু অভিমানি সুরে বললো........
- তুমি তো জানোই, এই টুকু না হলে সারাটা দিন ভালো যায় না আমার,তাহলে প্রতিদিন কেনো ভুলে যাও বলো তো?
- আচ্ছা বাবা, এমনটা আর কখনো হবে না এবার তো একটু হাসো ।
তারপর মিমির ঠোঁটের পাশের একটু খানি হাসি নিয়ে ইভান চলে যায় তার কাজের জায়গায়।
ওহ্, আপনাদের কে তো বলাই হয় নি।
ইভান আর মিমি দুজন স্বামী, স্ত্রী, মিমির প্রতিদিনের অভ্যাস ইভান যখন অফিস যাবে তখন সে ইভানের সাথে তাদের বাসার এই গেটটা পর্যন্ত আসবে, আর ওপরের ওই কথা গুলো বলবে।
ইভান চলে গেছে তাই মিমিও রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো, এমন সময় কোত্থেকে একটা পিচ্চি মেয়ে এসে আম্মু আম্মু বলে জড়িয়ে ধরলো মিমিকে, মিমির এত বছরের চাপা কষ্টটা আজ আবার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠলো, মিমির চোখ দুটো জলে ভিজে গেলো, মিমি মেয়েটার হাত দুটো তার কোমড় থেকে সরালো, আর মাটিতে হাঁটু ফেলে বসে পরলো মেয়েটার সামনে, মিমি মেয়েটার কাছে জানতে চাইলো।
- কে তুমি মামনি?
- তুমি তোমার মেয়েকে চিনতে পারছো না আম্মু?
কথাটা বলেই মেয়েটা খিলখিলিয়ে হাসতে শুরু করলো, কি মিষ্টি সেই হাসি, মায়া ভরা মুখ খানি, মিমির যেনো মনে হচ্ছে কত বছরের চেনা এই মুখটা, কেনো এমন মনে হচ্ছে মিমির? আজ কেনো বার বার মনে হচ্ছে এই তো আমার মেয়ে। কিন্তু এ মেয়ে তো মিমির নয়, মিমি যে অনেক আগেই তার মা হওয়ার ক্ষমতাটা হারিয়ে ফেলেছে।
- কি এত ভাবছো আম্মু, ভাবছো এতদিন আমি কোথায় ছিলাম, আরে বাবা তুমি তো খুব অসুস্থ ছিলে, তাই তো ভালো আন্টি আমাকে এতদিন তার কাছেই রেখেছিলেন, কিন্তু এখন তো তুমি সুস্থ হয়ে গেছো তাই তিনি আমাকে তোমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
- কিন্তু মা, আমি যে সত্যিই তোমার আম্মু নই।
- কেনো এমন মিথ্যে বলছো, এতদিন তো তোমায় ছেড়ে কত দূরে ছিলাম, আজ যখন কাছে এসেছি তখনো তুমি আমায় বুকে টেনে নিচ্ছো না, ভালো আন্টি মিথ্যে বলেছিলো তুমি একদমই ভালো না, খুব পঁচা তুমি, ছাড়ো আমায় আমি আমার ভালো আন্টির কাছেই চলে যাবো।
- ওরে আমার সুইট মামনি, খুব রাগ হয়েছে আমার ওপর তাই না?
- হুহ। (মুখ বেঁকিয়ে)
- আচ্ছা সরি, এবার বলো তো তোমার ভালো আন্টি টা কে, আর তোমার নামটা কি?
- এই রে, আমি তো ভালো আন্টির কোনো ছবিই আনি নি যে তোমাকে দেখাবো, আর আমার নাম নিহা ।
- তোমার নামটা খুব সুন্দর তো, তোমার আন্টির ছবিটা থাকলে খুব ভালো হতো, নেই যেহেতু কি আর করার, আচ্ছা চলো এবার রুমে যাওয়া যাক।
- হুম চলো।
মিমির খুব আনন্দ হচ্ছে আজ, মিমির সমস্ত সুখ, স্বপ্ন সব যেনো পাওয়া হয়ে গেছে এবার, কিন্তু কিছু ব্যাপার খুব ভাবাচ্ছে মিমিকে, কে এই মেয়েটি যে বার বার তাকে আম্মু বলে ডাকছে, আসলে মিমি তো তার আম্মু নয়, ও কি সত্যিই মিমির জীবনে আশার আলো নিয়ে এসেছে নাকি, মিমিকে আবারো নতুন কোনো কষ্টের মাঝে ফেলে দিতে এসেছে, আর ইভান সে তো বাচ্চাদের কথা একদম শুনতেই পারে না,
এই ক বছরে মিমি ইভানকে যত বার বলেছে একটা বাচ্চা দত্বক নিতে ইভান ততোবারই না করেছে, ও বলে আল্লাহ তায়ালা যা আমাদেরকে দেন নি তা নিয়ে আমরা কেনো ভাববো বলো তো? কিন্তু এই মেয়েটাকে যে মিমি কিছুতেই হারাতে পারবে না, কেনো যেনো ওর প্রতি অনেকটা মায়া জন্মে গেছে মিমির। কিন্তু ইভানকে কি করে বুঝাবে সেটা? আচ্ছা যা হবার পরে হবে এখন অত সব ভেবে কোনো কাজ নেই।
নিহাকে সাথে নিয়ে মিমির সময়টা খুব ভালোই কাঁটছে, কত গল্প করতে জানে এই পিচ্চি মেয়েটা, সারাটা ঘর যেনো ও একাই মাতিয়ে রাখবে।
- জানো আম্মু ভালো আন্টিকে না অনেক বার করে আসতে বললাম আমার সাথে কিন্তু এলোই না, খুব মনে পরছে ভালো আন্টিকে।(মন খারাপ করে)
- আচ্ছা মামনি মন খারাপ করতে নেই, আমি তো তোমার আম্মু, এখন থেকে তো তোমায় আমার কাছেই থাকতে হবে তাই না মামনি?
- হুম।
- নিহা মামনি চলো এবার গোসলে যেতে হবে তো নাকি?
- হুম চলো।
নিহাকে গোসল করানোর সময় মিমি নিহার গলায় একটা লকেট পেলো, মিমির বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো, এই লকেট টা নিহার গলায় কেনো? এটা তো নীলার লকেট এই রকম আরো দুটো লকেট আছে, একটা মিমির কাছে আরেকটা ইভানের কাছে, ওরা তিন জন যখন ভার্সিটিতে পড়তো তখন এই তিনটা লকেট নীলা কিনে এনেছিলো, এই লকেট গুলোর ভেতরে মিমি, ইভান এবং নীলার ছবি ছিলো, নীলা বলেছিলো এটা আমাদের বন্ধুত্বের স্মৃতি, আমরা তিন জন যদি কখনো আলাদা হয়ে যাই তখন এটাই আমাদেরকে মনে করিয়ে দেবে আমাদের সেই হারিয়ে যাওয়া দিন গুলোর কথা। মিমি লকেটটা খুললো কিন্তু এতে নীলার কোনো ছবি নেই, ইভান, মিমি আর নিহার ছবি।
মিমি ভাবতে লাগলো তাহলে কি নিহা নীলার মেয়ে? কিন্তু এত বছর পর নীলা...
আর কিছু ভাবতে পারছে না মিমি।
রাতে ইভান বাসায় ফিরলো, ফ্রেস হয়ে খাওয়া দাওয়া শেষ করে শুতে গিয়ে দেখতে পেলো বিছানায় ছোট্র একটি মেয়ে ঘুমিয়ে আছে। ইভান মিমির কাছে জানতে চাইলো।
- মিমি কে এই মেয়ে?
- এটাতো আজ আমার জানতে চাওয়ার কথা ইভান।
- মানে?
- এটা কি ইভান? (লকেট টা ইভানের সামনে ধরে)
- তুমি খুব ভালো করেই জানো এটা কি, অযথা আমাকে প্রশ্ন করছো কেনো?
- অযথা নয় তো ইভান, আজ অন্তত সত্যিটা লুকিও না আমার থেকে, বলো ইভান প্রতিটা রাতে আমি যখন ঘুমিয়ে যাই এই লকেট টা হাতে নিয়ে কেনো কাঁদো তুমি, তোমার কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙে যায় আমার, খুব জানতে ইচ্ছে করে আজও কেনো নীলাকে তুমি ভুলতে পারো নি, ও কি শুধুই তোমার বন্ধু ছিলো নাকি আরো অন্য কোনো সম্পর্ক ছিলো তোমাদের মাঝে?
ইভান চিৎকার করে বলতে শুরু করলো।
- কি জানতে চাও তুমি, নীলা কে ছিলো আমার? হ্যাঁ নীলা আমার এ দেহের নিশ্বাস ছিলো, নীলাকে আমি ভালবাসতাম আর সেই ভালবাসাকে স্বীকৃতি দিতেই বিয়ে করেছিলাম তাকে, কেও জানতো না সে কথা, কারণ কাওকে জানাই নি আমরা, ভেবেছিলাম লেখা পড়া শেষ করে যখন কিছু একটা করবো আমি, তখন সবাইকে জানাবো সবটা, কিন্তু আমাদের ভাগ্যটা সে পর্যন্ত অপেক্ষা করে নি, তার আগেই জানতে পারি আমি বাবা হতে যাচ্ছি, সেদিন খুশিতে আত্নহারা হয়ে যাই আমি, ছুটে যাই ক্যাম্পাসে খবরটা তোমাকে জানাবো বলে।
কিন্তু সেখানেই আমার জীবনের গল্পটা পাল্টে যায়, রিপন আমাদের তিন জনের এই বন্ধুত্বের সম্পর্কটাকে নোংরা ভাবে দেখে, খারাপ ভাষায় কথা বলে সেদিন, তখন ওর কথায় আমার মাথায় রক্ত উঠে যায়, সেখানে ওর সাথে খুব ঝগড়া লেগে যায় আমার, এক পর্যায়ে মারামারি, সেখানে তুমি বাঁধা দিতে গিয়ে প্রচন্ড রকমের আঘাত পাও পেটে, সেখান থেকে তোমাকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়, তোমার অপারেশন হয়, ডাক্তার জানায় তুমি আর কখনো মা হতে পারবে না, সেদিন কেনো যেনো বার বার মনে হচ্ছিলো আমিই দোষি, আর সবাই বলা বলিও করছিলো কে বিয়ে করবে তোমাকে, তোমার জীবনটা নাকি নষ্ট হয়ে গেলো, তখন প্রচন্ড রকমের অনুশোচনায় ভোগছিলাম আমি, কি করবো কিছু বুঝতে পারছিলাম না, এমন সময় তোমার মা এসে আমার হাত দুটো ধরে বললো।
- বাবা ইভান একমাত্র তুমিই পারো আমার মেয়েটার জীবনটাকে আবার রাঙিয়ে দিতে, আজ যদি তুমি মুখ ফিরিয়ে নাও তাহলে আমার মেয়েটার কি হবে এক বার ভেবে দেখো, প্লিজ না করো না।
সেদিন তোমার মা এর কথা রেখেছিলাম আমি, বিয়ে করেছিলাম তোমাকে, তারপর নীলাকে সব কিছু বলেছিলাম ও মেনেও নিয়েছিলো, আমি তোমাকে আমাদের ব্যাপারে সব কিছু বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু নীলা আমাকে বলতে নিষেধ করে ও বলে সব কিছু নাকি ও নিজেই জানাবে তোমাকে, নীলা বলেছিলো ও যতদিন কিছু না বলবে আমিও যেনো কিছু না বলি তোমাকে।
কিন্তু পরদিন যখন আমি নীলাকে খুঁজতে যাই
কেও নীলার কোনো খোঁজ দিতে পারে নি, সবাই বলেছিলো কাল থেকেই নীলাকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, আমার জীবন থেকে এভাবেই হারিয়ে যায় নীলা। তোমরা সবাই ভাবতে ও কোনো ছেলেকে নিয়ে পালিয়েছে, তোমাদের সবার কথা গুলো শুনে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করতো, নীলা আমার জন্যই হারিয়ে গেছে সবার জীবন থেকে, কিন্তু পারি নি আমি কারণ নীলাকে যে কথা দিয়েছিলাম, কাওকে কিছু জানাবো না আমি।
কিন্তু আজ হঠাৎ করে এসব কেনো জানতে চাইছো মিমি?
- কেনো জানতে চাইছি সেটা কাল জানতে পারবে, এখন যাও ঘুমিয়ে পরো।
- হুম।
পরদিন খুব সকালে মিমি ইভানকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে, আর ইভানকে রেডী হতে বলে, ইভানও রেডী হয়ে নেয়, অবশ্য ইভানের খুব জানতে ইচ্ছে করছিলো , কোথায় যাবে ওরা কিন্তু জানতে চাইলো না।
ইভান দের গাড়ি গিয়ে থামলো একটা বস্তির সামনে, মিমি আর নিহা নেমে গেলো সেখানে, একটু পর ওদের সাথে আরেকজন কাওকে আসতে দেখতে পেলো ইভান, ও গাড়ি থেকে নেমে আস্তে আস্তে করে পা বাড়ালো তাদের দিকে, ইভানের চিনতে খুব কষ্ট হচ্ছে মেয়েটাকে, এই কি সেই নীলা যে সব সময় এলো মেলো থাকতে পছন্দ করতো, কখনো নিজেকে গুছিয়ে রাখতে পারতো না, ওমন ভাবে থাকার জন্য নীলাকে কত কথা শুনাতো ইভান, কিন্তু আজ কত পরিপাটি সে, নিজেকে পুরোটাই গুছিয়ে নিয়েছে আজ।
ইভান শুধু তাঁকিয়েই আছে নীলার দিকে, কোনো কথা বলতে পারছে না সে, সব কথা যেনো ফুরিয়ে গেছে তার।
- আর কত দেখবে বলো তো, এবার ফিরিয়ে নিয়ে চলো না বাসায়।(মিমি)
- ওহ্ সরি , চলো নীলা অনেক তো হলো এবার প্লিজ বাসায় ফিরে চলো । (ইভান)
- ইভান, কি করে বলতে পারছো এই কথাটা তুমি, এক বারের জন্যও মিমির কথাটা ভেবে দেখেছো, ওর সাজানো সংসারটা কি করে নষ্ট করে দেবো আমি, সেটা যদি করারই হতো তাহলে অনেক আগেই করতে পারতাম , কিন্তু আমি চাই নি সেটা, তাই এত দিন পর্যন্ত তোমাদের চোখের আড়ালে ছিলাম।
- আমার সংসার নষ্ট হওয়ার চিন্তা তোকে করতে হবে না, ভার্সিটিতে আমরা তিনজন যেমন একসাথে ছিলাম এখনো তেমনই থাকবো, পারবি না আমার সাথে থাকতে?(মিমি)
- এ হয় না মিমি, তখন আমরা বন্ধু ছিলাম, কিন্তু এখন আর তা হতে পারবো না, আমার জন্য তোর জীবনে দুঃখ নেমে আসুক আমি তা কখনোই চাই নি, ফিরে যা মিমি, আর নিহাকে তুই তোর নিজের সন্তান মনে করিস, কারণ নিহা জানে তুই ওর মা, আমি নিহাকে সেই ছোট বেলা থেকেই তোর আর ইভানের ছবি দেখিয়ে বলতাম এরাই তোমার বাবা, মা, নিহাকে ভালো রাখিস মিমি।
- আচ্ছা নীলা তোর কি মনে হয় তুই একাই সব পারিস, আমি কিছু পারি না? দেখ এখন যদি তুই আমাদের সাথে না আসিস তাহলে আমি, তোকে, ইভানকে, নিহাকে সবাইকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে যাবো, যেখান থেকে চাইলেও তুই আর আমাকে ফিরিয়ে আনতে পারবি না, এখন ভেবে দেখ তুই কি করবি? আমার সাথে ফিরবি নাকি আমিই চলে যাবো তোদের সবাইকে ছেড়ে?
- এমন কথা আর কখনো বলবি না মিমি, আমি ফিরবো তোদের সাথে।
নীলার এই কথাটা শুনে ইভান, মিমি, নিহা সবাই খুব খুশি হয়, সবার চোখে তখন দু ফোঁটা অশ্রু জমা হয়, কিন্তু এটা কোনো কষ্টের কান্না নয় এটা ফিরে পাওয়ার আনন্দ অশ্রু।।
আসলে আমাদের দেশে এখনো এমন অনেক মানুষ আছে যারা তার স্বামীর সুখে নিজেকে সুখী মনে করে, স্বামীর ভুল গুলো নিজেই শুধরে নিতে জানে, ভালো থাকুক সেই মানুষ গুলো আর ভালো থাকুক প্রত্যেকটা ভালোবাসার সম্পর্ক।।
- সমাপ্ত
- হুম।
- আর অফিস পৌছেই ফোন দিবা কিন্তু।
- সে তো প্রতিদিনই দেই।
- আমি বলে দেই বলেই দাও।
- আচ্ছা মেনে নিলাম এবার আসি, অনেক দেরী হয়ে যাচ্ছে।
- হুম, এসো।
ইভান চলে যাচ্ছে আর মিমি গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে, কিছুদূর যাওয়ার পর ইভানের মনে পরলো কিছু একটা ভুল করেছে সে, তাই ইভান আবার ফিরে এলো মিমির কাছে, এসে ওর কপালে আলতো একটা চুমো এঁকে দিয়ে বললো "পাগলী একটা", মিমিও একটু অভিমানি সুরে বললো........
- তুমি তো জানোই, এই টুকু না হলে সারাটা দিন ভালো যায় না আমার,তাহলে প্রতিদিন কেনো ভুলে যাও বলো তো?
- আচ্ছা বাবা, এমনটা আর কখনো হবে না এবার তো একটু হাসো ।
তারপর মিমির ঠোঁটের পাশের একটু খানি হাসি নিয়ে ইভান চলে যায় তার কাজের জায়গায়।
ওহ্, আপনাদের কে তো বলাই হয় নি।
ইভান আর মিমি দুজন স্বামী, স্ত্রী, মিমির প্রতিদিনের অভ্যাস ইভান যখন অফিস যাবে তখন সে ইভানের সাথে তাদের বাসার এই গেটটা পর্যন্ত আসবে, আর ওপরের ওই কথা গুলো বলবে।
ইভান চলে গেছে তাই মিমিও রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো, এমন সময় কোত্থেকে একটা পিচ্চি মেয়ে এসে আম্মু আম্মু বলে জড়িয়ে ধরলো মিমিকে, মিমির এত বছরের চাপা কষ্টটা আজ আবার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠলো, মিমির চোখ দুটো জলে ভিজে গেলো, মিমি মেয়েটার হাত দুটো তার কোমড় থেকে সরালো, আর মাটিতে হাঁটু ফেলে বসে পরলো মেয়েটার সামনে, মিমি মেয়েটার কাছে জানতে চাইলো।
- কে তুমি মামনি?
- তুমি তোমার মেয়েকে চিনতে পারছো না আম্মু?
কথাটা বলেই মেয়েটা খিলখিলিয়ে হাসতে শুরু করলো, কি মিষ্টি সেই হাসি, মায়া ভরা মুখ খানি, মিমির যেনো মনে হচ্ছে কত বছরের চেনা এই মুখটা, কেনো এমন মনে হচ্ছে মিমির? আজ কেনো বার বার মনে হচ্ছে এই তো আমার মেয়ে। কিন্তু এ মেয়ে তো মিমির নয়, মিমি যে অনেক আগেই তার মা হওয়ার ক্ষমতাটা হারিয়ে ফেলেছে।
- কি এত ভাবছো আম্মু, ভাবছো এতদিন আমি কোথায় ছিলাম, আরে বাবা তুমি তো খুব অসুস্থ ছিলে, তাই তো ভালো আন্টি আমাকে এতদিন তার কাছেই রেখেছিলেন, কিন্তু এখন তো তুমি সুস্থ হয়ে গেছো তাই তিনি আমাকে তোমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
- কিন্তু মা, আমি যে সত্যিই তোমার আম্মু নই।
- কেনো এমন মিথ্যে বলছো, এতদিন তো তোমায় ছেড়ে কত দূরে ছিলাম, আজ যখন কাছে এসেছি তখনো তুমি আমায় বুকে টেনে নিচ্ছো না, ভালো আন্টি মিথ্যে বলেছিলো তুমি একদমই ভালো না, খুব পঁচা তুমি, ছাড়ো আমায় আমি আমার ভালো আন্টির কাছেই চলে যাবো।
- ওরে আমার সুইট মামনি, খুব রাগ হয়েছে আমার ওপর তাই না?
- হুহ। (মুখ বেঁকিয়ে)
- আচ্ছা সরি, এবার বলো তো তোমার ভালো আন্টি টা কে, আর তোমার নামটা কি?
- এই রে, আমি তো ভালো আন্টির কোনো ছবিই আনি নি যে তোমাকে দেখাবো, আর আমার নাম নিহা ।
- তোমার নামটা খুব সুন্দর তো, তোমার আন্টির ছবিটা থাকলে খুব ভালো হতো, নেই যেহেতু কি আর করার, আচ্ছা চলো এবার রুমে যাওয়া যাক।
- হুম চলো।
মিমির খুব আনন্দ হচ্ছে আজ, মিমির সমস্ত সুখ, স্বপ্ন সব যেনো পাওয়া হয়ে গেছে এবার, কিন্তু কিছু ব্যাপার খুব ভাবাচ্ছে মিমিকে, কে এই মেয়েটি যে বার বার তাকে আম্মু বলে ডাকছে, আসলে মিমি তো তার আম্মু নয়, ও কি সত্যিই মিমির জীবনে আশার আলো নিয়ে এসেছে নাকি, মিমিকে আবারো নতুন কোনো কষ্টের মাঝে ফেলে দিতে এসেছে, আর ইভান সে তো বাচ্চাদের কথা একদম শুনতেই পারে না,
এই ক বছরে মিমি ইভানকে যত বার বলেছে একটা বাচ্চা দত্বক নিতে ইভান ততোবারই না করেছে, ও বলে আল্লাহ তায়ালা যা আমাদেরকে দেন নি তা নিয়ে আমরা কেনো ভাববো বলো তো? কিন্তু এই মেয়েটাকে যে মিমি কিছুতেই হারাতে পারবে না, কেনো যেনো ওর প্রতি অনেকটা মায়া জন্মে গেছে মিমির। কিন্তু ইভানকে কি করে বুঝাবে সেটা? আচ্ছা যা হবার পরে হবে এখন অত সব ভেবে কোনো কাজ নেই।
নিহাকে সাথে নিয়ে মিমির সময়টা খুব ভালোই কাঁটছে, কত গল্প করতে জানে এই পিচ্চি মেয়েটা, সারাটা ঘর যেনো ও একাই মাতিয়ে রাখবে।
- জানো আম্মু ভালো আন্টিকে না অনেক বার করে আসতে বললাম আমার সাথে কিন্তু এলোই না, খুব মনে পরছে ভালো আন্টিকে।(মন খারাপ করে)
- আচ্ছা মামনি মন খারাপ করতে নেই, আমি তো তোমার আম্মু, এখন থেকে তো তোমায় আমার কাছেই থাকতে হবে তাই না মামনি?
- হুম।
- নিহা মামনি চলো এবার গোসলে যেতে হবে তো নাকি?
- হুম চলো।
নিহাকে গোসল করানোর সময় মিমি নিহার গলায় একটা লকেট পেলো, মিমির বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো, এই লকেট টা নিহার গলায় কেনো? এটা তো নীলার লকেট এই রকম আরো দুটো লকেট আছে, একটা মিমির কাছে আরেকটা ইভানের কাছে, ওরা তিন জন যখন ভার্সিটিতে পড়তো তখন এই তিনটা লকেট নীলা কিনে এনেছিলো, এই লকেট গুলোর ভেতরে মিমি, ইভান এবং নীলার ছবি ছিলো, নীলা বলেছিলো এটা আমাদের বন্ধুত্বের স্মৃতি, আমরা তিন জন যদি কখনো আলাদা হয়ে যাই তখন এটাই আমাদেরকে মনে করিয়ে দেবে আমাদের সেই হারিয়ে যাওয়া দিন গুলোর কথা। মিমি লকেটটা খুললো কিন্তু এতে নীলার কোনো ছবি নেই, ইভান, মিমি আর নিহার ছবি।
মিমি ভাবতে লাগলো তাহলে কি নিহা নীলার মেয়ে? কিন্তু এত বছর পর নীলা...
আর কিছু ভাবতে পারছে না মিমি।
রাতে ইভান বাসায় ফিরলো, ফ্রেস হয়ে খাওয়া দাওয়া শেষ করে শুতে গিয়ে দেখতে পেলো বিছানায় ছোট্র একটি মেয়ে ঘুমিয়ে আছে। ইভান মিমির কাছে জানতে চাইলো।
- মিমি কে এই মেয়ে?
- এটাতো আজ আমার জানতে চাওয়ার কথা ইভান।
- মানে?
- এটা কি ইভান? (লকেট টা ইভানের সামনে ধরে)
- তুমি খুব ভালো করেই জানো এটা কি, অযথা আমাকে প্রশ্ন করছো কেনো?
- অযথা নয় তো ইভান, আজ অন্তত সত্যিটা লুকিও না আমার থেকে, বলো ইভান প্রতিটা রাতে আমি যখন ঘুমিয়ে যাই এই লকেট টা হাতে নিয়ে কেনো কাঁদো তুমি, তোমার কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙে যায় আমার, খুব জানতে ইচ্ছে করে আজও কেনো নীলাকে তুমি ভুলতে পারো নি, ও কি শুধুই তোমার বন্ধু ছিলো নাকি আরো অন্য কোনো সম্পর্ক ছিলো তোমাদের মাঝে?
ইভান চিৎকার করে বলতে শুরু করলো।
- কি জানতে চাও তুমি, নীলা কে ছিলো আমার? হ্যাঁ নীলা আমার এ দেহের নিশ্বাস ছিলো, নীলাকে আমি ভালবাসতাম আর সেই ভালবাসাকে স্বীকৃতি দিতেই বিয়ে করেছিলাম তাকে, কেও জানতো না সে কথা, কারণ কাওকে জানাই নি আমরা, ভেবেছিলাম লেখা পড়া শেষ করে যখন কিছু একটা করবো আমি, তখন সবাইকে জানাবো সবটা, কিন্তু আমাদের ভাগ্যটা সে পর্যন্ত অপেক্ষা করে নি, তার আগেই জানতে পারি আমি বাবা হতে যাচ্ছি, সেদিন খুশিতে আত্নহারা হয়ে যাই আমি, ছুটে যাই ক্যাম্পাসে খবরটা তোমাকে জানাবো বলে।
কিন্তু সেখানেই আমার জীবনের গল্পটা পাল্টে যায়, রিপন আমাদের তিন জনের এই বন্ধুত্বের সম্পর্কটাকে নোংরা ভাবে দেখে, খারাপ ভাষায় কথা বলে সেদিন, তখন ওর কথায় আমার মাথায় রক্ত উঠে যায়, সেখানে ওর সাথে খুব ঝগড়া লেগে যায় আমার, এক পর্যায়ে মারামারি, সেখানে তুমি বাঁধা দিতে গিয়ে প্রচন্ড রকমের আঘাত পাও পেটে, সেখান থেকে তোমাকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়, তোমার অপারেশন হয়, ডাক্তার জানায় তুমি আর কখনো মা হতে পারবে না, সেদিন কেনো যেনো বার বার মনে হচ্ছিলো আমিই দোষি, আর সবাই বলা বলিও করছিলো কে বিয়ে করবে তোমাকে, তোমার জীবনটা নাকি নষ্ট হয়ে গেলো, তখন প্রচন্ড রকমের অনুশোচনায় ভোগছিলাম আমি, কি করবো কিছু বুঝতে পারছিলাম না, এমন সময় তোমার মা এসে আমার হাত দুটো ধরে বললো।
- বাবা ইভান একমাত্র তুমিই পারো আমার মেয়েটার জীবনটাকে আবার রাঙিয়ে দিতে, আজ যদি তুমি মুখ ফিরিয়ে নাও তাহলে আমার মেয়েটার কি হবে এক বার ভেবে দেখো, প্লিজ না করো না।
সেদিন তোমার মা এর কথা রেখেছিলাম আমি, বিয়ে করেছিলাম তোমাকে, তারপর নীলাকে সব কিছু বলেছিলাম ও মেনেও নিয়েছিলো, আমি তোমাকে আমাদের ব্যাপারে সব কিছু বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু নীলা আমাকে বলতে নিষেধ করে ও বলে সব কিছু নাকি ও নিজেই জানাবে তোমাকে, নীলা বলেছিলো ও যতদিন কিছু না বলবে আমিও যেনো কিছু না বলি তোমাকে।
কিন্তু পরদিন যখন আমি নীলাকে খুঁজতে যাই
কেও নীলার কোনো খোঁজ দিতে পারে নি, সবাই বলেছিলো কাল থেকেই নীলাকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, আমার জীবন থেকে এভাবেই হারিয়ে যায় নীলা। তোমরা সবাই ভাবতে ও কোনো ছেলেকে নিয়ে পালিয়েছে, তোমাদের সবার কথা গুলো শুনে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করতো, নীলা আমার জন্যই হারিয়ে গেছে সবার জীবন থেকে, কিন্তু পারি নি আমি কারণ নীলাকে যে কথা দিয়েছিলাম, কাওকে কিছু জানাবো না আমি।
কিন্তু আজ হঠাৎ করে এসব কেনো জানতে চাইছো মিমি?
- কেনো জানতে চাইছি সেটা কাল জানতে পারবে, এখন যাও ঘুমিয়ে পরো।
- হুম।
পরদিন খুব সকালে মিমি ইভানকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে, আর ইভানকে রেডী হতে বলে, ইভানও রেডী হয়ে নেয়, অবশ্য ইভানের খুব জানতে ইচ্ছে করছিলো , কোথায় যাবে ওরা কিন্তু জানতে চাইলো না।
ইভান দের গাড়ি গিয়ে থামলো একটা বস্তির সামনে, মিমি আর নিহা নেমে গেলো সেখানে, একটু পর ওদের সাথে আরেকজন কাওকে আসতে দেখতে পেলো ইভান, ও গাড়ি থেকে নেমে আস্তে আস্তে করে পা বাড়ালো তাদের দিকে, ইভানের চিনতে খুব কষ্ট হচ্ছে মেয়েটাকে, এই কি সেই নীলা যে সব সময় এলো মেলো থাকতে পছন্দ করতো, কখনো নিজেকে গুছিয়ে রাখতে পারতো না, ওমন ভাবে থাকার জন্য নীলাকে কত কথা শুনাতো ইভান, কিন্তু আজ কত পরিপাটি সে, নিজেকে পুরোটাই গুছিয়ে নিয়েছে আজ।
ইভান শুধু তাঁকিয়েই আছে নীলার দিকে, কোনো কথা বলতে পারছে না সে, সব কথা যেনো ফুরিয়ে গেছে তার।
- আর কত দেখবে বলো তো, এবার ফিরিয়ে নিয়ে চলো না বাসায়।(মিমি)
- ওহ্ সরি , চলো নীলা অনেক তো হলো এবার প্লিজ বাসায় ফিরে চলো । (ইভান)
- ইভান, কি করে বলতে পারছো এই কথাটা তুমি, এক বারের জন্যও মিমির কথাটা ভেবে দেখেছো, ওর সাজানো সংসারটা কি করে নষ্ট করে দেবো আমি, সেটা যদি করারই হতো তাহলে অনেক আগেই করতে পারতাম , কিন্তু আমি চাই নি সেটা, তাই এত দিন পর্যন্ত তোমাদের চোখের আড়ালে ছিলাম।
- আমার সংসার নষ্ট হওয়ার চিন্তা তোকে করতে হবে না, ভার্সিটিতে আমরা তিনজন যেমন একসাথে ছিলাম এখনো তেমনই থাকবো, পারবি না আমার সাথে থাকতে?(মিমি)
- এ হয় না মিমি, তখন আমরা বন্ধু ছিলাম, কিন্তু এখন আর তা হতে পারবো না, আমার জন্য তোর জীবনে দুঃখ নেমে আসুক আমি তা কখনোই চাই নি, ফিরে যা মিমি, আর নিহাকে তুই তোর নিজের সন্তান মনে করিস, কারণ নিহা জানে তুই ওর মা, আমি নিহাকে সেই ছোট বেলা থেকেই তোর আর ইভানের ছবি দেখিয়ে বলতাম এরাই তোমার বাবা, মা, নিহাকে ভালো রাখিস মিমি।
- আচ্ছা নীলা তোর কি মনে হয় তুই একাই সব পারিস, আমি কিছু পারি না? দেখ এখন যদি তুই আমাদের সাথে না আসিস তাহলে আমি, তোকে, ইভানকে, নিহাকে সবাইকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে যাবো, যেখান থেকে চাইলেও তুই আর আমাকে ফিরিয়ে আনতে পারবি না, এখন ভেবে দেখ তুই কি করবি? আমার সাথে ফিরবি নাকি আমিই চলে যাবো তোদের সবাইকে ছেড়ে?
- এমন কথা আর কখনো বলবি না মিমি, আমি ফিরবো তোদের সাথে।
নীলার এই কথাটা শুনে ইভান, মিমি, নিহা সবাই খুব খুশি হয়, সবার চোখে তখন দু ফোঁটা অশ্রু জমা হয়, কিন্তু এটা কোনো কষ্টের কান্না নয় এটা ফিরে পাওয়ার আনন্দ অশ্রু।।
আসলে আমাদের দেশে এখনো এমন অনেক মানুষ আছে যারা তার স্বামীর সুখে নিজেকে সুখী মনে করে, স্বামীর ভুল গুলো নিজেই শুধরে নিতে জানে, ভালো থাকুক সেই মানুষ গুলো আর ভালো থাকুক প্রত্যেকটা ভালোবাসার সম্পর্ক।।
- সমাপ্ত