২০০৫ সালের শুরুতে টেলিকম সেক্টরে হঠাৎ করেই প্রতিযোগিতা তীব্র হয়ে ওঠে। গ্রামীণফোনের একচেটিয়া দাপটে ক্রেতারা তখন বেশ বিরক্ত। কিন্তু তুলনামূলক সুবিধার দিকগুলো বিবেচনা করে তারা সেটার ব্যবহার অব্যাহত রেখেছিল। তখন কিছু দেশে কলচার্জ নাকি ছিল মিনিটে ২৫ পয়সা; অথচ আমরা দিতাম ৬ টাকা ৯০ পয়সা! এমন পরিপ্রেক্ষিতে বাংলালিংকের আগমন হঠাৎ করেই ইন্ডাস্ট্রির পালে জোর হাওয়া লাগায়।
মিসরভিত্তিক ওরাসকম টেলিকমের কৌশলই ছিল নতুন মার্কেটে প্রবেশের সময় বড় ধাক্কা দেয়া। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ফোন সেট ও টকটাইমের দিক থেকে এক ধামাকা অফার দিয়ে বাংলালিংক হুলস্থুল কাণ্ড ঘটায়। ভোরবেলা ক্রেতারা ওই প্যাকেজ যেসব স্টোরে পাওয়া যেত তার সামনে লাইন দিত! আজকাল আইফোনের নতুন মডেলের ক্ষেত্রে যেমনটা দেখা যায়। সেই ধাক্কা সামাল দিতে জিপি নড়েচড়ে বসে। তারা সবচেয়ে সমালোচিত ‘উচ্চ কলরেট’কেই হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেয়। রাতারাতি তা অর্ধেকে (৩ টাকা ৪৫ পয়সায়) নামিয়ে আনে! এভাবে আরেকদিন হঠাৎ তা ৮০ পয়সা করার ঘোষণা দেয়।
পরের দিন বাংলালিংক সংবাদপত্রে বড় বিজ্ঞাপন দিয়ে জিপিকে অভিনন্দন জানায়, মাত্র ২৪ ঘণ্টা দেশের সর্বনিম্ন কলরেট দেয়ার জন্য! কারণ তারা তখন করেছে ৭৯ পয়সা মিনিট। এভাবে পাল্টাপাল্টি অফার চলতে থাকে। দীর্ঘদিন উচ্চ কলরেটে ত্যক্ত-বিরক্ত ক্রেতারা তা দারুণ উপভোগ করতে থাকে। মার্কেট লিডার হিসেবে গ্রামীণফোনের বেশকিছু সুবিধা এমনিতেই ছিল। তার পরও তারা নতুন সিম চালু করে শুধু তরুণদের জন্য। ডি-জুস নামের সেই সিমে অন্য ডি-জুস গ্রাহকের সঙ্গে মাত্র ২৫ পয়সা মিনিটে কথা বলা যেত। বাংলালিংকও পাল্টাপাল্টি অফার দিতে থাকে। একপর্যায়ে রাত ১২টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত কলরেট শূন্য করা হয়! অর্থাৎ বিনা পয়সায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলার সুযোগ।
ওই অফারের সামাজিক প্রভাব নিয়ে বিস্তর সমালোচনা ছিল। তবে মার্কেটিংয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে আমরা লড়াইটাকে কোম্পানির পক্ষ থেকে দেখব। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানের স্বার্থের সঙ্গে এমন চর্চার সাংঘর্ষিক প্রভাব ছিল কি? নিঃসন্দেহে উভয় পক্ষই তাতে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল। কারণ উচ্চপ্রযুক্তিপণ্য ব্যবহারে ক্রেতারা শুরুর দিকে উচ্চমূল্য প্রদানে মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকে। অর্থাৎ যাদের আর্থিক সামর্থ্য থাকে তারাই লেটেস্ট টেকনোলজি ব্যবহার করে। তাই এমন পরিস্থিতিতে কোম্পানিগুলো ক্রেতাদের কাছ থেকে যত বেশি পারা যায় পয়সা খসানোই লক্ষ্য হওয়ার কথা ছিল। শুরুর দিকের অপারেটররা সেই কাজটি দক্ষতার সঙ্গে করে আসছিল। অন্তত ক্রেতাদের তেমনটাই অভিযোগ ছিল।
কিন্তু এক বাংলালিংকের আগমনে প্রতিযোগিতার সামগ্রিক চিত্র যেন বদলে যায়! ক্রেতারা তাদের দ্বন্দ্বের সুফল ভোগ করতে থাকে। জাস্ট ভাবুন, সাগরে দুটি বড় প্রাণী যদি আধিপত্যের আশায় পরস্পকে কামড়াতে থাকে তাহলে ক্রমেই পানির রঙ কেমন হবে? ছড়িয়ে পড়া রক্তে তা লাল হয়ে যাবে, তাই না? এ বিষয়টিই হলো রেড ওশেন স্ট্যাটেজি। কিন্তু তারা যদি একই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারে সচেষ্ট না থেকে বিশাল সমুদ্রের অন্যত্র খাবার ও আশ্রয় খুঁজতে থাকে তাহলে কি পরিবেশ সুন্দর থাকে না? তেমনটা হলে সাগর দেখতে শান্ত ও নীল মনে হবে। সংক্ষেপে এটাই হলো ব্লু-ওশান স্ট্যাটেজি।
যা-ই হোক, নানা সমালোচনার মুখে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ফোনে সারা রাত ফ্রি কথা বলার সুযোগ বন্ধের নির্দেশ দেয়। এ ঘোষণার পর পরই খুব সম্ভবত প্রতিযোগী উভয় কোম্পানির বোধোদয় হয়। তারা ভাবে, লাল পিঁপড়ার মতো নিজেরা কেন কামড়া কামড়ি করে মরছি? তারচেয়ে আমরা যদি পরস্পর বোঝাপড়ার ভিত্তিতে চলি তাহলে মনের সুখে সাগরের শান্ত নীল জলে সাঁতার কাটা সহজ হবে। তখন থেকে ক্রেতাদের সুখের দিন দ্রুতই শেষ হয়ে আসে। উভয় প্রতিষ্ঠান হানাহানিমূলক অফার কমাতে থাকে।
শত শত প্যাকেজের অন্তরালে ক্রেতাদের সুবিধা হ্রাস পেতে থাকে। প্রযুক্তিনির্ভর এ খাতে মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে (দুই যুগ পরে এসে) অনেক বেশি স্বচ্ছতা থাকার কথা ছিল। অথচ এখন আমরা ফোন কলের ক্ষেত্রে প্রতি মিনিটে ঠিক কত প্রদান করি তা স্পষ্ট নয়। বিশেষত কোনো প্যাকেজে না থাকলে কখনো মিনিটে ২ টাকারও বেশি কাটা যায়! আবার পর্যাপ্ত ব্যালান্স থাকার পরও শুধু মেয়াদের দোহাই দিয়ে ক্রেতাদের কল করার সুযোগ বন্ধ করা হয়। একটা প্যাকেজ কিনে ১ মিনিট কথা না বলেও মেয়াদ শেষে কোনো সুবিধা অবশিষ্ট থাকে না। এভাবেই তাদের ব্লু-ওশান নিশ্চিত হয়। টেলিকমের মতো প্রতিযোগীর সংখ্যা কম এবং কাস্টমাইজড প্রডাক্ট অফারের সুযোগ বেশি থাকা ইন্ডাস্ট্রিতে এ কৌশল খুব কাজ করে।
বিগত কয়েক দশকে প্রতিষ্ঠানগুলোয় অস্থিরতা বেড়েছে। একদিকে জায়ান্ট বহু কোম্পানি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, অস্তিত্ব সংকটে পড়ছে। অন্যদিকে খুব স্বল্প সময়ে ব্যাপক সফলতা পাওয়া প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ছে। গোটা দুনিয়ায় বর্তমানে অতি সফল ১০টি কোম্পানির অধিকাংশের বয়স ৩০-৪০ বছরের বেশি নয়। প্রযুক্তিসংশ্লিষ্ট বড় কোম্পানিগুলো এ সময়ে বিকাশ লাভ করেছে। অপ্রতিরোধ্য গতিতে তারা এগিয়ে চলছে। তবে লক্ষণীয় বিষয় হলো, তাদের অধিকাংশের লাইফটাইম খুব একটা দীর্ঘ হচ্ছে না। অর্থাৎ অল্প সময়ে ব্যাপক সফলতা পেয়েও কীভাবে যেন আকস্মিক চুপসে যাচ্ছে।
আবার কিছু শিল্প প্রচলিত ধারায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যাত্রাপালা, মঞ্চনাটক, সার্কাস ইত্যাদির ক্ষেত্রে আওতা দ্রুত সংকুচিত হচ্ছে। এমনকি সেই ফর্মে আর কখনো ফেরা সম্ভব নয় সেটাও অনুমিত। তাহলে তারা কি চিরতরে হারিয়ে যাবে? খুব সম্ভবত না। কারণ এরই মধ্যে বেশকিছু নতুন ধারার উদ্ভব হয়েছে এবং ক্ষুদ্র পরিসরে সেগুলো খুব ভালো করছে। যেমন প্রচলিত রেডিও শোনা লোকের সংখ্যা কমেছে। কিন্তু ভিডিও হিসেবে তাদের কনটেন্ট নানা মাধ্যমে প্রচার করে লক্ষ লক্ষ ভিউ পাচ্ছে! কিংবা সিনেমা হলের দুঃসময়ে ওটিটি প্লাটফর্ম এসে রুগ্ণ শিল্পকে ঘুরে দাঁড়ানোর পথ করে দিচ্ছে। কেন এমনটা হচ্ছে?
কারণ প্রচলিত ধারা পেরিয়ে তারা নতুন প্রযুক্তির সুবিধাকে কাজে লাগাতে পারছে। অর্থাৎ যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেদের প্রডাক্ট তৈরি করছে। এক্ষেত্রে লক্ষণীয়, প্রচলিত ধারায় নির্দিষ্ট মার্কেটে সফলতার জন্য লড়াই না করে তারা নিজেদের পণ্যে ভ্যালু অ্যাড করে নানা অফার সাজাচ্ছে। এ কাজটা দক্ষতার সঙ্গে করতে পারলেই তারা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। সফল শিল্পী, ক্রীড়াবিদ, শিক্ষক, সাংবাদিক ও অনলাইন উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে এমন ধারা লক্ষণীয়। তারা প্রচলিত পদ্ধতিতে অগ্রসর না হয়ে বিদ্যমান সেবার সঙ্গে অনন্য কিছু যুক্ত করছে। ক্রেতারা ভ্যালু দেয় এবং প্রতিযোগীরা সহজে কপি করতে পারবে না—এমন কিছু অফার করছে। বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী সম্ভাব্য ক্রেতা হওয়ার সুযোগ থাকায় ভিন্নমাত্রায় কিছু অফার করলে প্রত্যাশিত সফলতা মিলছে।
অন্যদিকে বহু ট্র্যাডিশনাল প্রতিষ্ঠান খরচের ভারে নুয়ে পড়ছে। তাদের বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট বন্ধ করে দিতে হচ্ছে। সেক্ষেত্রে গুটিকয় অতি শক্তিশালী কোম্পানির হাতে ক্রমেই সব ব্যবসা চলে যাচ্ছে। আগামীতে জায়ান্ট কোম্পানিগুলোর বিপরীতে ক্ষুদ্র ও নতুন ব্যবসায়ীদের টিকে থাকা কঠিন হবে। সেক্ষেত্রে বড় কোম্পানিগুলোর পক্ষে অফার করা সম্ভব (বা লাভজনক) নয় এমন ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিস খুঁজে বের করার বিকল্প নেই। এর সহজ দৃষ্টান্ত হলো—প্রচলিত অ্যাপগুলো যখন তাদের যোগাযোগে অন্যদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে পারছিল না তখন ব্যবহারকারীদের গোপনীয়তার নিশ্চয়তা দিতে পারায় ‘হোয়াটসঅ্যাপ’ বিপুল জনপ্রিয়তা পায়।
এমনিভাবে ক্রেতাদের চাহিদা রয়েছে (কিংবা অভাব অনুভব করে) এমন বৈশিষ্ট্য থাকলে আপনার পণ্য কম প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়বে এবং টিকে থাকা সহজ হবে। মোটের ওপর কথা হলো, মুখোমুখি লড়াই করে উভয় পক্ষের রক্ত ঝরানোর প্রবণতা বাদ দিতে হবে। বরং এমন একটা দিক খুঁজে বের করতে হবে যা কেউ অফার করছে না। অথবা অন্যদের থেকে বেটার উপায়ে আপনি অফার করতে সক্ষম। সে হাতিয়ারকে যথাযথভাবে ব্যবহার করা গেলে সেটাই আপনাকে দিন শেষে বিজয়ী করবে। তবে প্রযুক্তির ক্রমাগত উন্নয়নের ফলে এখন কোনো বৈশিষ্ট্যই দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর থাকছে না। তাই প্রতিনিয়ত বিদ্যমান পণ্যে নতুন বৈশিষ্ট্য যোগ ও তার দক্ষ যোগাযোগে মনোযোগী থাকতে হবে। তা না হলে যেকোনো সময় আপনার অতি কার্যকর হাতিয়ারটিও ভোঁতা হয়ে যেতে পারে।
ফলে বিদ্যমান বৈশিষ্ট্য কাজে লাগিয়ে সুবিধা তুলে নেয়ার পাশাপাশি নিত্যনতুন বৈশিষ্ট্য উদ্ভাবন করতে হবে যা আপনাকে অন্যদের থেকে স্পষ্টভাবে এগিয়ে রাখবে। প্রচলিত কাঠামোয় ইন্ডাস্ট্রির আওতা আগে থেকেই কল্পনা করা হয়। তারপর সেখানে একটা পজিশন দখলের চেষ্টা চলে। অর্থাৎ বিদ্যমান মার্কেটে ভাগ বসানোর চেষ্টাটা মুখ্য থাকে। আর সে কারণে বেঞ্চমার্কিং অপরিহার্য হয়ে ওঠে। অর্থাৎ অন্য প্রতিযোগীরা যা অফার করছে আমাকে তার চেয়ে বেটার সামথিং করতে হবে—এমন ভাবনা প্রতিযোগীদের তাড়িত করে। কিন্তু ব্লু-ওশান স্ট্র্যাটেজিতে এটা জরুরি নয়। কারণ এখানে মার্কেট শেয়ারের চেয়ে ‘ভ্যালু ইনোভেশন’কে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। সেটা দক্ষতার সঙ্গে করা সম্ভব হলে ক্রমাগতভাবে মার্কেটের আওতা বাড়তে থাকে।
অর্থাৎ বিদ্যমান কম্পিটিশনের ধারণাটি অকার্যকর হয় কিংবা নতুন বৈশিষ্ট্য যুক্ত হওয়ায় (ভ্যালু অ্যাডিশনের মাধ্যমে) সব সময় নতুন কিছু ক্রেতাকে আকৃষ্ট করা সম্ভব হয়। সেক্ষেত্রে ডিফারেন্সিয়েশন বা কস্ট লিডারশিপের কোনো একটা পথই বেছে নিতে হবে—তা জরুরি নয়। বরং নতুন কোনো আঙ্গিকও যুক্ত হতে পারে। সে বিষয়ে আরেকদিন বলা যাবে।