পোস্টস

গল্প

সমুদ্রের দাঁত

২০ মে ২০২৪

রিপন হালদার


বালিতে পা গেঁথে গেঁথে যাচ্ছে। ঢেউগুলির চোয়াল হাঁ করে তেড়ে আসতেই জল থেকে গুটিয়ে নিচ্ছে পা, বালি থেকেও। রোদের তাঁবু মাথার উপরে নিয়ে করাতের ফালির মত ধুঁধু উপকূল দিয়ে সাবধানে পা ফেলছে ওরা। এখান থেকে মনে হচ্ছে সমুদ্র পাড়ের শেষ অংশটা যেন মিশে গেছে আকাশের সাথে। নিচে সমুদ্র আর উপরে আকাশ। এর নিচে ওরা দুজন।

সমুদ্রে এসেছে বেশ কয়েকদিন হল। কত, তাও পাঁচ-ছয় দিন! পুজোর ছুটি ফুরবে ফুরবে। এবার বাড়ি ফিরতে হবে।

সায়ন আপত্তি করে, আর মাত্র দুটো দিন! এই নতুন স্পটে এইরকম আবহাওয়া। আর পাবি তুই?

--ভাই! বেসরকারি চাকরি! সময় মত জয়েন না করতে রেপুটেশন খারাপ হবে। বোঝ একটু !

--কী আর হবে! দুই দিনের মাইনে কেটে নেবে, তাই তো! তা এইরকম আদিম পরিবেশের জন্য তুই দুটোদিনের স্যালারি স্যাক্রিফাইস করতে পারবি না?

--নারে ভাই। প্রবলেম হবে। নতুন ক্লায়েন্টকে টাইম দেওয়া আছে।

এক মুহুর্ত ভাবল সায়ন। মুখ ফেরালো সমুদ্রের দিকে। দূর সমুদ্রের উচ্ছ্বাস ওর চোখে জীবন্ত প্রতিবিম্ব গড়ে তুলেছে। তারপর হঠাৎই সুকল্পের দিকে ফিরে বলে, তুই তাহলে চলে যা!

সুকল্প আঁতকে ওঠে সায়নের চোখের দিকে তাকিয়ে। তখনো সমুদ্রের ছবিদুটো ওর চোখে জ্বল জ্বল করছিল চিতাবাঘের মত।

--তুই একা থাকবি এখানে?

--আরেকবার ভেবে দ্যাখ! এই নির্জন দ্বীপে তুই একা থাকবি?

--একা কেনো? দেখলি না রিসর্টে দু-তিনটি ফ্যামিলি আছে। তাছাড়া রিসর্টের কর্মচারীরা রয়েছে।

--ফ্যামিলিগুলো কিন্তু আজই চলে যাচ্ছে!

--তুই অতো ভাবিস না তো! এই একা থাকার জন্যই এখানে আসা!

--ওকে ডান্! সাবধানে থাকিস! দুপরেই রওনা দিচ্ছি আমি তাহলে!

দুপুরের পর একা হল সায়ন। বিকেলে জানা গেল রিসর্টের ফ্যামিলিদুটোও চলে গেছে। চারজন কর্মচারী আর সায়ন এখানে। আয়লার পরপরই নাকি হঠাৎ করে বঙ্গোসাগরের বুকে এই দ্বীপের আবির্ভাব। একদম নতুন স্পট। তাই সেভাবে ভিড় বাড়েনি। অল্পকয়েকজনই ইন্টারনেটে দেখেছিল বিজ্ঞাপনটা। কাকদ্বীপ থেকে প্রায় চার ঘন্টা লঞ্চে করে এখানে আসতে হয়।

বিশেষ একটা জায়গা আছে এখানে। যেটা সম্ভবত সায়ন আর সুকল্পই আবিষ্কার করেছে। কোনো মানুষের পায়ের ছাপ দেখেনি তাই ওদের এটা মনে হয়েছিল যে ওরাই প্রথম। এতদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই জায়গাটাতেই ওরা কাটিয়েছে। নেশাগ্রস্তের মত লেগেছিল ওদের। সুন্দরী গাছের ঘন জঙ্গলের ভিতরে হাঁটতে হাঁটতে একদিন ওরা দেখে সুড়ঙ্গ পথটা। দিনের বেলাতেই যথেষ্ট অন্ধকার। মোবাইল টর্চ অন করে ওরা সেদিন ঢুকেছিল সেখানে ভিতরে অনেকটা পথ। সুকল্প ভয় পেয়েছিল বেশি। সায়ন ছিল অবিচল। আমি তো আছি! যা হবে দেখা যাবে। একদম প্যানিক করবি না। সায়ন বুঝিয়েছিল। ওটা আর যেন শেষই হচ্ছিল না। এভাবে কতক্ষণ মাটির নিচে সুড়ঙ্গ পথে হাঁটা যায়। একসময় দেখবি পাতালে পৌঁছে গেছি! অবশ্যই এটা কোথাও না কোথাও গিয়ে উঠেছে। সায়ন বোঝাতে থাকে।

সেদিন আর শেষটা দেখা হয়নি ওদের। সুকল্পের আপত্তিতে মাঝপথেই ফিরে আসতে হয়েছিল। তখনই সায়ন হয়ত মনে মনে চাইছিল সুকল্প এখান থেকে চলে যাক। রিসর্টের কাউকে বলার প্রশ্নই ওঠে না। এটা সায়নের আবিষ্কার।

পরদিন সকালের টিফিন সেরে সারাদিনের মত খাবার, জলের বোতল ব্যাগে ভরে নিল সায়ন। কালো জিন্সের উপর মেরুন টিশার্ট আর মাথায় ক্যাপ চোখে সানগ্লাস। একদম ডিসকভারির বিয়ার গ্রিলস।

সমুদ্রের পাশ দিয়ে অনেকটা পথ হাঁটতে হাঁটতে খুব নিঃসঙ্গ বোধ হল ওর। এই বিশাল উপকূল জুড়ে শুধু ও একা হেঁটে চলেছে। তীব্র রোদ সমুদ্রের স্বচ্ছ জল ফুঁড়ে নেমে গেছে নিচে। তলদেশের কিছুটা দেখাও যাচ্ছে। ঝিনুক, কাঁকড়া স্থির হয়ে আছে বালির উপর। লাল কাঁকড়াই বেশি। হঠাৎ বালির গর্ত থেকে উপরে উঠে আবার কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। জুতোর পাশে এসে সশব্দে আছড়ে পড়ছে সমুদ্রের ঢেউ। কোনো অতিকায় প্রাণির তরল জিভের মত যেন ওকে লেহন করে আবার ফিরে যাচ্ছে আগের স্থানে। হাওয়ার শোঁ শোঁ শব্দ একটানা ওর কানের পাশে জমাট বাধা অবস্থায় রয়ছে। শব্দটা সরছে না একটুও। কমবেশিও হচ্ছে না। একই রকম স্থির।

দাঁড়িয়ে পড়ল সায়ন। এখানেই তো ছিল সুড়ঙ্গটা কোথায় গেল! রাস্তা কী ভুল করে ফেলল! আরো ভাল করে খুঁজে দেখল চারপাশটা! তারপর বেশ কিছুক্ষণ এদিকওদিক ঘুরতে ঘুরতে শেষে খুঁজে পেয়েই গেল সুড়ঙ্গটা। দ্বিধাহীনভাবে ঢুকে পড়ল সায়ন। একসময় অন্ধকার এত ঘন হয়ে গেল যে টর্চ জ্বালাতে হল। সেভাবেই এগিয়ে চলল। পথটা কখনো ডান কখনো বাম দিকে সাপের মত এঁকে বেঁকে চলল। আদিম প্রকৃতির থ্রিল সায়নের দেহ মনে।

কতক্ষণ হেঁটেছিল মনে নেই। ঘড়ি দেখার কথা মনে ছিল না। পথটা একসময় মনেহল খাঁড়া গভীরে নেমে গেল। পাহাড় থেকে নিচে নামার মত। অন্ধকার একসময় আরো গাঢ় হয়ে পাথরের মত শক্ত দুর্ভেদ্য আবরণে ছেয়ে গিয়েছিল সুড়ঙ্গ পথটা। বেশ কিছুক্ষণ ঐভাবে চলার পর পথ আবার উঠতে থাকল উপরে।

শেষ পর্যন্ত যেখানে শেষ হল পথটা। সায়ন দেখল সমুদ্রেরই পাড় একটা। পথটা পাতাল থেকে যেন হঠাৎ করে ফুঁড়ে উঠেছে উপরে। যে স্থান থেকে এসেছিল মনে হচ্ছে সেখানেই পুনরায় ফিরে এসেছে। তেমন কিছু বিশেষত্ব নেই শুধু নিঃসীম একাকীত্ব ছাড়া। ক্লান্তিতে বসে পড়ল বালির উপরে। চোখ দূর সমুদ্রে। জল আর আকাশ যেখানে মিলেমিশে এক আকার। একসময় ওর মনে হল, ও যেন এই সমুদ্র, অগাধ জলরাশি, বালির ভঙ্গুরতা আর উপরে আচ্ছাদিত উদার নীল আকাশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আরো কিছু মুহূর্ত স্থিরভাবে কাটানোর পর মনে হল সময় যেন এখানে স্তব্ধ, স্থির হয়ে আছে। কিছুটা হতাশ হল সায়ন। সুড়ঙ্গ পথটা শেষ পর্যন্ত সমুদ্রের পাড়ে উঠে আসাটা ও হয়ত আশা করেনি।

একটু পর উঠে দাঁড়াল। শ্বাস নিল বুক ভরে। চারপাশের শূন্য দিগন্তে ওর দৃষ্টি যেন লেহন করে চলেছে।

কিছু একটা দেখা যাচ্ছে যেন দূরে। কৌতূহলী হল সায়ন। ছায়ার মত দুটো অবয়ব সমুদ্র পাড়ে ফিসফিস করে কী যেন বলছে। আরো কাছে গিয়ে শোনার চেষ্টা করল ওদের কথা-

--"ভাই! বেসরকারি চাকরি! সময় মত জয়েন না করতে রেপুটেশন খারাপ হবে। বোঝ একটু!

--কী আর হবে। দুই দিনের মাইনে কেটে নেবে, তাই তো! তা এইরকম আদিম পরিবেশের জন্য তুই দুটোদিনের স্যালারি স্যাক্রিফাইস করতে পারবি না?”

অবাক বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে সায়ন। আর কথাবলা অবয়বদুটো এগিয়ে চলে আরো দূরে দিগন্তের কাছাকাছি। কারো পায়ের শব্দে পিছন ফিরে দেখে আরো দুজন। একই কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসছে। তাদের কেউ সায়নের দিকে তাকাচ্ছেও না। যেন সায়নের কোনো অস্তিত্বই এখানে নেই! তাদেরও গন্তব্য সেই দিগন্তের কাছাকাছি। এভাবে অনেকগুলি জোড়া অবয়ব ঐ দিকে হেঁটে চলেছে শৃংখলাবদ্ধ অবস্থায়। তাড়াতাড়ি ব্যাগ থেকে বাইনাকুলারটা বের করল সায়ন।

মানুষের মতই দেখাচ্ছে অবয়বগুলো। তবে আগের থেকেও স্পষ্ট এখন। আর বিস্ময়কর ভাবে লক্ষ্য করল সুকল্পের অনেকগুলো প্রতিবিম্ব। একজায়গায় স্থির হয়ে গেল ওরা। একটুও নড়াচড়া করছে না। মনে হচ্ছে ওরা কোনোদিন এখান থেকে নড়েইনি। আদিমকাল থেকে এখানেই আছে বালিতে পা ডুবিয়ে স্থির হয়ে। ভাস্কর্যের মত দেখাচ্ছে।

কয়েকটা প্রশ্ন সায়নের দেহ ফুঁড়ে ফেটে উঠে এল, “আসলে এরা কারা? কোথা থেকে এল? দাঁড়িয়ে আছে কেন এভাবে?"

বাইনাকুলারটা ব্যাগে ঢুকিয়ে চেন আটকালো। মাথা ঘুরছে ওর। ব্যাগের খোপ থেকে জলের বোতল বের করে দুঢোক খেল। বাকিটা ঢেলে দিল মাথায়। প্লাস্টিকের বোতলটা বালির উপর ফেলে দিতেই দেখল কচ্ছপের মত জীবন্ত হয়ে ধীরে ধীরে নেমে গেল সমুদ্রের জলে। আর ঝাঁকে ঝাঁকে অজস্র ছোট-বড় মাছ জলের নিচ থেকে তীব্র বেগে লাফ দিয়ে উঠে আসছে উপরে। তারপর হঠাৎ ডানা বেড়িয়ে গিয়ে তারা পাখি হয়ে উড়ে যাচ্ছে শূন্যে....

একটা ভাবনা আস্তে আস্তে সায়নের মনে জমাট বাঁধছে যে, এখানে আর এক মুহুর্তও থাকা যাবে না। পাশ ফিরতে যাবে এমন সময় ঘটল বিপত্তি। নড়া যাচ্ছে না একটও। পাদুটো যেন ভারি হয়ে আটকে আছে। যেন আস্তে আস্তে গেঁথে যাচ্ছে বালির নিচে। তাহলে কী চোরাবালি। কিন্তু একটু পর হাঁটুর নিচ অবধি গেঁথে স্থির হয়ে গেল। আর নামছে না। এবার কী হবে! ছটফট করছে পা ওঠানোর জন্য। কিন্তু পারছে না। চিৎকার করছে জোরে। সমুদ্রের জলও কেঁপে যাবে এমন চিৎকার। অবশ্য কোনো ফল হল না তাতে। কয়েক মুহুর্ত পর বিশাল এক সমুদ্রের স্রোত বিরাট তরল জিভের মত ওকে চেটে দিয়ে চলে গেল। আঠার মত চটচটে কী যেন লাগল গায়ে। পর মুহুর্তেই স্রোতটা আবার সরে গেল দূরে। ওটা কী ঢেউ ছিল না অন্য কিছু!

অনেক্ষণ পর ক্লান্ত বিষণ্ণ হতাশাগ্রস্ত সায়ন ঘাড় কাত করে সেই দিগন্তের দিকে চেয়ে থাকল শুধু। ওকি মরে যেতে চলেছে! না কি ইতিমধ্যে মরে গেছে। ওর চেতনা কী দেহের বাইরে চলে এসেছে!

দিগন্তের সেই দিকেই তাকিয়ে থাকল সায়ন ভীত অসহায় ভাবে। দুপুর গড়িয়ে গেলেও কেউ ওর খোঁজ করতে এল না। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে উপকূল আর দিগন্তের আকাশ বিরাট দুটো চোয়ালের মত হাঁ করে আছে। আর নিচের চোয়ালে মানুষের মত অজস্র অবয়ব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দাঁতের মত দাঁড়িয়ে আছে, স্থির।