দ্বিতীয় পর্ব
এলাকার নতুন মেম্বর কাফিলউদ্দিন খাঁ। বড়বাজারে ব্যাবসা করেন। নতুন মোল্লা হইছেন। এ বাড়ি ও বাড়ি দাওয়াত খেয়ে বেড়ান। এ দেশে মোল্লা হইতে বেশি কিছু লাগেনা। লম্বা জামা আর দাঁড়ি টুপি পইরা যে কেউ মোল্লা হইতে পারে। শুধু যে পারে তা না, দিব্যি মানুষকে ফতোয়া দিয়ে বেড়ানো যায়। বিশেষ ব্যাক্তিগত ঝগড়াঝাটি ছাড়া পূর্বাপর ইতিহাস মানুষ তেমন আওড়ায়না। ঝগড়া হইলে আবার রক্ষা নাই। জীবনে ইস্কুল মাদ্রাসার বারান্দা দিয়ে না হাঁটা কাফিলউদ্দিন খাঁ টাকার জোরে হঠাৎ গণ্য মান্য ব্যাক্তি। সদ্য জ্ঞান যতটুকু তা ওই মাহফিলে মাহফিলে হুজুরদের মুখ থেকে শোনা কথা৷ সেখানেই কোন হুজুর বলছিলেন যারা গান-বাজনা করে তারা হইলো সাক্ষাৎ শয়তান। সমাজ থেকে এদের প্রতিহত করতে হবে৷ কথাটা সদ্য দ্বীনদার কাফিলউদ্দিন খাঁর বুকে গিয়া লাগলো। মনে পড়ে গেলো তারই প্রতিবেশি জমিরউদ্দীন বাউলের কথা। জীবনের অর্ধ বয়স তার গান শুনে এলেও আজ তাকে মনে করে ঘেন্না হতে লাগলো কাফিলউদ্দিন খাঁর। ব্যাটা আচ্ছা শয়তান, সারাদিন রাত গান-বাজনা করে। সাথে সাথেই প্রতিজ্ঞা করে ফেললেন মেম্বর সাহেব, যে করেই হোক তার সমাজ থেকে এ শয়তানকে উচ্ছেদ করতে হবে। যেই ভাবা সেই কাজ, পরদিন সকালে গ্রামের দোকানে গিয়ে দলবল নিয়ে হাজির মেম্বর সাহেব। ঘোষনা করলেন আজ থেকে গ্রামে কোন গানবাজনা হবেনা। কেউ যদি গান-বাজনা করে তবে তার জন্য কঠোর শাস্তির বিধান। উপস্থিত হিন্দু-মুসলিম সকলেই মেম্বরের কথা শুনে হতভম্ব। জমিরউদ্দীন বাউল নিয়ে লোকজনের মাঝে কানাঘুষা শুরু হতেই কফিলউদ্দিন খাঁ খোলাসা করে দিলেন,
-জমির চাচারে বলে দিবেন তিনি যেনো আর গান বাজনা না করেন।
দিনমজুর জামাল মোস্তফা আস্তে করে বলে উঠলেন,
-কিন্তু ভাই গান বাজনা করলে ক্ষতি কি? বাউল চাচাতো কাউরে বিরক্ত করেনা।
সাথে সাথেই কাফিলউদ্দিন খাঁর হুংকার,
-ব্যাটা শয়তানের বাচ্চা, ঠিক বেঠিক আমারে শেখাবি তুই? আমি গ্রামের মেম্বর। আমি কি তোর চাইতে কম বুঝি হারামজাদা?
কেউ আর টু শব্দ করার সাহসটুকুও পেলোনা। সন্ধ্যা বেলা দোকানদারের কাছে এ সংবাদ শোনার পর মাথায় যেনো আকাশ ভেঙ্গে পড়লো জমিরউদ্দীন বাউলের।
-গান করুমনা? এ কেমন কথা? বাঁচমু কেমনে তাইলে? গানই যে আমার তিন বেলার খাওন!
-চাচা আপনে চিন্তা কইরেননা। মেম্বর মনে হয় কোন কারনে রাগ। দুই চারদিন একটু ধৈর্য ধরেন, সব ঠিক হইয়া যাবে।
-তাই যেনো হয়, তাই যেনো হয়। একটা বিড়ি দাওতো বেনু।
বেনু দোকানদারের নাম। বাড়ি গ্রামের হিন্দু পাড়ায়৷ মুড়ির ব্যাবসা আর এই ছোট্ট দোকান। বাউল চাচার সবচেয়ে বড় ভক্তদের মধ্যে একজন। মেম্বরের এমন হঠকারী সিদ্ধান্তের আগা মাথা সেও খুঁজে পায়না৷ যেই মেম্বর দুইদিন আগেও বাউল চাচারে দেখলেই গানের বায়না ধরতো আজ তার কি হলো এ ভেবে কুল পায়না বেনু।
দিন দিন করে দু সপ্তাহ পেরিয়ে যায়, গাঁয়ে আর কোন আসর বসেনা। বেনুর দোকান যেনো এখন খাঁ খাঁ করে৷ দুই তিনদিন অন্তর অন্তর সন্ধ্যাকালীন বাউল চাচার আসর যেনো এই দোকানের প্রান ছিলো। ছেলে বুড়োদের আড্ডায় দোকান কানায় কানায় পরিপূর্ণ থাকতো। শুধুমাত্র বাউল চাচার আসরের জন্য বেনু দোকানে অতিরিক্ত কিছু বেঞ্চ রেখেছিলো মানুষ বসাবার জন্য। সামান্য চা সিগারেট আর চানাচুর-বিস্কুট ছাড়া দোকানে তেমন কিছু পাওয়া যায়না। কিন্তু আসরের দিন তাতেই যেনো বেনুর কপাল খুলে যেতো। বাউল চাচা আসে কিন্তু গান করার সাহস করেনা। একদিন বেনুর পীড়াপীড়িতে ভর দুপুরে গান ধরে জমিরউদ্দীন বাউল। খবরটা মেম্বরতক পৌঁছুতেই তিনি দলবল নিয়ে হাজির।
-শালা মালাউনের বাচ্ছা, তোর গান শোনার সখ হইছে না?
বলেই বেনুর দোকানে ঝাপিয়ে পড়লেন কাফিলউদ্দিন খাঁ। চড় থাপ্পড়ে গাল মুখ লাল করে দিয়ে ফিরলেন জমিরউদ্দীন বাউলের দিকে। ওই মিয়া আপনারে কইছিনা এই গ্রামে গান-বাজনা বন্ধ? এক ঠ্যাং তো কবরে তাও গানের নেশা যায়না? এইবার শুধু মুরুব্বি বইলা ছাইড়া দিলাম, নইলে.....
জমিরউদ্দীন বাউল এর চেয়ে বেশি কথা আর হজম করতে পারলেননা।
(পরবর্তী পর্ব পেতে লেখকের প্রোফাইলে দেখুন)