ভারত এক বিশাল দেশ। কত ভাষা, কত সংস্কৃতি, কত জাতি, কত ধর্মের লোক বাস করে এই দেশে। কিন্তু কিভাবে এত বিশাল একটি রাষ্ট্র গঠিত হল এটা কি আমরা জানি। কত মানুষের স্বপ্ন বিলীন হয়েছে এই রাষ্ট্রের মাঝে। তারা ভালোবাসায় তাদের দেশের বিশালতা বাড়িয়েছে না আগ্রাসন করে জয় করেছে। তাই আজ আলাপ করি।
আজকের দিনে ভারতের যে চেহারা আমরা দেখি স্বাধীনতার সময় এমন ছিল না। নানান ষড়যন্ত্র, নানান যুদ্ধ, নানান বদল এবং সংযুক্তিকরণের মধ্যে দিয়ে ভারত তার আজকের রূপ লাভ করে। এর পিছনে আছে কত শত হত্য, কত যুদ্ধ। ভারত নিজেই ব্রিটিশ উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলন করে স্বাধীন হলেও তারা নিজেরাই অনেক স্বাধীন দেশ দখল করে। নব্য উপনিবেশ স্থাপন করে। নিজেরাই অন্যের স্বাতন্ত্র্যতায় বিশ্বাসী না। আমরা কথাই কথাই বলে থাকি ভারতবর্ষ ধর্মের ভিওিতে বিভাজিত হয়েছে। কিন্তু এটা পূর্ণ সত্য নয়। ভারত যদি শুধু ধর্মের ভিওিতে বিভাজিত হতো, তাহলে কেন পুরো কশ্মীর, পুরো বাংলা, পুরো পাঞ্জাব পাকিস্তানের নয়। কেন তাদের বিভক্ত করা হলো। তারা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট ছিল। ভারত স্বাধীনের বছর খানেক সময় পিছিয়ে যাওয়া যাক। স্বাধীনতার প্রাক্কালে দেশের অবস্থা তখন অগ্নিগর্ভ। দেশভাগ নিয়ে দুই শীর্ষস্থানীয় নেতা নেহেরু এবং জিন্নার মাঝে মতানৈক্যের আগুন জ্বলে উঠল।কিন্তু ব্রিটিশ যত দ্রুত সম্ভব ক্ষমতা হস্তান্তরের করতে চেয়ে ছিল। তবে দেশভাগের ক্ষেত্রে আরও একটি বড় সমস্যা দেখা দিল। কারণ ভারতবর্ষকে ব্রিটিশরা প্রধানত দুইভাবে শাসন করত।একটা অংশ তারা প্রত্যকভাবে শাসন করত। বাকী অংশগুলো তাদের অধীনে অর্থের বিনিময় স্বাধীন রাজ্য হিসেবে পরিচালিত হত। আবার রাজ্যগুলোর স্বাধীনতার মাত্রার মাঝে অনেক তারতম্য ছিল। কোন রাজ্য বেশি স্থায়িত্বশাসন কোনো রাজ্য কম স্থায়িত্বশাসন ভোগ করত। ব্রিটিশরা তাদের শাসিত রাজ্যগুলো ভারত ও পাকিস্তানের মাঝে সরাসরি ভাগ করে দিল। কিন্তু স্বাধীন রাজ্যগুলোর সিদ্ধান্ত রাজ্যগুলোর উপরই রাখা হলো। তখন সব মিলিয়ে বিভিন্ন প্রান্তে ৫৬৫টি এমন রাজ্য ছিল। সবমিলিয়ে অবিভক্ত ভারতবর্ষের ৪৮ শতাংশ আয়তন এই রাজ্যগুলোর ছিল। তৎকালীন ভারতীয় জনসংখ্যার ২৮ শতাংশ মানুষে বসবাস এই অঞ্চলে। ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা পাকাপাকি হল ১৯৪৭ এর ১৫ আগষ্ট। এই রাজ্য গুলোর সামনে রাখা হলো ৩ টি রাস্তা। হয় রাজ্যগুলো ভারতের সাথে যুক্ত হবে নায়তবা পাকিস্তানের সাথে। এছাড়া রাজ্যগুলোকে আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন সুযোগ রাখা হয়।শুধুমাত্র এ রাজ্যের জনগণই তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারের কথা বলা হয়। কিন্তু এটা পর্দার সামনে।পেছনে মাউন্টব্যাটেন, প্যাটেল এবং আমলা ভি পি মেনন এই ত্রয়ী শক্তির মুখোমুখি হয়ে এই রাজ্যগুলোর রাজারা দেখলেন তাদের সামনে নড়াচড়ার খুব বেশি সুযোগ নেই। তাদের বলা হলো আপনারা ভারতে যোগ দিন, যোগ দিলে প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্রনীতি এবং যোগাযোগ এই তিন বিষয় ছাড়া বাকি সব ক্ষেত্রে আপনাদের নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকবে, আপনাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারগুলোতে ভারত হাত দিবে না।কিন্তু যদি তারা এটা করতে অস্বীকৃতি জানায় তাবে রাজাদেরকে তাদের প্রজাদের হাতে উৎখাত হবার ঝুঁকি নিতে হবে এবং কেউ তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে না। সমূহ বিপদের আশংকা এবং নিজেদের অসহায়তা বুঝতে পেরে বেশির ভাগ রাজাই ভারতে যোগদানের চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেন এবং অধিকাংশ রাজ্যই ভারতের সাথে যুক্ত হয়। অল্প কয়েকটি পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হয়। তবে কিছু রাজ্য তারপরেও স্বাধীন হয়ে থাকতে চাইল। যাদের নিজস্ব শক্তিশালী সেনাবাহিনী, প্রশাসন ছিল। যার মধ্যে ত্রিবাঙ্কুর, ভোপাল, হায়দ্রাবাদ, কাশ্মীরউল্লেখযোগ্য। ভারত কিংবা পাকিস্তান কোনো দেশেরই অন্তর্ভুক্ত হতে চাই না রাজ্যগুলো। তাছাড়া সিকিম ও তার স্বাধীনতা বাজায় রাখতে চাইল। আবার ব্রিটিশ শাসকরা ভারতবর্ষ থেকে বিদায় নিলেও পর্তুগিজ উপনিবেশ রয়ে গিয়েছিল ভারতে। স্বাধীন হওয়ার পর ভারত এইসব রাজ্যের স্বাধীনতা হরনের কৌশল শুরু করে। যারা নিজেরাই হয়ে উঠল আরেক ভারতরাজ। একে একে ভোপাল, যোধপুর নিজেদের মাঝে সংযুক্ত করে।হায়দরাবাদ, সিকিমের স্বাধীনতা হরন করে।পর্তুগিজদের যুদ্ধে পরাজিত করে ভারতবর্ষ থেকে বিদায় করে। তারা যেন এক আগ্রাসী রূপ ধারন করে। সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল আর মেনন হয়ে উঠে রাজ্য দখলের রাজা। আধুনিক কালের ইতিহাসে পৃথিবীতে এত অল্প সময়ে এত অঞ্চল দখলের নজির দেখা যায় না। এক সদ্য স্বাধীন দেশ যেন এক পরাক্রমশালী সাম্রাজ্য গড়ে তুলে। কোথাও যুদ্ধ, কোথাওবা ষড়যন্ত্র। আমরা অনেকই জানি ভারতের তার নিজের প্রতিবেশী রাষ্ট্রদের সাথে সম্পর্ক তেমন ভালো না। পাকিস্তান তার জন্ম শত্রু। মালদ্বীপে ভারত বিরোধী সরকার ক্ষমতায়, বাংলাদেশের জনগণের মনেও ভারত বিরোধিতা প্রবল। নেপালের সাথে তাদের বর্ডার বিরোধ দেখা যায়। শ্রীলঙ্কাও চীন মুখী। ভুটান ও ধীরে ধীরে চীনের সাথে সম্পর্ক বাড়াচ্ছে। মিয়ানমারত চীনের একেবারে মিত্র শক্তি। ভারতের সাথে এইসব দেশগুলোর সম্পর্ক ভালো না হওয়ার কারণ কি ভারত একবার চিন্তা করে। এই রাষ্ট্রগুলোর জনগন ভারতের এই আগ্রাসী মনোভাব জানে। তাই তারা নিজেদের সার্বভৌমত্ব হারানোর ভায় পাই। ভারতের কিছু নেতারা সামনাসামনি অখণ্ড ভারতের আওয়াজ তুলেছে। সংসদ ভবনে পর্যন্ত এই মানচিত্র স্থাপন করেছে। আর বর্তমান ক্ষমতাসীন বিজেপি দলের মাতৃ সংঘটনের ঘোষিত নীতিই ত অখণ্ড ভারত। তাই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মানুষগুলো সর্বদা সর্তক থাকে।
সিকিম : স্বাধীনদেশের পরাধীন হওয়ার গল্প
সিকিম ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চল অবস্থিত একটা রাজ্য। যা একসময় স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল।কিন্তু কিছু ব্যক্তির বিশ্বাসঘাতকতার জন্য সিকিম তার স্বাধীনতা হারায়। ১৬৪২ সালে সতন্ত্র সিকিম রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথম চোগিয়াল দ্বারা নামগিয়াল রাজবংশ সূচনা হয়েছিল। কিছুকাল পরে ভারতে ব্রিটিশদের শাসন শুরু হয়। তিব্বতের সাথে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার জন্য ব্রিটিশদের নজর পরে সিকিমের দিকে। ব্রিটিশদের সাথে সিকিমের সামরিক পরাজয়ের পরে অ্যাংলো-সিকিম চুক্তি হয়। চুক্তির ফলে সিকিম ব্রিটিশদের অধীনে একটি রাজকীয় রাজ্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। একজন ব্রিটিশ রাজনৈতিক অফিসারকে সিকিমের প্রতিরক্ষা ও বিদেশী বিষয়গুলোতে চোগিয়াল প্রশাসনকে সহায়তা করার জন্য নিযুক্ত করা হয়। ফলে তারা রাজ্যের ভার্চুয়াল শাসক হয়ে যায়। কিন্তু ব্রিটিশরা চৌগিয়ালদের কখন উচ্ছেদ করেনি। বরং চৌগিয়ালরা নিজেদের সেনাবাহিনীসহ সিকিমকে আধুনিকীকরণের চেষ্টা করতে থাকে।তারা মোটামুটি স্বাধীনভাবেই রাজ্য শাসন করতে পারত। এমনকি রাজা জর্জ পঞ্চমের সাথে সিডকং এর একটা ভালো পরিচয় ছিল। তাই সিডকং ক্ষমতা গ্রহনের পরে বিস্তৃত সার্বভৌমত্বের ব্যবস্থা করে। ব্রিটিশরা যখন ভারত ছেড়ে চলে যায় তখন সিকিমকে নিজেদের মত সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ দেয়া হয়। সিকিম রাজা চিন্তা করলেন তিনি স্বাধীন থাকবেন, তবে ব্রিটিশদের মত ভারত সিকিমের কিছু বিষয়ে সহয়তা করবে। বিনিময়ে ভারত সিকিমকে স্বাধীনতার গ্যারান্টি দেয়। এমনকি সিকিমকে ভারতীয় ইউনিয়নে যোগদানের জন্য একটি ভোটে জনগণ ভারতে যুক্ত না হওয়ার ফল জানায়। তাই ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু একটি বিশেষ ব্যবস্থা করেন সিকিমের সুরক্ষার জন্য। ১৯৫০ সালে ইন্দো-সিক্কিমিজ চুক্তিতে, সিকিমকে স্বাধীনভাবে পরিচালিত হওয়ার সুযোগ দেয়া হয় এবং ভারত শুধু সিকিমের বাহ্যিক সম্পর্ক, প্রতিরক্ষানীতি পর্যবেক্ষণের সুযোগ লাভ করে। বিপরীতে ভারত সিকিমের যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণের সুযোগ পায়। অনেকটা ভুটানের মত।১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধের পর ভারতের কাছে সিকিমের গুরুত্ব আর বেড়ে যায়। শাসক তশি নামগিয়াল ১৯৬৩ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। চৌগিয়াল প্যালডেন থন্ডুপ নামগিয়াল ১৯৬৫ সালে সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন। ভারত সিকিমের স্বাধীনতা হরনের জন্য তাদের ঠান্ডা মাথার বুদ্ধির প্রয়োগ শুরু করে। ভারতের পরামর্শে সিকিমে জনগণের ভোটাধিকার দেয়া হয়। ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার পর থেকেই সিকিমে রাজনৈতিক দল তৈরি হতে শুরু করেছিল। ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনী তাদের মিশন শুরু করে দেয়। তারা সিকিমে রাজতন্ত্র বিরোধী মনোভাব প্রবলভাবে ছড়াতে থাকে। গোয়েন্দারা নিজেদের বিশ্বস্ত কিছু রাজনৈতিক নেতা তৈরি করে। নেতারা পূর্ণ রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং অধিকার পাওয়ার জন্য প্রচারণা চালাতে থাকে। চেগিয়াল আন্দোলনকে দমন করার চেষ্টা করতে থাকেন। ১৯৫৫ সালেই সাংবিধানিক সরকারের আদলে স্টেট কাউন্সিল গঠন করা হয়েছিল। এটাই তাদের জন্য কাল হয়। ১৯৭০ সালে রাজতন্ত্রবিরোধী সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেস পার্টি র্নির্বাচিত হয় এবং তিনি নেপালি জনগোষ্ঠীর অধিকতর প্রতিনিধিত্ব দাবি করে। নয়াদিল্লি উদ্বিগ্ন ছিল সিকিমের স্বাধীন সত্তার বিষয়ে। ভুটানের পথ ধরে সিকিম যদি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে জাতিসঙ্ঘের সদস্যপদ লাভ করে তবে নয়াদিল্লির পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবে না। তাই ইন্ধিরা গান্ধী দ্রুত কাজ শুরু করেন। ১৯৭৩ সালের ভোটের ফলাফলে অসন্তুষ্ট হয়ে সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেস ভোট কারচুপির অভিযোগ এনে দেশব্যাপী তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। যা পরে রাজতন্ত্র বিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়। যার নেপথ্যে ছিল ভারত। তারা সিকিমের নেপালি জনগন ও স্থানীয় লোকদের মাঝে বিভেদ ছড়িয়ে দেয়। নেপালিরা এখানের আধিবাসী ছিলনা। তারা নানা সময়ে সিকিমে অভিবাসীরূপে এসেছিল। এই নেপালি জনগন মূলত ভারতের সাথে যুক্ত হতে চাইতেন। সিকিম জনতা কংগ্রেস এবং সিকিম ন্যাশনাল কংগ্রেস একীভূত হয়ে রাজতন্ত্র বিরোধী আন্দোলন পরিচালনা করে। আধিপত্যবাদী ভারত এ সুবর্ণ সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। সেদিনটা সিকিমের জন্য ছিল অন্যরকম এক অন্ধকার যাত্রা। পাঁচ হাজার ভারতীয় সেনা রাজধানী গ্যাংটকে ঢুকে পড়ে। চেগিয়াল পালডেন ও সিকিমবাসীর জন্য সেটাই ছিল স্বাধীন রাজ্যের শেষ দিন। ভারতীয় সেনারা মুহুর্মুহু গুলি চালিয়ে প্রবেশ করে। ভারতীয় সেনারা রাজপ্রাসাদ ঘিরে ফেলে। রাজপ্রাসাদের ১৯ বছর বয়সী প্রহরী বসন্ত কুমার ছেত্রি ভারতীয় সেনাদের গুলিতে নিহত হন। আধা ঘণ্টার অপারেশনেই সকল প্রহরী আত্মসমর্পণ করে। প্রহরীদের কাছে থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে তাদের বন্দী করা হয়। সিকিমের রাজপ্রাসাদে উড়িয়ে দেয়া হয় ভারতীয় পতাকা। ইন্দিরা সরকার রাজার নিরাপত্তার কথা বলে ভারতীয় বাহিনী দ্বারা রাজাকে গৃহবন্দি করে রাখে। অল্পসময়ের মধ্যেই অপারেশন সিকিম সমাপ্ত হয়। বহির্বিশ্বের সাথে সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। ভারত সিকিমের ক্ষেত্রে দ্বৈত খেলা খেলে। এক দিকে চেগিয়াল লামডেনকে বলেছে, সিকিমে রাজতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে হবে। অপরদিকে লেন্দুপ দর্জিকে বলেছে যেকোনো মূল্যে রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করতে হবে। দখলের পরে ভারত সাজানো নির্বাচনের আয়োজন করে। ১৯৭৪ সালের তথাকথিত এই নির্বাচনে লেন্দুপ দর্জির দল ৩২টি আসনের ৩১টিতেই জয়লাভ করে। এ নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতার উপর ভর করে লেন্দুপ দর্জি নতুন প্রধানমন্ত্রী হন।চেগিয়াল আর লেন্দুপ দর্জির দা-কুমড়ো সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে ভারত পৃথিবীর মানচিত্র থেকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের মানচিত্র মুছে ফেলে।কাউন্সিল অব মিনিস্টারের নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী লেন্দুপ দর্জির ইচ্ছায় পার্লামেন্টে বিনা বিরোধিতায় রাজতন্ত্রের আনুষ্ঠানিক অবসান করা হয়। সিকিমের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে লেন্দুপ দর্জি ভারতীয় পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব করার এবং ভারতীয় ইউনিয়নে যুক্ত করার আবেদন জানান। তাই ১৯৭৫ সালের ১৪ এপ্রিল ভারতীয় সেনাদের ছায়ায় এক গণভোট হয়। যার ফলাফলে লেন্দুপের ইচ্ছার প্রতিফলন দেখানো হয়। ১৯৭৫ সালের ১৬ মে সিকিম সরকারিভাবে ভারত ইউনিয়নভূক্ত হয়। লেন্দুপ দর্জিকে করা হয় সিকিমের মুখ্যমন্ত্রী। একটি স্বাধীন দেশ হত্যা করে লেন্দুপ দর্জি প্রধানমন্ত্রী থেকে হলেন মুখ্যমন্ত্রী। চীন ছাড়া বেশিরভাগ রাষ্ট্র সিকিমের স্বাধীনতরা বিষয়ে আওয়াজ তুলেনি। হারিয়ে যায় এক স্বাধীন রাষ্ট্র।
ধনী রাষ্ট্রের পরাজয় গাঁথা : হায়দরাবাদ
ভারত স্বাধীন হওয়ার পরেও যে দেশীয় রাজ্যগুলো ভারতে যোগদান করতে অস্বীকার করেছিল, তারই অন্যতম ছিল হায়দারাবাদ । হায়দারাবাদের নবাবী শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ত্রয়োদশ শতকের শেষ দিকে। তখন থেকেই হায়দারাবাদকে কেন্দ্র করে শিল্প-সংস্কৃতির যে বিকাশ ঘটে, তা পুরো দাক্ষিণাত্যকে প্রভাবিত করেছিল। ১৮৬৮ সালে, হায়দ্রাবাদ রাজ্যটি ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত একটি রাজকীয় রাজ্য হিসাবে ব্রিটিশ ভারতের অংশ হয়ে ওঠে।হায়দ্রাবাদ রাজ্যের শেষ নিজাম, মীর ওসমান আলী খান, তার সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ছিলেন। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশের বিদায়ক্ষণেই হায়দারাবাদের ভাগ্য অনিশ্চিত হয়ে যায়। ব্রিটিশ সরকার রাজকীয় রাজ্যগুলোকে ভারত বা পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হওয়ার অথবা স্বাধীন থাকার বিকল্প প্রস্তাব করে। ভারতের স্বাধীনতার পর ,হায়দরাবাদের নিজাম ভারত বা পাকিস্তানে যোগদান করেননি। তারই প্রধানমন্ত্রী মীর লায়েক আলী তার বইয়ে লিখেন, এই সিদ্ধান্ত অনুসারেই হায়দারাবাদের নিযাম মাউন্টব্যাটেনের কাছে চিঠি লিখে জানিয়েছিল, হায়দারাবাদ ভারত বা পাকিস্তান কোন রাষ্ট্রেই যোগ দিবে না, সে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবেই থাকবে। এছাড়াও তিনি ব্রিটিশ কমনওয়েলথের একটি স্বাধীন রাজতন্ত্র হওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু ব্রিটিশরা তাতে রাজি হয়নি। ফলে তিনি হায়দ্রাবাদকে স্বাধীন রাজ্য ঘোষণা করেন। নিজামকে ভারতে যোগদানের জন্য ভারতের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর ভারত তার কাজ শুরু করে। তারা কিছু উগ্র জনগনকে উস্কে দেয়। তারা ভারতে যুক্ত হওয়ার জন্য আন্দোলন শুরু করে। আন্দোলন দমন করতে গিয়ে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। উভয়পক্ষই অনেক মানুষের উপর অত্যাচার করা। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ভারত সরকার একটি সামরিক অভিযান শুরু করে।আগ্রাসনের তারিখ নির্ধারিত হয় ১৩ই সেপ্টেম্বর ১৯৪৮। এ দিনটি নির্ধারণের পেছনেও একটি কারণ ছিল। কারণ মাত্র দু’দিন আগেই জিন্নাহ মারা যান। সমগ্র পাকিস্তান তখন শোকে আচ্ছন্ন। এ সময় হায়দারাবাদে অভিযান চালালে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে তেমন কোনো বাধা সৃষ্টি হবে না। আধুনিক অস্ত্রে সুসজ্জিত ভারতীয় বাহিনী হায়দরাবাদে প্রবেশ করে। তাদের সাথে হায়দরাবাদের সেনাবাহিনী টিকে থাকতে পারেনি। সেনাপ্রধান এল এলভিস বিশ্বাসঘাতকতা করেন। কাশেম রিজভীর নেতৃত্বাধীন দুই লাখ সদস্যের একটি স্বেচ্ছাসেবক দল ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সৃষ্টি করে। কিন্তু সেনাবাহিনীর সামনে এই অপ্রশিক্ষিত জনবল বিফল হয়।হায়দারাবাদ ভারতের পদানত হয়েছিল। মাত্র পাঁচ দিনের যুদ্ধে ৭০,০০০ হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়। লুটতরাজ, নারী ধর্ষণ এগুলো তো ছিলই। নিজাম ১৯৪৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর আত্মসমর্পণ করেন। পাকিস্তান এর বিরুদ্ধে আলোচনা তুললেও জাতিসংঘে এর আলোচনা পিছিয়ে যায়। হায়দরাবাদের স্বাধীনতাও অস্তমিত হয়। মীর লায়েক আলীর লেখা ‘The Tragedy of Hyderabad’ গ্রন্থে হায়দারাবাদের মানুষের সেই বেদনাঘন কাহিনীর বর্ণনা দেখতে পাওয়া যায়। মীর লায়েক আলী ছিলেন স্বাধীন হায়দারাবাদের শেষ প্রধানমন্ত্রী।
ভোপাল: স্টেট হতে জেলা হওয়া
ভোপাল ভারতের মধ্যপ্রদেশের একটি জেলা। যা একসময় স্বাধীন রাজ্য ছিল। মোঘল সেনাবাহিনীর আফগান যোদ্ধা দোস্ত মোহাম্মদ খান ১৭০৮ সালে বেরাসিয়া এস্টেট লীজ নিয়ে সাথে আরো কতগুলো এলাকা যুক্ত করে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ভোপাল নগরীকে। তার পরিবার ব্রিটিশদের অধীনে ভোপাল শাসন করত। নবাব হামিদুল্লাহ খান ১৯২৬ সালে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি ছিলেন ভোপালের সর্বশেষ নবাব । স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন সক্রিয় সদস্য। তবে স্বাধীনতার সময় তিনি তার রাজ্যের স্বায়ত্তশাসন বজায় রাখতে চেয়েছিলেন। ভোপাল ভারত বা পাকিস্তানের সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগদান করতে অস্বীকার করে। হামিদুল্লাহ খান ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে ভোপালকে পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে ধরে রাখার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু ভারতে প্রচেষ্টায় কিছু লোক ভারতে যুক্ত হওয়ার জন্য নবাবের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। যার ফলে নবাবের বাহিনী তাদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে এবং সহিংসতা দেখা যায়। সরদার প্যাটেল এই পরিস্থিতিটিকে কাজে লাগান। তিনি ১৯৪৯ সালে ভিপি মেননকে মার্জার চুক্তি আলোচনার জন্য প্রেরণ করেন। তাকে উচ্চেদের ভয় দেখিয়ে ভারত চুক্তিতে সই করতে বাধ্য করে। নবাব ভোপালকে ভারতের সাথে সংযুক্তির জন্য ১৯৪৯ সালের ৩০ এপ্রিল চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। তার স্বাধীনতার স্বপ্ন, স্বপ্নই থেকে যায়।
জুনাগড় কিভাবে পাকিস্তানের অংশ থেকে ভারতের হয়
জুনাগড় ভারতের গুজরাটের একটি জেলা। এটি ব্রিটিশ ভারতের একটি স্বাধীন রাজ্য ছিল। দেশভাগের সময় রাজ্যটি পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হয়েছিল। কিন্তু ভারত তাকে দখল করে নেয়।স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্র সচিব ভপ্পলা মেনন ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরে জুনাগড়কে ভারতের সাথে যুক্ত হওয়ার কথা বলেন। কিন্তু রাজ্যের নবাবেরা প্রধানমন্ত্রী শাহ নেওয়াজ ভুট্টো তাতে না বলে দেয়। জুনাগড় রাজ্যের নবাব তৃতীয় মহম্মদ মহবত খানজী ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট একটি সরকারি গেজেটে পাকিস্তান রাষ্ট্রে যোগ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। তার স্বাক্ষর করা অন্তর্ভুক্তি চুক্তি নিয়ে একটি প্রতিনিধিদল পাকিস্তানের গণপরিষদ যায় এবং গৃহিত হয়।এটিই প্রথম কোনে রাজকীয় রাজ্যের যা পাকিস্তানে যোগদান করে।পাকিস্তান ও জুনাগড় রাজ্যের সরকারী গেজেটে এই চুক্তি স্বাক্ষরের কথা ঘোষণা করা হয়। এটা শুনে ভারত তাদের জাল তৈরি করতে থাকে। প্রথমেই ভারত সরকারের পক্ষ থেকে জুনাগড়ের বাইরে বোম্বের অস্থায়ী এক সরকারেকে স্বীকৃতি দেয়া হয়, যারা ভারতের সাথে যুক্ত হতে চায়। তারপর তারা দ্বিতীয় চাল চালে। তারা কিছু উগ্রপন্থিকে পাকিস্তানে যুক্ত হওয়ার বিপক্ষে লেলিয়ে দেয়। উগ্রবাদীরা বাবারিয়াওয়াড় ও মাংরোল অঞ্চলের স্বাধীনতা ঘোষণা করে ভারতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা ঘোষণা করে। তাদের নিয়ন্ত্রনের জন্য জুনাগড় রাজ্যের সেনাবাহিনী আসে। এর সুযোগ নেয় ভারত। ভারত সরকার তাদের সেনাবাহিনীকে জুনাগড়ের চারিদিকে কৌশলগত অবস্থান নেওয়ার নির্দেশ দেয়। সেনাবাহিনী জুনাগড় রাজ্যের অন্তর্গত ভারতে যোগদানে ইচ্ছুক বাবারিয়াওয়াড় ও মাংরোল অঞ্চল দখলের নেয়ার আদেশ পায়। এর প্রস্তুতি হিসেবে পোরবন্দরে তিনটি যুদ্ধজাহাজ এবং রাজকোট বিমানবন্দরে আটটি যুদ্ধবিমান প্রস্তুত রাখা হয়। ভারত সরকার জুনাগড়ের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ করে মাল পরিবহন স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। এমন পরিস্থিতি নবাব করাচি যান পাকিস্তানের সাথে যোগদানের কাজ সমাপ্ত করতে।এর মাঝেই ভারত আক্রমণ শুরু করে। এছাড়া কাশ্মীর, গোয়া তারা দখল করে এটা নিয়ে আরেকটা লেখা আসবে।