পোস্টস

নন ফিকশন

মিসির আলির মনস্তত্ত্ব

১৯ মে ২০২৪

ওয়াসিম হাসান মাহমুদ

মূল লেখক ওয়াসিম হাসান মাহমুদ

মিসির আলি। হুমায়ূন আহমেদের সৃজন করা অন্যতম একটি চরিত্র। হিমুর মতো ব্যাপক জনপ্রিয়তা না পেলেও বাংলাদেশে এই সাইকোলজির শিক্ষকের গুনমুগ্ধ কম নেই। হিমু এন্টি-লজিক হলে মিসির আলি লজিক।
  
"দেবী" উপন্যাসের মধ্য দিয়ে যাত্রা করে এই চরিত্রের পরিচয় পান অনেক পাঠক। চিরকুমার, অত্যন্ত মানবিক একজন ব্যক্তি হিসেবে শীঘ্র‌ই পাঠকের নজর কাড়েন লেখক হুমায়ূনের "মিস্টার লজিক"।পিএইচডি কোর্স সম্পন্ন করতে না পারলেও দেশে-বিদেশে একজন মোস্ট ক্লিয়ার মাইন্ডেড পার্সন হিসেবে তাকে কিছু গল্পে দেখা যায়। যদিও নিজের কৃতিত্ব নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষকের খুব একটা বড়াই নেই। 
 
বিভিন্ন আখ্যানে দেখা যায় ভৌতিক-আধিভৌতিক এবং প্যারানর্মাল বিষয় নিয়ে বিপদে পড়া অনেকে মিসির আলির কাছে ছুটে যান। প্যারানর্মাল ব্যাপার-স্যাপারের লজিক্যাল বা যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা এবং সমাধান দেন তিনি। তাঁর কাছে যুক্তির বাইরে কিছু নেই। কোন বিষয়‌ই যেন লজিকের ডোমেইনের বাইরে নয়। 
 
শিক্ষকতার পাশাপাশি মিসির আলি সাইকোলজিক্যাল কাউন্সেলিং করে থাকেন। অনেক সময় ভৌতিকতার মোড়কে সংগঠিত অপরাধের তদন্তে নেমে পড়েন আলি সাহেব ঠিক শার্লক হোমসের মতো। হোমসের গোয়েন্দাগিরির সুদক্ষতার সাথে মানবিকতার সংমিশ্রণে হুমায়ূন আহমেদ এই চরিত্রের রূপায়ন ঘটান। 
 
মিসির আলি সুন্দর এক মনের অধিকারি ব্যক্তি। কারো সাহায্যে তিনি জীবন পর্যন্ত বাজি লাগিয়ে দেন। বিনিময়ে তিনি কোন সম্মানি নেন না। তাঁর বিভিন্ন গল্পে ব্যাচেলর হিসেবে থাকা ভদ্রলোকের কাজের ছেলেরা টাকা-পয়সা, টিভি নিয়ে পালিয়ে যায়। সব জেনে-বুঝেও তিনি ভ্রুক্ষেপ করেন না। পার্থিব বিষয়াদি মিসির আলিকে তেমন টানে না। নারী বিষয়ে তাঁর তেমন আগ্রহ দেখা যায় না। একা একা লেখাপড়া করে এবং মানুষের সাহায্য করে তাঁর জীবন কেটে যায়। 
 
ভঙ্গুর স্বাস্থ্যের অধিকারি এবং বেশিদিন বাঁচতে না চাওয়া এই চরিত্রের মাঝে অন্তত এক ছটাক নায়ালিজম বা নিরর্থবাদ কাজ করে। মিসির আলি সম্ভবত কিছুটা নিতসে দ্বারা প্রভাবিত। নিতসেও পুরোপুরি নায়ালিস্ট ছিলেন না। স্বাস্থ্য ভালো না হলেও মিসির আলির আছে ঠিক হিমুর মতোই এক জোড়া তীক্ষ্ম চোখ। এই তীক্ষ্মতা বেশ ধারালো। "বৃহন্নলা" গল্পে সাধু পুরুষ সেজে থাকা ক্রিমিনাল আলির চোখকে ফাঁকি দিতে পারেন নি। যেকোন অপরাধী ধরে ফেলার পর মিসির আলির মধ্যে কোন ভয় কাজ করেনা। অথচ ঐ স্থানে অনেক সময় অপরাধী এবং মিসির আলি ছাড়া আর কেউ উপস্থিত না থাকা সত্ত্বেও। "বাঘবন্দি মিসির আলি" আখ্যানে ভয়ানক এক সাইকোকে ধরে ফেলার আগে এবং পরে শিক্ষক সাহেবের মনে কোন ভয় দেখা যায় নি। এত দুঃসাহস এবং আত্মবিশ্বাস মিসির আলি পান কোত্থেকে? 
 
বিভিন্ন উপন্যাসে দেখা যায় ভয়ানক ক্রিমিনাল অথবা ভৌতিক চরিত্রের সামনে এই প্যারাসাইকোলজিস্ট সাধারণ মানুষের তুলনায় অনেক স্বাভাবিক থাকেন। তিনি লজিক দিয়ে ধরে নেন ঐসব আত্মা বা ভৌতিক চরিত্র তাঁর হ্যালুসিনেশন। লজিকের প্রতি তাঁর এরকম বিপুল আস্থা এবং দখল আসলে অবাক করে দেয়ার মতো। কিন্তু ভয়ানক অপরাধীরা তো তাঁর ভ্রম নয়। তিনি কেন সহজে তাদের ভয় পান না। ঠিক হিমু যেমন ভয় পায় না। 
 
মিসির আলি খুব সম্ভবত একজন হাইলি ফাংশনাল সোশিওপ্যাথ। সোশিওপ্যাথরা সবসময় ভয়ংকর হন না। অনেক সময় তাঁরা বেশ কাজের হন। কোনান‌ ডয়েলের মতে শার্লক এরকম‌ই। ব্যক্তিত্ব ভিন্ন হলেও শার্লকের সাথে মিসিরের বেশ কিছু জায়গায় মিল পাওয়া যায়। হাইলি ফাংশনাল সোশিওপ্যাথরা অন্যান্য বিপদজনক সাইকোপ্যাথ এবং সোশিওপ্যাথদের সামনে মোটামোটি স্বাভাবিক থাকে। হিমুও যেরকম একদম নর্মাল থাকে। দ্বিধা-ভয়হীন। 
 
মিসির আলি চা খুব পছন্দ করেন‌। রান্না-বান্নার প্রতি তাঁ‌র আগ্রহ অনেক গল্পে পাওয়া যায়। তবে উল্লেখিত বিভিন্ন‌ তুলনা খেয়াল করলে আশ্চর্যজনকভাবে হিমুর সাথে আলির বেশ কিছু মিল পাওয়া যায়। "হিমুর দ্বিতীয় প্রহর" উপন্যাসে প্রচন্ড ভয় পেয়ে স্বয়ং হিমু যখন কাউন্সেলিং এর জন্যে গভীর রাতে মিসির আলির বাসায় হাজির হন তখন এরকম একটি বিষয় উঠে আসে। দরজা-জানালা খুলে "মিস্টার লজিক" এর বেরিয়ে আসাটা দেখে হিমালয় মনে মনে ভাবেন যে মিসির আলির মধ্যে কিছু "হিমু-হিমুভাব" আছে। মিস্টার "এন্টি-লজিক" ফিরবার আগে খেয়াল করেন যে মিসির আলি আকাশপানে তাকিয়ে আছেন। এক ধরণের ফিলসফি, এক ধরণের ভাবুক বিষয় তাঁর চরিত্রে একদম হার্ড-ওয়্যারড। এই ভাবালুতা মিসির আলিকে একদম পুরোপুরি লজিক মেনে চলা ব্যক্তি থেকে একটু সরিয়ে আনে। "ক্লোজ ইওর আইজ এন্ড ওয়ান্ট টু সি" ভাবনার প্রেমে পড়া একজন মনে হয় তাকে। 
 
মিসির আলির অনেক অমীমাংসিত রহস্য আছে। ওসবের এক ডায়রি তিনি মেইনটেইন করেন। বিভিন্ন অযৌক্তিক বিষয় আলি সাহেব হরহামেশা দেখেছেন। এসব ব্যাপারে তাঁর মাঝে কাজ করে এক রহস্যময় নীরবতা। "দেবী" এবং "নিশিথিনী" উপন্যাসদ্বয়ে অনেক কিছু মিসির আলির ব্যাখ্যার ধার ধারেনি। অনেকে তার প্রতি তিনি সংশয়বাদি বা নাস্তিক হ‌ওয়া বিষয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দিলে তিনি বরাবর‌ই উত্তর দেন যে তিনি বিশ্বাসী।‌ হিমু যেমন সময়-অসময়ে মিথ্যা কথা বলেন, মিসির আলি ঠিক তার বিপরীত। তার মানে দাড়ায় তিনি বিশ্বাসী। তবে তাঁর বিশ্বাসের স্বরূপটাও রহস্যের অন্তরালে থেকেই যায়। কারণ ব্যক্তিগত সাধারণ জীবনযাপনের অন্তরালে মিসির আলি একজন বেশ রহস্যময় ব্যক্তি। 
 
বেশিরভাগ মানুষের মন এক অন্ধকার গুহা। মিসির আলির মন বেশ আলোকিত। তবে এই আলোর নিচে কোথায় জানি এক অন্ধকার আছে যা তাঁর একান্ত‌ই নিজের। মনের ভিতরকার এই রহস্যের সমাধান হয়তো তাঁর নিজের কঠিন লজিক‌ও দিতে পারবে না। 
 
ভঙ্গুর স্বাস্থ্যের অধিকারি নিঃসঙ্গ এই ব্যক্তি "হিমুর দ্বিতীয় প্রহরে" হিমালয়কে সেই ভয়কে ফেইস করার সকল বুদ্ধি-পরামর্শ দেয়ার পর আবার স্ববিরোধি বক্তব্য দেন। তিনি হিমুকে নিজ হাতে রান্না করে খাওয়ানোর পর ঐ "জিনিসের" মুখোমুখি হতে নিষেধ করেন। হিমু আবার ঠিক মিসির আলির মতো ব্যাখ্যা দেন যে মায়ার বশবর্তি হয়ে তিনি এসব বলছেন। হিমুর মধ্যে "লজিক" এবং মিসির আলির মধ্যে "এন্টি-লজিক" দেখা দেয় ক্ষণিকের জন্যে। শুধুমাত্র মিসির আলির মনে হিমুর প্রতি সৃষ্ট মায়ার কারণে। 
 
যে রহস্যময় মায়ার ব্যাখ্যা স্বয়ং মিসির আলি দিতে পারবেন কিনা সন্দেহ আছে।