পোস্টস

গল্প

অপার্থিব

১১ জুন ২০২৪

আহনাফ রাফি

‘আমি জীবনের উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেলেছি।’

রাজীবের কথা শুনে ডাক্তার নোরা খস খস করে কাগজে কী যেন লিখলেন।

‘আপনার সমস্যাটা আরও খুলে বলুন।’

‘খুলে বলেছি একবার।’

‘আপনি আপনার সমস্যার কথা বলেছেন। আমি ডিটেইল ডেসক্রিপশন চাইছি।’

রাজীব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সে এখন ভাবছে মায়ার কথা শুনে এখানে আসাই ভুল হয়েছে। ওর যাওয়া উচিত ছিল রাস্তায়। রাস্তায় দুই মাইল টানা হাঁটা লাগিয়ে বালতিতে মাথা চুবিয়ে বসে থাকলেও শান্তি পাওয়া যেত। এখানে পুরো টাকাটা জলে গেল।

‘আপনাকে দেখে খুবই চিন্তিত মনে হচ্ছে। অথবা আপনি কোনো কারণে খুবই বিরক্ত।’

রাজীব আরও জোরে শব্দ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

ডাক্তার নোরা কাউচ থেকে উঠে দাঁড়ালেন। এখানে ঢুকে রাজীব খুবই অবাক হয়েছিল। ডাক্তারের চেম্বারে থাকবে বড় একটা ডেস্ক আর একটা মস্ত বড় এক্সামিনেশন টেবিল। বাতাসে থাকবে রোগের গন্ধ, যাতে রোগ না থাকলেও মানুষ নিজেকে রোগী ভাববে। কিন্তু এই ডাক্তারের চেম্বার সম্পূর্ণ অন্যরকম। এখানে কেবল দুটো বড় কাউচ আছে মুখোমুখি। এছাড়া রুমটা প্রায় খালি। দেয়ালে ম্লান হলুদ রঙ করা। বাতাসে রজনীগন্ধার সুবাস, অথচ সে এখনো রজনীগন্ধা দেখতে পেল না কোথাও। একটা টবে দুটো টিউলিপ দেখা যাচ্ছে, তা আসল নাকি নকল তা নিয়ে সন্দেহ জাগছে।

ডাক্তার দুই গ্লাস পানি নিয়ে আসলেন। গ্লাস খুবই পরিষ্কার, নিজের প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে। রাজীব ঢকঢক করে পান করল।

‘আপনার কী মনে হয় আপনি ডিপ্রেশনের মধ্যে আছেন?’

‘না, ডিপ্রেশন নেই।’

‘আপনার জীবনে কোনো কষ্ট আছে? যা নিয়ে আপনি চিন্তিত থাকেন সবসময়?’

‘কোনো কষ্ট নেই। ডালভাত টাইপের জীবন।’

‘ডালভাত কথাটা দ্বারা আপনি কি বুঝাচ্ছেন?’

‘আমার জীবনে কষ্টও নেই আবার আনন্দও নেই। কোনো ঘটনা ছাড়াই কেটে যাচ্ছে দিনকাল।’

‘আপনি নিশ্চিত?’

‘হ্যাঁ, নিশ্চিত।’

‘কখনো কখনো আপনার মাথা ভারী হয়ে উঠে না? কিংবা মাথার মধ্যে কেউ কথা বলে না?’

‘না। এরকম কেন হবে?’

ডাক্তার নোরা আবারও খস খস করে কী যেন লিখলেন কাগজে।

‘আপনি কি আমার সামনে এভাবে বসে থাকতে অপ্রস্তুত বোধ করছেন? ফ্রি হতে পারছেন না? আপনার গার্লফ্রেন্ডকে ডেকে আনাব?’

রাজীব মেঝে থেকে চোখ তুলল। ডাক্তারের কথার পেছনে কারণ এখন বুঝতে পারছে। সে চেম্বারে ঢোকার পর থেকে একবারও ডাক্তারের চোখে চোখ রাখেনি। এবার তাকিয়ে অবাক হলো। ডাক্তার ঠোঁটে নুড কালারের লিপস্টিক। চুলগুলো সামনে এলিয়ে দেয়া। তিনি ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন তার দিকে। রাজীব আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলতে গিয়ে নিজেকে আটকালো। ডাক্তার হবে ডাক্তারের মত, মডেল সেজে থাকবে কেন?

‘আমি ফ্রী আছি। আর মায়া নেই, সে চলে গেছে।’

‘সে তো বলেছিল থাকবে।’

‘না, চলে গেছে। আপনার কি কি প্রশ্ন বলে ফেলুন জলদি, আমার কাজ আছে।’

ডাক্তার হাতের প্যাডটা টেবিলে ছুড়ে ফেললেন। পায়ের উপর পা তুলে বসলেন। 

‘আপনি আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন। কেন?’

রাজীব বিরক্ত হল। মায়া একে এসবও বলে দিয়েছে? 

‘বোরিং লাগছিল তাই। অন্য কোনো কারণ নেই।’

‘আপনার বাবা মায়ের সাথে সম্পর্ক কেমন?’

‘ওরা কেউ নেই। দশ বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় বাবা মা মারা যায়।’

‘আপনি নিশ্চিত দশ বছর আগে? বারো বছর আগে নয়?’

‘না, দশ বছর আগে।’

‘এই বিষয় নিয়ে আপনি চিন্তিত থাকেন? বা হঠাৎ এ বিষয় নিয়ে ইমোশনাল হয়ে যান?’

‘না। আমার কোনো ইমোশন কাজ করছে না।’

‘আপনার ডিভোর্সের পরও কিছু ফিল হয় নি?’

‘না, হয়নি।’

‘আপনার কী করতে ভালো লাগে? কোনো শখ আছে বা এমন কিছু যা আপনি ভালো পারেন?’

‘না। আমার কিছু করতেই ভালো লাগে না। কোনো শখও নেই। কিছু আমি ভালো পারি না, চেষ্টাও করি নি, ইচ্ছাও নেই।’

‘ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো পরিকল্পনা নেই?’

‘নেই।’ 

‘আপনার ঘুম কেমন হয়?’

‘খুব ভাল হয়। স্বপ্ন দেখি।’

‘ভাল স্বপ্ন নাকি খারাপ?’

‘দুটোই।’

ডাক্তার নোরা কিছুক্ষণ কি যেন ভাবলেন। তারপর বললেন, ‘আপনার মধ্যে আমি অস্বাভাবিক কিছু দেখতে পারছি না। কিন্তু আপনার এই ধরনের ব্যবহার খুবই স্বাভাবিক যে তাও নয়। আপনার জীবনে কোনো কষ্ট নেই, অথচ কষ্ট থাকার মত ব্যাপার আপনার জীবনে ঘটেছে। আপনি কিছু ফিল করেন না, সব কিছু আপনার কাছে বোরিং লাগে, তাই আপনি আত্মহত্যা করতে চেয়েছেন। বোরিং লাগার কারণে আত্মহত্যা আমার কাছে নতুন বিষয়, এরকম হতে পারে তা কখনো ভাবিনি।’

তিনি কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন। কথা গুলো হজম করতে দিলেন রাজীবকে।

‘আমার মতে আপনার সমস্যা মানসিক। আপনার একটা ভালো সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো উচিত, নিউরোলজিস্ট নয়। তারপরও একটা সিটি স্ক্যান দিচ্ছি, সেটা করিয়ে নেবেন, আর কিছু ছোটখাটো টেস্ট তাও করাবেন। আর অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট দিয়ে দিচ্ছি।’

রাজীব চেম্বার থেকে বের হওয়ার পরপরই মায়ার ফোন আসল। সে কেটে দিল। 

 

***

ডাক্তার নোরা কেবল ডিনার সেরেছেন। ডিনারের পরপরই একটু ঝিমুনির মত আসে। তখন তিনি কফি নিয়ে সোফায় বসেন। এক হাতে কফি আরেক হাতে কোনো এক ফিকশন বই। কফি খেলে মানুষের ঘুম কাটে, নোরার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা উলটো। বই পড়তে পড়তে তিনি ঘুমিয়ে যান। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখেন তার জামায় কফির দাগ।

আজকে গল্পের বইয়ে মন দিতে পারছেন না তিনি। বারবার অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছেন। চোখ চলে যাচ্ছে ফোনের স্ক্রীনের দিকে। 

আরো আধ ঘণ্টা মত বই পড়ার চেষ্টা করে তিনি বই রেখে দিলেন। আরেকটা শাওয়ার নিলেন। তারপর তার ল্যাপটপ অন করলেন। 

তার দশ বছরের ক্যারিয়ারে তিনি এরকম ধাঁধায় আর পড়েন নি। কেসটাকে প্রথমে খুব একটা আমলে নিচ্ছিলেন না তিনি, কিন্তু এখন এই রিপোর্টটাই তার ঘুম কেড়ে নিয়েছে। কিছুক্ষণ মন দিয়ে পড়লেন। এ নিয়ে হাজার খানেক বার পড়া হয়েছে গিয়েছে। নতুন কিছু পাচ্ছেন না। যা পড়ছেন তা বিশ্বাস করাতে পারছেন না নিজেকে, ভুল কিছুও চোখে পড়ছে না। 

ফোনের ভাইব্রেশন হল। মেইল এসেছে। অবশেষে! ওপেন করলেন। 

‘দিস ইজ ইমপসিবল! বাট দ্য রিপোর্ট সিমস ফাইন। গেট মোর ইনফো… হ্যাস টু বি সাম রিজন। হ্যাস টু বি!’

নোরা এবার নিশ্চিত হলেন। তিনি ভুল করেন নি। মায়াকে মেইল করলেন, ‘মিট টুমরো। আর্জেন্ট! ব্রিং দ্য পেশেন্ট।’

***

‘পেশেন্ট আসে নি?’

‘না। জোর করেছি, আসতে চায় নি। আমি কি পরে আসব ওকে সাথে নিয়ে?’

‘না, তার প্রয়োজন নেই। আপনার সাথেই আমার কথা আছে, উনার সাথে কথা বলে কাজ নেই আর।’

‘আপনার কথাটা ঠিক বুঝতে পারছি না। কাজ নেই মানে?’

‘সব খুলে বলছি। তবে ব্যাপারটা একটু জটিল, আমি আপনার পূর্ণ মনোযোগ চাই। আর চাই কিছু প্রশ্নের উত্তর। কফি খাবেন?’

মায়ার উত্তরের অপেক্ষা না করেই নোরা কফি মেকার থেকে দুই কাপ কফি বানিয়ে আনলেন। কড়া কফির ঘ্রাণে তার চেম্বার ভরে গেল।

‘ব্রাজিলিয়ান। ইম্পোর্টেট।’ মায়ার মুখের ভাব দেখেই হয়ত বললেন ডাক্তার

নোরা। ‘আচ্ছা, এবার আমাকে কিছু বিষয় ক্লিয়ার করুন।’

‘কি জানতে চাচ্ছেন?’

‘মিস্টার রাজীব আমাকে কিছু মিথ্যে বলেছিলেন।’

‘যেমন?’

‘সড়ক দুর্ঘটনায় তার বাবা, মা আর তার স্ত্রী নিহত হন আজ থেকে ঠিক বারো বছর আগে। এই ঘটনায় তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন, কোমায় চলে যান। কিন্তু তিনি আমাকে বলেন এই ঘটনা ঘটেছিল দশ বছর আগে।’

মায়া কিছু বলতে যাচ্ছিল, ডাক্তার নোরা তাকে বাধা দিলেন। ‘আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম  ডিভোর্সের পরও কিছু ফিল  হচ্ছে কীনা। তিনি বললেন কিছু ফিল হয় নি। কিন্তু উনার কখনো ডিভোর্স হয় নি।’

মায়ার আবার কিছু বলতে গিয়ে বাধা পেল। 

‘তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম কখনো কখনো উনার মাথা ভারী হয়ে উঠে কীনা। কিংবা মাথার মধ্যে কেউ কথা বলে কীনা। উনি বলেছেন এরকম কিছু হয় না। কিন্তু আপনি বলেছেন পেশেন্ট আপনাকে মাঝে মধ্যে এরকম হয় জানায়। তখন তিনি খুব ছটফট করেন, কিছু চিনতে পারেন না।’

ডাক্তার নোরা একটু বিরতি নিয়ে আবার শুরু করলেন, ‘আপনি বলেছিলেন উনি লেখালেখি করতে পছন্দ করেন।’

‘হ্যাঁ, এর জন্যে ও নিজের জবও ছেড়ে দিয়েছে।’

‘কিন্তু উনি বলেছিলেন উনার কোনো কিছু তে ইচ্ছে নেই।’

‘আমি দুঃখিত। আমি আপনাকে কীভাবে বলব বুঝতে পারছি না। আমার সাথেও সে মাঝে মধ্যে করে এমন। মুখের উপর মিথ্যে বলে। তারপর এমন ভাব করে যেন সে কোনো ভুল করেনি।’

ডাক্তার নোরা কাউচ ছেড়ে উঠলেন। কিছুক্ষণ পায়চারি করলেন। তারপর আবার বসে পড়লেন। 

‘এবার আমার কথা আপনি একটু মন দিয়ে শুনুন। আমার কথা সম্পূর্ণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আপনি উত্তেজিত হবেন না দয়া করে।’

‘খারাপ কিছু হয়েছে?’

ডাক্তার নোরা কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন। কীভাবে কথাটা বলবেন বুঝতে পারছেন না। থমথমে নীরবতায় নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। 

‘পেশেন্টের সাথে প্রথম সাক্ষাতে আমার মনে হচ্ছিল তিনি পিটিএসডি তে ভুগছেন। পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার। চোখের সামনে পুরো পরিবার শেষ হয়ে যেতে দেখে এবং মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসার পর অনেকের মধ্যে এমনটা দেখা যায়। তার উপর সবচেয়ে কাছের মানুষগুলিকে হারানো কারণে তার নিজের কাছে জীবনে উদ্দেশ্য হারিয়ে যায়। ফলে পিটিএসডি মারাত্মক রূপ নেয় এবং ডিপ্রেশনকে বাড়িয়ে দেয়, যার ফলে পেশেন্ট সুইসাইডাল হয়ে যান। আপনি ঠিক সময়ে উনাকে না বাঁচালে হয়তো আজকে আমাদের এই সাক্ষাতের কোনো অর্থ থাকত না।’

নীরবতা আরো মারাত্মক হয়ে আঁকড়ে ধরছে নোরাকে। তার কাছে এখন এসির বাতাসও ভারী লাগছে। খোলা বাতাস প্রয়োজন।

‘ডাক্তার, আমার কাছে এই এক্সপ্লেনেশনটাইতো জুতসই মনে হচ্ছে।’ মায়া বিভ্রান্ত বোধ করছে।

‘আমার কাছেও মনে হচ্ছিল। কিন্তু উনাকে যা যা টেস্ট করতে দিয়েছিলাম তার রেজাল্ট দেখার পর ঘটনাটা একশ আশি ডিগ্রী কোণে ঘুরে গেছে।’

‘কি বলতে চাইছেন আপনি?’

নোরা কেশে গলা পরিষ্কার করলেন। ‘আপনি কী এফটিডি এর নাম শুনেছেন?’

       ‘ফ্রন্টোটেম্পোরাল ডিমেনশিয়া?’ ডাক্তারের বিভ্রান্ত চেহারা দেখে মায়া তাড়াতাড়ি বলল, ‘আমি মেডিক্যাল স্কুল গ্র্যাজুয়েট।’

‘তাই বলুন। হ্যাঁ, আপনি ঠিক ধরেছেন। ঘটনা এটাই।’

‘কিন্তু সামান্য কিছু আচরণে তো আপনি এত বড় সিদ্ধান্তে আসতে পারেন না!’ 

‘প্লীজ উত্তেজিত হবেন না। আমার কথা সম্পূর্ণ শুনুন।’ একটু বিরতি দিয়ে নোরা আবার শুরু করলেন, ‘উনার ব্রেন স্ক্যান থেকে আমি এই জিনিসটা আন্দাজ করি। কিন্তু আমি নিশ্চিত হতে পারছিলাম না। তাই ইউএস এ আমার একজন কলিগের কাছে রিপোর্টটা পাঠাই। সে আরো কিছু এনালাইসিস করে নিশ্চিত করে যে এটা এফটিডি কেস। কিন্তু এই জিনিসটা খুবই রেয়ার। আর আপনি তো জানেনই যে, এর শেষ পরিণতি মৃত্যু। তাই আমি আবার নিশ্চিত করার জন্যে আরো কিছু টেস্ট দেই। গতকাল সেই টেস্ট এর রেজাল্ট আমার কাছে আসে এবং রেজাল্ট দেখে আমি হতবাক হয়ে যাই।’

‘এফটিডি থেকে ভয়াবহ আপনি আর কি আবিষ্কার করতে পারেন?’

মায়ার তির্যক প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তিনি বলে চললেন, ‘আপনি নিশ্চয় জানবেন এফটিডি এর সিম্পটমসগুলো কী কী। প্রথমে রোগী সামান্য সামান্য জিনিস বেমালুম ভুলে যাবেন। তারপর আসতে আসতে তিনি এমন সব কাজ করবেন যা খুবই অস্বাভাবিক এবং তিনি বুঝতেও পারবেন না যে তিনি অস্বাভাবিক কোনো কাজ করছেন। তার কাছে সবই স্বাভাবিক মনে হবে। তারপর আসে উদাসীনতা। রোগীর মধ্যে যাবতীয় সকল বিষয়ের প্রতি আগ্রহের অভাব দেখা যাবে। খুব কাছের মানুষকেও তার কাছে অচেনা মনে হবে, তাদের প্রতি উদাসীনতা দেখাবে। আমাদের পেশেন্টের মধ্যে আমরা দেখতে পাচ্ছি, তিনি নিজের মাথার মধ্যে অলটারনেট একটা বাস্তবতা তৈরি করে ফেলেছেন। তার কাছে নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে মর্মান্তিক দুর্ঘটনার হিসেব এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। নিজের পার্টনার মারা গিয়েছে অথচ তিনি ভেবে রেখেছেন তাদের ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে। নিজের মস্তিষ্কে অন্য কারো শব্দ শুনছেন এবং তা মনে রাখতে পারছেন না।’

ডাক্তার নোরা এক গ্লাস পানি পান করে আবার শুরু করলেন, ‘এসব টিপিক্যাল এফটিডি রোগীর লক্ষণ। কিন্তু আমরা যে জিনিস নিয়ে বিভ্রান্তিতে আছি তা আপনাকে এখন বলি। এফটিডি মূলত আমরা মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল এবং টেম্পোরাল লোবের কোষগুলির ক্ষয় দ্বারা চিহ্নিত করে থাকি। কিন্তু উনার ক্ষেত্রে আমরা একটু ভিন্নতা লক্ষ্য করেছি। আপনি জানবেন যে ক্রিয়েটিভিটি বা মৌলিক ধারণা তৈরি করার ক্ষমতা সাধারণত ডান মস্তিষ্ক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়; যা কল্পনা, চিন্তা ভাবনা এবং সংবেদনশীলতার জন্য দায়ী। আবার রেশনালিটি বা যুক্তি ব্যবহার করে সমস্যা সমাধান করার ক্ষমতা সাধারণত বাম মস্তিষ্ক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, যা ভাষা, যুক্তি এবং গণিতের জন্য দায়ী। আবার ক্রিয়েটিভিটি এবং রেশনালিটি উভয়ই মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে…’

‘আপনি লেকচার ঝাড়ার জন্যে আমাকে এখানে ডেকেছেন?’

‘দুঃখিত। আপনি দয়া করে হাল ধরে থাকুন। এসব না বলে আপনাকে আমি সম্পূর্ণ পরিস্থিতিটা বুঝাতে পারব না।’

‘বলুন।’

‘ধন্যবাদ। হ্যাঁ, যা বলছিলাম। ক্রিয়েটিভিটি আর রেশনালিটি। এখন আমাদের পেশেন্টের এই দুই জিনিসের মধ্যে মিচম্যাচ দেখা যাচ্ছে।’

‘যেমন?’

‘প্রথম যে টেস্ট আমরা করি তাতে উনার ব্রেনের বাম দিকটা একেবারে নিস্তেজ হয়ে পড়েছিল। তবে ডান দিকটা ছিল অস্বাভাবিকভাবে উদ্দীপ্ত। তখন তিনি কাউকে চিনতে পারছিলেন না। উসখুস করছিলেন। আপন মনে কথা বলছিলেন।’

একটা ঢোক গিলে তিনি আবার বললেন, ‘তার কিছুক্ষণ পর আমরা আরেকটা টেস্ট করি। এতে উলটো ঘটনা দেখা যায়। বাম মস্তিষ্ক অস্বাভাবিকভাবে উদ্দীপ্ত এবং ডান মস্তিষ্ক নিস্তেজ। তখন তিনি খুবই স্বাভাবিক আচরণ করছিলেন এবং সবাইকে ভালোই চিনতে পারছিলেন। তার মধ্যে কোনো রকমের অদ্ভুত আচরণ আমরা লক্ষ করিনি। এফটিডি এর প্রাইমারি স্টেজেও পেশেন্ট এরকম সুস্থ বোধ করতে পারে না।’

মায়া কোনো কথা বলল না। কফির কাপে শব্দ করে চুমুক দিল।

***

রাজীবের চোখ আধবোজা।

সকাল থেকে ওর ভীষণ মাথা ব্যথা করছিল। কদিন ধরে একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর এটা হচ্ছে। প্রথম প্রথম সে খুব ঘাবড়ে যেত। তখন তার মনে হত সব কিছু উলটে গেছে। মাথার ভেতর কিছু একটা খুব জোরে জোরে আওয়াজ করে। চোখে সব কিছু ঝাপসা দেখে। মাথার ভেতর থেকে একটা আওয়াজ বারবার বলে কিছু একটা করার জন্য। কিছু একটা যে কী সেটা সে প্রথমে বুঝতে পারত না। পরে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়। 

তবে এখন তেমন কিছু ঘটছে না। সে চোখ আধবোজা করে বিছানায় উপুড় করে শুয়ে আছে। কেবল মাথার ভেতর ভারী কিছুর উপস্থিতি টের পাচ্ছে। কানে শোঁশোঁ আওয়াজ আসছে। 

‘কেমন আছো নিনিত?’

রাজীব গোঙানির মত আওয়াজ করল। আবার এসে গেছে! সে উঠে বসার চেষ্টা করল, কিন্তু হাত পা অবশ হয়ে গেছে যেন। 

‘উত্তর দিচ্ছ না কেন নিনিত? আমার কথা কী তুমি শুনতে পারছ না?’

এই মুহূর্তে রাজীবের ইচ্ছে হচ্ছে পালিয়ে যেতে, সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে অনেক দূরে চলে যেতে। ‘না… না…।’

‘কী বলছ নিনিত? আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না!’

‘না।’

‘তুমি কী সোজা হয়ে বসবে? তোমার সাথে কিছু কথা ছিল। বসবে সোজা হয়ে? এই দেখ আমি মেঝেতে বসে আছি। দেখতে পাচ্ছ আমাকে?’

‘চলে যাও প্লীজ! আমি করব না!’

‘কী করবে না নিনিত? তুমি কী করবে না?’

‘তোমার কথা আমি শুনবো না! কিছুই শুনবো না। প্লীজ চলে যাও।’

‘শুনবে তো বটেই! আমার কথা না শুনে আর কার কথা শুনবে বল, নিনিত?’

‘আমাকে ঐ নামে ডাকবে না প্লীজ।’

‘কেন ডাকব না? তুমি সোজা হয়ে বসো তো। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। তোমার জন্যে আমার সব কাজ ফেলে এসেছি জানো?’

‘আমি করব না, আমার ভয় করে। দয়া কর…’

‘কিছু হবে না নিনিত! বিশ্বাস রাখ। এইতো সোনা আমার, আরেকটু। উঠ… হ্যাঁ… আরেকটু। এত দূরত্ব আমি কীভাবে সইবো বলো? এত কষ্ট আমি কীভাবে নেবো? চল আজকেই সব দূরত্বের অবসান করি। কতদিন তোমাকে কাছে পাই না। নিনিত… আর দেরি করো না সোনা…’

রাজীবের মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরোচ্ছে না। সে প্রাণপণ চাইছে চিৎকার করতে। চিৎকার করে সাহায্য চাইতে। কিন্তু পারছে না সে। 

আমি যেতে চাই না! যেতে চাই না তোমার কাছে। আমার ভয় করছে!

‘যেতে তোমাকে হবেই। এই পৃথিবী তোমার নয়। যে পৃথিবীতে আমি নেই সে পৃথিবীতে তোমারও থাকার কোনো অধিকার নেই!’

চাইছে না তবু ওর দেহ যেন উড়ে যাচ্ছে। পালকের মত হালকা হয়ে গেছে সে! নিজেকে থামাতে পারছে না। চোখে সব ঝাপসা দেখছে। কোথায় যাচ্ছে তাও বুঝতে পারছে না। শুধু বুঝতে পারছে সে ভয়াবহ কোনো ঘটনা বাধাতে চলেছে। সবই বুঝতে পারছে, কিন্তু নিজের উপর আর নিয়ন্ত্রণ নেই ওর। 

‘এইতো আরেকটু… আরেকটু সোনা… তোমার আমার দূরত্ব এখন কেবল কয়েক মুহূর্তের…’

ঠাণ্ডা বাতাস লাগছে ওর মুখে। চুল বাতাসে উড়ছে। রাস্তায় গাড়ির মৃদু গুঞ্জন কানে লাগছে। আর ঠক্‌ ঠক্‌ আওয়াজ। 

‘আসো প্রিয়! আমার কাছে আসো! আর একটু…’

সে বুঝতে পারছে সে কী করতে চলেছে। কিন্তু নিজেকে থামাতে পারছে না সে। ঠক্‌ ঠক্‌ আওয়াজটা আরো তীব্র হচ্ছে। নিজের নিঃশ্বাসের শব্দ নিজের কানে বাজছে। এখনই ঝাঁপ দিবে সে। জন্ম জন্মাতরের অপেক্ষা আজ ফুরাবে। এখনই… 

‘নিনিত!’

হুট করে চোখ খুলে গেল ওর। কয়েক মুহূর্ত চোখে কিছু দেখল না, সবই ঝাপসা। তারপর দেখতে পেল আকাশ। ঘন কালো আকাশ। আর সপ্তর্ষিমালা। মেঘের কোনো দেখা নেই। নেই চাঁদ। ঘোর অমাবস্যায়ও সে বুঝতে পারল রেলিং এ দাঁড়িয়ে আছে সে। নিচে কংক্রীটের মেঝে তার জন্যে অপেক্ষা করে আছে। ডাকছে তাকে কাছে। 

‘নিনিত!’ আবার সেই আওয়াজটা কানে বাজল। 

এতক্ষণ পর খেয়াল করল কেউ ওর পা জড়িয়ে ধরে আছে। খুব শক্ত করে। আসতে করে নেমে আসল রেলিং থেকে। 

মায়ার চিন্তিত ক্লান্ত মুখটা দেখে সব বাঁধন খুলে গেল। কান্নায় ভেঙে পড়ল ওর বুকে। 

মায়া আস্তে আস্তে আঙ্গুল বুলিয়ে দিল ওর চুলে। চোখ দুটো স্থির। কোনো অনুভূতি কাজ করছে না ও দুটো চোখে।

***

‘অদ্ভুত… খুবই অদ্ভুত!’ বলেই কফিতে একটা চুমুক দিলেন ডাক্তার শামস। 

       ডাক্তার নোরা কিছু বললেন না। 

       কফির কাপে আরেকটা চুমুক দিয়ে নোরার দিকে তাকালেন তিনি। সম্ভবত আধ ঘণ্টা পর এই প্রথম তাকালেন। নোরা স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। 

       ‘তোমার এই আইডিয়াটা কীভাবে আসলো, নোরা?’

       ডাক্তার নোরা এবারও কোনো উত্তর দিলেন না। বুঝতে পারছেন না উনি প্রশংসা করছেন নাকি সার্কাজম করছেন। কফির মগটা উলটে পালটে দেখতে থাকলেন তিনি। 

       ডাক্তার শামস উঠে গিয়ে জানালার সামনে দাঁড়ালেন। বড় করে একটা শ্বাস নিলেন। ‘এই রুমের ভিউটা আমার বড্ড ভালো লাগে। যখন প্রথম জয়েন করি আমাকে পাশেই একটা ছোট্ট রুম দেয়া হয়েছিল। একদম ছোট। কোনো জানালাও ছিল না। দম বদ্ধ হয়ে আসত। তখন আমার সুপিরিয়র ছিলেন ডাক্তার হায়ৎ। উনাকে বলার পর উনি এই রুমটা আমাকে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। এটা তখন ছিল রিসার্চ ল্যাব। তাই রুমটা বেশ বড়সড়। আমার ইউএস যাওয়ার পর তোমাকে দিয়ে যাই।’

       নোরা বুঝতে পারল ডাক্তার এখন খোশগল্পের মেজাজে আছেন। এই সুযোগে কিছু জিনিস জেনে নেওয়া ভালো হবে। 

       ‘স্যার, আপনি কি দেশে বিশেষ কোনো কাজে এসেছেন?’

       ‘বিশেষ না, তবে একটা কাজে অবশ্যই এসেছি। কাজটা শেষ, তাই ভাবলাম তোমাকে একটু দেখা দিয়ে যাই। মেইলে যখন থেকে এই কেসটার ব্যাপারে জানিয়েছ তখন থেকে খুবই ইন্টারেস্ট লাগছে।’

‘আপনি এসেছেন বলে খুবই খুশি হচ্ছি, স্যার। এই কেসটা নিয়ে পড়েছি বেশ বেকায়দায়। প্রথমে রোগীর কন্ডিশন ভাবিয়ে মারছিল, এখন আবার এই সমস্যা। কি করব কিছুই বুঝতে পারছি না।’

‘ব্যাপারটা খুবই কনফিউজিং বটেই। তবে তোমার প্রশংসা অবশ্যই করতে হয়। এই আইডিয়া তো আমার মাথায়ও আসতো না। পেশেন্ট এর বেকগ্রাউন্ডের ব্যাপারে ফ্যাক্ট চেকিং করার আইডিয়া তোমার কীভাবে আসল তা তো বললে না!’

ডাক্তার নোরার গাল লাল হয়ে গেল। ডাক্তার শামস তাকে স্নেহ করেন এটা তিনি জানেন। কিন্তু এভাবে সামনাসামনি প্রসংশা তিনি খুব কমই করেন। কেশে গলা পরিষ্কার করে বললেন, ‘স্যার, সত্যি বলতে কি, এটা খুবই কাকতালীয় ভাবে হয়েছে। পেশেন্ট এবং উনার গার্লফ্রেন্ডের কথার মধ্যে অনেক অমিল পাচ্ছিলাম। তাই ভাবলাম পেশেন্টের ফ্যামিলির পুরনো মেডিকেল ফাইলগুলো একটু ঘেঁটে দেখি কোনো ক্লু পাই কীনা। ফ্যামিলির কারো যদি এমন কিছু থেকে থাকে, কিংবা যদি কোনো সিম্পটমও থাকে তবে অনেক কিছুই পরিষ্কার হবে। কিন্তু ফাইল ঘাঁটতে গিয়ে বেশ কিছু এনমালি লক্ষ করি। আমার সন্দেহ জাগে। আমার এক পরিচিত ক্লায়েন্ট ডিবিতে আছেন, তাকে কল করি। পেশেন্টের ফ্যামিলির এক্সিডেন্টের ঘটনা তখন অনেক আলোড়ন তুলেছিল, পুলিশও বেশ ঢালাও ভাবে তদন্ত করেছিল, কেস ফাইলে নিশ্চয় অনেক ইনফো থাকবে যা আমাকে পেশেন্টের বেকগ্রাউন্ড সম্পর্কে আরো জানতে সাহায্য করবে। তবে কেস ফাইল সিভিলিয়ান কাউকে ওরা দিতে পারে না, এমনটাই জানালেন আমার ক্লায়েন্ট। আমি অনেক করে রিকুয়েস্ট করি, আমার পরিস্থিতি উনাকে বোঝাই। উনি অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্বের পর রাজি হলেন। বললেন কিছু ম্যানেজ করতে পারলে আমাকে জানাবেন। কাল রাত্রে তিনি আমাকে কেস ফাইলটা সম্পূর্ণ পাঠান। যা আপনি পড়লেন একটু আগেই।’

‘খুবই কাজের কাজ করেছ, ব্রাভো!’

‘কিন্তু স্যার…’ ডাক্তার নোরা হতাশ কন্ঠে বললেন, ‘এখন তো দেখছি কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ খুঁড়ে বসে আছি! পেশেন্ট এফটিডি রোগী তাই নাহয় ওলট পালট বলছে এটা বুঝতে পারছি, কিন্তু মায়া, আই মিন উনার গার্লফ্রেন্ড, কেন এত মিথ্যা বলল সেটা বুঝতে পারছি না।’

‘বিষয়টা খুবই সাসপিশাস…’ আনমনে বিড়বিড় করে বললেন ডাক্তার শামস। চোখের চশমাটা নাকের ডগার উপর নেমে এসেছে তাও তাঁর কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। ‘নোরা…’

‘ইয়েস স্যার?’

‘খোঁজ লাগাও। এই মায়া কে, সে ব্যাপারে খোঁজ লাগাও। এই মহিলার ব্যাপারে কেস ফাইলে কোনো ইনফো নেই কেন তাও বের কর। তবে এখনই কনফ্রন্ট করবে না। পারলে তোমার ডিবি বন্ধুকে কাজে লাগাও। এর ব্যাপারে যা যা জানতে পার সব জানার চেষ্টা কর… পেশেন্ট বলছে একে চেনে অনেক দিন থেকে, কিন্তু এর ব্যাপারে পুলিশ কিছুই বের করতে পারল না? এক্সিডেন্টের পর হুট করে কোথা থেকে উদয় হলো এই মায়া?’

আবার অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন তিনি। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বললেন, ‘পেশেন্ট এখন এফটিডি-র ক্রিটিকাল ফেইযে চলে গেছে। মায়াকে ছাড়া এই মুহূর্তে আর কাউকে চিনছেও না। কদিন পরে হয়ত একেও চিনবে না। যা করার এখনই বের করতে হবে…’

ডাক্তার শামসের কথা শেষ হতে না হতেই, হন্তদন্ত হয়ে রুমে ঢুকল ডাক্তার নোরার এসিসটেন্ট কাদের। ‘ম্যাম…’ কিছু একটা বলতে চাইছিল কিন্তু ডাক্তার শামস দেখে হকচকিয়ে গেল। মুখ দিয়ে কিছু বের হল না, সালাম দিতেও ভুলে গেল। 

‘ইয়েস…?’ নোরা বললেন। ‘এত এক্সাইটেড লাগছে কেন আপনাকে? কী হয়েছে?’

‘ম্যাম…’ হাতের ফাইল গুলো কাঁপা কাঁপা হাতে নোরাকে দিল কাদের। ‘আপনার সন্দেহ ঠিক। এই দেখুন…।’

নোরা চশমাটা পরে উলটে পালটে দেখলেন ফাইলগুলো কয়েক মুহূর্ত। ‘ওহ্‌ মাই গড!’ ধপাস করে চেয়ারে বসে পড়লেন তিনি। 

নোরার হাত থেকে ফাইলগুলো নিলেন ডাক্তার শামস। তিনি একটু চোখ বুলিয়েই বুঝে গেলেন তার প্রাক্তন এসিসটেন্ট কেন এত অবাক হয়েছে। ‘ফাকিং হেল! এবার বুঝা গেল পেশেন্টের ব্রেনের এই কন্ডিশন কীভাবে হলো। এই লেভেলের টক্সিনে পেশেন্ট এতদিনে মারা গেল না এটাই আশ্চর্য! নোরা! পুলিশে খবর দাও এখনি। এভাবে আর কিছুদিন চললে পেশেন্টকে মেরেই ফেলবে এই মহিলা। নোরা…!’

ডাক্তার নোরা উত্তর দিলেন না। তিনি দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে শুরু করলেন মাথার ভেতর। তার সন্দেহই ঠিক তাহলে! 

***

রাজীব লিখতে বসল। সামনে একটা খাতা। সম্পূর্ণ খালি। একটা শব্দও লেখা নেই।

এই সাদা খাতা দেখে মায়া লাগছে তার। আচ্ছা আগে কী সে খাতা কলমে লিখত নাকি কম্পিউটারে? এখন তো কিছুই মনে থাকছে না। সেদিন মেঝেতে একটা বইয়ে নিজের ছবি দেখে চমকে উঠেছিল সে। পরে বুঝল এটা তার নিজের লেখা বই!

       সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল সে। সব লিখে ফেলবে। এখন মাথা খানিকের জন্যে ভাল আছে। এখন যা যা মনে পড়ছে সব লিখে ফেলবে। কিন্তু লিখে পাঠাবে কোথায়? কে বা ওর কথা গুরুত্বের সাথে দেখবে? মায়া ছাড়া তো এই মুহূর্তে ও আর কাউকেই চেনে না! 

       মায়ার কথা মনে পড়তেই শিরদাঁড়া দিয়ে ঠাণ্ডা একটা স্রোত বয়ে গেল। মাথা ভারী হয়ে আসল। ও বুঝতে পারছে, এখন না লিখে রাখলে আর কখনোই কাউকে জানানো যাবে না। 

প্রিয় _____, 

আমার কথা মন দিয়ে শুনুন। বিশ্বাস করতে হবে না। আমি নিজেও বিশ্বাস করতে পারছি না আমার সাথে এইসব ঘটছে। আমার হাতে বেশি সময় নেই। মায়া কোনো একটা কাজে বাইরে গেছে। ও আসার আগেই আমাকে লিখে শেষ করতে হবে। 

মায়া! মায়া! ওহ্‌ ঈশ্বর! এই একটা নাম আমি ভুলতে পারছি না। মায়া নামে কী কেউ আছে? নাকি এসব আমার কল্পনা? 

আপনি যদি আমাকে চেনে থাকেন তাহলে অবশ্যই আপনি বলবেন, আরে এটা কেমন কথা? মায়া অবশ্যই বাস্তব। সে না থাকলে তুমি এতক্ষণে মরে পড়ে থাকতে! সেই তো তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। ঔষধ কিনে দেয়। দুই দুই বার ছাদ থেকে ঝাঁপ দিতে গিয়েও বেঁচে গিয়েছ তো তার জন্যেই। 

আমি আপনার সাথে একমত। আপনাকে একটা কথা বলি? অবাক হবেন না তো? আচ্ছা বলি… আমাকে মায়া আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেছে। অবাক হয়েছেন? আরো অবাক করি? ও আমাকে বিষ দেয়। খাওয়ার সাথে মিশিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে দেয় না। ঔষধের মত করে রোজ দেয়। কি বললেন? আমি খাই কেন? কেন বাধা দেই না? 

হা হা হা! হাসালেন। আপনাকে তো পুরো ব্যাপার বলা হয় নি। ও আমার মাথার মধ্যে থাকে। কখনো ঘুমিয়ে থাকে। কখনো জেগে থাকে। ও আমাকে নিয়ন্ত্রণ করে। আপনাকে বলেছিলাম না ওকে আমার অবাস্তব মনে হয়? বিশ্বাস করলেন এখন? 

আমি খুবই বিভ্রান্ত বোধ করছি। আমি ওকে চিনি আবার চিনি না। ও একই সাথে ভালো আবার খারাপ। আমি কি করব বলুন? আমার কিছুই ভাল লাগছে না। মরে যেতে ইচ্ছা করে আবার বাঁচার জন্যে মন কাকুতি-মিনতি করে। 

বলুন আমি কী করব?

আমাকে দয়া করে বাঁচান। আমি এভাবে থাকতে পারছি না। আমি কিছু ভাবতে পারছি না। দয়া করুন। 

ইতি, রাজীব।

       সে লিখাটা শেষ করে চেয়ার ছেড়ে উঠতে যাবে তখনই ওর মাথা ভারী হয়ে আসে। বুক ধুকপুক শুরু করে। সে বুঝতে পারে সময় হয়ে এসেছে ওর। 

       ‘নিনিত! এই নিনিত!’

***

রাজীবের চিঠিটা হাতে নিয়ে বসে আছেন ডাক্তার নোরা। আসল কপিটা পাননি। এটা ফটোকপি করা— পুলিশ থেকে পেয়েছেন। কয়েশ’ বার পড়া হয়ে গেছে, তাও তিনি হাত থেকে ফেলতে পারছেন না। 

       ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলেন তিনি, ফোনের ভাইব্রেশনে ঘোর ভাঙল। ডাক্তার শামস। 

       ‘নোরা, কেমন আছ?’

       ‘ভাল। স্যার, মেইলটা পেয়েছেন?’

       ‘হ্যাঁ, কেবল। পেয়েই তোমাকে কল করছি। পেশেন্ট কখন মারা গেছে?’

       ‘দুই থেকে চার ঘণ্টা আগে।’

       ‘পুলিশ এতো পরে পৌঁছাল কেন?’

       ‘পুলিশ ফোন পেয়ে সাথে সাথে চলে গিয়েছে। তবে ফরেন্সিক রিপোর্ট বলছে দুই থেকে চার ঘন্টা আগে ঘটেছে।’

       ‘ফোন? কার ফোন? ফোন কে করল? ফ্ল্যাটে আর কে ঢুকেছিল?’

       ‘মায়া ফোন করেছিল, স্যার। মায়া।’

       ‘নো ফাকিং ওয়ে…’ 

       দু জনেই বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন। কথা খুঁজে পেলেন না কেউ। 

       নীরবতা ভঙ্গ করে ডাক্তার শামস বললেন, ‘হোয়্যার ইজ শি?’ 

       ‘নো আইডিয়া, স্যার।’ 

       আবার নীরবতা। 

       ‘ইজ দিস ফাকিং জোক? পুলিশকে আমরা অনেক আগেই জানিয়েছিলাম। তারা তখন আমাদের কথা আমলে নেয় নি কেন?’

       ‘ওরা খোঁজ শুরু করেছিল। সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। পেশেন্টই একমাত্র তাকে চেনে, আর তিনিই কিছু জানাতে পারছেন না। তাই ওরা অন্য প্ল্যান করছিল।’

       ‘ফাক দেয়ার প্ল্যান! আমি তো বলেছিলাম ওদেরকে পেশেন্টের ঘরে পাহারা রাখার জন্যে ওরা রাখল না কেন? এখন কী হবে?’

       নোরা চুপ থাকলেন। কী জবাব দিবেন তিনি? তিনি নিজেও তো সেই তিমিরে। কেসটা এক দিক দিয়ে দেখলে চুকেই গেল। তার আর কোনো বাধ্যবাধকতা থাকছে না। তাও তিনি মন থেকে শান্তি পাচ্ছেন না। অনেক কিছুর উত্তর জানার বাকি আছে। 

       ‘নোরা?’

       ‘জী স্যার?’

       ‘এই কেসটা এভাবে ফেলে রাখা যাবে না। আমি পুলিশকে ইন্সিস্ট করব যাতে ওরা খোঁজ চালিয়ে যায়। আমি এখন থাইল্যান্ডে। ইউএস ফেরার আগে তোমার সাথে আরেকবার দেখা করব। উই উইল ডিসকাস ইট ফেইস টু ফেইস, ওকে?’

       নোরা কোনো উত্তর দিলেন না। হাত থেকে ফোন পড়ে গেল তার। 

       ‘কে? কে ওখানে?’

       ওপাশ থেকে কোনো উত্তর আসল না। নোরা মনের ভুল ভেবে উড়িয়ে দিতে পারলেন না— কেবলই কেউ একজনকে হেঁটে যেতে দেখলেন। বাসাতে তিনি একাই থাকেন। 

       ‘সামনে আসুন প্লীজ।’ নোরা পা টিপে টিপে ড্রয়িং রুমের দিকে গেলেন। তিনি ভিতু নন, কিন্তু এখন একটু ভয় ভয় করছে। 

       হঠাৎ তার পেছনে পায়ের আওয়াজ কানে আসল। তিনি চকিতে পেছনে ফিরলেন। কেউ একজন দৌড়ে মাস্টার বেড়রুম থেকে হল ঘরের দিকে ছুটে গেল। 

       নোরা এবার সত্যি সত্যি ভয় পেলেন। পিছু হটলেন আস্তে আস্তে। ড্রয়িং রুমের লাইটটা জ্বালিয়ে দিতে পারলে কিছু একটা করা যেতে। আস্তে আস্তে পিছু হটছেন, সামনে থেকে চোখ সরাতে পারছেন না। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় পর্যন্ত সজাগ হয়ে আছে। পিছু হটতে হটতে হঠাৎ তার পিঠে কিছুর ধাক্কা লাগল। ধীরে ধীরে পেছনে মাথা ঘুরালেন। যা দেখলেন তা দেখার জন্যে মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না তিনি। তার মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেললেন। 

       দৌড়ে পিছু হটার চেষ্টা করলেন কিন্তু কিছুর সাথে পা আটকিয়ে পড়ে গেলেন। পা মচকে গেল। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলেন। দুই সেকেন্ড নিঃশ্বাস বন্ধ করলেন তিনি। মনকে শান্ত করলেন। মনে মনে বললেন, এসব কিছুই না, এত রাত জাগার কারণেই মাথা ওলট-পালট হয়ে গিয়েছে। এখনই পেছন ফিরে দেখবেন কেউ নেই। 

       ডাক্তার নোরা পেছন ফিরলেন। তার ধারণা ভুল প্রমাণিত হল। 

       ‘মায়া…’ অনেক কষ্টে মুখ দিয়ে কথা বের করলেন তিনি। ‘আপনি?’

       মায়া কোনো কথা বলল না। তার পরনে সাদা শাড়ি। শাড়িতে শুকনো রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। রক্ত শুকিয়ে গাঢ় কালো হয়ে গিয়েছে। সে দুই পা সামনে বাড়াল। মুখটা খুবই অস্পষ্ট। তবে যতটুকু বুঝা যাচ্ছে, ডাক্তার নোরা দেখতে পেলেন মায়ার মুখে ভয়ানক কাটা দাগ। বীভৎস দেখাচ্ছে ওকে।

       নোরা দুই হাতে ভর দিয়ে নিজেকে পেছনে ঠেলার চেষ্টা করছেন। মায়া আরো সামনে আসল। 

       ‘আপনি এখানে কীভাবে আসলেন?’ 

       কোনো উত্তর নেই। 

       ‘প্লীজ আপনি বসুন। আমাকে এভাবে চমকে দিলেন কেন? আপনার খোঁজ করছিলাম আমরা সবাই। আপনার সাথে কথা বলতে চাই আমি।’

       ‘তুমি মরবে!’

       ‘কী বলছেন এসব?’ নোরার মুখ দিয়ে এবার আর একটুও কথা বের হচ্ছে না। একটু পানি পান করা প্রয়োজন। খুব তৃষ্ণা পেয়েছে। 

       ‘তুমি মরবে!’ মায়া হঠাৎ গগন বিদারী চিৎকার দিয়ে উঠল। নোরার রক্ত হিম হয়ে গেল। কথা বলা তো দূরের কথা নড়তেও পারলেন না তিনি জায়গা থেকে।

       মায়া শাড়ির আঁচল থেকে কিছু একটা বের করতে লাগল। নোরা প্রথমে বুঝতে পারলেন না। তিনি দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে থাকলেন। কিন্তু পারলেন না। পা খুব বাজে ভাবে মচকে গেছে। 

       মায়া শাড়ির আঁচল থেকে একটা রিভলবার বের করল। নোরা এবার আর থাকতে পারলেন না। ‘বাঁচাও…’ হামাগুড়ি দিয়ে প্রাণপণ পেছনে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। বেশি দূর যেতে পারলেন না। মায়া তার পথ আটকে দিল। 

       ‘বড্ড বেশি জেনে গেছ ডাক্তার! তোমাকে মরতে হবেই!’

       ‘প্লীজ…’ নোরা কোনো রকমে উচ্চারণ করলেন। ‘দয়া করুন… আপনি নিজেই তো আমার কাছে পেশেন্টকে এনেছেন। আপনিই তো আমার সাথে যোগাযোগ করলেন… প্লীজ… বন্দুকটা নামান… প্লীজ…’

       মায়া কোনো কথা বলল না। এক হাতে বন্দুক উঁচিয়ে রেখেছে। আরেক হাত রাখল নিজের পেটে। পেট এমন ভাবে ফুলে আছে কেন? নোরা এখনই বিষয়টা খেয়াল করলেন। আগে তো এমনটা দেখেন নি।

       ‘সরি ডাক্তার…’ 

       ওপাশ থেকে নোরা হটাৎ চুপ হয়ে যাওয়াতে ডাক্তার শামস বেশ অবাক হলেন। তিনি ফোন রেখে দেবেন ভাবছিলেন, হটাৎ গোঁঙানি মত আওয়াজ শুনলেন। ‘নোরা… নোরা… প্লীজ আন্সার মি… তোমার কী হয়েছে…’ ওপাশ থেকে কোনো আওয়াজ নেই, কেবল গোঁঙানির শব্দ। তারপর হঠাৎ টানা দুটো গুলির শব্দ। তারপর সব কিছু চুপ। 

       ডাক্তার শামস চেঁচাতে লাগলেন নোরা বলে। কিন্তু ওপাশ থেকে কোনো শব্দ আসে না। 

***

রাজীবের দম বন্ধ হয়ে আসছে গাড়ির ভেতর। বার বার বলেছে সে, এসি না দিলে ওর বমি আসে। কিন্তু বাবার এজমার সমস্যা আছে, তাই এসি দেয়া যাবে না। তার পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে স্ত্রীর যন্ত্রণা। পেছনের সিটে ওর পাশে উশখুশ করছে সে। মেয়েটা আসতে চাইছিল না। কিন্তু ওই জোর করল। 

       ড্রাইভিং সিটে বাবা আপন মনে গাড়ি চালাচ্ছেন। তার পাশে মা ঘুম। স্ত্রী জানালা দিয়ে কী যেন দেখতে চেষ্টা করছে। রাজীব তার কাঁধে হাত রাখল। টান দিয়ে হাত সরিয়ে নিল সে। 

       রাজীব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। স্ত্রীর পেটের দিকে তাকাতে ওর কষ্ট হচ্ছে এখন। বেচারা এখনো পেটে হাত দিয়ে বসে আছে। কী দোষ ছিল মেয়েটার? সব দোষ তো ওরই। ওর জন্যেই এত্ত বড় একটা ঘটনা হল। কিন্তু কী করবে সে? সন্দেহ নিয়ে যদি সে রাখতেও দিত, তাহলে কী সারা জীবন নিশ্চিন্তে থাকতে পারত সে? যে প্রাণ ভালবাসার কারণে আসেনি সে প্রাণের মূল্য কারও কাছে আছে?

      আছে নিশ্চয়। মায়ের কাছে আছে। শত হোক, নিজের ভেতর বেড়ে ওঠা প্রাণকে কোন মা মেরে ফেলতে দিতে পারে? 

       ‘গাড়ি দাঁড় করাও। আমি স্মোক করব।’

       রাস্তার ডান সাইডে গাড়ি দাঁড় করালেন বাবা। রাজীব নেমে গেল। ভাবল ওকেও বলবে নামার জন্যে। পাহাড়ি বাতাসে শ্বাস নিলে ভাল লাগবে। কিন্তু ওর মুখ দেখে আর সাহস পেল না। 

       দুইটা শলাকা শেষ করে সে ভাবল আরেকটা ধরাবে কীনা। কিন্তু বাবা দুইবার হর্ণ দিলেন। তাই অগত্যা ফিরতে হল। 

       সবে মাত্র দরজাটা খুলল সে, তখনি ঠিক সামনের বাঁক থেকে একটা ট্রাক উদয় হল। ট্রাক প্রচণ্ড গতিতে চলছিল, তাই ব্রেক করেও গতি কমানো গেল না। কেউ কিছু ভেবে উঠবার আগেই ভয়াবহ এক সংঘর্ষ হল। গাড়ি ধাক্কা খেয়ে খাদে পরে গেল। রাজীব পড়ল অন্য সাইডে। এরপর ওর আর কিছুই মনে নেই। 

***

ডাক্তার কাদের টেবিলে পায়ের উপর পা তুলে বসলেন। এই রুমে আগে কোনো টেবিল ছিল না, ছিলে কেবল দুইটা কাউচ। তিনি নিজে একটা টেবিল আনিয়েছেন। টেবিল একটা নেমপ্লেটের উপর লেখা, ড. কাদের সিদ্দিকী, এমডি, পিএইচডি। ডাক্তার নোরা অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পর তার পিএইচডি ডিগ্রীটা কমপ্লিট করা হয় নি। কিন্তু কি এসে যায়? 

       তার ফোন বেজে উঠল। যা সন্দেহ করেছিলেন তাই। বুড়োটা আবার ফোন করেছে। তিনি রিসিবার তুললেন। 

       ‘ডাক্তার নোরা! অসাধারণ একটা লিড পেয়েছি। এবার এই কেস সল্ভ হবেই হবে। আমি ইন্টারপোলকেও কাজে লাগিয়ে দিয়েছি, দরকার হলে সিয়াইএ লাগিয়ে দেবো। তারপরও…’

       কাদের ফোন রেখে দিল। নোরা অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পর ডাক্তার শামস পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন। পুলিশকে বলেন তিনি নাকি গুলির আওয়াজ পেয়েছিলেন। কিন্তু গুলি তো দূরের কথা পুলিশ ডেড বডিও খুঁজে পায়নি। ডাক্তার শামসের জন্য কষ্ট হয় কাদেরের। এতো বড় একজন বিজ্ঞানী এতো তাড়াতাড়ি ঝড়ে পড়লেন? 

       তবে তার কি এসে যায়? জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন তিনি। মন্দের ভালো— এত্ত বড় একটা কেবিন পেয়েছেন। নোরা না গেলে তো তিনি খেটেই মরতেন সারাজীবন, এখানে আসা হত না। তার ভাবনায় ছেদ পরে কলিং বেলের শব্দে। 

       পেশেন্ট এসেছে। 

(সমাপ্ত)