১
— ইরা না?
আমি চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিলাম এমন সময় প্রশ্নটা করল প্রীতি। নিজের অজান্তেই ভ্রু কুঁচকে গেল। ইরা এখানে? অবাক হওয়ার সাথে সাথে একটা ভীতিও বোধহয় কাজ করল। প্রীতি আবার সন্দেহ করবে না তো? এই পনেরো বছরের সংসার জীবনে প্রীতিকে যতটা চিনেছি, ও এতোটা পজেসিভ না। তারপরও, মেয়ে তো!
প্রীতি আর আমি মুখোমুখি বসে ছিলাম। আর প্রীতি প্রশ্নটা করেছিল আমার পেছনে তাকিয়ে। অর্থাৎ ইরা বলে যাকে সন্দেহ করছে সে আছে ঠিক আমার পেছনে। স্পন্টেনিয়াস রিয়াকশানে চায়ের কাপটা নামিয়ে প্রীতির দৃষ্টি অনুসরণ করে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালাম। ইয়েস। ইরা। গাড়ি থেকে নামছে। সাথের লোকটা ওর হাজব্যান্ড। একটা মেয়েও আছে সাথে। বোধহয় ওদের মেয়ে।
যদিও এক্সপেক্ট করিনি তারপরও রিয়াকশানটা হল। বুকটা ধক করে উঠল। এলাকাটা তাকিয়ে দেখছে ইরা আর ওর মেয়ে। মেয়েটা কিছুটা বিরক্ত। ইরা নির্লিপ্ত। ওর হাজব্যান্ড দুটো লাগেজ দুহাতে নিয়ে এগোতে শুরু করেছে।
ঘাড় ঘোরালাম। ঠিক সিওর না ইরা আমাকে দেখেছে কি না। দেখলেও রিয়াক্ট করেনি।
প্রীতির দিকে তাকালাম। ও আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ঠোঁটের কোণে দুষ্টুমির হাসি। কিভাবে রিয়াক্ট করব বুঝতে পারছি না। নিজেকে ডিফেন্ড করে কিছু বলতে গেলে ‘আমি কলা খাইনি’ টাইপ ব্যাপার হয়ে যাবে। তাই চুপ থাকাই বেটার মনে হল। কিছুই হয়নি এমন ভাব করে চায়ের কাপে চুমুক দিলাম।
কাজটা যে বোকামি হল সেটা সাথে সাথেই টের পেলাম।
— প্ল্যানড?
অযথা প্রচণ্ড মনোযোগ দিয়ে পেপারটা পড়ার চেষ্টা করছিলাম। সেখানে থেকে চোখ সরিয়ে প্রীতির দিকে তাকালাম। হাসছে। আর ওর হাসি বলে দিচ্ছে, আমাকে খোঁচানোর জন্য বলছে। ওর দুষ্টুমির উত্তরে আমিও দুষ্টুমি করতে পারতাম। করলাম না। ইচ্ছে করল না। শান্তভাবেই মাথা দুদিকে নেড়ে ‘না' বোঝালাম।
কিন্তু এরপরের কাজটা অনিচ্ছায় হয়ে গেল। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসল।
প্রীতির গোয়েন্দা চোখ মিস করল না ব্যাপারটা। নিজের চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলল
— এখনো দীর্ঘশ্বাস?
উত্তর কিছু না বলে শুধু প্রীতির দিকে তাকালাম। সেই চাহনিতে কি ছিল জানি না, প্রীতি টপিকটা ড্রপ করল। চোখের দুষ্টুমির ভাবটা সরে গিয়ে সাবলীল একটা ভাব আনল। এরপরে উঠতে উঠতে বলল
— চাইলে দেখা করে আসতে পার।
নিজেকে কষে একটা চড় মারতে ইচ্ছে করছিল।
কি করব বুঝে উঠতে না পেরে বলে ফেললাম
— সরি।
কাজে দিল না। অবশ্য সরিটা কেন বললাম, আমি নিজেই জানি না। হয়তো বোঝাতে চাইলাম, ওর জন্য এখনো দীর্ঘশ্বাস ফেলাটা অন্যায় হয়েছে। বাট… এসবের জন্য তো সরি কোন সলিউশান না। প্রীতি আর বসল না। উঠে গেল।
উঠে গিয়ে ওকে হাত ধরে আটকাবার চেষ্টা হয়ত করা যেত, কিন্তু করতে মন সায় দিল না। আমার সিক্সথ সেন্স বলছে, ও নিজেকে পরাজিত ফিল করছে। আর এর কোন রিমেডি নেই। আর এই মুহূর্তে তো নয়ই।
তাছাড়া কিছুটা সময় বোধহয় একা থাকতে ইচ্ছে করছে। প্রীতিরও। বোধহয় সেটাই চাইছে।
প্রীতি চলে যাওয়ার পরে ফিল করলাম খুব ইচ্ছে করছে ঘাড় ঘুরিয়ে আরেকবার তাকাতে। লজিক বলছে, ইরা আর ওখানে নেই। ভেতরে ঢুকে গেছে।
তারপরও। খুব করে মন চাইছে, আরেকবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতে। যদি না গিয়ে থাকে? যদি কোন কারণে এখনো দাঁড়িয়ে থাকে বাইরে?
বেশ কিছুটা সময় নিজের সাথে ফাইট করলাম। পারলাম না। ঘুরলাম। কেউ নেই। আরেকবার দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসল।
রিসোর্টটায় বেশ অনেকগুলো কটেজ আছে। প্রত্যেকটা কটেজের বাইরে একটা বারান্দা টাইপ জায়গা আছে। আর রুমের সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে দুই টাইপের কটেজ। এ টাইপ আর বি টাইপ। এ টাইপে ভেতরে দুটো রুম। আর বি টাইপে একটা। প্রতিটা রুমের সাথেই অ্যাটাচড বাথ। ইউজুয়ালি ফ্যামিলি নিয়েই সবাই আসে। সেটা কেবল হাজব্যান্ড ওয়াইফ হোক আর কিডস সহই হোক।
আজ আমাদের দ্বিতীয় দিন।
এই ফাঁকে আমার নিজের সম্পর্কে একটু বলে নিই। আমি ফয়সাল। পেশায় ডাক্তার। স্পেশালিটি হচ্ছে হার্ট সার্জন।
সেভাবে অবসর পাই না। টাকার পেছনে ছুটতে গিয়ে ফ্যামিলিকেও সময় দিতে পারি কম। সেদিন এক ফার্মা কোম্পানি গিফট হিসেবে এই রিসোর্টে তিনদিনের একটা প্যাকেজের অফার করে। এধরনের অনেক গিফটের অফারই পাই। বেশিরভাগই নষ্ট যায় আর নয়তো কাউকে দিয়ে দিই। এবার কেন যেন ইচ্ছে করল। হঠাৎ অপরাধবোধ জাগল, অনেকদিন পরিবারকে সময় দেয়া হয় না।
এনিওয়ে। যেমনটা বলছিলাম, আমরা গতকাল সকালে পৌঁছেছি। ঢাকার কাছেই। সকাল সকাল বেরোলে, ঘণ্টা খানেকের ড্রাইভ। নিজের গাড়ী নিয়েই এসেছি। নিজেই ড্রাইভ করে। গতকাল গেছে এলাকাটা ঘুরে ঘুরে দেখতে। অ্যামেজমেন্টের জন্য এখানে তেমন কোন ব্যবস্থা নেই। ছোট খাট একটা পার্ক টাইপ আছে। বেশ কিছু ফুলের বাগান। একটা সুইমিং পুল। ব্যাস।
খাওয়া দাওয়া খারাপ না।
আজকে করার মত তেমন কিছুই ছিল না। হয়তো প্রীতিকে নিয়ে ফুলের বাগানেই আবার যেতাম। বাট ইরা ইন্সিডেন্টের পর মনে হচ্ছে ভ্যাকেশানটা শিকায় উঠল। এতদিন পরে ফ্যামিলি নিয়ে বেরলাম!
কেমন এলোমেলো লাগছে সবকিছু।
সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগছে প্রীতির জন্য। প্রীতি কি অভিমান করেছে? মন বলছে করেছে। আর সেটা ওই দীর্ঘশ্বাসের জন্য।
বাট দীর্ঘশ্বাসটা আসল কেন? কিংবা ওটা কি প্রুভ করে? ইরা কি এখনো আমার মনের কোণে বাসা বেঁধে আছে? কিংবা সাবকনসাস মাইন্ডে? ওকে দেখে বুকটা ধক করে উঠল কেন? এখনো কি ওকে মিস করছি?
আমার ধারণা ছিল, ওকে পুরোপুরি মন থেকে সরিয়ে ফেলেছি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে...
তবে ডিজনেস্ট হাসব্যান্ড আমাকে বলা যায় না। ইরা সম্পর্কে প্রীতিকে আমি সব জানিয়েছি। আই মিন, যতটুকু জানালে চলে। আর সেটা বিয়ের আগেই।
প্রীতির সাথে আমার বিয়েটা অ্যারেঞ্জড। আমার এক খালা সম্পর্কটা আনেন। বাসায় সবার পছন্দ হয়। তখন একদিন প্রীতির সাথে আমার ওয়ান টু ওয়ান কথা বলা অ্যারেঞ্জ করা হয়।
একটা রেস্টুরেন্টে। এটা সেটা গল্প করার সময় ইরার কথা জানিয়েছিলাম। প্রেম যে ছিল আর সেটা ব্রেকাপ দিয়ে শেষ হয়েছে, দুটোই জানাই। কাউন্টার প্রশ্ন করেনি। শুধু শুনে গিয়েছিল প্রীতি। তখন কেন যেন মনে হল, ব্রেকাপের কারণটাও বলা উচিত। তাই কেন আমাদের সম্পর্কে শেষ দিকটায় তিক্ততা চলে এসেছিল, সেটা বলি। আর কিভাবে সেই তিক্ততা ব্রেকাপে গিয়ে থামল, সেটাও।
ব্যাখ্যাগুলোও বেশ শান্তভাবেই শুনেছিল প্রীতি। ওর কোন রিয়াকশান নেই দেখে নিজে থেকেই বলেছিলাম, যেহেতু ইরার বিয়ে হয়ে গেছে, আমার তরফ থেকে ঐ চ্যাপ্টার ক্লোজড। এরপরে প্রীতি সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম। জিজ্ঞেস করেছিলাম, ওর কোন পাস্ট আছে কি না। জানিয়েছিল, নেই। কেন যেন বিশ্বাস হয়নি। তবে সেটা ওকে বুঝতে দিই নি। দ্বিতীয় কোন প্রশ্নও করিনি।
আসলে প্রীতিকে বেশ ভালরকম পছন্দ হয়ে গিয়েছিল। বেশ বুদ্ধিমতি। সুন্দরী। সেই সময় বাংলাদেশের আর সব পাত্রের মত আমারও ছিল দুটি চাওয়া। বুদ্ধিমতি আর সুন্দরী। প্রীতি দুটোই।
এরপরে এই পনের বছর আমাদের দাম্পত্য জীবন খুব খারাপ কাটেনি। আমাদের দুটো ছেলে। দুজনকে মানুষ করার পুরো দায়িত্বটা প্রীতি একাই হ্যান্ডেল করেছে। অনেস্টলি স্পিকিং, শী ইজ ব্রিলিয়ান্ট অ্যাজ অ্যা ওয়াইফ অ্যাজ ওয়েল অ্যাজ অ্যাজ মাদার।
বড় একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। ধীরে ধীরে উঠলাম। রুমের দিকে এগোলাম।
আনকন্ডিশনাল সারেন্ডার করার মানসিকতা নিয়েই রুমে ঢুকলাম। প্রীতি নেই। পাশের রুমে ঢুকলাম। সেখানেও নেই। ঢোকার একটাই দরজা। এর মানে ও ওয়াশ রুমে।
বিছানায় বসে অপেক্ষা করা ছাড়া এখন কিছু করার নেই। সেটাই করছিলাম। কিন্তু কখন যে অতীতে ফিরে গিয়েছিলাম, নিজেই জানি না। আমার আর ইরার পাঁচ বছরের প্রেম, বিচ্ছেদ সবকিছুর একটা ফ্ল্যাশব্যাক দেখে ফেললাম। আরও কিছুক্ষণ হয়তো মেমোরি লেনে হাঁটতাম, ফিরে আসতে হল প্রীতির আওয়াজে
— চল
— কোথায়?
— ঘরে বসে কি করবে?
প্রীতির হাত ধরলাম। বিছানায় আমার পাশে বসালাম। ওর চোখে চোখ রাখলাম। বোঝার চেষ্টা করলাম ওর মনের অবস্থা। আমার ডাক্তারি চোখ বলছে, অভিমান হয়েছে। আর সেটা আমাকে বুঝতে না দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে।
আমার তাকিয়ে থাকার ভেতরে কিছু ছিল কি না জানি না, প্রীতি চোখ নামিয়ে বলল
— কি দেখছো?
‘তোমাকে' বললে রোমান্টিক শোনাত হয়তো, কিন্তু মিথ্যে বলা হত। মন চাইল না। কি বলব কথাগুলো গুছাচ্ছিলাম এমন সময় প্রীতি নিজে থেকেই বলল
— এখন না।
বলেই প্রীতি উঠে দাঁড়াল। যদিও তেমন কোন ইচ্ছে আমার ছিল না, তারপরও ওর কথার উত্তরে ছোট্ট একটা নড করে সম্মতি জানালাম।
ও এগিয়ে যেতে চাইলেও এগোতে পারল না। আমি হাত ধরে রেখেছি। এরপরে কি যে হল, আমিও উঠে দাঁড়ালাম। ওর অন্য হাতটাও ধরলাম। এরপরে, এতদিনের না বলা একটা অনেস্ট কনফেশান করে ফেললাম।
— সরি।
ম্লান একটা হাসি দিল প্রীতি।
— ইটস ওকে।
— আই হ্যাভ সামথিং টু কনফেস।
— কি ব্যাপারে?
— ইরার ব্যাপারে।
ভ্রু কুঁচকে গেল প্রীতির। ঠোঁটের কোণে ঝুলে থাকা দুষ্টুমির হাসিটা হারিয়ে গেল।
— মানে?
আমি আমার দুই হাত দিয়ে প্রীতির দুই হাত ধরে রেখেছিলাম। সেই হাতের দিকে তাকিয়ে বললাম
— পনেরো বছর আগে… ওর বিয়ের কিছুদিন আগে… একদিন… আই রেপড ইরা।
চলবে