প্রথম ফেলুদা পড়েছিলাম বললে ভুল হবে, বলা ভালো শুনেছিলাম। না অডিও বুক টুক কিছু নয়। আমার বয়স তখন ৫-৬ এর বেশি হবে না। অডিও বুক সে যুগে ছিলই না!
প্রথম বই অপ্সরা থিয়েটারের মামলা। ডবল ফেলুদা বলে আনন্দের একটি সংস্করণ বের হয়েছিল। ওতে ছিল অপ্সরা থিয়েটারের মামলা আর ভূস্বর্গ ভয়ংকর। পাশের বাড়িতে ছিল বইটা, সেই বাড়িতে এক স্নেহশীলা মাসি ছিলেন আমার। তিনিই পড়ে শুনিয়েছিলেন প্রথম গল্পটি। এরপরই যে ফেলুদা আমাকে পেড়ে ফেলল, বিষয়টি ঠিক তেমন না।
আরো কবছর পরে সিলেট আমার মেজোমামার বাসায় গিয়ে ফেলুদার সপ্তকাণ্ড হাতে পাই। সিলেট যতদিন থাকতাম সেই বইটা পড়তাম। ছোট ছিলাম তাই পড়তেও সময় লাগত। কিন্তু বাদশাহী আংটি পড়েই ফেলুদা ভালো লাগা মূলত শুরু। এরপর বাবু, মা কিনে দিয়েছেন প্রায় সব ফেলুদার বই।
ক্যাপশনের বইগুলো অবশ্য আমার নিজের না, ছবিটা ধার করা।
বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়-এই তথ্য সত্যি বলতে বেশ বড় হয়েই জেনেছিলাম আমি! আমার কাছে আগে তিনি লেখক! কারণ ওই যে, ফেলুদা দিয়ে চেনা! ফেলুদার মাধ্যমেই সত্যজিৎকে চেনা আমার। গোয়েন্দা কাহিনীর উত্তেজনার পাশাপাশি ভ্রমণকাহিনী-ইতিহাস আর নানাবিধ বিষয়ের যে সমাবেশ, তা আর কোন সিরিজে এত সুচারুরূপে চোখে পড়ে না। ফেলুদার হাত ধরে লখনৌয়ের ভুলভুলাইয়ার গোলকধাঁধায় ঘুরেছি, শুনেছি পাখির মতো গান করতে পারা নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের গান, ইলোরার দশাবতার গুহা আর মহাবলীপুরমের ঐশ্বর্যের পাশাপাশি হাজারিবাগের সৌন্দর্য আর রাজস্থানের সোনার কেল্লা জানার যে তীব্র রোমাঞ্চ তা এই বয়সেও সমান আনন্দ দেয়। আনন্দ দেয় ফেলুদার নানা জিনিস জানার আগ্রহ, কোন জায়গায় গেলে পায়ে হেঁটে ঘুরে শহরের প্ল্যান মাথায় তুলে নেয়ার আগ্রহ। বেনারসের প্রাচীনত্বের বিপরীতে অজপাড়াগাঁ গোসাইপুর বা ঘুরঘুটিয়া কোনটাই তো কম রোমাঞ্চকর নয়। আর কলকাতা! স্রেফ কলকাতা ঘোরার গাইড হিসেবেও কিন্তু ফেলুদা অনবদ্য, যেটা পরবর্তীতে জটায়ু ছদ্মনামে এক লেখক সন্ধানে ধন্দায় ফেলুদা বইতে চমৎকার দেখিয়েছেন ও।
ফেলুদা সকাল বিকাল নানা বিষয়ের বই পড়ে, অনুবাদ করে, রহস্যোদঘাটন না থাকলে মস্তিষ্ককে সচল রাখে সেভাবেই। ইনডোর গেমসের পাশাপাশি ভালো ক্রিকেট খেলে, যোগব্যায়াম করে। তোপসের চোখে ফেলুদা যেমনভাবে ধরা পড়ে, আমরা নিজেরাও তোপসে হয়েই সেভাবেই ফেলুদাকে দেখি পড়তে পড়তেই৷
আর জটায়ু! এমন সরল, রসিক, হৃদয়বান বন্ধু চরিত্রও তো কম বাংলা সাহিত্যে! সোনার কেল্লা থেকে পুরোপুরি ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছেন ভদ্রলোক ফেলুদা কাহিনীতে।
আমার চরিত্রের অনেক কিছুতেই ফেলুদার প্রভাব রয়েছে। ফেলুদা, তিন গোয়েন্দা, মুহম্মদ জাফর ইকবাল এর কিশোর উপন্যাস এবং কাকাবাবু এরা আমার শৈশবের সর্বকালীন সঙ্গী ছিল, এখনো মন খারাপ হলেই ফিরে যাই, এদের হাত ধরে সোনালি শৈশবে।