Posts

উপন্যাস

প্রেমিকার চিঠি ও ছবি পকেটে নিয়ে ৫৩ বছর...

June 10, 2024

রাহিতুল ইসলাম

Original Author রাহিতুল ইসলাম

মাঘের শেষ দিন। মুন্সিগঞ্জের একটি রিসোর্টে বসে আমরা অপেক্ষা করছিলাম বীর মুক্তিযোদ্ধা তানেসউদ্দিন আহমেদের জন্য। ৭৫ বছর বয়সী মানুষটি যখন এলেন, মনে হলো, এখনো ঝকঝকে তরুণ। আমরা কথা শুরু করলাম। ততক্ষণে গাছের ফাঁক গলে রোদ উঁকিঝুঁকি দিতে শুরু করেছে।

কমলারঙের জামার বুকপকেট থেকে একটা পাসপোর্ট সাইজের ছবি বের করে আমাদের দেখালেন তানেসউদ্দিন। হেসে বললেন, ‘ওর নাম জোহরা।’ ১৯৭১ সালে জোহরাকে রেখে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন তিনি। যুদ্ধ শেষে স্বাধীন দেশ পেয়েছেন, কিন্তু ভালোবাসার মানুষটিকে আর পাওয়া হয়নি তাঁর। দুষ্কৃতকারীর হাতে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। সেই থেকে ৫০ বছর ধরে প্রেমিকার ছবি বুকপকেটে নিয়ে বেঁচে আছেন তানেসউদ্দিন। তবে বিয়ে করেননি তিনি। ছবির মধ্যেই তিনি প্রয়াত জোহরাকে খুঁজে পান। তানেসউদ্দিন বলছিলেন, ‘স্বপ্নে আজও তাকে দেখি। জোহরার মতো সুন্দর আমার কখনো কাউকে লাগেনি। আর লাগার প্রশ্নই ওঠে না। ও এত ভালো, এত ভালো!’

১৯৬৭ সালে ঢাকার বোম্বে স্টুডিও থেকে জোহরার সাদাকালো ছবিটি তোলা। সেই থেকে ছবিটি তানেসউদ্দিনের পকেটে। ‘ছবি দেখেই আপনারা বুঝবেন, জোহরা কত সুন্দর ছিল, আদরের ছিল। সম্ভ্রান্ত পরিবারে ওর জন্ম,’ বলছিলেন তানেসউদ্দিন। কীভাবে ভালোবাসা এত প্রবল হল? চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে তানেসউদ্দিন আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যান ১৯৬৪ সালে।

 

প্রেমিকার ছবি হাতে বীর মুক্তিযোদ্ধা তানেসউদ্দিন আহমেদ
        প্রেমিকার ছবি হাতে বীর মুক্তিযোদ্ধা তানেসউদ্দিন আহমেদছবি: লেখক

                        

ফুফাতো বোনের সঙ্গে প্রেম

তানেসউদ্দিন আহমেদ তখন ক্লাস টেনে পড়েন। ফুফাতো বোন জোহরার সঙ্গে তাঁর প্রেম। জোহরা পড়তেন ক্লাস এইটে। কিশোর মনের চঞ্চলতা, ভীরুতা নিয়েই হয়েছিল সম্পর্কের শুরু।

তানেসউদ্দিনের এক চাচাতো ভাইয়ের বিয়ের আয়োজনে পরিবারের সঙ্গে বউভাতের অনুষ্ঠানে এসেছিলেন জোহরা। তখন সুযোগ বুঝে বন্ধুর কথা বলে জোহরাকে গোপনে একটা চিঠি দেন তানেস। চিঠি দেওয়ার পর তাঁর বুক ধুকপুক করতে থাকে। কী জানি কী হয়! জোহরা যদি বাড়ির লোকদের বলে দেয়, তাহলে কপালে দুঃখ আছে!

সাহস করে তানেস কিছুক্ষণ পর আবার জোহরার সামনে গেলেন। বললেন, ‘চিঠিটা কি দেখেছ?’ জোহরা শুধু হাসি দিয়েই যা বোঝানোর বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। আর তানেসউদ্দিনও পেয়ে গিয়েছিলেন একের পর এক চিঠি লেখার সাহস।

জোহরার ছোট ভাই বজলুর রহমানকে দিয়ে তানেস নিয়ম করে চিঠি পাঠাতে লাগলেন। জোহরা চিঠির উত্তর দিতেন না ঠিকই, কিন্তু চিঠি পেলে খুশি হয়ে ভাইকে টাকা দিতেন। এভাবে টানা ছয় মাস চিঠি চালাচালির পর তানেস একদিন জোহরাকে বললেন, ‘জেলখানার কয়েদি কি আহারও পায় না? সৌখিন আহার নয়, যতটুকু তার বরাদ্দে আছে, ততটুকু তো দেওয়া উচিত।’ এ কথার পর জোহরার কাছ থেকেও উত্তর আসতে শুরু করল।

জোহরার সঙ্গে দেখা করার জন্য প্রায়ই সন্ধ্যায় তানেসকে মেঘনা নদী পার হতে হতো নৌকায় করে। দেখা করে আবার নৌকায়ই ফিরতেন তিনি। একদিন তাঁদের সন্ধ্যায় দেখা হওয়ার কথা। আগে থেকেই জোহরাকে খবর দেওয়া হয়ে গেছে। সন্ধ্যায় মেঘনা নদীর ওপারে জোহরা অপেক্ষা করছিলেন। এদিকে পারাপারের জন্যও নেই কোনো নৌকা। কীভাবে ওপারে যাবেন তানেস?

উপায় না পেয়ে সাঁতরে মেঘনা পার হয়েছিলেন তিনি। ওপারে উঠে জোহরার সঙ্গে দেখা করেন তিনি। সেই রাতে উত্তাল জোয়ারের মধ্যে উন্মত্তের মতো ছুটে গিয়েছিলেন বলে জেহরার বকাও খেয়েছেন। তাতে কী, সম্পর্কের গভীরতাটুকু দুজন ঠিকই বুঝেছিলেন।

যুদ্ধের শুরু

১৯৬৭ সাল। শয্যাশায়ী বাবার পাশে বসে জোহরা কথা দিয়েছিলেন, কোনোদিন ছেড়ে যাবেন না। এরই মধ্যে তানেস-জোহরার প্রেমের ঘটনা দুই পরিবারে জানাজানি হয়ে গেল। জোহরার পরিবারের লোকেরা ক্ষেপে উঠলেন। তানেসের ফুফু এমন সম্পর্কে রাজি হতে পারলেন না। ততদিনে তানেসের বাবাও মারা গিয়েছেন। ফুফু তানেসের ওপর ভরসা করতে পারছিলেন না। সবার চাওয়ার বিরুদ্ধেও চলছিল তাঁদের প্রেম। জোছনার নরম আলোয় মেঘনা নদীর পাড়ের ঘাসের ওপর বেড়ে উঠছিল তাঁদের ভালোবাসার চারাগাছ।
একসময় ঘনিয়ে এল মুক্তিযুদ্ধের বছর, ১৯৭১। চারদিকে যুদ্ধের ডাক। সেই ডাকে সাড়া দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন তানেস। এ কথা শুনে কেঁদে বুক ভাসিয়েছিলেন জোহরা। প্রথমে আপত্তি করেছিলেন, কিন্তু পরে সম্মতি দিলেন ঠিকই।

তানেস জোহরাকে বলেছিলেন, ‘দেশ স্বাধীন করে তবেই তোমাকে বিয়ে করব। তুমি অপেক্ষা কইরো।’ বিদায় দেওয়ার সময় জোহরা তানেসকে ১০০ টাকার একটি নোট দিয়েছিলেন। আর বলেছিলেন, ‘রাখো, তোমার কাজে লাগবে। আর সঙ্গে আমার ভালোবাসাও রাইখো।’ দুই চোখে তখন অশ্রু গড়াচ্ছে জোহরার। তারপরও হাসিমুখে তানেসকে যুদ্ধযাত্রার জন্য বিদায় দিলেন তিনি।
জোহরাকে রেখে যুদ্ধে গেলেন তানেস । কলকাতা-আগরতলায় থেকে প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফেরেন তিনি।

তানেস লোকেশন রেকি করতে যান। মিটিং করেন। শত্রুপক্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। এভাবেই মুক্তিযুদ্ধের দিন কাটতে থাকে তাঁর। জোহরা কেমন আছে, কী করছে—এসব ভেবে মাঝেমধ্যে আনমনা হয়ে পড়েন। স্টেনগান মাথায় ঠেকিয়ে ভবিষ্যতের কথা ভাবতেন তানেসউদ্দিন। রণক্ষেত্রে বসেও মন পড়ে থাকত জোহরার কাছে। মেঘনার ওপার; যেখানে উত্তাল স্রোত ঠেলে যেতে হয়। যেখানে চাঁদের আলোর নিচে জোহরার আঁচল বিছানো থাকে।

 

ফেরা

১৯৬৭ সালে ঢাকার বোম্বে স্টুডিও থেকে জোহরার সাদাকালো ছবিটি তোলা
১৯৬৭ সালে ঢাকার বোম্বে স্টুডিও থেকে জোহরার সাদাকালো ছবিটি তোলা

১৯৬৭ সালে ঢাকার বোম্বে স্টুডিও থেকে জোহরার সাদাকালো ছবিটি তোলাছবি: সংগৃহীত

যুদ্ধে অংশ নেওয়ার তিন মাস পর একবার তানেস গ্রামে এলেন। বাড়িতে পৌঁছেই তিনি ছুটে গেলেন জোহরাকে দেখতে। জোহরাদের বাড়িতে তখন বহু লোকের আনাগোনা। দূর থেকে জোহরা ও তানেসের দেখা হলো, কিন্তু কথা হলো না। একজন আরেকজনকে বুক ভরে শুধু দেখলেন, কাছে যেতে পারলেন না।

সময় সীমিত হওয়ায় তানেস সেদিন ফিরে এসেছিলেন। রণাঙ্গনে দলের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। এরই মধ্যে একদিন খবর এল, জোহরা আর তাঁর বাবাকে দুষ্কৃতকারীরা গুলি করে হত্যা করেছে। তানেস বলেন, ‘শুনে আমি জ্ঞান হারাইছিলাম। জ্ঞান ফেরার পর একা একা খুব কাঁদছিলাম।’

এরপরের গল্পটা বিজয়ের। যুদ্ধ শেষে বিজয়ী হয়ে তানেস গ্রামে ফিরে আসেন। জোহরার স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে থাকতে শুরু করেন। বাকি জীবনও তিনি এমনিভাবেই কাটাতে চান। ছবি ও চিঠি আঁকড়ে রেখেই তানেসউদ্দিন আহমেদ তাঁর জোহরাকে কাছে পান।

Comments

    Please login to post comment. Login