Posts

গল্প

জন্মকথা

May 2, 2024

আযাহা সুলতান

Original Author আযাহা সুলতান

হৃদ্য, অ হৃদ্য, কোথায় লুকিয়ে আছিস রে কামচোর? শুনতে কি পাস না? হারামজাদাটার কাণ্ড দেখো ত—শুনেও শুনে না! হে আল্লাহ্‌, এমন অপদার্থ সন্তান যেন কারও কপালে না জুটে। রাগে আগুনজ্বলা জ্বলছে আর গজগজ করে পালাক্রমে কথাগুলো বলে যাচ্ছে গৃহিণী নিনা জোয়ার্দার। এমুহূর্তে হৃদ্যকে পেলে বোধ হয় সিদ্ধ ছাড়া আলুভর্তা বানিয়ে তবেই দম নিত বোঝা যায়। 
 
একটুপর হৃদ্য কোত্থেকে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলল, আ-ম্বা, আ-স-সি ট। রাঁধার কাজে ব্যস্ত নিনা ওর দিকে না-দেখেই আপনা-আপনি বলে যাচ্ছে, হাতির মতো হয়েছে খেয়ে তবু আজও ‘মা’ শব্দটাও সুন্দর করে বলতে পারে না জানোয়ার। এত করে বলি, ‘আম্মা’ ‘আম্মা’ বলবি। আর ঐ হাবার নবাব ‘আম্মা’ বলতে গেলে মুখে গজায় তার গজেন্দ্রের দাঁত (কণ্ঠ বিকৃত করে) বলবে ‘আম্বা’ ‘আম্বা’ যেন মা-হারা গাভির বাচ্চা ডাকছে ‘হাম্বা’ ‘হাম্বা’ করে—হাবা কোথাকার। কাচের একটা পাত্র হাতে দিয়ে বলছে, ধর, এটা নিয়ে শান্তার মাকে দিয়ে আয়। আর পারলে একটাকে ভেঙে চারটা করিস, তোর ত আবার সেই আদত।  
 
হৃদ্য বারো বছরের কাণ্ডজ্ঞানহীন বালক। নিনা জোয়ার্দারের স্বামী জিরান হায়দার বারো বছর আগে আঁস্তাকুড়ে পেয়েছিল তাকে। হয়তো কোনেক কুমারিত্বহারা কলঙ্কের ত্যাগত ফল। নিনা একসময় তাকে সন্তানের মতো দেখেছে ঠিকই কিন্তু ইদানীং চাকরের চেয়েও বেশি অবজ্ঞা দেখা যাচ্ছে। ঘর থেকে কিছু হারিয়ে গেলে, হৃদ্য হারামজাদাটার কারবার। স্বামীর কোনো শুভকাজে অশুভ হলে, হৃদ্য মনহুচটাকে দেখে গেলে ত অমন হবেই। সদাই আনতে গিয়ে কিছু ভুলে আসলে বা হারিয়ে এলে (স্বামীকে লক্ষ্য করে) কত বলছি তোমাকে, এই হতচ্ছাড়াকে সঙ্গে নিয়ো না, তুমি আমার কথা শুনলেই ত হয়। কদমে কদমে সে নিনার কাছে অপরাধী। যেন তার হালের গরুর গোঁজকাটা পরম শত্রু। ধীরে ধীরে নিনার এমনই চক্ষুশূল হয়ে ওঠে সে, পারলে গলাটিপে হত্যা করে এমুহূর্তেই আপদ তাড়ায়। তবে তার সেই সামর্থ্য আছে বলে মনে হয় না। কারণ, জিরান হৃদ্যকে সন্তানের মতো ভালবাসে। তাই সমস্ত অত্যাচার স্বামীর অগোচরেই হয়? এমন কথা আমরা পরিষ্কার বলতে পারব না। সমস্ত অত্যাচারই যে স্বামীর গোচরে হয়, একথাও আমরা তর্জনি হাঁকিয়ে দেখিয়ে দিতে পারি না। এব্যাপারে আমাদের বক্তব্য নিখুঁত করা গেল না।
 
নিনা যেটা অনুভব করতে পারে না বা পারলেও বর্তমানে ভুলে গেছে, সেটা জিরান কীভাবে ভুলতে পারে! এটা আমাদের বুঝে আসে না। তাদের একসময় কেটেছিল খুব অভাব-অনটনের মধ্যে দিয়ে। আজ বলতে গেলে পাহাড়সমান সম্পদের মালিক তারা! সংসারে কিন্তু কে কার উছিলায় টাকা কামাই করে এবং কে কার উছিলায় বড়লোক হয় একমাত্র উছিলাকারী ছাড়া কেউই বলতে পারে না। এখানে তবে স্পষ্ট বলা না গেলেও ধারণা হয়, হৃদ্যের উছিলায় জিরান আজ উন্নতির চূড়ায়। কেননা, যেদিন হৃদ্যকে ঘরে আনে সেদিনই চাকরিতে বিরাট পদোন্নতি তার, সামান্য শ্রমিক থেকে তত্ত্বাবধায়ক এবং বছরদুয়েকের মধ্যেই একেবারে প্রধান পরিচালক—প্রায় দুই-তিন হাজার লোকের প্রতিনিধি। তারপর বছরদেড়েক যেতে-না-যেতে কোম্পানির অংশীদারিত্ব পাওয়া—এসবে চিন্তা করলে একটাই যোগফল মিলে—হৃদ্য। হৃদ্যের উছিলায় হয়তো লটারির মতো একের পর এক ভাগ্যচক্রের চাকা ঘুরে জিরানের জীবনটা দ্রুত পরিবর্তন হয়েছে বলা যায়। একথা আমরা জিরানের বন্ধুবান্ধবের আড্ডায় জিরানের মুখ থেকেও বহুবার শুনতে পাই—একজন প্ল্যাস্টিকসামগ্রী-প্রস্তুতকারক-কোম্পানির শ্রমিক মাত্র... 
 
 তাদের দাম্পত্যজীবন বিরাট এক শোকের মধ্যে অতিবাহিত হচ্ছে। ডাক্তার সাফ বলে দিয়েছে, নিনার গর্ভধারণ-ক্ষমতা অক্ষম। নিনা ভীষণ দুঃখিত। তবে জিরান ভাগ্যের উপর প্রসন্ন। তবু—গাছের সৌন্দর্য যেমন শাখাপ্রশাখা—প্রত্যেক জিনিসেরই একটা সৌন্দর্য আছে এবং থাকে। তাই মানতসানতেরও কোথাও অবহেলা করা হয়নি। যে যেখানে বলেছে ছুটেছে এবং যেটাই করতে বলেছে করেছে। জিরানের মা-বাবা চিন্তিত—ছেলের একটা সদগতি হওয়া দরকার। প্রত্যেক অভিভাবকের এটা নিয়ম—ছেলেমেয়ে অসুখী থাকলে মা-বাবার শান্তির ঘুম হারাম। এমন সময় জিরানের সংসারে হৃদ্যের আগমন। জিরান মাটি ধরলে কবে তা সোনায় পরিণত হচ্ছে সে নিজেও টের পাচ্ছে না আর। এক সোনালি ভোরের অধ্যায় থেকে শুরু হয় তার সোনালি দিনের যাত্রা। এ ভোরের কথা সে কোনো দিন ভুলতে পারেনি। কারণ, এ ভোরে হৃদ্যকে ডাস্টবিনের ময়লায় তলিয়ে যাওয়ার থেকে উদ্ধার করেছিল সে। আরেকটু দেরি হলে বোধহয় গল্পের দৃশ্যপট অন্যরকম হতো। 
 
খুব ভোরে ওঠে জিরানকে বাস চাপতে হতো চাকরির উদ্দেশ্যে। একদিন জনশূন্য বাস স্টপে এসে দেখছে, পাশে ডাস্টবিনের লক্ষ্যে বিক্ষুব্ধ কাকের চিৎকার। পরিষ্কার কানে আসছে একটি নবজাতকের কান্না! এদিক-ওদিক সবদিকে ঘুরেফিরে দেখল কোথাও মানুষজনের সাড়াশব্দ নেই। ডাস্টবিনে দেখতেই হতবাক—নাড়ি পেঁচানো সদ্য জন্ম নেওয়া একটি রক্তাক্ত শিশু! তাড়াতাড়ি উঠিয়ে টিফিনের কাপড়ের থলিটা দিয়ে বেড়িয়ে নেয় কোলে। তারপর একদৌড়ে বাড়ি এসে স্ত্রীর কোলে দিয়ে বলছে, মাকে ডাকো। টাকা কিছু হাতে দিয়ে—বাবাকে বলো তাড়াতাড়ি ডাক্তার নিয়ে আসতে বলেই দ্রুত বের হয়ে যায়। নিনা অবাক। কিছু জিজ্ঞেস করবে সেকথা থাক, স্বামী কী বলে গেল সেটাও খেয়াল করতে পারেনি! 
 
সাধারণত অসুখবিসুখ ছাড়া চাকরিতে জিরানের গরহাজিরি একদম নেই বললেই চলে। ডিউটিতে সবার আগে পৌঁছার সুনামও বেশ রয়েছে তার। আজ ছুটির পর এতটু সময় অপচয় করেনি কোথাও। মাঝের মাধ্যে বন্ধুবান্ধবের আড্ডায় বসে একটু খোশগালগল্প করার বদাভ্যাস আছে ঠিক। আজ কীভাবে তাড়াতাড়ি ঘর পৌঁছবে সেই চিন্তায় মন অস্থির। কীভাবে শোনাবে কুড়িয়ে পাওয়া রত্নের কথা। খুশির আনন্দে মন উড়ুক্কু। ঘরে এসে শিশুটির কাহিনী শোনাতে পারলে বোধহয় হৃৎস্পন্দের গতির মাত্রা একটু কমতে পারে। মনে মনে একটা প্রতিজ্ঞাও করেছে—এ ছেলেকে নিজের সন্তানের পরিচয়ে মানুষ করবে। চাকরির থেকে আসতে আসতে ‘কাফি’ ‘আফি’ ‘রাফি’ ‘শাফি’ ‘উদয়’ ‘হৃদয়’ ‘দীপন’ ‘দীপ্ত’ এরকম আরও অনেকটা নামও ভাবা হয়েছে। 
 
বাবার কথা তবে সত্যি হলো—এধরনের সন্তান যাদের কপালে জুটে তাদের সংসার সৌভাগ্যমণ্ডিত হয়। হৃদ্য বছরচারেকে পড়লে নিনা গর্ভবতী হয় তারপর জন্ম নেয় একটি ছেলে—নাম রাখা হয় ‘শুভ’। শুভর দুবছরের মাথায় জন্ম হয় একটি কন্যা—নাম রাখা হয় ‘সূচনা’। সূচনার সুন্দর মুখ দেখা জিরানের মা-বাবার নসিব হয়নি। শুভর জন্মের বছরখানের মধ্যেই—কিছু দিনের ব্যবধানে মা-বাবা পরপারে চলে যান। তারপর ধীরে ধীরে নিনার কাছে ‘হৃদ্য’ নামটা চোখের কাঁটায় পরিণত হতে থাকে এবং সূচনার জন্মের পর একেবারে অসহ্য।  
 
‘হৃদ্য’ নামটা তবে জিরানের বাবার দেওয়া। ভদ্রলোক অল্পশিক্ষিত হলেও একজন শিক্ষিত লোকের জ্ঞান রাখত। তার কারণ, শিক্ষিতজনদের সঙ্গে ওঠাবসা এবং বিভিন্ন বইপত্তর পড়া। যত দিন তিনি জীবিত ছিলেন কার সাধ্য ছিল হৃদ্যকে ‘হুঁ’ বলে। এমন মায়া করতেন, যেন হারিয়ে পাওয়া তাদেরই নাড়িছেঁড়া ধন। আর তিনিবা কেন, তার স্ত্রী ও ছেলে জিরান এবং পুত্রবধূ নিনাও ত কম করত না। এটা স্বাভাবিক, কেননা তাদের সংসারে তখন শুভ-সূচনার মতো সুসন্তানদের আসার সম্ভাব্যকোনো চিহ্নই ছিল না। ওদের অপ্রত্যাশিত আগমনে যেখানে খুশির জোয়ার বইছে সেখানে কুড়িয়ে পাওয়া কুড়োর হাবাগিরি কারও-না-কারও কাছে অসহ্য হবেই। এটাই সম্ভবত দুনিয়ার দস্তুর—যতই কাজের জিনিস হোক, নিজসন্তানের মমতার কাছে কোনো জিনিসই বড় নয় আর এখানে ত হৃদ্য অসম্পূর্ণও বটে। অতএব এটা জিরানের কাছে তেমন একটা গুরুত্বের ব্যাপার না হলেও কিন্তু নিনার কাছে সন্তানপরিচয় আজ লজ্জার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে! হৃদ্যকে সে এখন অনেকটা বোঝা মনে করছে। সংসারে মানুষ যেখানে নিজের বোঝা বইতে অক্ষম, সেখানে...সচরাচর মেয়েদের মন মনে হয় এমনই হয়? 
 
হৃদ্য কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারে বা করবে এ ক্ষমতা ক্ষমতাবান তাকে দান করেনি। নিজের উপর যতই অন্যায় বা অত্যাচার হোক নীরবে সহ্য করবে। যতই মার খাক কখনো এক ফোঁটা চোখের পানি ঝরবে না। দেখা যায়, গাধাটা একটুপর আবার হাসচ্ছে। এ জীবটাকে সৃষ্টিকর্তা মনে হয় জ্ঞানহারা করার সঙ্গে সঙ্গে যেকোনো অনুভূতিহারাও করেছে! পড়ার মেধাশক্তি নেই কিন্তু স্কুলে যাওয়ার আগ্রহটা প্রবল। জিরান দুয়েকবার স্কুলে ভর্তি করেও সার্থক হতে পারেনি। শিক্ষকদের মন্তব্য, বাকপ্রতিবন্ধীও আজকাল পড়তে পারে এবং সুশিক্ষিত হতে পারে। অন্ধজনও শিক্ষিত হওয়ার ক্ষমতা রাখে। তবে হৃদ্যের মধ্যে এ লৌকিক জ্ঞানটুকু নেই। তাকে দেখিয়ে দিলে কিছু কিছু কাজকর্ম করতে পারবে ঠিক কিন্তু নিজের থেকে জ্ঞান খাটিয়ে কিছুই করতে পারবে না। তাকে অন্যরকম এক মানসিক প্রতিবন্ধী বলা যায়। সেজন্যে আমরা দুঃখ বোধ করব না, দুঃখ বোধ করব এজন্যে যে, প্রভু প্রতিবন্ধী সৃষ্টি করুক কিন্তু তাকে একটা ভালো আশ্রম দান করুক। আর এভাবে কোনো প্রসূতি হৃদ্যের মতো সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া গর্ভধনকে আঁস্তাকুড়ে ছুড়ে ফেলে শিয়াল-কুকুরের খাদ্য না-করুক—দোহাই—কেননা, কারও সামান্য আনন্দে অসামান্য বেদনার গল্প সৃষ্টি হোক, আমাদের কাম্য নয়। 
 
হৃদ্য আজকাল খুবই অসুস্থ, পাণ্ডু ধরা পড়েছে তার। ডাক্তার বলেছে, কিছু দিন বিশ্রামে থাকলে এরোগ তাড়াতাড়ি সেরে যেতে সক্ষম। সুতরাং চিন্তার কোনো কারণ নেই। কিন্তু হৃদ্যের কপালে তা জুটলেই ত হয়। শুভ আর সূচনাকে প্রতিদিন স্কুলে নেয়া-আনা, বাজারসাজার এবং ঘরের বিভিন্ন কাজকাম সে ছাড়া আর করবেইবা কে। 
 
হৃদ্য, অ হৃদ্য, (নিনার নিত্যকড়াডাক শুনে সে রীতিমতো ভয়ে কাঁপছে—ছটপট বিছানা থেকে ওঠে দৌড়ে আসে) টাকা একশো হাতে দিয়ে বলছে—পারিস ত হারাইস। যা, শুভসূচনাকে স্কুলে দিয়ে আয় আর আসার সময় মঞ্জুর দোকান থেকে চারটা ডিম আর একটা পাউরুটি আনিস। কোথাও দাঁড়িয়ে আবার তামাশা দেখিস না, তাড়াতাড়ি আসিস। পারলে ডিম চারটাকে ভেঙে একখানে করিস। কয়লা ধুইলে যেমন ময়লা যায় না, তোর স্বভাবও তেমন পরিবর্তন হবার নয়। 
হৃদ্য কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল, আ-ম্বা, আ-মা-র ক্যা-ন জা-নি লা-গ-চে। (হৃদ্যের কথাগুলো একটু তোতলাকারে) ‘কী বললি কামচোর’ বলে ঠাস করে গালে তার সজোরে এক চড় মারে। আরেকটা মারার আগে আগে ‘এঃ এঃ করকি! করকি!’ বলে জিরান তাড়াতাড়ি এসে হৃদ্যকে বুকে জড়াইয়া ধরলে জানতে পারে তার জ্বরের কথা। কপালে হাত রেখে—হায় হায় একি! ছেলেটা যে একেবারে পুড়ে যাচ্ছে, মানুষ নাকি তুমি। জানোয়ারও ত জানোয়ারের প্রতি মমতা রাখে। কড়াগলায় বলছে, দেখ নিনা, আমি এগুলো আর সহ্য করব না। দরদ বলতে যদি তোমার কিছু না থাকে—থাকতে পারে; তবে আমার আছে, আমি এমন নির্দয় হতে পারব না। তারপর স্বামী-স্ত্রীতে তুমুল লড়াই...হৃদ্যের জন্মকথা...তাদের দরিদ্রতার কথা...উত্থানের কথা...ইত্যাদি—অনেক কথাই ওঠে আসে। নিনা কোনো কথা বা কোনো যুক্তি শুনতে ও মানতে রাজি না। অতঃপর...নিনা...‘থাকো তোমার আদরের ছেলেকে নিয়ে’ বলে সন্তানদুটোকে নিয়ে দ্রুত বের হয়ে যেতেই কাজের মেয়েটি মেমসাহেবকে অনেক মিনতি করে এবং রুখানোর অনেক চেষ্টা করে কিন্তু কে শুনে কার কথা। 
 
হৃদ্য কাঁদছে আর জিরানের হাতধরে টানছে এবং বলছে, ‘ও-ঠ বা-ব্বা, আ-ম্বা চ-লে যা-চ্চে গা, আ-ম্বা-কে ফি-রা-তে হ-বে যে...জিরান হেঁচকা দিয়ে হাত মুক্ত করে অভিমানী গলায় বলছে—দূর হ জানোয়ার আমার সামনে থেকে বলে দ্রুতপায়ে সেও ঘর থেকে বের হয়ে যায়। 
 
হৃদ্য বিছানায় শোয়ে কাঁদছে আর ভাবছে তার জন্মকথা। আজ প্রথমবার শুনেছে সে তার জন্মের কাহিনী। চোখের পানি তার কে রোধ করে। জন্মের সকল কান্না এবং সকল দরদ যেন আজ অনুভব হতে লেগেছে! স্রষ্টা মনে হয় আজ তাকে বোঝার ক্ষমতা এবং উপলব্ধি-অনুভূতি সকলপ্রকার জ্ঞান একসঙ্গেই দান করেছে! এদিকে জ্বরের তাপে শরীর চুর হয়ে যাচ্ছে। ‘হুঁ...হাঁ’ শব্দ করে করে জোরে জোরে গোঙাচ্ছে। কাজের মেয়েটি হৃদ্যের গোঙানি শুনে ছুটে আসে এবং দেখে মারাত্মক অবস্থা—জ্বরের বেগে ছেলেটি কী পরিমাণ কাঁপছে! এদিক-ওদিক খুঁজে একটা জ্বরের ট্যাবলেট খাইয়ে দেয়। তারপর মাথায় পানি ঢেলে সমস্ত শরীর মুছে দিয়ে জ্বরপট্টি লাগায়। কী খাবে জিজ্ঞেস করে। অবস্থা বেগতিক দেখে জিরানের কাছে ফোন করে হালত জানালে জিরান ‘আমি শিগগির আসছি’ বলে এসব সেবাশুশ্রূষা ঘনঘন করার আদেশ দেয়। 
 
হৃদ্যকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে আজ দুদিন। তার সেবাযত্নের জন্যে আছে মাত্র কাজের মেয়েটি। নাম—সুমনা। বয়স—উনিশ কি বিশ। সাহেবের বিষণ্ন মুখ দেখে নিনার কাছে ফোন করে সে হৃদ্যের অবস্থার কথা জানাল। নিনা ‘মরুক গে’ বলে ফোনকল কেটে দিল। কোনো কিছু বুঝিয়ে বলার সুযোগটাও দিল না একবার।
 
চার দিন পার হচ্ছে হৃদ্যের কোনোরকমের উন্নতি দেখা যাচ্ছে না। পাশে বসে মাথায় হাত বুলাচ্ছে জিরান, একটু তফাতে বসে আছে সুমনা। হৃদ্যের চোখ দিয়ে অঝরধারায় গড়িয়ে পড়ছে জল। বলছে—বাবা, একি! হৃদ্যের আওয়াজ আজ এভাবে স্পষ্ট হলো কী করে! এ ত বিরাট কুদরতি ব্যাপার! এখন একটুও তোতলাচ্ছে না যে! বাবা, আম্মার কথা খুব মনে পড়ছে, মনে পড়ছে খুব শুভ আর সূচনার কথা। একবার তাদের দেখতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে বাবা। ওদেরকে নিয়ে আস-না, একবার দেখি। আমি আর বাঁচব না ত বাবা। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। জিরান ধমক দিয়ে—কে বলছে তুই বাঁচবি না। আল্লাহ্ বাঁচাবে তোকে—অবশ্য সুস্থ করে দেবে। সান্ত্বনার গলায় আরও বলছে—তুই কি কারও দোষ করেছিস। আর তোর হয়েছেইবা কী, এমন অসুখবিসুখ স্বাভাবিক হয় বাবা। আমি অনেক বড় বড় ডাক্তার দেখাব তোকে। আমার কি আজ টাকার অভাব আছে বলে বুকে জড়িয়ে ধরে সেও কাঁদতে লাগল। সুমনাও কাঁদছে—কেঁদে কেঁদে বলছে, সাব, মেমসাবকে একটা ফোন করেন-না আপনি; আপনি কইলে অবশ্য আইবে। রিদুর অবস্থা খুববেশি ভালো লাগছে না আমার। জিরানের মায়ের মতো সুমনাই একমাত্র হৃদ্যকে ‘রিদু’ বলে ডাকে। 
 
স্বামীর কল দেখে নিনা ফোন ধরছে না। নিনার মা বললেন, ফোন ধরলে এমন কী গজব হবে শুনি, কী বলতে চাচ্ছে অন্তত সেটা ত একবার শুনবি।
নিনা অসহ্যগলায় বলল, কী আর বলবে, হারামিটা হসপিটালে...মরলে ত বাঁচি।
মা বললেন, এমন বলতে নেই রে নিনা, আল্লাহ্‌ তোকেও ছেলেপুলে দিছে। কাউকে এমন হিংসে করতে নেই মা, একদিন নিজেকেই সব ভোগতে হয়। অতীত ভুলে যাওয়া মানুষ অনেকবেশি কষ্ট পায়। কথাটা সব সময় মনে রাখিস। 
 
নিনা ফোন ধরল। ওদিক থেকে জিরানের কান্নামিশ্রিতকণ্ঠ—হৃদ্য প্রতিমুহূর্তে তোমাদের কথা বলছে। তোমাদেরকে একবার দেখতে চাচ্ছে। বাঁচার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ডাক্তারেরাও তেমন একটা আশাবাদী নয়। তুমি তার কাছে ক্ষমা চাওয়া একান্ত দরকার। কারণ, যার দোষ করে সে যদি ক্ষমা না করে স্রষ্টারও ক্ষমতা নেই তাকে মাফ করে। সুতরাং আর বেশি কিছু বললাম না বলে হাসপাতালের ঠিকানা দিয়ে বলল, যদি ইচ্ছে হয় এক্ষুনি আস। নিনা আর একমুহূর্ত দেরি না করে হাসপাতালে ছুটে এল। হৃদ্য নিনাকে ও শুভ-সূচনাকে দেখতে পেয়ে খুব খুশি হলো। শুভকে আর সূচনাকে জড়িয়ে ধরে বারবার চুমু খেল, খুব আদর করল। নিনাকে লক্ষ্য করে বলল, আম্মা, আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি, পারো ত আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো আম্মা। এজন্মে যদিওবা তোমার কোলে জন্ম নিতে পারিনি আমি, কিন্তু ওজন্মে ঠিকই তোমার কোলে জন্ম নেবো। আল্লাহ্‌র কাছে এটুকু চাইব। এ জীবনের যত না-পারা সেই জীবনে যেন পুরা করতে পারি আম্মা, স্রেফ—এতটু দোয়া আমার জন্যে করো। হৃদ্যের কথা শুনে নিনা অবাক। মনের সমস্ত বিষ তার সঙ্গে সঙ্গে পানিতে পরিণত হয়। সজোরে বুকে চেপে ধরে বলছে, কে বলেছে তুই আমার কোলে জন্ম নেসনি। তুই আমারই বুকের ধন, শুভ আর সূচনা তোরই আপন ভাইবোন। আমি তোর প্রতি অনেক অন্যায় করছি রে হৃদ্য, অনেক তোকে মেরেছি; এ অপরাধিনী মাকে একবার মাফ করে দে রে বাপ, একবার মাফ করে দে বলে খুব কাঁদল। 
হৃদ্য কেঁদে বলল, আম্মা, আমি আল্লাহ্‌কে ত কোনো দিন দেখিনি, তবে তোমাদেরকে দেখেছি। আমি তোমাদেরকে অনেকবেশি ভালবাসি। তুমি কোনো দিন অনুভব করতে চাওনি আম্মা। তবে আল্লাহ্‌কে যদি কোনো দিন দেখি—জিজ্ঞেস করব এমন জীবন আমাকে কেন দিল।  
নিনা—আমি অন্ধ হয়ে গেছিলাম রে বাপ, তুই আমার সকল অন্ধত্ব দূর করে দিলি হৃদ্য। আমরাও তোকে অনেকবেশি ভালবাসি, তুই কোনো দুঃখ মনে রাখিস না বাপ। হৃদ্যের কথায় সকলের চোখ দিয়ে ঝরঝর করে অশ্রু পড়ছে। 
 
হৃদ্যকে অবশ্য শুভ-সূচনার মতো ভালবাসত জিরান। তার হারানোব্যথা জিরানকে পাগলের মতো করে দিল অনেকটা। নিনাও আজ তাই। এখন হাড়ে হাড়ে টের পারছে তারা হৃদ্যের তাৎপর্য। কিছু জিনিস সহজে পেলে তার কদর হয় না। কিছু জিনিস হারিয়ে গেলে মানুষ তার মর্যাদা বুঝে। হৃদ্য চলে যাওয়ার পর থেকে জিরান একবিন্দু সুখ উপলব্ধি করতে পারেনি কোনো দিন, না করতে পেরেছে নিনা। সংসারে নেমে এল বিপর্যয়। আস্তে আস্তে জিরানের সমস্ত ব্যবসাবাণিজ্যে অবনতি দেখা দিল। তখন দুজনারই বোঝার বাকি রয় না—তাদের সংসারে হৃদ্যই একমাত্র উন্নতির সিঁড়ি ছিল। 
 
কিছু মানুষ পৃথিবীতে আসে আবার চলে যায়—কারও জন্যে কিছু করতে না-পারার মধ্যেই আবার অনেক কিছু করে যায়। তার কিছু স্মৃতি, কিছু কথা এবং কিছু মায়ামমতা অন্যদেরকে আজীবন কাঁদায়। হৃদ্য চলে গেল, রেখে গেল জিরানের সংসারে অনেক স্মৃতি, দুঃখকষ্ট, হাসিমাতি ও নির্বুদ্ধিতা। 

 

Comments

    Please login to post comment. Login