শেষ প্রত্যাবর্তন
বৃষ্টির শব্দ থামার কোনো লক্ষণ নেই। পাহাড়ি এলাকায় এমন বৃষ্টি একবার শুরু হলে সহজে থামে না। সুপ্তি ভেজা শরীরে স্নানঘরে ঢুকল। শাওয়ার চালিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। চোখ-মুখ ভিজে যাচ্ছিল, অথচ শরীর থেকে শীতল আতঙ্ক যেন কাটছে না।
সকালের ঘটনাগুলো বারবার মনে পড়ছে। সিয়াম তার হুইলচেয়ারে বসে জানালার পাশে তাকিয়ে বলেছিল, “শুপু, জানো, বৃষ্টিকে আমি কত ভয় পাই?”
সুপ্তি হেসে উত্তর দিয়েছিল, “তুমি জানো না, আমি বৃষ্টিকে কতটা ভালোবাসি।”
তখন সব স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু বিকেলের সেই মুহূর্তে যখন সিয়াম নিখোঁজ হয়ে গেল, সুপ্তির মনের ভেতর কিছু একটা ধসে পড়ল। প্রতিবেশীদের নিয়ে খুঁজতে বের হয়েও সিয়ামের কোনো খোঁজ পায়নি। তারা বলেছিল, হয়তো খাদে পড়ে গেছে। সুপ্তি তাদের বিশ্বাস করতে পারেনি।
ঘরে ফিরে সুপ্তি দরজাটা সামান্য খোলা দেখল। ভয়ে ভয়ে দরজাটা বন্ধ করতে যাবে, এমন সময় পেছন থেকে শীতল কণ্ঠস্বর শোনা গেল।
“আমাকে খুঁজছিলে?”
সুপ্তি আঁতকে পেছনে ঘুরল। তার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে সিয়াম। কিন্তু এই সিয়াম যেন অন্যরকম। চোখের চারপাশে গাঢ় কালি, মুখটা ফ্যাকাশে। তার শরীরে বৃষ্টির পানি ঝরছে, অথচ ঠোঁটে এক অদ্ভুত হাসি।
“সিয়াম? তুমি এখানে কীভাবে?”
“তুমি তো আমাকে ফেলে চলে গিয়েছিলে, শুপু। আমি বৃষ্টিকে ভয় পাই, এটা তুমি জানো। তবু তুমি আমাকে ওই আঁধারে একা ফেলে এলে কেন?”
“তুমি… তুমি ঠিক আছো?”
“ঠিক আছি? হাহ!” সিয়াম হেসে বলল, “আমি ফিরেছি। শুধু তোমার জন্য।”
সুপ্তি পেছাতে চাইল। কিন্তু পা যেন আটকে গেল। সিয়াম ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল।
“ওরা আমাকে ফিরিয়ে এনেছে।”
“ওরা মানে কারা?”
“আঁধারের বাসিন্দারা। ওরা আমাকে বলেছে, আজ আমার জন্য একটা উপহার আছে।”
“উপহার?”
“তুমি, সুপ্তি। তুমি।”
হঠাৎ ঘরের বাতাস ভারী হয়ে উঠল। সুপ্তি স্পষ্ট অনুভব করল, ঘরে তারা দু’জন ছাড়াও অন্য কেউ আছে। অদৃশ্য, ছায়ার মতো। মেঝে থেকে ঠান্ডা হাত উঠে এসে সুপ্তির পা আঁকড়ে ধরল।
“না! সিয়াম, এটা তুমি কী করছো?”
“আমি কিছু করছি না, শুপু। এটা ওরা করছে। ওরা চায় তুমি আমার সাথে থাকো, চিরদিনের জন্য।”
সুপ্তি চিৎকার করতে চাইল। কিন্তু গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না। ঘর ভরে উঠল পৈশাচিক হাসিতে। ছায়াগুলো ক্রমশ ঘন হয়ে আসছে। সিয়াম তার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, “তুমি আমার, শুপু। আর কেউ আমাদের আলাদা করতে পারবে না।”
ঠিক তখনই দরজায় জোরে ধাক্কার শব্দ হলো। বাইরে থেকে প্রতিবেশী রিয়াদ ভাই চিৎকার করে ডাকছে, “সুপ্তি! তুমি কি ঘরে আছো? দরজা খোলো!”
“বাঁচাও!” সুপ্তি চিৎকার করল। কিন্তু তার আওয়াজ যেন বৃষ্টির শব্দে মিলিয়ে গেল।
“তুমি পালাতে পারবে না,” সিয়ামের ফিসফিস কণ্ঠ। “এটা তোমার নিয়তি। আমার সাথে এক হতে হবে।”
বাইরে থেকে ধাক্কার আওয়াজ জোরালো হতে লাগল। কিন্তু সুপ্তি অনুভব করল, সে আর নড়তে পারছে না। ঘরের ভেতরের অন্ধকার তাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিচ্ছে।
বৃষ্টি তখনো ঝরছে। সুপ্তির আর্তনাদ আর অদ্ভুত ছায়াদের সুরেলা নাচানাচি ততক্ষণে বৃষ্টির সুরের সাথে মিশে গেছে।
শেষ।