Posts

উপন্যাস

দহনধ্বনি

December 2, 2024

হাবিবুল্লাহ রাসেল

পর্ব- ০১

‘প্রথমে বিসমিল্লাহ বলে জারি করলাম শুরু
অনাথের নাথগো আল্লা দোয়া কর গুরু।
আহা গুরু কল্পতরু তুই সংসারের সার
আমি ভাবিয়াছি অচল ভরা কর আমারে পার।’
(জারিগান)                                                                            

অসহনীয় গরম পড়েছে আজ। বেলা বাড়ার সাথে সাথে রোদের তীব্রতা বাড়ছে। যেনো আগুনের ফুলকি ঝরছে মাঠে-ঘাটে। আগুনরোদ শরীরে মেখে বৈঠা চালাচ্ছে তৈয়ব। ঘামে ভিজে স্যাঁতসেঁতে হয়েছে গোটা শরীর। জোরে জোরে বৈঠা চালাচ্ছে আর কপালের ঘাম মুছছে তৈয়ব। কিছুক্ষণ পর পর বৈঠাসহ হাত দু’খানা ভিজিয়ে নিচ্ছে জলে। 
    নৌকার ভেতর থেকে যাত্রীদের হাঁক আসে, ‘জলদি চালাও মাঝি’।
    মনে মনে রাগ ধরে তৈয়বের। এই গরমে স্রোতের প্রতিকূলে আর কতো জোরে বাইতে পারে তৈয়ব। পয়ত্রিশ বছর ধরে নাও চালাচ্ছে। একটি টাবুরে নাও আর কতো জোরে চলতে পারে? পাশ দিয়ে ঢেউ উঠিয়ে দ্রুত গতির ট্রলার চলে যায়। নৌকা দোল খায়। তৈয়বের নৌকাখানি তো আর ট্রলার নয়। যাত্রীদের কথায় রাগ ধরলেও প্রকাশ করে না তৈয়ব। 
    বিনীত স্বরে বলে, ‘চালাচ্ছি ভাইজান, চালাচ্ছি।’
    নতুন এ নৌকাখানা গড়েছে মাস দেড়েক হয়েছে। এ জন্য তৈয়বকে এনজিও থেকে লোন নিতে হয়েছে। প্রতি সপ্তাহে পরিশোধ করতে হয় লোনের কিস্তি। মাঝে মধ্যে কিস্তি চালাতে হিমশিম খেতে হয় তৈয়বকে। নৌকা চালিয়ে আর আয় নেই আগের মতো। এই যন্ত্রের যুগে নিতান্ত প্রয়োজন না হলে নৌকায় উঠে না কেউ। 
    নৌকার ভেতর থেকে যাত্রীরা প্রশ্ন করে, ‘কতোদূর এলামরে মাঝি?’
    ‘এইতো দস্তুর খান দিঘি।’
    স্বরূপকাঠির ইন্দুরহাট বন্দর থেকে এক কিলোমিটার দক্ষিণে দস্তুর খান দিঘি। যদিও দিঘির কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। এখন এ দিঘির উপর সবুজের ঢেউ খেলে যায়। সাত বিঘা এ দিঘির উপর এখন কৃষকেরা ফসল ফলায়। আবার কিছুটা অংশে ঘর-বাড়িও নির্মিত হয়েছে সময়ের ব্যাবধানে। এখন আর কোনো চিহ্নই দৃষ্টিগোচর হয় না এ দিঘির। এ দিঘি নিয়ে অনেক লোককাহিনী রয়েছে মানুষের মুখে মুখে। 
    মুঘল সম্রাট আকবরকে তেরো বছর বয়সে সাম্রাজ্যের দায়িত্ব নিতে হয়েছিলো। তখন তাঁর শিক্ষক ছিলেন দস্তুর খান। পির দস্তুর খান। এক আধ্যাত্মিক শক্তির অধিকারী। এ আধ্যাত্মিক শক্তির কথা গোপন রেখেই তিনি শিক্ষকতার দয়িত্ব পালন করে চলছিলেন। কিন্তু এই গোপনীয় শক্তি সম্রাট আকবরের দৃষ্টি এড়াতে পারেনি। আকবর লক্ষ্য করলেন যেদিন তিনি শিক্ষক দস্তুর খানের কাছ থেকে আশীর্বাদ নিয়ে কোনো কাজ শুরু করেন, সে কাজে অপ্রত্যাশিত সফলতা আসে। আর গুরুকে না জানালে প্রত্যাশিত সফলতাও ব্যর্থতায় পরিণত হয়। ফলে সম্রাট একদিন গুরুর কাছে জানতে চাইলেন- তার কাছে কী এমন আধ্যাত্মিক শক্তি আছে এবং তিনি আসলে কে, কী তার পরিচয়? দস্তুর খান এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে না চাইলে সম্রাট আকবর তাকে সম্পূর্ণ পাথরের গৃহে বন্দী করে রাখেন। যার দরোজাও ছিলো পাথরের। 
    কিন্তু সম্রাটের এই পাথরের গৃহ দস্তুর খানকে বন্দী করে রাখতে পারেনি। তিনি তাঁর আধ্যাত্মিক শক্তি দ্বারা দরোজা ভেঙে দুটো পাথর দুই বগলে করে অলৌকিকভাবে ভাসতে ভাসতে স্বরূপকাঠির সোহাগদলে চলে আসেন। অবশ্য তখনো এ এলাকার নাম সোহাগদল হয়নি। পুরো এলাকা জুড়ে ছিলো গাছ-পালা, লতা-পাতা, গুল্মের ঝোপ, ঝিলগাছ, নল-খাগরা, হোগলার বন। জনবসতি ছিলো না বললেই চলে। তিনি এখানের কিছুটা জায়গা আস্তানার জন্য মনোনীত করেন এবং ছোটোখাটো একটি গৃহ নির্মাণ করে ধর্ম প্রচার শুরু করেন।
    তখন এ এলাকায় খাবার পানির দারুণ অভাব ছিলো। তিনি এ অভাব পূরণের জন্য অলৌকিক ভাবে একরাতে এ দিঘিটি খনন করেন। দিঘির উত্তর পাশে পাকা সিঁড়ি নির্মাণ করেন। 
    দিঘি খননের সাত দিন পার হলো কিন্তু এক বিন্দু জলও ওঠে না। একদিন দস্তুর খান ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখলেন, যদি এ দিঘিতে কোনো ব্রাহ্মণের ছেলে সাদা ঘোড়ায় সাতবার চক্কর দেয় তবেই জল উঠবে। বাওন নামে এক ব্রাহ্মণের ছেলে এবং একটি সাদা ঘোড়া আনা হলো। দৌড় শুরু হলো। সাত চক্কর দেওয়ার সাথে সাথে দিঘি কানায় কানায় জলে পূর্ণ হয়ে গেলো। সাদা ঘোড়া ও ব্রাহ্মণের ছেলে বাওন আর উঠতে পারলো না। পরে সাদা ঘোড়া ও বাওনকে শ্রীরামকাঠির দেওদরিয়ার ঘোপে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। যে খাল দিয়ে মৃতদেহ দেওদরিয়ার ঘোপে পৌঁছেছে বাওনের নাম অনুসারে এখন সেটি বাওনার খাল নামে পরিচিত। 
    কতোদিন তৈয়ব বাওনার খাল দিয়ে দূর-দূরান্তে নৌকা চালিয়ে গিয়েছে। দুই তীরে নল-খাগরা, হোগলার ঝোপ। মাঝে মাঝে ছৈলা আর ঝিলগাছ। ঝিলগাছের শাখা-প্রশাখা থেকে শেকড় নেমে গেছে জল-কাদায়। আর ছৈলাগাছের শ্বাসমূল উপরের দিকে উঠে এসেছে জল-কাদা ভেদ করে। 
    রাতে এখান থেকে নৌকা চালালে কেমন ভয় ভয় লাগে তৈয়বের। জোনাকি পোকা জ্বলে-নিভে, হয়তো পেঁচা ডাক দেয়। আচমকা গোসাপ জলে লাফ দেয়। তৈয়বের মনে হয় বাওন ঘোড়া চালিয়ে যাচ্ছে জলের ভেতর। কখনো মনে হয় বাওনের লাশ ভাসছে। কাছে গিয়ে দেখে কলাগাছ ভাসছে। 
    বুকে থুতু দিয়ে দম নিয়ে, ছড়া-মন্ত্র কেটে সাহস যোগায় তৈয়ব-
‘কাইল্লা ভূত কাইল্লা ভূত
আগুন জ্বলে ফাতফুত।’
    এসব গল্প তো তৈয়ব শুনেছে দাদা-দাদি কিংবা অন্য কারো মুখে মুখে। তারাও হয়তো শুনেছে তাদের শৈশবে। 
    আরো কতো কাহিনীই যে শুনেছে তৈয়ব। দস্তুর খানের বগলে করে নিয়ে আসা পাথর দু’টি দিঘির জলে ভাসতো। অমাবস্যা রাতে দিঘি দিয়ে এক ধরনের সুর ভেসে আসতো। পির দস্তুর খান একটি ঝিলগাছের নিচে ধ্যান করতেন। সে ঝিলগাছটির পাতা কোনোদিন ঝরেনি। কেউ পাতা ছিঁড়লে রক্ত বেরুতো। এলাকায় বড় ধরণের কোনো অনুষ্ঠান থাকলে থালা-বাসন, হাঁড়ি-পাতিলের প্রয়োজন হলে একজন ইমানদার ব্যক্তি ওজু করে দিঘির জলে দুধ ছিটিয়ে চাইলে থালা-বাসন, হাঁড়ি-পাতিল সিঁড়িতে উঠে আসতো। প্রয়োজন শেষে আবার সিঁড়িতে রাখলে দিঘির জলে মিশে যেতো। একবার এক দাসী দু’তিনটে বাটি চুরি করে গোয়াল ঘরে লুকিয়ে রেখেছিলো। সকলে এ কথা জানতে পেরে বাটিগুলো নিয়ে সিঁড়ির উপরে রাখলো। দিঘির জলে মিলে গেলো। কিন্তু এ ঘটনার পর শত চাওয়ার পরেও আর কোনোদিন দিঘি দিয়ে থালা-বাসন উঠেনি।
    দস্তুর খান ধর্ম প্রচারের জন্য অন্যত্র চলে গেলে ধীরে ধীরে দিঘিটি ভরাট হয়ে যায়। পাথর দু’টি দিঘির পাশেই পড়ে থাকে। 
    একদিন প্রবল বেগে বন্যা আসে। চারদিকে জলে থৈ থৈ। 
    খান বংশের একজন পাথর দুটি বাড়ির ভেতর নিয়ে যায়। একটি পাথরের উপর মল ত্যাগ করলে সকলকে অবাক করে সেটি অদৃশ্য হয়ে যায়। এ ঘটনার পর অন্য পাথরটির প্রতি সকলের অতিমাত্রায় ভক্তি চলে আসে। ফলে রোগ মুক্তির জন্য লোকজন পাথরের উপর দুধ দেয়া শুরু করে। দুধ দিলেই পাথর তা চুষে নিতো। কিন্তু এ প্রথা বেশি দিন টিকে থাকেনি। মসজিদের ইমাম এবং মুসল্লিগণ একে পূজা প্রথা, শিরক গুনাহ বলে বন্ধ ঘোষণা করেন। 
    পাথরটি এখনো খান বাড়ির মসজিদে সংরক্ষিত আছে। তৈয়ব কতোদিন দেখেছে সে পাথরখানি। ছুঁয়ে মুখাবয়বে বুলিয়েছে হাত। এখন আর দুধ দিলে চুষে নেয় না। কেউ কেউ বলে- এটি জীবিত ছিলো, এখন মরে গেছে। 
    ইন্দুরহাট বন্দরে পৌঁছতে সূর্যের তেজ অনেকটা কমে গেছে- তবু ঘামছে তৈয়ব। কমেছে বন্দরের উচ্চ কোলাহল। খালের অন্যপাড় থেকে স-মিলের মৃদু শব্দ ভেসে আসছে। ভটভট শব্দ করে চলে যাচ্ছে দু’একটি ট্রলার। বেকারির চালায় সাটা চোঙ থেকে ধোঁয়া বের হয়ে মিলছে হাওয়ায়। খালচরের আবর্জনার স্তূপের ভেতর খাবার খুঁজছে দু’টি কুকুর। ঝাঁকেঝাঁকে কাক কা-কা কলোরবে মাতিয়ে তুলছে চারদিক। 
    ‘কতো দিমু মাঝি?’ জিজ্ঞেস করলো যাত্রীদের একজন।
    ‘চল্লিশ।’
    ‘কি কও মিয়া! রিক্সায় আইলে তো কুড়ি টাহায় আইতে পারতাম।’
    ‘তয় রিক্সায় ওডলেন না কিয়া?’
    ‘হেইডাই তো ভুল করলাম।’
    ত্রিশ টাকা দিয়ে নৌকা থেকে যাত্রীরা নেমে পড়ে একে একে। নৌকা চালানো শেষের অনুভূতির সাথে ক্রোধ মিলে তৈয়ব আরো বেশি করে ঘামতে থাকে।
(চলবে...)

Comments

    Please login to post comment. Login