পোস্টস

প্রবন্ধ

লাকী আখান্দ: উদাস হাওয়া কত যে গান গেয়ে যায় আনমনে

৮ জুন ২০২৪

মিলু আমান

পুরোনো ঢাকার এক সংগীতানুরাগী পরিবারে ১৯৫৬ সালের ৭ জুন লাকী আখান্দের জন্ম। লাকী আখান্দের সংগীতে হাতেখড়ি বাবা আবদুল আলি আখান্দের কাছে। টেলিভিশন এবং রেডিওতে শিশু শিল্পী হিসেবে নিয়মিত অংশ নিয়েছেন বিভিন্ন সংগীতানুষ্ঠানে। কৈশোরের শুরুতেই আধুনিক সংগীতে পাকিস্তান আর্ট কাউন্সিলের পদক লাভ করেন। ১৪ বছর বয়সেই লাকী আখান্দ পাকিস্তান এইচএমভি স্টুডিওতে সুরকার হিসেবে কাজ করার সুযোগ পান। দুই বছর পর এইচএমভি ইন্ডিয়ায় সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রে কণ্ঠযোদ্ধা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। বুলেটিনের ফাঁকে মুক্তিযোদ্ধাদের সদা উজ্জীবিত রাখতে দেশের সব গান শোনাতেন। স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে বাংলাদেশ বেতারে সংগীত পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। 

 

আজম খান উচ্চারণ নিয়ে বাংলা রক গান করবেন ঠিক করলেন। অন্যদিকে লাকী আখান্দ বিভিন্ন শিল্পীর জন্য সংগীত আয়োজনের কাজ করতে শুরু করেন। লাকীর সঙ্গে জুটে যায় ছোট ভাই হ্যাপী। ট্যালেন্টেড দুই ভাই ‘আখান্দ ব্রাদার্স’ নামে বেশ সুনাম কুড়ায়। তারা সে সময় ফেরদৌস ওয়াহিদের ‘এমন একটা মা দে না’ গানের সংগীত আয়োজন করেন। কুমার বিশ্বজিৎ, ফিরোজ সাঁইসহ বিভিন্ন শিল্পীর সঙ্গে কাজ করে আখান্দ ব্রাদার্স। 

 

ব্যান্ডসংগীতের পাশাপাশি ভিন্নধারার আধুনিক বাংলা গান উপহার দেন প্রতিভাবান সুরস্রষ্টা লাকী আখান্দ। তার সৃষ্ট সংগীতে নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করতেন। হ্যামন্ড অর্গান, অ্যাকর্ডিয়ান, স্যাক্সোফোনসহ নানা বিদেশি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করেন। এ ছাড়া তিনি গানে ব্যাঞ্জো, হারমোনিকা, বাঁশি, সেতার, হারমোনিয়াম, পিয়ানো, তবলা-বিভিন্ন ধরনের পারকশনের সংমিশ্রণ করেন। 


১৯৭৫ সালে আখান্দ ব্রাদার্স ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’ এবং ‘কে বাঁশি বাজায় রে’ দুটি গানের জন্য সংগীত আয়োজন করেন। গান দুটিতে কণ্ঠ দেন হ্যাপী আখান্দ। ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’ দেশের প্রথম রক ব্যালেড বলা যায় গানটিকে। দ্রুত সবার মন জয় করে নেয়। এই গান শুনে আব্বাসউদ্দীন, মান্না দে, সমর দাশ, আরডি বর্মণের মতো শিল্পীরা প্রশংসা করেন। দুই ভাই মিলে কণ্ঠ দেন ‘স্বাধীনতা তোমাকে নিয়ে’ ও ‘পাহাড়ি ঝরনা’ দুটি গানে। লাকী একক হিসেবে কণ্ঠ দেন ‘নীল নীল শাড়ি পরে’ ও ‘হঠাৎ করে বাংলাদেশ’ গানে। এ ছাড়া ‘খোলা আকাশের মতো তোমাকে চেয়েছি’, ‘তুমি আমার প্রথম প্রেমের গান’, ‘পলাতক সময়ের হাত ধরে’, ‘এই পৃথিবীর বুকে আসে যারা’-আখান্দ ব্রাদার্সের এসব অনবদ্য গান তখন সবার মুখে মুখে ছিল। 


১৯৮০ সালে রাইসুল ইসলাম আসাদ, সুবর্ণা মুস্তাফা প্রমুখ অভিনীত ‘ঘুড্ডি’ চলচ্চিত্রে ‘আবার এলো যে সন্ধ্যা’ গানটি ব্যবহৃত হয়। একজন মিউজিশিয়ান হিসেবে হ্যাপী আখান্দ গানটি পরিবেশন করেছিলেন। ‘ঘুড্ডি’ চলচ্চিত্রের পরিচালক সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী, চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা করেন লাকী আখান্দ। লাকী আখান্দের ‘এই নীল মনিহার’ গানটিও সে সময় সুবর্ণা মুস্তাফা অভিনীত একটি নাটকে প্রচার হয়। 


১৯৮৪ সালে লাকী আখান্দ প্রথম একক অ্যালবাম রিলিজ করেন। সারগামের ব্যানারে প্রকাশিত অ্যালবামের ‘আমায় ডেকো না’, ‘আগে যদি জানতাম’, ‘মামনিয়া’, ‘এই নীল মণিহার’, ‘সুমনা নামের মেয়েটি’, ‘রূপসী নীল’, ‘হৃদয়ে আমার’-এসব গান বাংলা গানে নতুন মাত্রা যোগ করে।  


১৯৮৭ সালে সাতাশ বছর বয়সে হ্যাপীর অকাল মৃত্যু হয়। তার এই মৃত্যুতে শ্রোতারা তো বটেই, সহশিল্পীরাও মুষড়ে পড়েন। হ্যাপী মারা যাওয়ার পর, লাকী আখান্দ গানের জগৎ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন, নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখেন অনেক দিন পর্যন্ত।


নব্বই দশকে হ্যাপী আখান্দের গান পুনর্নির্মাণ করে ‘শেষ উপহার’ অ্যালবাম বের করেছিলেন লাকী। হ্যাপীর স্মরণে ব্যান্ডের নামও রাখেন ‘হ্যাপী টাচ’। 


১৯৯৮ সালে দ্বিতীয় একক অ্যালবাম ‘পরিচয় কবে হবে’ রিলিজের মাধ্যমে লাকী আখান্দ পুরোদমে গানের জগতে ফিরে আসেন। একই বছর তার সংগীতায়োজনে ব্যান্ড ও আধুনিক গানের মিক্সড অ্যালবাম ‘বিতৃষ্ণা জীবনে আমার’ রিলিজ দেন। অ্যালবামে জেমস, আইয়ুব বাচ্চু, হাসান, কুমার বিশ্বজিৎ, তপন চৌধুরী ও সামিনা চৌধুরী কণ্ঠ দেন। অ্যালবামে জেমসের কণ্ঠে ‘লিখতে পারি না কোনো গান’ এবং আইয়ুব বাচ্চুর ‘কী করে বললে তুমি’ লাকী আখান্দের অনবদ্য সৃষ্টি। সে বছর ঢাকার জাতীয় জাদুঘরে অঞ্জন দত্তের সঙ্গে একসঙ্গে স্টেজ শো করেন। 


১৯৯৯ সালে সামিনা চৌধুরীর সঙ্গে ডুয়েট অ্যালবাম ‘আনন্দ চোখ’ প্রকাশ করেন। ‘কাল কী যে দিন ছিল’, ‘বলো কে পারে’, ‘এই বরষা রাতে’ অ্যালবামের উল্লেখযোগ্য গান। সামিনা চৌধুরীর ‘আমায় ডেকো না’ একক অ্যালবামের সংগীতায়োজন করেন একই বছরে। এ ছাড়া সে বছরই ‘দেখা হবে বন্ধু’ মিক্সড অ্যালবামে আর্ক ব্যান্ডের হাসানের জন্য ‘হৃদয়ের দুর্দিনে’ গানের সুর করেন। 


২০০০ সালে লাকী আখান্দের সুর ও সংগীতায়োজনে ‘গান বন্ধু’ মিক্সড অ্যালবাম প্রকাশ পায়। লাকী আখান্দ ‘কে আছে কোথায়’, ‘কেনো বলো’, ‘এসব কি ঠিক’, ‘বিশ্বাস করো না করো’ গানে কণ্ঠ দেন; অ্যালবামটির অন্যান্য গানে কণ্ঠ দেন বাপ্পা মজুমদার, ফাহমিদা নবী ও নিপু।

 

লাকী আখান্দ তার সংগীতে নতুনত্বকে প্রাধান্য দিতে কুণ্ঠাবোধ করতেন না। কখনো লোকসংগীতকে ফিউশন করে পাশ্চাত্য সুরের সৃষ্টি করেছেন। কখনোবা স্প্যানিশ মূর্ছনায় বাংলা গানে মিশ্রণ করে জাদুকরী সুরের ছোঁয়া দেন। দেশীয় ঠুমরি কিংবা ধ্রুপদী সুরেও ছিলেন পারদর্শী; সৃষ্টি করেছেন ‘ভুলতে পারিনি তোমায়’ গানের মতো মনকাড়া কিছু গান। ওস্তাদ নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরীর কণ্ঠের ক্লাসিক্যাল সুরের গজল ঘরানার গান ‘আজ এই বৃষ্টির কান্না দেখে’ লাকী আখান্দকে করেছে কালোত্তীর্ণ।

 

লাকী আখান্দ তার সংগীত আয়োজনে এস এম হেদায়েত, গোলাম মোরশেদ কিংবা কায়সার আহমেদ চৌধুরীর মতো ভিন্নধারার গীতিকবিদের সঙ্গে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। লাকী আখান্দের সুরে এসব সহজবোধ্য আধুনিক গান বাংলা গানের ভান্ডারকে করেছে সমৃদ্ধ। 

 

২০১৭ সালের ২১ এপ্রিল গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হয়। দীর্ঘদিন ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন এই কিংবদন্তি। তার সুরের মূর্ছনা বাংলা গানের শ্রোতাদের হৃদয়ে চিরস্থায়ীভাবে জায়গা করে নেয়।