গল্প: কালো বাড়ির রহস্য
লেখক: আজিজুল হাকিম
একদা একটি ছোট্ট গ্রাম ছিল।যেখানে সূর্য সবসময় মেঘে ঢাকা থাকত।আর সেই গ্রামে একটি পুরনো কালো বাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। বাড়িটি এতটাই পুরনো এবং ভীতিকর ছিল যে গ্রামের মানুষ সেখানে আসতে পর্যন্ত ভয় পেত। বাড়ির চারপাশে দীর্ঘ ঘাস, জঙ্গল, এবং ছায়াময় পথ ছিল। তার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িটি যেন এক অজানা রহস্যের কেন্দ্রস্থল সবার কাছে পরিচিত ছিলো।
এছাড়া গ্রামের মানুষজন জানতেন, বাড়িটির ইতিহাস খুবই অন্ধকার। বহু বছর আগে, এক প্রভাবশালী জমিদার তাঁর পরিবার নিয়ে সেখানে বাস করতেন। কিন্তু এক রাতে পুরো পরিবার উধাও হয়ে যায়। তাদের কি হয়েছিল, কেউ জানতো না।
তারপর থেকে বাড়িটি এক ধরনের অভিশাপের জায়গা হয়ে ওঠে। কেউ সেখানে রাতে ঢোকার সাহস পায়নি। বলাবলি ছিল, যে কোনো লোক যদি বাড়ির কাছে যায়, সে কখনও আর ফিরে আসে না।
এমনই এক ঘটনা ঘটলো একদিন, যখন এক যুবক, অজয়, গ্রামে নতুন এসে পৌঁছেছিল। সে শুনেছিল সেই রহস্যময় বাড়ির কথা এবং মনস্থির করেছিল, সে একদিন সেখানে যাবে। লোকেরা তাকে ভরসা দিয়ে বলেছিল, "ওখানে যেও না, সেখানে গিয়ে কোনো ভালো ফল আসবে না।" কিন্তু অজয়ের মন ছিল অবিচল।
এক রাতে, অজয় একাই বেরিয়ে গেল। হালকা জ্বালানো মোমবাতি হাতে, সে বাড়ির দিকে এগোতে লাগল। বাড়ির কাছে পৌঁছালে, সে দেখলো বাড়ির একটুকরো জানালা দিয়ে আলো ঝলমল করছে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, বাড়ির দরজা খুলে গিয়েছিল, যেন কেউ তাকে ভিতরে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে।
অজয় ভিতরে ঢুকলো। বাড়ির ভেতর সেলাই করা পলেস্তারা, ছাদের ভেঙে যাওয়া অংশ, এবং অদ্ভুত অন্ধকার গন্ধে পরিপূর্ণ ছিল। কিন্তু একটা অদ্ভুত অনুভূতি তাকে টানছিল, যেন কেউ তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে বাড়ির মধ্যেকার সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠল।
তখনই একটি কটকট শব্দ শোনা গেল। অজয় হঠাৎ পেছনে ফিরে তাকালো। কিন্তু কিছুই ছিল না। যখন সে আবার সামনে তাকাল, তখন দেখল, বাড়ির কোণায় একদল কালো ছায়া সরে সরে চলছিল। তার হৃদস্পন্দন তীব্র হয়ে উঠল, এবং সে জানতে পারল, এই বাড়িতে কোনো মৃতদেহের মতো কিছুটা রয়েছে।
অজয়ের সামনে এসে দাঁড়ালো এক বৃদ্ধ নারী, যার মুখটি যেন মৃত। তার চোখ দুটো ছিল বড় বড়, অন্ধকার চাহনিতে। "তুমি কেন এসেছো?" বৃদ্ধা বললো।
অজয় ভয়ে বললো, "আমি জানি, আপনি এই বাড়ির সাথে জড়িত। আমি জানতে চাই, এই বাড়ির ইতিহাস কী?"
বৃদ্ধা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো, তারপর বললো, "এই বাড়ি কখনো শান্তি পায়নি। এখানে একজন হিংস্র আত্মা বাস করে, যার কারণে এই বাড়ি সবসময় অন্ধকারে ডুবে থাকে। জমিদারের পরিবার যখন এখানে ছিল, তারা এক অন্ধকার জগতে বাস করেছিল, যা পৃথিবীর সঙ্গে সংযোগ ঘটিয়েছিলো। কিন্তু সেই ভয়ানক বাড়ি ভুল হয়ে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। আর এর ফলস্বরূপ, আত্মা মুক্তি পায়নি।"
অজয়ের কপালে ঠান্ডা ঘাম বেয়ে পড়ল। "তাহলে, এই বাড়িতে কি কিছু করা সম্ভব?" সে জিজ্ঞেস করল।
বৃদ্ধা বললো, "একটি পথ আছে। তবে সেটি খুব বিপদজনক। তোমার আত্মা যদি সেই পথের মধ্য দিয়ে চলে যায়, তবে হয়তো সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।"
অজয় সিদ্ধান্ত নিল। সে বৃদ্ধার কথামতো একটি নির্দিষ্ট রুমে গিয়ে সেই অন্ধকার ছায়া পুনরায় করতে শুরু করলো। কিন্তু যতটা সাবধানে সে কাজটি করছিল, ততই বাড়ির মধ্যে অদ্ভুত শব্দ বাড়তে লাগলো। হঠাৎ, বাড়ির চারপাশে এক তীব্র হাওয়া উঠলো, এবং বাতাসে ভেসে আসলো এক ভয়ানক আওয়াজ।
অজয় তীব্রভাবে কাঁপতে লাগল, কিন্তু সে জানত, যদি সে মাঝপথে থেমে যায়, তবে আবারও সেই অভিশাপ গ্রাস করবে। তার মোমবাতি নিভে যাওয়ার আগ মুহূর্তে, অজয় শেষবারের মতো সেই ছায়ার কাজ সম্পন্ন করলো।
আর তাতে, মুহূর্তের মধ্যে, ঘরটি আলোকিত হয়ে উঠলো। বাড়ির চারপাশের কালো ছায়াগুলো তৎক্ষণাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল। একটা অদ্ভুত শান্তি ভরে গেল বাড়ির ভেতর। তবে, অজয় জানত, সে আর কখনো এই জায়গায় ফিরে আসবে না।
গ্রামবাসীরা বললো, "অজয় সে বাড়ির রহস্য সমাধান করেছে, কিন্তু তার নিজের জীবনেও কিছুই আর আগের মতো রইল না।"
এমনকি আজও, কেউ ওই বাড়ির কাছে যেতে সাহস পায় না। কারণ, কালো বাড়ির রহস্য আজও অমীমাংসিত রয়ে গেছে।
সমাপ্ত......