বাড়ি ফেরা
পিওনা আফরোজ
প্রতিদিন যখন গঞ্জ থেকে ফেরেন প্রৌঢ় হায়দার আলী, তখনই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে ছোট্ট জয়া। হায়দার আলীর হাতে বাজারের ব্যাগ দেখেই বলবে, ‘আমার হাতে এটা দাও তো নানা। কতদূর থেকে এইটা টাইনা আনছো! দাও দাও, এবার আমারে দাও।’ সে ব্যাগ হাতে নিয়ে এক পা দুই পা ফেলে হাঁটতে চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না। পারবে কী করে? ব্যাগের ওজন তো কম নয়!
নাতনির অপারগতা দেখে হায়দার আলী বলেন, ‘আচ্ছা হইছে হইছে। এবার দে তো আমারে। অনেক দূর তো আগায়া দিলি!’
‘তাইতো ! অনেক দূরই তো। নাও, এইবার তুমিই নাও।’ দু ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা টেনে বলে জয়া।
বাড়িতে ঢুকে বাজারটা রেখে যখন শার্টটা খুলে চেয়ারে বসেন হায়দার আলী, তখনই তাঁর পিঠে চড়ে বসে ছোট্ট জয়া। অমনি হায়দার আলীর স্ত্রী জেবুন্নেস বলেন, ‘কিরে, তোর নানাতো মাত্রই বাজার থেইকা আইলো। একটু জিরাইতে দে...।’
‘থাকনা। সেই সকাল থেইকা আমারে দেখে না। থাক কিছুক্ষণ...।’ হায়দার আলী হাসেন আর বলেন।
নানির কথায় পিঠ থেকে তো নামেই না জয়া, উল্টো আরও শক্ত হয়ে চেপে বসে। যখনই সুযোগ পায় তখনই সে নানার পিঠে চড়ে। আর পিঠে চড়তে চড়তে কত গল্প করে! রূপকথার রাজা-রাণীর গল্প, স্কুলে আজ বন্ধু পেন্সির সাথে কী কী কথা হলো, কেন পেন্সি তার সাথে অভিমান করেছে, নানি আজ সারাদিনে তাকে বকেছে কিনা, আরও কত কী!
এভাবে বেলা বেড়ে দুপুর হয়। সময় হয় নামাযের।
জয়ার নানি আবারও রসুইঘর থেকে গলা হাঁকিয়ে বলেন, ‘শুনছেন, দুপুরের আযান পইড়া গেছে। গোসল কইরা তৈয়ার হইয়া মসজিদে যান।’
হায়দার আলী তখন নাতনিকে পিঠ থেকে নামিয়ে কোলে নেন। বলেন, ‘এখন থাক নানুভাই। নামায পইড়া, দুপুরে খাইয়া আবার বিকালে আমরা খেলবো, কেমন!’
বহুদিন হলো স্বেচ্ছায় চাকরি থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন হায়দার আলী। কাজ বলতে প্রতিদিন দ’ুবেলা বাজারে যাওয়া। একই খবরের পাতায় বারবার চোখ বুলানো। টিভিতেও বারবার একই খবর দেখা। এছাড়া বাকি সময়টুকু নাতনি জয়ার সাথেই কাটে । জয়াই এখন তাঁর একঘেঁয়ে বৈচিত্র্যহীন জীবনের একটুকু আনন্দ।
চাকরি ছাড়ার পর হায়দার আলীর স্ত্রী জেবুন্নেসা বহুবার স্বামীর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, তিনি আর বিদেশে যাবেন কি না? কিন্তু হায়দার আলী সবসময়ই এই প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যেতেন। একদিন পুকুর ঘাটে বিকেলের ফুরিয়ে যাওয়া আলোয় স্বামী-স্ত্রী মুখোমুখি বসে নিজেদের যাপিত জীবনের নানান কথায় উজ্জীবিত হয়ে উঠেছিলেন। সেদিন আবারও তাঁর স্ত্রী বিদেশে যাবার ব্যাপারে জানতে চাইলে হায়দার আলী বলেন, ‘কী কইরা যাই কও! আমার চৈতন্যে যে আইজও সেই পূর্ণিমা রাইত ঝইরা পড়ে। যদি জীবনের এই পড়ন্তবেলায় কোনো আনন্দের কাছে ফিরা যাইতে কও তাইলে তো সে আমাগো জয়া। ওরে রাইখা কোথাও যাইতে নিলেই মন কেমন বিষাদে ভইরা যায়!’
হায়দার আলীর স্ত্রী জানতেন নাতনির জন্য তাঁর ভালোবাসা কতটা প্রগাঢ়! সেদিন স্বামীর কথাগুলো সেই ভালোবাসার গভীরতা আবারও মনে করিয়ে দিলো। আর ভালোবাসবেই বা না কেন? একটি মাত্র মেয়ে ছাড়া তাদের তো আর কেউ ছিল না। মেয়ে জলির বহু বছর পর এ-বাড়িতে যে শিশুটি ভূমিষ্ঠ হয়েছে, সে জয়া। তখন জয়ার মা জলি বাবার বাড়িতেই ছিল। আর জয়ার বাবা ছিল বিদেশে। যতদিন জয়ার বাবা বিদেশে ছিল ততদিন জলি আর জয়া এ বাড়িতে থাকায় জয়ার সাথে অদৃশ্য এক মায়ার বাঁধনে নিজেদের জড়িয়ে ফেলেছেন হায়দার আলী ও তাঁর স্ত্রী। পরে জয়ার বাবা বিদেশ থেকে এসে জয়ার মাকে নিয়ে ঢাকায় থিতু হয়। জয়া গ্রামেই থেকে যায়। যদিও জয়ার বাবা-মা চেয়েছিল জয়াকে তাদের সঙ্গে ঢাকায় নিয়ে আসতে। কিন্তু হায়দার আলী ও তার স্ত্রী চেয়েছিলেন জয়া তাদের কাছেই থাকুক আর জয়াও মা-বাবার চাইতে নানা-নানির কাছে থাকাতেই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। তাই নাতনিকে কাছে পেয়েও বিদেশে পাড়ি জমিয়ে আবার ওর কাছ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাননি হায়দার আলী।
প্রতিদিন নানাই তাকে স্কুলে নিয়ে যান নিয়ে আসেন। বেলাশেষে সন্ধ্যায় পড়াতে বসান। জয়াও ল²ী মেয়ে। সারাদিন যতই দুষ্টুমিতে মেতে থাকুক না কেন, পড়াশোনাটা ঠিকভাবেই করে। স্কুলে বরাবরই তার রেজাল্ট ভালো। পরীক্ষায় কখনও বন্ধু পেন্সি ফার্স্ট হয়, কখনও বা জয়া। তাই প্রতিবছর ফাইনাল পরীক্ষার ঠিক আগের রাতেই সে নানার কাছে বায়না ধরে বলতো, ‘এবার যদি পরীক্ষায় ফার্স্ট হই, তাইলে আমারে কী দিবা?’
‘কী লাগবো তোর?’
একটু ভেবে জয়া উত্তর দিতো, ‘আমারে কালো ফিতার একটা ঘড়ি কিনা দিও। না না ঘড়ি না। রাউন্ড চুলের ব্যান্ড। কালো মখমলের কাপড় দিয়া মোড়ানো। তার উপরে পাথর বসানো। শেষবার যখন শহরে বেড়াতে গেছিলাম তখন মিনার চুলে দেখছিলাম। খুব সুন্দর। ঐ যে বাবার পাশের বাসাটাতে যেই মেয়েটা থাকে, তার নামই মিনা। আমারে ওইরকম একটা কিনা দিও।’ মুখে হাসি আর চোখ বড় বড় করে, কণ্ঠে যতটা সোহাগ ছিল তার সবটুকু ঢেলে দিয়ে অনেকটা আবদারের স্বরেই হায়দার আলীর দিকে তাকিয়ে বলতো জয়া।
হায়দার আলীও পরীক্ষার রেজাল্ট পাওয়ার পরপরই উপহার নিয়ে তবেই বাড়ি ফিরতেন। সেজন্য যদি গ্রামের বাজার থেকে শহরের দিকেও যেতে হতো, তবে তিনি তাই করতেন।
বরাবরের মতো ডিসেম্বরে জয়ার পঞ্চম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়। তখন স্কুলের পড়াশোনার চাপ নেই। নানা-নানি আর সমবয়সিদের সঙ্গে খেলাধুলা আর গল্প করেই সময় কাটে জয়ার। একদিন দুপুরে খাওয়া-দাওয়া শেষে জয়ার নানা আর নানি দুজনেই বিশ্রাম নিতে গেলেন। জয়াও ছিল তাদের সাথে। হঠাৎ চোখ দুটো ঘুমে লেগে এলো হায়দার আলী ও তাঁর স্ত্রীর। কিন্তু জয়া তখনও জেগে। কিছুক্ষণ পর জয়ার নানির ঘুম ভেঙে গেলে দ্যাখেন বিছানায় জয়া নেই। বুকটা ধক করে ওঠে তাঁর। বিছানা ছেড়ে উঠে ঘরের ভিতরে সবখানে খোঁজেন, কিন্তু কোথাও নেই। স্বামী হায়দার আলীকে ঘুম থেকে জাগিয়ে জানতে চান, ‘জয়ারে দেখছেন?’ হায়দার আলী হাই তুলতে তুলতে বলেন, ‘না। কই আর যাইব! ঘরেই আছে, খুঁইজা দ্যাখো।’
‘না। ঘরে নাই। আমি সবখানে খুঁজছি।’
দু’জনে তাড়াহুড়ো করে ঘর থেকে বেরিয়ে আশেপাশের ঘরগুলো খুঁজে দেখেন, সেই ঘরগুলোতেও নেই। কী করবেন, কোথায় খুঁজবেন, ভেবে ভেবে দিশেহারা হয়ে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই বিষণœ, ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বসে থাকেন ঘরের সামনের ছাদযুক্ত দাওয়ায়। হঠাৎ কারও কথার শব্দে একইসাথে দুজনে সম্মুখে তাকিয়ে দেখেন, দুদিকে সুপারি আর নারকেল বাগানের মাঝখানের আঁকাবাঁকা চওড়া মেঠো পথ ধরে বাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে জয়া। সঙ্গে ছিল তার বাবা। জয়াকে দেখেই আনন্দে বিহŸল হয়ে দ্রæতপায়ে হেঁটে গিয়ে জড়িয়ে ধরেন তার নানি। কোলে নিয়ে ওর গালে টুকটুক করে চুমু খান।
‘কই গেছিলি সোনা, আমার জয়ামণি, পুতুলসোনা!’ এমন কত প্রিয় নামে ডাকে তাঁর পুতুল পুতুল নাতনিকে। উঠানে দাঁড়িয়ে জয়ার বাবা আর নানা তাকিয়ে দেখেন ভালোবাসার এমন অপার্থিব দৃশ্য। সাথে আশেপাশের ঘর থেকেও কয়েকজন এসে ভিড় জমায়। অস্থিরতা কমে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এলে জয়ার বাবা আলী আহমেদ হায়দার আলী এবং তাঁর ¯ত্রী‘র দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আপনাদের জাগাইতে চাই নাই দেইখা কিছু বলি নাই। ওরে নিয়া একটু মোড়ের দোকানে গেছিলাম।’ উত্তরে জেবুন্নেসা বলেন, ‘হ বাবা, চোখটা কখন যে লাইগা আইলো, টেরই পাই নাই। তাছাড়া ও তো কোনো সময় বাড়ি থেইকা একলা কোনও খানে বাইর হয় না। এইজন্যই একটু ভয় পাইছিলাম। যাই হোক, ‘তুমি আছ কেমন ?’
‘ভালো আম্মা।’
জয়ার নানা হায়দার আলী তখন হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে স্ত্রীকে বললেন, ‘তোমরা ঘরে যাও, আমি আসরের নামাযটা পইড়া আসি।’
‘আচ্ছা।’ স্বামীর কথায় সম্মতি জানিয়ে জয়ার বাবাকে তার নানি বলেন, ‘আস, ঘরে যাই।’ কথাটি শেষ করে একটু থেমে জয়ার বাবার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন, জলি আইলো না ক্যান? কতদিন হয় ওরে দেখি না! ও ভালো আছে তো? মাইয়াটা এহনও আমাগো উপর রাগ কইরা আছে, তাই না?’ হাঁটতে হাঁটতে আর কথা বলতে বলতে ঘরে গিয়ে জয়ার নানি খাটে বসেন, তাঁর পাশে রাখা চেয়ারে বসে জয়ার বাবা। অনেকদিন পর শ্বশুরবাড়িতে এসে ঝকঝকে ঘরের মেঝে, দেওয়াল, আসবাব এসবকিছুতে চোখ বুলাতে বুলাতে বলেন, ‘হ্যাঁ আম্মা ও ভালো আছে। আর রাগের কথা জানতে চাইতেছেন! গরিবে কী আর ধনীর লগে রাগ কইরা থাকতে পারে?’
‘ছি ছি বাবা। কি কইতাছ এইসব। বাবা-মা আর সন্তানের মধ্যে ধনী-গরিব থাকে?’
এরই মাঝে কুলসুমের মা এসে বিকেলের চা আর কিছু হালকা নাস্তা রেখে গেছে, জয়ার বাবার সামনে রাখা টেবিলে। জয়ার নানি মাথার ঘোমটাটা ঠিক করতে করতে জয়ার বাবার দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘নাও বাবা একটু নাস্তা কইরা নাও। আর একটা কথা মন দিয়া শোনো, তোমার শ্বশুরের যা কিছু আছে সবতো তোমাগোরই। তাছাড়া তুমিতো জানোই, জয়ার জন্মের পর উনি আর চাকরি করতে যান নাই। দেশেও ব্যবসা-বাণিজ্য যা করতে চাইছিলেন, তাও পারেন নাই। ওইসব কারণে আগের মতো এখন আর সবসময় নগদ টাকা পয়সা হাতে থাকে না। জায়গা জমিই এখন তাঁর সম্বল। এইগুলার আয় দিয়াই আমরা চলি। বুঝইতো, আমগো তো আর আয়-রোজগার করার কেউ নাই। জলির কথামতো বড়ভিটাটা এহন যদি বেইচা ফেলি, তাইলে আমাগো চলতে কষ্ট হইয়া যাইবো। তুমি ওরে একটু বুঝাইয়া কইও বাবা। আর এইসব নিয়া গোস্যা কইরা থাইকো না।’
এরই মধ্যে আসরের নামায শেষ করে মসজিদ থেকে ফেরেন হায়দার আলী। ঘরের দরজা দিয়ে ঢুকতেই স্ত্রী আর জামাতার আলাপ শুনে জানতে চান, ‘কি নিয়া কথা কইতাছ তোমরা?’ বলে স্ত্রীর পাশে এসে বসেন।
জয়ার বাবা শ্বশুরকে দেখেই প্রসঙ্গ পাল্টে বলে, ‘বাবা, জয়ারতো পরীক্ষা শেষ হইছে। তাই ওরে নিতে চইলা আসলাম। আগামীকাল সকালেই ঢাকায় রওনা হবো আমরা।’
‘কাইলই?’ বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে জেবুন্নেসার। হঠাৎ করেই জয়ার মা-বাবা এরকম একটা সিদ্ধান্ত নেবে তা তিনি কিছুক্ষণ আগেও ভাবতে পারেননি। এমনকি জয়ার নানা হায়দার আলীও নয়।
‘হ্যাঁ আম্মা। কালই। এতদিন তো এইখানেই ছিল। এখন আমি চাই ও ক্লাস সিক্স থেকে ঢাকাতেই কোনো ভালো স্কুলে ভর্তি হোক। জলিও তাই চায়...।’
‘কিন্তু জয়া কি ওইখানে থাকতে পারব?’ খুব শান্তভাবে জয়ার বাবা আলী আহমেদের কাছে জানতে চান হায়দার আলী।
‘কেন পারব না বাবা? আমরা যেইখানে থাকি, যেইভাবে চলি, যা খাই জয়াও সেইভাবেই নিজেরে মানায়া নিব। আর আমার মনে হয়, তাতে ওর কোনো সমস্যা হইব না।’ কথাগুলো কোনোরকম জড়তা ছাড়াই একনাগাড়ে বলে গেল জয়ার বাবা। কিন্তু তার স্বরে মিশেছিল কিছুটা বিরক্তির রেশ।
এর আগেও জয়ার বাবা-মা তাকে নিতে চেয়েছিল কিন্তু জয়া যেতে চায়নি। সে নানা-নানির কাছে থাকতে চায় বলে বাবা-মা দুজনেই তার ওপর বিরক্ত। আগে জয়ার মা গ্রামে এলে সুযোগ পেলেই জয়াকে বলতো, ‘এত যে নানা-নানি করিস, তাদেরকে ছাইড়া যাইতে চাস না, তারা কি তোরে সত্যি ভালোবাসে? বাড়িতে প্রাইভেট মাষ্টারের টাকাটাওতো তোর বাপেরই পাঠাইতে হয়। আরবী শিখায় সেই হুজুরের টাকা, বই-খাতা, কলম সব খরচইতো তোর বাপেই দেয়। দুই-এক মাস না দিতে পারলেই তোর নানি আমারে কথা শুনাইতে ছাড়ে না। খালি মুখে মুখে দরদ। ওইসব আমি সব বুঝি! এতই যদি ভালোবাসে তাইলে দিঘির পাশের উঁচু জমিটা বল না তোর নামে লেইখা দিতে! ভবিষ্যতে ওইটা থাকলে তো তোরই কামে লাগবো।’
জয়া মায়ের কথা শুনে চুপ করে থাকে। তাছাড়া ক্লাস থ্রিতে পড়া একটা বাচ্চার এসব বৈষয়িক বিষয় বোঝার কথাও নয়। তারপরও বাবা-মা কয়েকবার এই নিয়ে তাকে বলার পরও জয়া নানাকে কিছু না বলায় জয়ার ওপর তাদের ক্ষোভ কম ছিল না। শুধু জমি চেয়েই ক্ষান্ত হয়নি, জয়ার বাবা দেশে ফেরার পর থেকে আজ পঞ্চাশ হাজার, কাল ত্রিশ হাজার টাকা লাগবে, জয়ার বাবাকে ব্যবসা ধরিয়ে দিতে হবে। এমন নানা চাওয়া একের পর এক চেয়েই যেতো হায়দার আলীর কাছে তাঁর মেয়ে ও জামাতা। বিয়ের পর জামাতা আলী আহমেদকে দুই, দুইবার বিদেশেও পাঠিয়েছেন হায়দার আলী। সেটাও আলী আহমেদের ইচ্ছেতেই। এসব চাওয়ার যেন কোনো শেষই নেই। প্রাপ্তির শেষে অপ্রাপ্তিরা ভিড় করে চলে নিয়ত।
পরদিন সকালের নাস্তা শেষ করেই ঢাকায় রওনা হয় বাবা-মেয়ে। জয়ার মন খুব খারাপ। প্রতিদিনের অভ্যাসের মতো এতগুলো দিন যাদের পাশে পেয়েছিল সেই ভালোবাসার মানুষগুলোকে ছেড়ে যেতে তার খুব খারাপ লাগছে। মায়ার বাঁধন কেটে মানুষ হয়তো এভাবেই এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চলে যায়। আবার নতুন বাঁধনে জড়ায়।
জয়াকে বিদায় দেবার পর হায়দার আলীর ঘর জুড়ে শুধুই শূন্যতা। সারাটি ঘর হুই হুল্লোড়ে আর দুষ্টুমিতে মুখর করে রাখতো ছোট্ট একটি মেয়ে। সেই ঘরে এখন গভীর রাতের মতো নিস্তব্ধতার বসবাস। জীবনের স্বাভাবিক নিয়মে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই প্রাত্যহিক কাজ করে যাচ্ছেন ঠিকই কিন্তু কোথায় যেন সেই প্রাত্যহিকতার ছন্দপতন ঘটেছে।
জীবনের এই ছন্দপতন মেনে নেওয়া সহজ নয়। তাই হয়তো মানুষ চিরকালই তার চারপাশের মানুষগুলোকে ভালোবেসে নিজের কাছে আগলে রাখতে চায়। সেতারে গলা সাধার মতো প্রতিদিন বহু সাধনায় আর যতনে সম্পর্কগুলোকে হৃদয়ে লালন করে চলে! তবুও ভালোলাগার মানুষগুলো পাশে থাকে না জীবনভর।
জয়া এবং তার বাবা যখন গাড়ি থেকে নেমে বাসায় ঢুকে তখনই জয়ার মা জলি অস্থির হয়ে পড়ে তার স্বামী আলী আহমেদকে নিয়ে। পথে আসতে স্বামীর কোনো কষ্ট হয়েছে কিনা, তার জন্য গোসলের পানি গরম দিবে কি না, দুপুরের খাবার কি এখনই দিবে না একটু পরে, এসব নিয়ে বেশ অস্থিও হয়ে পড়ে। কিন্তু এতদিন পর মেয়েকে কাছে পেয়েও তার ক্ষেত্রে এমন কিছুই চোখে পড়েনি। জয়া ভেবেছিল, তাকে দেখেই মা হয়তো কাছে এসে জড়িয়ে ধরবে, মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে জানতে চাইবে, পথে আসতে কোনো অসুবিধা হইছে রে মা ? ক্ষিধা পাইছে তোর, না রে? কিন্তু না, জয়ার মা এমন কিছুই বলেনি। উল্টো পিপাসার্ত জয়াই মাকে বলল, ‘মা একটু পানি খাব।’
উত্তরে জলি বলল, ‘পানির জগটা যে টেবিলের উপর রইছে, চোখে দেখস না? না কি তুই পানি ঢাইলা খাইতে পারিস না?’
‘জগে পানি নাই মা।’ টেবিলে রাখা জগের দিকে তাকিয়ে বলে জয়া।
‘পানি নাই তো দাঁড়ায়া আছিস ক্যান, কলপাড় থেইকা পানি ভইরা নিয়া আয়। তোর বাপেরে খাওন দিত হইব। যা যা তাড়াতাড়ি কর।’
এতদূর পথ পেরিয়ে এসে জয়া ক্লান্ত। অথচ একবারের জন্যও মা তাকে কাছে ডাকেনি, পাশে এসে বসতেও বলেনি। তার প্রতি মায়ের এই আচরণে সে খুব কষ্ট পায়, মন খারাপ করে। নিজেকে তার দূরের কেউ বলেই মনে হয়।
খাবার খেতে বসেও দেখা মিললো ভিন্নচিত্রের। অনেকদিন পর সন্তানকে কাছে পেলে একজন মা যেভাবে তার সন্তানকে খাবারের সময় খুব যতœ করে খাওয়ায়, জয়ার ক্ষেত্রে তেমন কিছুই ঘটেনি। বরং বিষয়টা ছিল এমন, খাবার দেওয়া আছে, তার ইচ্ছে হলে খেলো না খেলে নেই।
পরবর্তী দিনগুলোতে সবার খাওয়া শেষ হলে ময়লা থালা-বাসনগুলো ধুয়ে রাখা, জয়ার প্রতিদিনের নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। জয়াও ল²ী মেয়ের মতো মায়ের কথা শুনতো।
তবে গ্রামে কাটানো সেই দিনগুলোর মতো এখন আর কেউ ওর সাথে আগ্রহ নিয়ে কথা বলে না, গল্প করে না। সারাদিন একা একাই কাটে তার প্রহরগুলো। মা-বাবার কাছ থেকে দূরে থাকতে থাকতে সম্পর্কের মাঝেও যেন একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে।
ঢাকায় আসার কিছুদিন পরেই জয়া খ্যাতনামা একটি স্কুলে ভর্তি পরীক্ষা দেয়। যেদিন ভর্তিপরীক্ষার রেজাল্ট দেয়, সেদিন জয়া আর তার বাবা একসাথে স্কুলে যায়। কিন্তু রিকশা যখন স্কুলের গেটে এসে থামল, তখন বাবাকে কিছু না বলেই সরাসরি প্রধান শিক্ষিকার রুমে চলে যায় জয়া। শরীরটা ধনুকের মতো বাঁকিয়ে টেবিলে হতে রেখে জানতে চায়, ‘বড় আপা, আমি কি চান্স পাইছি?’
প্রধান শিক্ষিকা জয়ার কথার উত্তর না দিয়ে এভাবে বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখে খুব বিরক্ত হন। রেগে গিয়ে বলেন, ‘কীভাবে শিক্ষকের সাথে কথা বলতে হয় এই সামান্য ম্যানারটুকুও শেখোনি?’ জয়া বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে থাকে প্রধান শিক্ষিকার দিকে। কেননা সে তখনও জানে না কেন এভাবে তিনি রেগে গেলেন? কী করেছে সে? অনেকক্ষণ বকাঝকা দেবার পর একসময় তিনি জানতে চাইলেন, ‘তোমার সাথে কেউ কি এসেছে?’
‘জি । আমার বাবা আসছে।’
‘যাও, তোমার বাবাকে নিয়ে এসো। বলবে, আমি ওনার সাথে কথা বলতে চাই।’
জয়ার বাবা রুমে ঢুকতেই তিনি চশমার ফাঁক দিয়ে বড় বড় চোখে তাকিয়ে বিরক্তির স্বরে জানতে চাইলেন, ‘আপনিই ওর বাবা?’
‘জি।’ একটু ইতস্তত স্বরে উত্তর দিল জয়ার বাবা।
‘একজন শিক্ষকের রুমে দাঁড়িয়ে তার টেবিলে হাত রেখে কথা বলাটা কোন ধরনের ভদ্রতা? সামান্য এতটুকু ম্যানারও যদি একটি বাচ্চা তার পরিবার থেকে না শিখে আসে, তাহলে স্কুল থেকে আর কতটুকুই বা শেখাতে পারে?’
‘সরি’ বলে প্রধান শিক্ষিকার রুম থেকে বেরিয়ে আসে জয়ার বাবা। স্কুল থেকে বাসা পর্যন্ত পুরোটা পথে বাবা-মেয়ের মধ্যে কোনা কথা হয় না। জয়া বুঝতে পারে, বাবা রেগে আছে। নিজের ওপরও খুব রাগ হয়। ভাবে- আমার ভুলের জন্যই বড় আপা আজ বাবাকে এতগুলো কথা শুনিয়েছেন! কিন্তু কীইবা করার ছিল! আমি তো জানতাম না এভাবে শিক্ষকের সামনে কথা বলা ঠিক নয়। বড় আপা বুঝিয়ে বললেই তো হতো।
সেদিন জয়ার বাবা আলী আহমেদ বাসায় ফিরে দ্যাখে, জয়ার মা সবজি কাটছিলো দুপুরের রান্নার জন্য। দরজা খোলাই ছিল। বাবা আর মেয়েকে ঘরে ঢুকতে দেখেই খুব আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল, ‘জয়ার রেজাল্টের কি খবর?’
অমনি জয়ার বাবা ক্ষুব্ধ হয়ে বলে, ‘খবর আর কী হইব, দিনের পর দিন মাইয়ারে বাড়িতে রাইখা কিছুই তো শিক্ষা দিতে পারো নাই, একটা অপদার্থ বানাইছো। তোমাগো মা, মাইয়ার লাইগা আইজ আমারও অপমান হইতে হইছে।’
জয়া তখন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল তার পড়ার টেবিলের চেয়ারের উপর হাত রেখে। দৃষ্টি ছিল পায়ের দিকে। জয়ার বাবাকে এভাবে রেগে যেতে দেখে রেজাল্ট জানার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে তার মা।
একটু থেমে জয়ার বাবা জয়ার দিকে তাকিয়ে আবারও চেঁচিয়ে বলে ওঠে, ‘আমি বুঝলাম না, রেজাল্টের জন্য হেড মিস্ট্রেসের কাছে যাইতে হবে কেন তোরে? এমনকি আমারে না জানায়াই। রেজাল্ট তো বাইরে বোর্ডেই দেওয়া থাকে।’
এই কথা শোনার পর জয়ার মাও রেগে যায়। স্বামীর কথার মাঝখানেই মেয়েকে জিজ্ঞেস করে, ‘কিরে তোর বাপরে না বইলা গেলি ক্যান?’ কিন্তু জয়া নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকে। কোনও উত্তর দেয় না। তার মা আবারও জিজ্ঞেস করে, ‘তোরে কি জিগাই, কথা কস না ক্যান? কানে কথা ঢুকে না?’
‘আরে এইটা তোদের ঐ মফস্বলের স্কুল পাইছিস? কোনো নিয়ম কানুন নাই যেইখানে! জানোয়ারের বাচ্চা জানোয়ার!’ মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাতের আঙুল উঁচিয়ে রাগান্বিত স্বরে কথাগুলো বলে জয়ার বাবা।
দিনভর স্কুলে, বাসায় বকা শুনে শুনে মনটা খুব খারাপ জয়ার। তবুও সারাদিনেও কেউ প্রয়োজন বোধ করেনি তাকে একটু সান্ত¦না দেবার! রাতে বিছানায় শুয়ে তার মনে পড়ে গ্রামের কথা। সেখানে এমন করে কেউ কখনো তাকে বকা দেয়নি। তাছাড়া কখনো মন খারাপ হলে কী করে তার মন ভালো করবে এই নিয়ে নানা নানির চেষ্টার কোনো কমতি থাকতো না। আর এখানে তাকে নিয়ে ভাববার কেউ নেই। মা-বাবা সবাই আছে তবুও যেন ভীষণ একা।
জয়া ঘরে এবং বাইরে কোথাও নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে না পারার কারণে নিজের কাছে নিজেই অপরাধী হয়ে উঠছিল দিনে দিনে। স্কুলেও সে অমনোযোগী। তার এই অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পেতে কিংবা একটু ভালোবাসা পাবার আশায় বাসার সব কাজে সে মাকে সাহায্য করতো। আবার কখনো কখনো মায়ের রাগারাগির ভয়ে অনিচ্ছাসত্তে¡ও বাধ্য হয়েই কাজ করতো। তবুও সামান্য ভুল হলেই মা কেমন স্নেহহীন চোখে তাকাতো তার দিকে! সে চোখে জয়া যেন কেবলই খুঁজে পেতো শাসন আর উপেক্ষার ছায়া।
এরই মধ্যে জয়ার প্রথম সাময়িকী পরীক্ষার রেজাল্ট হয়েছে। সন্ধ্যায় সে ঘরে বসে পরেরদিনের স্কুলের পড়া তৈরি করছিল। বাবা কাজ থেকে ফিরে এসে খাটে বসে গায়ের শার্টটা খুলতে খুলতে জয়াকে বলল, ‘শুনলাম, তোর না কি আজ রেজাল্ট বেরোইছে! রিপোর্ট কার্ডটা দে তো, দেখি!’
বাবার কথা শুনে তখন ভয়ে হাত-পা কাঁপতে শুরু করে জয়ার। মুহূর্তেই গলা শুকিয়ে যায়। কাঁপা কাঁপা হাতে ব্যাগ থেকে রিপোর্ট কার্ড বের করে বাবার দিকে এগিয়ে দেয়। বাবা রিপোর্ট কার্ড হাতে নিয়ে বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখে। জয়ার মা তার বাবার হাতে এক গøাস পানি দিয়ে স্বামীর পাশেই বসে। এক পলক মায়ের দিকে তাকিয়ে জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে জয়া। হঠাৎ জয়ার বাবার চোখে পড়ল অঙ্কে নম্বর কম, ঠিক তখনি তাঁর চোখ দুটো রাগে লাল হয়ে গেল। হাতের গøাসটা ছুঁড়ে মারলো মেঝেতে। স্টিলের গøাসের ঝনঝন শব্দে জয়া আঁতকে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে বসা থেকে দাঁড়িয়ে উঁচু গলায় চেঁচিয়ে বলল, ‘সারাদিন এত খাটা-খাটনি করে মাস শেষে স্কুলের বেতন দেই আর বাসায় বইসা বইসা আমার হোটেলে খাইয়া লেখাপড়ার এই অবস্থা? অংকে মাত্র সাতাইশ? পাসও করতি পারলি না। দাঁড়া, তোরে আইজ আমার এত কষ্টের টাকা নষ্ট করার মজা বুঝাইতেছি!’ এই বলেই কোমর থেকে প্যান্টের বেল্টটা খুলে জয়াকে আঘাত করতে লাগল। একের পর এক আঘাত করেই চলল। কড়াস, কড়াস, কড়াস... শব্দ প্রতিধ্বনি তুলছে একনাগাড়ে। জয়া যেন কাঁদতেও ভুলে গেছে বাবার এমন রুদ্র মূর্তি দেখে। আঘাতের তীব্রতায় গোঙানির মতো শব্দ বের হতে থাকে তার মুখ দিয়ে। ‘মারুক যত পারে, এমন অভিমান বুকে চেপে রেখে সহ্য করতে থাকে সে আঘাতের পর আঘাত। কিন্তু চোখের পানি আটকাতে পারে না কিছুতেই। গাল বেয়ে অবিরাম ঝরে পড়ে উষ্ণ জলধারা। নিঃশব্দে। তাছাড়া ওর সয়ে যাওয়া ছাড়া কিইবা করার আছে। কেননা ততদিনে সেই ছোট্ট জয়াও বুঝে ফেলেছে কান্নার শব্দে সবার হৃদয় আর্দ্র হয় না। এভাবে মার খেতে দেখেও মায়ের মুখে কোনো কথা নেই। তাকিয়ে দেখে মায়ের চোখ দুটিও ধ্বকধ্বক করে জ্বলছে। একটিবারের জন্যও মা বলেনি, ওকে ছেড়ে দাও। শহরের স্কুলে নতুন ভর্তি হয়েছে। এখানকার পড়াশোনার ধরন বুঝতে কিছুদিন সময় তো লাগবেই। পরেরবার দেখো ভালো করবে! না, তার হয়ে মা কিচ্ছু বলেনি। নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হয় জয়ার।
আঘাত করতে করতে একসময় ক্লান্ত হয়ে বিছানায় গিয়ে বসে জয়ার বাবা। জয়া তখন চোখের পানি মুছে নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরে যায়। বেসিনের সাথে লাগোয়া এক কোনায় গুটিসুটি হয়ে মেঝেতে বসে। আঘাতের যন্ত্রণায় তখন ছটফট করছিল সে। আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। সময় গড়িয়ে ধীরে ধীরে রাত বাড়ে। এক এক করে শহরের ঘরগুলোর আলো নিভতে থাকে। তার খুব একা লাগে, ভয় হয়। তবুও সে সাহস হারায় না। রান্নাঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে অধীর অপেক্ষায় বসে থাকে জয়া। ভাবে- রাগ কমে গেলে বাবা হয়তো খোঁজ করবে আর বাবা না করলেও মা তো নিশ্চয়ই খুঁজে বের করবে। তাছাড়া এভাবে একা রাতেরবেলা ঘরের বাইরে থাকতে যে তার ভয় করবে সেটা নিশ্চয় মা জানে। মা ঠিক নিতে আসবে।
গরমে আর অন্ধকারের মধ্যে বসে থেকে তার চোখে কেবলই ভেসে উঠছিল নানা-নানির মুখচ্ছবি আর মমতায় ঘেরা গ্রামটি। গ্রামের অভ্যস্ত জীবনই তার ভালো লাগতো। ঘুম ভাঙলেই পায়ের তলায় মাটি, চারদিক সবুজে ঘেরা আর মাথার উপর দিগন্ত বিস্তৃত নিস্তব্ধ খোলা আকাশ। তারই মাঝে থেকে থেকে যেন মাঠ, ঘাটের সীমানা ছাড়িয়ে দূরের কোনো জঙ্গল পেরিয়ে কুবো পাখির একটানা ডাক ভেসে আসতো। গ্রামের সেই সন্ধ্যাগুলোকে স্বাগত জানাতো জোনাকিরা। রাত গভীর হতো ঝিঁঝিঁ পোকাদের সংগীতের সাথে সাথে। উঠানে পাটি বিছিয়ে বসে রাতের আকাশের তারা গুণতো জয়া। অসংখ্য নক্ষত্রে ছাওয়া ছিল সেই রাতগুলোর আকাশ। তাকিয়ে থাকত সে নির্নিমেশ। কথা বলত, আকাশের নক্ষত্রগুলোর সাথে। এই ইট পাথরের শহরে এসে সেইসব ফেলে আসা মুহূর্তগুলোকে কেবলই ফিরে পেতে চাইতো জয়া। সেই প্রকৃতি, আশেপাশের মানুষ সবকিছু তার মনকে আকর্ষন করতো। কিন্তু বাবা বা মাকে কখনো সাহস করে জিজ্ঞেস করতে পারে না, ‘বাবা কবে বাড়ি যাবো?’ রাতভর এমন কত ভাবনা তার মনে উঁকি দিয়ে যায়। একটু একটু করে ভোরের আলো ফুটে ওঠে। কিন্তু বাবা বা মা কেউই তাকে নিতে আসে না।
নিজেকে তার এই সংসারে অনাবশ্যক একজন মানুষ মনে হয়। ধীরে ধীরে তার এই অসহায়ত্ব আর নীরব ব্যথার আশ্রয় হয়ে উঠেছিল চিঠি। এখনকার মতো সেসময় এতটা প্রযুক্তি নির্ভর ছিল না। যোগাযোগ করতে হতো চিঠির মাধ্যমে। তাই সে প্রতিদিন চিঠি লিখতো। কখনও স্কুলের বাড়ির কাজের খাতায় কখনো বা ডায়েরিতে বিচ্ছিন্নভাবে লিখে যেতো। তার প্রতিটি চিঠিই ছিল নানাকে উদ্দেশ্য করে লেখা। শহুরে দৈনন্দিন জীবনে খাপ খাইয়ে চলতে না পারার অপারগতা আর গ্রামের প্রতি তার ভালোবাসা তাকে ক্রমশ একা করে তুলছিল। সেইসব যন্ত্রণা আর না-পাওয়ার ব্যথাই যেন চিঠির প্রতিটি শব্দ বয়ে বেড়াতো। প্রতিবারই চিঠি লেখার শুরুতে ভাবতো, শেষ করেই ডাকযোগে পাঠিয়ে দেবে তার নানার কাছে। কিন্তু সাহস করে ঘর থেকে বেরিয়ে সেই চিঠি আর পাঠানো হয় না। ডায়েরির ভাঁজে ভাঁজে চিঠির পর চিঠি জমে অথচ প্রাপকের কাছে তা কখনও পৌঁছায় না।
একদিন চৈত্রের দুপুরে ডায়েরি খুলে পুরনো চিঠিগুলো দেখছিল জয়া। হঠাৎ জয়ার মা খাটের নিচ থেকে একটা পাতিল বের করে মেয়ের হাতে দিয়ে বলল, ‘যা তো, ভাতের পানিটা গরম করতে দিয়ে আয়। পানি ফুটলে চাল ধুয়ে দিস। আমি হাতের কাজটা শেষ করি।’
জয়া রান্নাঘরে গিয়ে দেখে অকারণেই চুলা দুটি জ্বলছে। সে পানি ফোটানোর জন্য চুলায় হাঁড়ি চাপায়। ঘরে ফিরে টিনের ড্রাম থেকে ভাতের চাল নিয়ে কলপাড়ে গিয়ে দেখে সেখানে অনেক ভিড়। কয়েকজন মিলে বাসন-কোসন মাজছিল। তারা যে বাড়িতে থাকতো সেখানে অনেকে মিলে একটা রান্নাঘরেই রান্না করতো, স্নানের সময় লাইন ধরে স্নান করতো। স্নানঘরও ছিল একটাই।
জয়া কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর সুযোগ পেয়ে চাল ধোয়ার কাজ শেষ করে রান্নাঘরে গিয়ে দেখে রান্নাঘর ফাঁকা। চুলায় পানি ফুটছে। কিন্তু নব ঘুরিয়ে চুলার আঁচ কি করে কমাতে হয়, তা সে জানে না। একটু খটকা লাগল জয়ার এই ভেবে যে, সে পারবে তো ফুটন্ত পানিতে চাল দিতে! যদি গরম পানি ছিটকে এসে তার হাতে পড়ে! মাকে কী ডেকে বলবে, মা যেন চালটা পাতিলে দিয়ে দেয়! আবার ভাবে, মাকে ডাকলে মা যদি রাগ করে!
তাই মাকে আর ডাকে না জয়া। সে তার গায়ে পরে থাকা ফ্রকের নিচের অংশের দু’ধার দিয়ে পাতিলটা নামাতে গেলে হঠাৎ পাশের চুলা থেকে আগুন ধরে যায় তার ফ্রকে। ভয় পেয়ে যায় জয়া। ফ্রকে আগুন নিয়েই রান্নাঘরে এলোমেলোভাবে ঘুরতে থাকে সে। বুঝতে পারে না কী করবে!
কিছু সময় পর জয়া রান্নাঘর থেকে বেরুতেই প্রতিবেশী দেখতে পায় তাকে। ততক্ষণে তার জামার আগুন নিচ থেকে ক্রমশ উর্ধ্বমূখী হতে লাগল। সে তখনি তাড়াহুড়ো করে উঠানের মাঝখানেই জয়াকে দাঁড় করিয়ে ওর জামাটি টেনে ছিঁড়ে ফেলে। মুহূর্তেই মানুষের জটলা তৈরি হয় উঠান জুড়ে। আশেপাশের প্রতিবেশীদের অনেকেই তখন জয়াকে ঘিরে ফেলে। খবর পেয়ে জয়ার মাও ছুটে আসে। মেয়েকে দেখে চিৎকার করে বলে ওঠে, ‘কেউ একটা গাড়ি ডাকেন। ওরে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়া যাইতে হইব।’
বাড়ির গেইটের সামনে যখন রিকশা থামল তখন হাসপাতালে নেওয়ার জন্য পাঁজাকোলা করে জয়াকে রিকশায় তোলে ওর মা। আশেপাশের লোকজনের মধ্যে তখন কেবলই অস্থিরতা। কেউ বলছে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওরে হাসপাতালে নিয়া যান। কেউ বা বলছে, এ্যাই যে রিকশাওয়ালা ভাই একটু তাড়াতাড়ি চালায়া যাইয়েন। আবার আরেকটি কন্ঠস্বর বলছে, শরীরে একটু দাঁত মাজার পেস্ট দিলে ভালো হইতো কিংবা ডিম ফাটাইয়া পোড়া অংশটায় দিলে জ্বালাপোড়া কিছুটা কমত।
রিকশা তখনও পলাশীর বাসার সামনে দাঁড়ানো। চালক প্যাডেল ঘোরাতেই দেখে জয়ার বাবা এগিয়ে আসছে বাসার দিকে। ‘থামেন, থামেন ভাই একটু থামেন।’ অস্থির হয়ে বলে জয়ার মা।
বাসার সামনে মানুষের ভিড়, হট্টগোল এইসব কিছু জয়ার বাবার চোখ এড়ায়নি। কি হয়েছে বোঝার জন্য দ্রুতগতিতে রিকশার কাছে এগিয়ে যায় সে। চোখে-মুখে তখন তার অজানা কোনও বিপদের ভয় লেপ্টে ছিল। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই আশেপাশের লোকজনই বলে উঠল, ‘তাড়াতাড়ি রিকশায় উঠেন ভাই। তাড়াতাড়ি কইরা ওরে নিয়া হাসপাতালে যান। দেরি করাটা ঠিক হইব না।’
কিন্তু তখনও তার মনে নানা প্রশ্ন উঁকি দিয়ে যাচ্ছে। ভাবে- কখন, কীভাবে মেয়েটার এমন সর্বনাশ হলো? প্রশ্নবিদ্ধ চোখে কখনো আশেপাশের লোকজনের দিকে কখনো বা স্ত্রীর দিকে তাকায়। তবু সেই অস্থির সময়ে কোনো কিছুই মুখ ফুটে জানতে চায় না কারো কাছেই। জয়ার বাবা রিকশায় চড়ে বসলে চালক দ্রুত প্যাডেল ঘুরিয়ে ঢাকা মেডিকেলে পৌঁছায়।
সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের জন্য কোনো হাসপাতালই স্বস্তির জায়গা নয়। আর বার্নইউনিট সম্ভবত অন্য সবধরণের হাসপাতালের চেয়ে বেশি বিভীষিকাময়। এর ভেতরের রুম ও করিডোরগুলোর বাতাস ভারী হয়ে থাকে মানুষের পোড়া চামড়া, বাস্পায়িত ঘাম, রাসায়নিক জীবাণুনাশকের তীব্র গন্ধে, সবে হাঁটতে থাকা শিশু থেকে শুরু করে চলনশক্তি হারিয়ে ফেলা বৃদ্ধ পর্যন্ত দগ্ধ রোগীদের গোঙানির শব্দে। আর রোগীদের যেসব অবস্থায় দেখা যায় তা ভাষায় বর্ণনা করার মতো নয়। পুড়ে-ঝলসে ছাইয়ের মতো কালো হয়ে যাওয়া মানুষ সাদা সাদা ব্যান্ডেজে মোড়া, কত বিচিত্র শব্দ গোঙানির। এদের মধ্যে কেউ পুড়েছে আগুনে, কেউ বিদ্যুতে, কেউবা অ্যাসিডে। মেয়েকে ভর্তি করিয়ে রোগি ও তাদের আত্মীয়-স্বজনের মুখে তাদের দগ্ধ হওয়ার কাহিনিগুলো শুনতে শুনতে মনটা কেমন ভারী হয়ে ওঠে জয়ার মায়ের।
জয়ার বাবা যখন মেয়ের বেডের সামনে ডাক্তারের জন্য অপেক্ষা করছিল, তখন সেই ওয়ার্ডে কর্তব্যরত একজন চিকিৎসক অন্য চিকিৎসককে গরম তেলে পুড়ে যাওয়া একটি শিশুকে দেখিয়ে বলেন, ‘এই বাচ্চাটির শরীরের ৩৫ শতাংশই পুড়ে গেছে, যেখানে শিশুদের ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ পোড়াই প্রাণঘাতী হতে পারে। এসব কথা শোনার পর মেয়েকে নিয়ে তার দুশ্চিন্তা আরও বেড়ে যায়। জয়ার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ভাবে, মেয়েটা বাঁচবে তো?
এদিকে জয়া হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে অস্ফুট স্বরে বলে, ‘আমি গ্রামে যাব। নানার কাছে যাব। নানা আমারে নিয়া যাও।’ একটু থেমে আবার বিড়বিড় করে বলতে থাকে, ‘বাবা আমারে আর মাইরো না। আমি মন দিয়া পড়ব, বিশ্বাস করো। আর মাইরোনা আমারে।’
যন্ত্রণায় ছটফট করা মেয়েকে দেখে চোখের পানি আর থামাতে পারে না জয়ার বাবা। হাত দিয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে জয়ার বেডের কাছে রাখা টুলে বসে। অসুস্থ মেয়ের বিছানায় এলিয়ে পড়ে থাকা হাতটি স্পর্শ করতেই আবারও তার চোখের পানি গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকে।
তখন হাসপাতালের ওয়ার্ডের চারদিকে জয়ার দুটো চোখ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে কী যেন বারবার খুঁজে ফেরে। তার মা হয়তো মেয়ের মনের গোপন প্রত্যাশার কথা বুঝতে পেরে কানের কাছে গিয়ে শান্ত গলায় বলে, ‘তোর নানা-নানিরে খবর পাঠাইছি। তারা শিগগিরই চইলা আসব।’
এরই মধ্যে ডাক্তার জয়াকে দেখে জানায় তার শারীরিক অবস্থা আশঙ্কাজনক। তবুও আমাদের দিক থেকে সাধ্যমতো চেষ্টা করবো। আপনারা আল্লাহকে ডাকুন।
ডাক্তারের এমন কথায় জয়ার মা-বাবা দুজনেই চমকে গিয়ে দুজনের দিকে তাকালো। জয়ার মায়ের চোখে-মুখে তখন অপরাধবোধ স্পষ্ট। সে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। সে কান্না আর কিছুতেই থামছে না। জয়ার বাবাও অসহায় দৃষ্টিতে যন্ত্রণাকাতর মেয়ের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আর প্রতিমুহূর্তে তারা দুজনেই জয়ার নানা-নানির জন্য অপেক্ষা করে চলেছে। কখন আসবে? কখন?
সেদিনই রাতে জয়ার নানা নানি হাসপাতালে এসে উপস্থিত হন। নাতনির ব্যান্ডেজে মোড়ানো শরীর দেখে নিজেকে স্থির রাখতে পারেন না তাঁর নানি। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন। এ কী দেখছেন তিনি ? কাকে দেখছেন? নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। এমনভাবে ওকে কখনও দেখতে হবে, ভাবেননি তিনি। স্ত্রীকে থামানোর চেষ্টা করেন হায়দার আলী। কিন্তু স্ত্রীকে তিনি কী বলে সান্ত¦না দেবেন, কীভাবে বোঝাবেন, ভেবে পান না। নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হয় তাঁর সেই মুহূর্তে।
জয়ার নানি নাতনির মাথায় হাত রেখে কান্না জড়ানো কণ্ঠে আগের মতো করে ডাকেন, ‘জয়া নানুমনি, আমার সোনা, ময়না পাখি...। জয়া চোখ খুলে তাকায়। ভালোবাসার এমন ব্যাকুল করা ডাক উপেক্ষা করতে পারে না জয়া। খুব ধীরে জবাব দেয়, ‘হুম।’ যেন এই ডাক শোনার জন্যই সে তৃষ্ণার্ত চাতকের মতো বহুদিন ধরে অপেক্ষায় ছিল।
তাঁর নানি আবার তাকে ডাকেন, নানুর জয়ামণি...
জয়া আবারও খুব আস্তে আস্তে বলে,‘নানু আমারে বাড়ি নিয়া চলো। আমি বাড়ি যাব। বাড়ি গিয়া ঘুমাবো।’